1.7.14

ইসলামী রাষ্ট্রঃ ইসলামী দাওয়াতের জনসংযোগ পর্যায়

ইসলামী দাওয়াতের জনসংযোগ পর্যায়

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) দাওয়াতী জীবনে আপোসের পরিবর্তে সংগ্রামের পথই বেছে নিয়েছিলেন এবং তাঁর দলকে কুরাইশদের সামনে সরাসরি এবং দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করে তাদের দিকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ফলে, কুরাইশদের উপর এর প্রভাব যা হবার কথা তাই হয়েছিল। ইসলামের এ দৃঢ় আহবানকে অস্বীকার করায় তাদের এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। এছাড়া ইসলামের আহ্বানের যে প্রকৃতি ছিল তা স্বভাবতই একে কুরাইশ এবং তৎকালীন সমাজের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করেছিল। কারণ, এ আহবান ছিল আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকৃতি দেবার, এ আহবান ছিল মূর্তি পূজা ত্যাগ করে শুধুই মাত্র তাঁকে ইবাদত করার আর ক্ষয়ে যাওয়া যে কলুষিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কুরাইশরা বাস করছিল তা পুরোপুরি বদলে ফেলার। মূলতঃ রাসুল (সাঃ) যখন কুরাইশদের চিন্তা-ভাবনার অসারতা প্রমান করেন, তাদের উপাস্য দেব-দেবীকে সমাজে হাস্যকর ভাবে উপস্থাপন করেন, তাদের ক্ষয়ে যাওয়া জীবন ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং সর্বোপরি তাদের নিপীড়নমূলক সমাজ ব্যবস্থার মুখোশ উম্মোচন করেন, তখন স্বভাবতই ইসলাম দাঁড়িয়ে যায় তৎকালীন সমাজের সাথে সাংঘর্ষিক এক অবস্থানে।

আল্লাহ তা’আলার নাযিলকৃত আয়াত দিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কুরাইশদের জীবন-ব্যবস্থাকে আক্রমন করতেন। তিনি তাদের শুনাতেন সেই আয়াত, যেখানে আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ

“নিশ্চিতভাবে তোমরা (অবিশ্বাসীরা) এবং তোমরা আল্লাহকে ছাড়া যাদের উপাসনা করো তারা তো জাহান্নামের ইন্ধন।” [সুরা আল-আম্বিয়াঃ ৯৮]

তিনি কঠিনভাবে সমাজের প্রচলিত শোষনমূলক সুদী ব্যবস্থাকে আক্রমন করতেন।

“এবং তোমরা সুদ হিসাবে (অন্যদের) যা দিয়ে থাকো, এ আশায় যে তা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে, আল্লাহর দৃষ্টিতে এতে কোন বৃদ্ধি নেই।” (সুরা আর-রুমঃ ৩৯)

তিনি আক্রমন করতেন তাদের যারা মাপে কম দেয়ঃ

“ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যখন তারা অন্যের কাছ থেকে মেপে নেয় পুরোপুরি নেয়, কিন্তু যখন অন্যকে দেয় তখন প্রাপ্যের চাইতে কম দেয়।” (সুরা আল-মুতফফিফিনঃ ১-৩)

এর ফলশ্রুতিতে কুরাইশরা স্বাভাবিকভাবেই রাসুল (সাঃ) কে প্রতিহত করার চেষ্টা করে এবং তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সংঘর্ষের ফলে তারা ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর প্রচারিত দ্বীনকে অপপ্রচার, নির্যাতন, বয়কটসহ বিভিন্ন উপায়ে আক্রমন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তাদের এহেন কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সাঃ) কোন রকম নমনীয়তা প্রদর্শন না করে তাদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যান এবং আল্লাহর আদেশ অনুসারে তাদের ঘুঁণে ধরা কলুষিত আদর্শকে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন। কুরাইশদের শত অত্যাচার আর নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি (সাঃ) কোন রকম আপোষ বা সমঝোতা ছাড়াই সব মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন, যদিও তাঁর না ছিল নিজেকে রক্ষা করার মতো কোন ব্যবস্থা, না পেয়েছিলেন বাস্তবিকভাবে কোন সাহায্য, না ছিল তাঁর পক্ষে কোন জোট আর না তাঁর কাছে ছিল কোন অস্ত্র। সমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব নিয়েই তিনি (সাঃ) নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। সকল দূর্গম বাঁধা অতিক্রম করে তিনি দৃঢ়তা ও বিশ্বাসের সাথে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহবান করেছিলেন, তিনি (সাঃ) কখনও ক্ষমতাশীন কাউকে দলে ভিড়ানোর জন্য এতোটুকু দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি এবং আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য সবসময় যন্ত্রনাদায়ক দূর্গম গিরিপথ অতিক্রম করতে প্রস্তুত ছিলেন। বস্তুতঃ এ কারনেই কুরাইশরা তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের পথে যে কঠিনতম প্রতিবন্ধকতা তৈরী করেছিলো তা তিনি অবলীলায় অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) দক্ষতা ও সফলতার সাথে সত্যের আহবান মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার পর মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আসতে থাকে আর সত্য তার আপন শক্তিতে পরাজিত করে মিথ্যাকে। এভাবেই ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে আরববাসীদের মধ্যে, বহু মূর্তিপূজারী, খ্রীষ্টান ধর্মের অনুসারী ইসলামের আলোয় হয় আলোকিত, উপরন্তু কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় লোকেরাও গভীর আগ্রহে শুনতে থাকে কুরআনের সুললিত বাণী।

