জিহাদের প্রস্তুতি
মদীনার
প্রান্তসীমায় অবস্থিত ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে চুক্তি সম্পন্ন হবার পর রাসুল (সাঃ) যখন বুঝলেন
যে, মদীনার নবগঠিত ইসলামী সমাজ দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন তিনি জিহাদের
জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। কারণ, দ্বীন ইসলামের আহবানকে সমস্ত পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে
দিয়ে কুফর নিয়ন্ত্রিত ভূমিকে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
আর ইসলামের আহবানকে ছড়িয়ে দেবার এ কাজটি কোনভাবেই মিশনারীদের কাজের সাথে তুলনীয় নয়।
বরং, ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করা, তাদেরকে ইসলামী
ধ্যান-ধারণা ও হুকুম-আহকাম শিক্ষা দেয়া ও সমাজের মানুষকে এ আলোকে গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি
সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বীন ইসলাম বাস্তবায়নের পথে যে কোন ধরনের বস্তুগত বাঁধা অপসারণ করতে
প্রয়োজনীয় বস্তুগত পদক্ষেপ গ্রহন করা।
বস্তুতঃ
মক্কার কুরাইশরা সবসময়ই দ্বীন ইসলাম প্রচারের পথে সর্বাত্মক বস্তুগত বাঁধা তৈরী করেছে,
যে কারণে এ বাঁধা অপসারনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা এমনিতেই জরুরী ছিলো। এ চিন্তা
মাথায় রেখে এবং একই সাথে মদীনার সীমানা অতিক্রম করে ইসলামের আহবানকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার
লক্ষ্যে রাসুল (সাঃ) তাঁর সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করতে শুরু করলেন।
এ উদ্দেশ্যে তিনি (সাঃ) কুরাইশদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বিশেষ উদ্দেশ্যে কিছু বাহিনী
প্রেরণ করেন যা একই সাথে মদীনার মুনাফিক, ইহুদী ও মদীনার বাইরের ইহুদী গোত্রগুলোকেও
সর্তক সংকেত প্রদান করেছিলো। তিনি চারমাসে মদীনার বাইরে তিনটি সৈন্যদল পাঠান।
তিনি (সাঃ) হামযাহ (রা.) এর নেতৃত্বে
মুহাজিরদের মধ্য হতে ত্রিশজনের একটি দলকে আল-ইশয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে পাঠান, এ অভিযানে
আনসারদের মধ্য থেকে কেউ অংশগ্রহন করেনি। হামযাহ (রা.) তাঁর দলবলসহ সমুদ্র তীরে আবু জাহল ইবন হিশাম
ও তার তিনশত সহযাত্রীর মুখোমুখি হলে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়, কিন্তু মাযদি ইবন আমর
আল-জুহানি উভয় পক্ষকে যুদ্ধ ব্যতীতই আলাদা করে দেন। এরপর রাসুল (সাঃ) মুহাজিরদের
মধ্য হতে ষাট জন অশ্বারোহীকে মুহাম্মদ ইবন উবাইদা ইবন আল-হারিছাহ-র নেতৃত্বে অভিযানে
পাঠান। এ অভিযানেও আনসারদের মধ্য হতে কেউ ছিলো না। মুহাম্মদ ইবন উবাইদা (রা.) রাবিগাহর
উপত্যকায় আবু সুফিয়ানের মুখোমুখি হন। আবু সুফিয়ান এ সময় দু’শোরও বেশী অশ্বারোহী
বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এ অভিযানও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি, শুধুমাত্র সা’দ
ইবন আবি ওয়াক্কাস ঐদিন শত্রুপক্ষকে উদ্দেশ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ
করেছিলেন। এছাড়া, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে বিশজন অশ্বারোহীকে
মক্কার দিকে প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু তারাও
কোনরকম যুদ্ধ ব্যতীতই ফিরে আসেন।
এ
অভিযানগুলো মূলতঃ মদীনায় যুদ্ধের একটি আবহ তৈরী করেছিলো এবং রাসুল (সাঃ) এর পরিকল্পিত
একের পর এক এই অভিযানগুলো মক্কার কুরাইশদেরকেও যথেষ্ট পরিমাণে শঙ্কিত করেছিলো। কিন্তু,
রাসুল (সাঃ) শুধু তাঁর দলবলকে অভিযানে প্রেরণ করেই থেমে থাকেননি বরং, পরবর্তীতে
তিনি (সাঃ) নিজেও কুরাইশদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশগ্রহন করেন। মদীনাতে রাসুল (সাঃ) এর হিজরতের
এক বছর পর তিনি (সাঃ) কুরাইশ এবং বনু দামরাহ গোত্রকে অতর্কিত আক্রমণের উদ্দেশ্যে ওয়াদ্দান
পর্যন্ত পৌঁছে যান। এ অভিযানে তিনি (সাঃ) কুরাইশদের মুখোমুখি না হলেও বনু দামরাহ গোত্র
আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) সাথে শান্তিচুক্তি করে। এরপর আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মদীনার
আনসার ও মুহাজিরদের সমন্বয়ে গঠিত দুইশত যোদ্ধাসহ অভিযানে বের হন এবং রাদওয়ার নিকটবর্তী
বুয়াত নামক স্থানে পৌঁছান। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো উমাইয়া ইবনে খালফের নেতৃত্বে
প্রায় আড়াই হাজার উট এবং একশত যোদ্ধার সম্বন্বয়ে গঠিত পৌত্তলিকদের বাণিজ্য কাফেলাকে
ধাওয়া করা। কিন্তু, এ বাণিজ্য কাফেলাটি প্রচলিত পথ না ধরে অন্য পথ ধরে যাত্রা করায়
আল্লাহর রাসুল (সাঃ) পৌত্তলিকদের এ দলটিকে ধরতে ব্যর্থ হন। বুয়াত অভিযানের তিন মাস পর রাসুল (সাঃ) আবু সালামাহ
ইবন আবদ আল-আসাদকে মদীনার দায়িত্বে রেখে দু’শোর বেশি মুসলিমসহ আবারও অভিযানে বের
হন। তিনি (সাঃ) তাঁর দলবলসহ ইয়ানবু উপত্যকার আল-উশাইরাহ নামক স্থানে পৌঁছান। এ স্থানে
তিনি (সাঃ) জমাদিউল আউয়াল মাসে পৌঁছান এবং জমাদিউস সানির কিছুদিন পর্যন্ত এখানে
অবস্থান করেন। এ স্থানে তিনি কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলাকে ধাওয়া করার
জন্য অবস্থান গ্রহন করেন। কিন্তু, এবারও তিনি (সাঃ) তাঁর লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন।
কিন্তু, এ অভিযান একেবারে ব্যর্থ হয়নি, কারণ এই অভিযানে তিনি (সাঃ) বনু মুদলাজ
এবং তাদের মিত্র বনু দামরাহর সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন।
এরপর
আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মদীনায় ফিরে আসার মাত্র দশদিনের মধ্যে কারজ ইবন জাবির আল ফাহরি নামে
এক পৌত্তলিক মদীনার চারনভূমি আক্রমণ করে। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে তার খোঁজে
বের হন। কারজ ইবন জাবির ছিলো কুরাইশদের মিত্র পক্ষের লোক। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বদরের
নিকটবর্তী সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত কারজ ইবন জাবিরকে ধাওয়া করেন। কিন্তু, কারজ ইবন
জাবির পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এটা ছিলো বদর প্রান্তরে মুসলিমদের প্রথম আক্রমণ।
এভাবেই
আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর গঠিত সৈন্যবাহিনীকে সমস্ত আরব ব-দ্বীপ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে
অভিযানে পাঠিয়ে কুরাইশদের প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। যদিও এ সকল অভিযানে
প্রকৃতপক্ষে কোন যুদ্ধ সংগঠিত হয়নি, কিন্তু তারপরেও এ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিযান থেকে অর্জিত
প্রাপ্তি পরবর্তী সময়ের বড় বড় যুদ্ধের পথকে মসৃণ করেছিলো। কারণ, এ সমস্ত অভিযানে মুসলিমদের
যে সামরিক প্রশিক্ষণ হয় তা মূলতঃ তাদের যুদ্ধের ময়দানের জন্যই প্রস্তুত করে। এছাড়া,
মুসলিমদের ছোট ছোট এ সমস্ত অভিযান মদীনার মুনাফিক ও ইহুদী গোত্রগুলোর মেরুদন্ডে আতঙ্কের
স্রোত প্রবাহিত করে, যা তাদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ঝামেলা তৈরী করার চিন্তা
থেকে বিরত রাখে। কুরাইশদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ যেমন
একদিকে পৌত্তলিকদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিলো আবার অন্যদিকে মুসলিমরা মানসিকভাবে প্রচন্ডভাবে
আত্মবিশ্বাসের সাথে উজ্জীবিত হয়েছিলো। এছাড়া, রাসুল (সাঃ) মদীনা এবং লোহিত সাগর তীরের
মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকৃত বিভিন্ন গোত্র যেমনঃ বনু দামরাহ, বনু মুদলাজ এবং আরও অনেক
গোত্রের সাথে মিত্রতার চুক্তি করে কুরাইশদের সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার পথে অনেক বাঁধা-বিপত্তিরও সৃষ্টি
করেন।
জিহাদের সূচনা
মদীনা
নামক যে ভূমিকে রাসুল (সাঃ) বসবাস করবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন, সেখানে তিনি (সাঃ) ইসলামী
