1.7.14

ইসলামী রাষ্ট্রঃ সাহাবাদের গঠন পর্যায় এবং দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা

সাহাবাদের গঠন পর্যায়

দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে রাসুল (সাঃ) যাদের মাঝেই ইসলাম গ্রহন করার মতো মন মানসিকতা লক্ষ্য করতেন, জাতি, বর্ণ, বয়স, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি ভেদাভেদে তাদের কাছেই তাঁর এ আহবান পৌঁছে দিতেন। তিনি কখনো তাঁর নির্বাচিত কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে দ্বীনের আহবান পৌঁছে দেননি বরং সকল শ্রেনীর মানুষকে তিনি সমানভাবে ইসলামের দিকে আহবান করেছেন এবং তারপর ইসলাম গ্রহনে তাদের মন মানসিকতা বিচারে সমর্থ হয়েছেন। এভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ঈমান আনে এবং ইসলাম গ্রহন করে।

নও মুসলিমদের পরিপূর্ণভাবে দ্বীন এবং কুরআন শিক্ষা দেবার ব্যাপারে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন থাকতেন। তিনি তাঁর সাহাবীদের মধ্য হতে একটি দল তৈরী করেন যারা পরবর্তীতে দাওয়াতের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এ দলে নারী-পুরূষসহ মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চল্লিশ জনে উন্নীত হয়। যদিও এরা ছিল বিভিন্ন বয়সের কিন্তু এদের মধ্যে তরুনদের সংখ্যাই ছিল বেশী। এদের মধ্যে ছিল ধনী, গরীব, সবল এবং দূর্বল সবধরনের মানুষ।

মুসলিমদের এ দলটি আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ঈমান এনেছিল এবং এরাই মূলতঃ দাওয়াতের কার্য পরিচালনা করেছিল। এরা হলোঃ

১. আলী ইবন আবু তালিব (৮ বছর)
২. যুবাইর ইবন আল আওওয়াম (৮ বছর)
৩. তালহাহ ইবন আল উবাইদুল্লাহ (১১ বছর)
৪. আল আরকাম ইবন আবি আল আরকাম (১২ বছর)
৫. আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (১৪ বছর)
৬. সাঈদ ইবন যায়িদ (বিশ বছরের নীচে)
৭. সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস (১৭ বছর)
৮. সা’উদ ইবন রবি’য়াহ (১৭ বছর)
৯. জা’ফর ইবন আবি তালিব (১৮ বছর)
১০. শুহাইব আল রুমি (বিশ বছরের নীচে)
১১. যায়িদ ইবন হারিছা (প্রায় বিশ)
১২. উছমান ইবন আফফান (প্রায় বিশ)
১৩. তুলাইব ইবন উমায়ির (প্রায় বিশ)
১৪. খাব্বাব ইবন আল আররত (প্রায় বিশ)
১৫. আমির ইবন ফুহাইরাহ (২৩ বছর)
১৬. মুসা’ব ইবন উমায়ির (২৪ বছর)
১৭. আল মিকদাদ ইবন আল আসওয়াদ (২৪ বছর)
১৮. আবদুল্লাহ ইবন জাহস (২৫ বছর)
১৯. উমর ইবন আল খাত্তাব (২৬ বছর)
২০. আবু উবাইদাহ ইবন আল জাররাহ (২৭ বছর)
২১. উতবাহ ইবন গাজওয়ান (২৭ বছর)
২২. আবু হুদাইফাহ ইবন উতবাহ (৩০ বছর)
২৩. বিলাল ইবন রাবাহ (প্রায় ৩০ বছর)
২৪. আইইয়াস ইবন রাবি’আহ (প্রায় ৩০ বছর)
২৫. আমির ইবন রাবি’আহ (প্রায় ৩০ বছর)
২৬. না’ম ইবন ’আব্দুল্লাহ (প্রায় ৩০ বছর)
২৭. উছমান (৩০ বছর) এবং
২৮. আবদুল্লাহ (১৭ বছর) এবং
২৯. কুদামাহ (১৯ বছর) এবং
৩০. আল সাইব (প্রায় ২০, এরা সবাই মাজ’য়ুন ইবন হাবিব এর চার ছেলে)  
৩১. আবু সালামাহ আবদুল্লাহ ইবন আবদ আল আসাদ আল মাখযুমি (প্রায় ৩০ বছর)
৩২. আবদ আর রাহমান ইবন আওফ (প্রায় ৩০ বছর)
৩৩. আম্মার ইবন ইয়াসির (৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে)
৩৪. আবু বকর আল সিদ্দিক (৩৭ বছর)
৩৫. হামজাহ ইবন আবদ আল মুত্তালিব (৪২ বছর)
৩৬. উবাইদাহ ইবন আল হারিছ (৫০ বছর)
কিছু সংখ্যক মহিলাও এদের সাথে ইসলাম গ্রহন করে।