রাসুল (সাঃ) মক্কায় থাকাকালীন সময়েই আল-তুফাইল ইবন আমর আল-দাউসী একবার সেখানে আসেন। তিনি ছিলেন আরবদের মধ্যে সম্মানিত, তীক্ষ্ম ধীশক্তির অধিকারী আর উচুঁ দরের একজন কবি। মক্কার পা রাখার সাথে সাথেই কুরাইশরা তাকে মুহাম্মদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয় এবং বলেঃ মুহাম্মদ হচ্ছে একজন ভয়ঙ্কর যাদুকর, তার কথা মানুষকে তার পরিবার থেকে পৃথক করে ফেলে। তারা খুবই উদ্বিগ্নভাবে তাকে বলে যেন সে কোন ভাবেই মুহাম্মদের সাথে কথা না বলে কিংবা তার কথাও না শুনে এরপর একদিন তুফাইল কাবাগৃহে যান, ঘটনাক্রমে মুহাম্মদও (সাঃ) সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তুফাইল তাঁর কিছু কথা শুনলেন এবং আবিষ্কার করলেন এগুলো খুবই চমৎকার। তারপর তিনি নিজেই নিজেকে বলেনঃ “আল্লাহর শপথ, আমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ, একজন কবি, খুব ভালো ভাবেই জানি ভালো আর মন্দের পার্থক্য, তাহলে এই মানুষটি যা বলছে তা শুনতে আমাকে কিসে বাঁধা দিচ্ছে? যদি তা ভালো হয় তবে আমি অবশ্যই তা গ্রহন করবো আর যদি খারাপ হয় তবে তা ছুঁড়ে ফেলে দেবো।” তারপর তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) কে তাঁর গৃহ পর্যন্ত অনুসরন করেন এবং তাকে তার নিজের সবকথা খুলে বলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনান এবং দ্বীন ইসলামের দিকে আহবান করেন। তুফাইল দ্বিধাহীন চিত্তে সত্যকে আলিঙ্গন করেন এবং মুসলিমদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যান। এরপর তিনি নিজ গোত্রের লোকদের মাঝে ফিরে যান এবং সেখানে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন।

নতুন নবী আর্বিভাবের খবর শুনে বিশজন খ্রীষ্টানের একটি দল মক্কায় আসে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে। রাসুল (সাঃ) এর আহবান শুনবার পর তাকে সত্য নবী বলে স্বীকৃতি দেয় এবং তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। এই ঘটনা শুনে কুরাইশরা ক্রোধে উম্মত্ত হয়ে পড়ে এবং মক্কা ত্যাগ করার সময় এ দলটির পথ রোধ করে দাঁড়ায়, তারপর ছুঁড়ে দেয় তাদের দিকে তীর্যক আর অপমানজনক মন্তব্য, বলেঃ “আল্লাহ তোমাদের ধ্বংস করুন! কি জঘন্য খারাপ লোকই না তোমরা। তোমাদের স্বজাতি তোমাদের এখানে পাঠিয়েছে এই মানুষটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবার জন্য। আর যেই মাত্র না তোমরা তার সাথে সাক্ষাৎ করলে ওমনি নিজ ধর্ম ত্যাগ করে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করলে!” কিন্তু এ ঘটনা তাদের অবস্থানকে এতোটুকু টলায়মান না করে বরং আল্লাহর উপর তাদের বিশ্বাসকে করে আরও দৃঢ় আর মজবুত করে। এভাবে, সমাজে রাসুল (সাঃ) এর প্রভাব যতোই বাড়তে থাকে, মানুষের কুরআনের বাণী শুনবার আগ্রহও ততো গভীর হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হয় যে, কুরাইশদের মধ্য হতে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ঘোরতর শত্রুও কুরআনের বাণী শুনে চমৎকৃত হয়ে ভাবতে থাকে মুহাম্মদ আসলে যা বলে তা সবই সত্য এবং এ ভাবনা তাদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, তারা লোকচক্ষুর অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে কুরআন শুনতে শুরু করে।