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই ইসলামী হুকুম-আহকামও বাস্তবায়ন করেছিলেন। বস্তুতঃ মদীনায়
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই আল্লাহর তরফ থেকে হুকুম-আহকামের আয়াত নাযিল হতে থাকে।
রাসুল (সাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের মূলভিত্তি এবং মদীনার সমাজকে ইসলামী আকীদাহ ও আইন-কানুনের
ভিত্তিতেই শক্তিশালী করেছিলেন এবং মদীনার মুসলিমদের (মুহাজির ও আনসার) মধ্যে ভ্রাতৃত্বের
বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এরপর শরী’আহ-র মাধ্যমে ইসলামী শাসনব্যবস্থা মদীনার
মুসলিমদের জীবনে বাস্তবিকভাবে অনুপ্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে ইসলামী শাসনব্যবস্থার
আলোকে গঠিত এই সমাজই সমস্ত পৃথিবীতে ইসলামের বার্তা বহনের গুরুদায়িত্ব পালন করে। মুসলিমদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেতে থাকল এবং তারা একটি
শক্তি হিসেবে পরিগণিত হতে লাগল, একইভাবে ইয়াহুদী ও অন্যান্য
গোত্রগুলো থেকে ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে লোকেরা পর্যায়ক্রমে/ধীরে ধীরে ইসলামে প্রবেশ
করতে লাগলো।
রাসুল (সাঃ) মদীনার
ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তিসামর্থ্য এর ব্যাপারে নিশ্চিত হবার সাথে সাথে সমস্ত আরব ব-দ্বীপে
ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেবার ব্যাপারে মনোযোগী হলেন। একই সাথে তিনি (সাঃ) এটাও বুঝতে
পারছিলেন যে, মক্কার কুরাইশরা ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রমের পথে যে কঠিন বাঁধা সৃষ্টি
করে রেখেছে সে কঠিনতম বাঁধা অতিক্রম করতে শক্তিপ্রয়োগ অপরিহার্য। কারণ, কুরাইশদের এই
প্রবল প্রতিরোধের মুখে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা
করা আর অরণ্যে রোদন করা ছিলো আসলে একই কথা।
রাসুল (সাঃ) যখন মক্কায়
তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন তখন তাঁর পক্ষে এ কঠিনতম বাঁধা অতিক্রম করা
ছিলো অসম্ভব। কারণ, তখন না ছিলো ইসলাম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আর না ছিলো বাঁধা অপসারণে
প্রয়োজনীয় বস্তুগত শক্তি অর্জনের কোন সুযোগ। কিন্তু, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার
সাথে সাথেই রাসুল (সাঃ) বস্তুগত এ শক্তি অর্জনের সুযোগ ও ক্ষমতার অধিকারী হন।
বাঁধা অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করার সুযোগও তাঁর হাতে এসে যায়। এরপর
তিনি (সাঃ) যা করেন, তা হলো মূলতঃ তাঁর সৈন্যবাহিনীকে মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য
প্রস্তুত করা এবং দাওয়াতী কার্যক্রম প্রচার প্রসারে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরী করা। এ
কারণেই তিনি (সাঃ) তাঁর দলবলকে বিভিন্ন আরব ভূ-খন্ডের বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত অভিযানে
পাঠান, যার মধ্যে কোন কোনটিতে তিনি নিজেও অংশগ্রহন করেছিলেন।
এ সমস্ত অভিযানের উদ্দেশ্যই
ছিলো পৌত্তলিকদের মুসলিমদের শক্তিসামর্থ্য প্রদর্শন করার মাধ্যমে পৌত্তলিকদের সরাসরি
চ্যালেঞ্জ করা। এ অভিযানগুলোর মধ্যে সর্বশেষ অভিযান ছিলো আবদুল্লাহ ইবন জাহশের
অভিযান, মূলতঃ এটা ছিলো বদরের যুদ্ধের সূচনা পর্ব।
হিজরী
দ্বিতীয় সালের রজব মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবন জাহশের নেতৃত্বে মুহাজিরদের একটি
দলকে অভিযানে পাঠান। তিনি (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবন জাহশকে তাঁর লিখিত একটি চিঠি দেন
এবং আদেশ দেন যেন দুই দিনের পথ অতিক্রম করার পূর্বে এটি খোলা না হয়। চিঠি খোলার পর
তিনি (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবন জাহশকে তাঁর লিখিত নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার আদেশ দেন
এবং এ আদেশ পালনে তার দলের অন্যান্যদের জোর জবরদস্তি করতে নিষেধ করেন। দুইদিন যাত্রার