তিন বছর পর এ সকল সাহাবাদের হৃদয় এবং অন্তর যখন পুরোপুরি ইসলামের আদর্শ এবং ধ্যান-ধারনার ভিত্তিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে তখন মুহাম্মদ (সাঃ) আশ্বস্ত বোধ করেন। তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন যে, তাদের হৃদয়ে ইসলাম গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে এবং ইসলামী আকীদাহ-র ভিত্তিতে তারা উচ্চমান সম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া, এই দলের অর্ন্তভূক্ত মুসলিমরা যখন সমাজের মানুষকে মুকাবিলা করার জন্য যথাযথ যোগ্যতা এবং দৃঢ়তা অর্জন করে তখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) দুশ্চিন্তা মুক্ত হন এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী কুরাইশদের মুকাবিলায় মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন।

দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা

আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) নিকট ওহী নাযিলের শুরুতেই ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। মক্কার মানুষ প্রথম থেকেই জানতো যে, মুহাম্মদ (সাঃ) মানুষকে এক নতুন দ্বীনের দিকে আহবান জানাচ্ছেন এবং বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলামকে দ্বীন হিসাবে গ্রহন করেছে। তারা আরও জানতো যে, তিনি এসব মুসলিমদের সাথে একত্রে মিলিত হন, তাদের দেখাশোনা করেন এবং মুসলিমরা যে কুরাইশ সমাজের লোকচক্ষুর আড়ালে একত্রিত হয়ে নতুন দ্বীন শিক্ষা করে এটাও তারা জানতো।

মক্কার লোকেরা ইসলামী দাওয়াতের ব্যাপারে এবং যারা ইসলাম গ্রহন করছে তাদের ব্যাপারে সচেতন ছিল, কিন্তু তারা কখনো জানতে পারেনি কোথায় তারা মিলিত হয় এবং কারা মিলিত হয়। এজন্যই মুহাম্মদ (সাঃ) যখন প্রকাশ্যে মক্কার মানুষকে নতুন এ দ্বীনের দিকে তাদের আহবান জানালেন তখন এটা তাদের কাছে আশ্চর্যজনক কোনও বিষয় ছিল না। মূলতঃ যেটা তাদেরকে বিস্মিত করেছিল সেটা হল মুসলিমদের নতুন একটি দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা। মুসলিমদের এ নতুন দলটি আরও শক্তিশালী হয় যখন হামযাহ ইবন আবদ আল মুত্তালিব এবং এর ধারাবাহিকতায় উমর ইবন আল খাত্তাব ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। এরপর আল্লাহ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করলেনঃ

“অতএব তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে ঘোষনা কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমিই তোমার জন্য যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সঙ্গে অপর ইলাহ নির্ধারন করেছে, সুতরাং শীঘ্রই তারা জানতে পারবে। [সুরা আল-হিজরঃ ৯৪-৯৬]