মুহাম্মদ (সাঃ) যখন তাঁর গৃহে নামাজ আদায় করতেন তখন আবু সুফিয়ান ইবন হারব, আবু জাহল আমর ইবন হিশাম এবং আল-আকনাস ইবন সুরাইক এরা প্রত্যেকেই কুরআন শুনবার আকাঙ্খায় একে অন্যেকে লুকিয়ে সেখানে উপস্থিত হতো। প্রত্যেকেই ছদ্মবেশ ধারন করে এমন এক জায়গায় বসতো যেখান থেকে তারা তিলাওয়াত শুনতে পারে। কেউই টের পেতো না অপরজনের উপস্থিতি। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) প্রতিদিনই রাতের ইবাদতের জন্য উঠতেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করতেন। প্রতি রাতেই তারা খুব মনোযোগের সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কুরআন শুনতো যে পর্যন্ত না ভোরের আলো ফুটে উঠে, তারপর তাড়াতাড়ি ছত্রভঙ্গ হয়ে স্থান ত্যাগ করতো। এভাবে একদিন বাড়ি ফিরবার পথে হঠাৎ করেই তাদের একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়, ফলে অপ্রস্তুত হয়ে একজন আরেকজনকে অভিযুক্ত করে বলতে থাকে, “খবরদার এমন কাজ যেন আর না হয়, যদি আমাদের মধ্য হতে কোন দূর্বল চিত্তের নির্বোধ লোক তোমাদের দেখে ফেলে তবে কিন্তু সমাজে তোমাদের অবস্থান হয়ে যাবে নড়বড়ে আর পাল্লা মুহাম্মদের দিকেই ঝুঁকে যাবে।” পরদিন তারা প্রত্যেকেই অনুভব করতে থাকে তাদের পা যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের চুম্বকের মতো সেদিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে তারা কাটিয়েছে গতরাত। তারা তিনজন সেদিন আবারও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কন্ঠে কুরআনের সুমধুর বাণী। ভোরবেলা বাড়ি ফেরার পথে আবারও দেখা হয় তাদের, একইভাবে অভিযুক্ত করে তারা একে অন্যেকে, কিন্তু এসব কোন কিছুই তাদের তৃতীয় রাতে সেখানে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তারা যখন বুঝতে পারে মুহাম্মদের প্রচারিত বাণীর প্রতি তাদের অপ্রতিরোধ্য দূর্বলতা তখন তারা দৃঢ়চিত্তে শপথ করে যে, সেখানে তারা আর কখনই যাবে না। এ ঘটনাটির ফলে মূলতঃ মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাপারে তাদের অন্তরে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম হয়। কিন্তু, এ ঘটনায় মূলতঃ তাদের নিজেদের দূর্বলতা নিজেদের কাছে যেভাবে উম্মোচিত হয়ে পড়ে, গোত্রীয় প্রধান হিসাবে তা মেনে নেয়া তাদের জন্য হয়ে যায় খুবই কষ্টকর। তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এটা অন্যদেরকে মুহাম্মদের দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করবে।

বস্তুতঃ কুরাইশদের তৈরী সবরকম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইসলামের আলো মক্কার সীমানা ভেদ করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের আশঙ্কাকে সত্যে পরিণত করে ইসলামের আহবান আরব উপদ্বীপের সমস্ত গোত্রগুলোর মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে তারা মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আক্রমনাত্মক ভূমিকা গ্রহন করে। ক্রমবর্ধমান নির্যাতন আর আক্রমন যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে তখন রাসুল (সাঃ) তায়িফ গোত্রের কাছে নুসরাহ (সাহায্য) আর বনু ছাকিফ গোত্রের কাছে নিরাপত্তা চান এই আশায় যে, তারা হয়তো ইসলাম গ্রহন করবে। তিনি নিজে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন, কিন্তু বিনিময়ে তারা মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে করে প্রচন্ড রূঢ় আর নির্মম আচরন। তাদের লেলিয়ে দেয়া দাস আর বখাটে ছেলেরা মুহাম্মদ (সাঃ) কে নানা রকম কটুক্তি করেই ক্ষান্ত হয় না, সেইসাথে অবিরাম ভাবে পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত করে ফেলে রক্তাক্ত। এদের নির্মম অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে তিনি (সাঃ) রবি’য়াহর পুত্র শাবিব ও শায়বার খেজুর বাগানে আশ্রয় নেন এবং সেখানে বসে বিষন্ন হৃদয়ে ভাবতে থাকেন ইসলামের দাওয়াত ও তাঁর বর্তমান পরিস্থিতির কথা। সে জানত যে, সে মক্কায় কোন গোত্রপ্রধানের আশ্রয় ব্যতীত প্রবেশ করতে পারবে না, আবার তায়েফবাসী যে আচরন করেছে তার ফলে সে সেখানেও ফিরে যেতে পারবে না এবং সে এই দুই অবিশ্বাসীর খেজুর বাগানেও অবস্থান করতে পারবে না। প্রচন্ড অসহায়ভাবে তিনি মর্মাহত আর ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে আকাশের দিকে দু’হাত উচুঁ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। ব্যথিত হৃদয়ে প্রচন্ড দৃঢ়তার সাথে বলেনঃ হে আল্লাহ! আমার অক্ষমতা, সহায়-সম্বলহীনতা এবং মানুষের কাছে আমার নগন্যতার জন্য আমি আপনারই কাছে ফরিয়াদ করছি। পরম করুণাময় আমার! আপনিই তো দূর্বলদের প্রতিপালক এবং আপনি আমার রব। আপনি আমাকে কার হাতে সোপর্দ করছেন? যারা আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় নাকি সেই ত্রু হাতে, যাকে আপনি আমার উপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন? আপনি যদি আমার উপর নারাজ না হয়ে থাকেন, তবে আমার আর কিছুর পরোয়া নেই। আপনার প্রদত্ত নিরাপত্তাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমার প্রতি আপনার ক্রোধ কিংবা আপনার অসন্তুষ্টি বর্ষণ হতে আপনার সেই নুরের আশ্রয় চাই, যা দ্বারা সকল আধাঁর কেটে যায় এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্যার সমাধান হয়। আমার উদ্দেশ্য আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করা। নিশ্চয়ই আপনিই সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান, সর্বময় কর্তৃত্বশীল।
      
পরবর্তীতে রাসুল (সাঃ) আল-মুত’ম ইবন আদির নিরাপত্তায় মক্কায় ফিরে আসেন। এদিকে কুরাইশদের কানে তায়িফের ঘটনা পৌঁছানোর সাথে সাথে তারা তাদের অত্যাচার আর দূর্ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং তারা মক্কাবাসীদের মুহাম্মদ (সাঃ) আহবানে সাড়া দিতে নিষেধ করে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে মক্কাবাসীরা তাঁর সাহচার্য পরিত্যাগ করে এবং তাঁর আহবান শোনা থেকে বিরত থাকে। এতো কিছুর পরও মুহাম্মদ (সাঃ) বিন্দুমাত্র ভেঙ্গে না পড়ে উৎসবের মাসগুলোতে আগত গোত্রের মানুষদের আল্লাহর দ্বীনের পথে আহবান করতে থাকেন, তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল হিসাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করে তাঁর উপর ঈমান আনতে বলেন। কিন্তু তিনি (সাঃ) প্রতি পদক্ষেপেই হন তাঁর অবিশ্বাসী এবং কুটিল মানসিকতার চাচা আবু লাহাবের নজরদারীর শিকার। সে আগত গোত্রের লোকদের আহবান করে রাসুল (সাঃ) কে উপেক্ষা করতে, তাঁর কথা না শুনতে কিংবা তাঁর প্রতি মনোযোগ প্রদর্শন না করতে।

এরপর দাওয়াতী কাজ পরিচালনার জন্য মুহাম্মদ (সাঃ) ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি (সাঃ) বিভিন্ন গোত্রের আবাসস্থলে যান এবং তাদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তিনি কিন্দা, কালব, বনু হানিফাহ এবং বনু আমির ইবন সা’সাহ গোত্রগুলোকে আহবান করেন সত্য দ্বীনের পথে। কিন্তু, এরা সকলেই রাসুল (সাঃ) এর আহবানে সাড়া না দিয়ে তিক্ততার সাথে তাঁর বিরোধিতা করে বিশেষ করে বনু হানিফাহ। বনু আমির ইবন সা’সাহ তাঁর (সাঃ) মৃত্যুর পর কাঙ্খিত কর্তৃত্বের দাবী করে। তিনি (সাঃ) বলেনঃ “শাসন-কর্তৃত্ব তো শুধুই আল্লাহর হাতে এবং তিনি যাকে খুশী তাকে তা দান করেন।” একথা শোনার পর বনু আমির কোন রকম সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে।


এভাবে মক্কা ও তায়িফবাসীসহ সকল গোত্রের লোকেরা ইসলাম প্রত্যাখান করে। মক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগত অন্য সকল গোত্রের লোকেরা ক্রমশঃ এইসব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সরে যায় মুহাম্মদ (সাঃ) থেকে অনেক অনেক দূরে। সমস্ত জায়গা থেকে প্রত্যাখাত মুহাম্মদ (সাঃ) হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ একাকী। মক্কাবাসীদের চরম প্রত্যাখান, অবিশ্বাস আর প্রচন্ড বিরোধিতার মুখে তাঁর মক্কায় দ্বীন প্রচারকে ক্রমশঃ কঠিনতর করে তুলে আর মক্কাবাসীদের ইসলাম গ্রহন করার সম্ভাবনাও ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে।

No comments:

Post a Comment