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আল্লাহর এ আদেশ যথাযথ ভাবে পালন করেন এবং তার দলকে সমস্ত মক্কাবাসীদের সাথে পরিচিত করান। তিনি তাঁর সাহাবীদের দুটি লাইনে সজ্জিত করেন, একদিকের নেতৃত্বে থাকেন উমর ইবন আল খাত্তাব আর একদিকের নেতৃত্বে থাকেন হামযাহ ইবন আবদ আল মুত্তালিব এবং এ দলটি নিয়ে তিনি এমনভাবে পথ চলতে থাকেন যা মক্কাবাসীদেরকে বিস্মিত করে। এভাবে তিনি তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে করে কাবাঘর পরিভ্রমন করেন।

এটা ছিল এমন এক পর্যায় যখন মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের সাথে গোপনীয়তা থেকে প্রকাশ্য দাওয়াতের দিকে অগ্রসর হন এবং ইসলাম গ্রহন করার মতো মন মানসিকতা সম্পন্ন লোকদের আহবানের পরিবর্তে সাধারনভাবে সমাজের সমস্ত মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। এ পর্যায়ে ইসলামী দাওয়াত এক নতুন দিকে মোড় নেয়, শুরু হয় সমাজে ঈমান আর কুফরের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ভ্রান্ত আর ঘুঁণে ধরা আদর্শগুলোর সাথে সংঘর্ষ হতে থাকে সত্য আদর্শের। বস্তুতঃ এই সময় থেকেই শুরু হয় মুহাম্মদ (সাঃ) এর দাওয়াতের দ্বিতীয় পর্যায়, যাকে বলা যায় প্রকাশ্য দাওয়াত আর সংঘাতের পর্যায়।

ইসলামের এ আহবানকে বাঁধাগ্রস্থ করার জন্য অবিশ্বাসী মুশরিকরা রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাদের উপর সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং অত্যাচার শুরু করে। বস্তুতঃ এটা ছিল চরমতম কঠিন একটা সময়। রাসুল (সাঃ) এর বাসগৃহে পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মু জামিল মুহাম্মদ (সাঃ) এর গৃহের সামনে নানা নোংরা আর্বজনা নিক্ষেপ করে তাকে উক্ত্যক্ত করতে থাকে। তিনি (সাঃ) এসব কিছু নীরবে উপেক্ষা করেন এবং নিজ হাতে সেগুলো পরিষ্কার করেন। একবার আবু জাহল তাঁর দিকে কাবার মূর্তিদের উদ্দেশ্যে বলিকৃত ছাগলের নাড়িভুড়ি নিক্ষেপ করে। মুহাম্মদ (সাঃ) এসব সহ তাঁর কন্যা ফাতিমার বাড়ীতে উপস্থিত হলে তাঁর কন্যা সেগুলো নিজহাতে পরিষ্কার করে দেন। এ সমস্ত অত্যাচার ও নির্যাতন মুহাম্মদ (সাঃ) কে প্রতিনিয়ত আরও শক্তিশালী করে তুলে এবং তিনি আরও দৃঢ়ভাবে দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।

ইসলাম গ্রহনকারী মুসলিমরাও হতে থাকে হুমকী আর নির্যাতনের সম্মূখীন। প্রতিটি গোত্রের লোকেরা তাদের স্বগোত্রীয় মুসলিমদের উপর অত্যাচার আর নির্যাতন শুরু করে। ইসলাম গ্রহন করার অপরাধে মক্কার এক মুশরিক তার দাস বিলাল (রাঃ) কে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখে। এতো নির্মম অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলতে থাকেনঃ “আহাদ! আহাদ!”। বিলাল (রাঃ) শুধু তার রবের জন্য অবলীলায় এ সমস্ত নির্মম অত্যাচার সহ্য করেন। আর একজন মহিলা ইসলাম ত্যাগ করে তার পূর্ব পুরুষের ধর্মে ফিরে যেতে অস্বীকার করায় তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়।

মুসলিমরা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অত্যাচার, নির্যাতন, উপহাস আর বঞ্চনার এ পর্যায় ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার সাথে অতিক্রম করে।

No comments:

Post a Comment