পর আবদুল্লাহ ইবন জাহশ চিঠি খুলে দেখলেন সেখানে লেখা আছে, “আমার এই চিঠি পড়ার পর তোমরা মক্কা
ও তা’য়িফের মধ্যবর্তী স্থান নাখলাহ পর্যন্ত যাত্রা করবে এবং কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার
জন্য ওৎ পেতে থাকবে এবং তারা যা যা কিছু বহন করছে সে সম্পর্কে আমাদের
অবহিত করবে।” চিঠি
পড়ার পর তিনি চিঠির বিষয়বস্তু ও রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ সম্পর্কে তার সঙ্গীদের
অবহিত করেন এবং একই সাথে এটাও জানিয়ে দেন যে, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এ দায়িত্ব
পালনে কাউকে জোর জবরদস্তি করতে নিষেধ করেছেন।
দলের
সকলেই অর্পিত দায়িত্ব পালনে সম্মতি প্রকাশ করে এবং গন্তব্যের দিকে দলবদ্ধভাবে এগিয়ে
যেতে থাকে। একপর্যায়ে সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস আল জুহরি এবং উতবাহ ইবন গাজওয়ান তাদের
হারানো উট খুঁজতে গিয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে, তারা দু’জন কুরাইশদের
হাতে বন্দী হয়। এদিকে, আবদুল্লাহ ইবন জাহশ নাখলাহ নামক স্থানে পৌঁছে রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ
অনুসারে কুরাইশদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে এবং একপর্যায়ে বাণিজ্য সামগ্রী ভর্তি কুরাইশদের
একটি ক্যারাভান তার নজরে আসে। আবদুল্লাহ ইবন জাহশ কি করবে সেটা নির্ধারণ করার জন্য
তার সঙ্গী সাথীদের সাথে পরামর্শ করতে থাকে। কারণ, সেদিন ছিলো রজব মাসের শেষ দিন আর
রজব মাস ছিলো যুদ্ধ করার জন্য নিষিদ্ধ মাস। তারা ভাবতে থাকে, যদি তারা কাফেলাকে আক্রমণ
করে তবে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা হবে অথচ আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাদের এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ
দেননি। তারা একে অপরকে বলতে থাকে, “আল্লাহর কসম, তোমরা যদি আজ রাতে তাদের
ছেড়ে দাও তবে তারা পবিত্র এলাকায় প্রবেশ করবে এবং তোমাদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ হয়ে যাবে।
আর যদি তোমরা তাদের হত্যা করো, তবে তোমরা তাদের নিষিদ্ধ মাসে হত্যা
করবে।” প্রথমদিকে
তারা আক্রমণ করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্থ এবং ভীত থাকলেও পরবর্তীতে তারা শত্রুপক্ষকে আক্রমণ
করার জন্য এক অন্যকে উৎসাহিত করে এবং আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিমদের মধ্য হতে একজন
বাণিজ্য কাফেলার নেতা আমর ইবন হাদরামিকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে এবং তাকে হত্যা
করে। শেষ পর্যন্ত তারা কাফেলার দু’জনকে বন্দী করে এবং সমস্ত বাণিজ্য সামগ্রী নিয়ে তারা
মদীনায় ফিরে আসে।
মদীনায়
প্রত্যাবর্তন করার পর রাসুল (সাঃ) তাদের বলেনঃ “আমি তো তোমাদের নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ
করার কোন নির্দেশ দেইনি।” অতঃপর, তিনি (সাঃ) বন্দী দু’জনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন
বা যুদ্ধলদ্ধ মালামাল
থেকে কোনকিছু নিতে অস্বীকার করেন। এটাই ছিলো আবদুল্লাহ ইবন জাহশের নেতৃত্বে অভিযানের
সর্বশেষ ফলাফল। যদিও আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এ দলটিকে কুরাইশদের উপর নজরদারি করার জন্য পাঠিয়েছিলেন,
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ
ঘটনা নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ, হত্যাকান্ড, শত্রুপক্ষকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে মদীনায় নিয়ে
আসা এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গণীমতের মাল হিসাবে নিয়ে আসা পর্যন্ত গড়ায়। সুতরাং, এ বিষয়ে
ইসলামী শরী’আহ-র হুকুম
কি হতে পারে?
বস্তুতঃ
এ বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তের জন্যই রাসুল (সাঃ) অপেক্ষা করতে থাকেন এবং এ কারণেই
তিনি (সাঃ) যুদ্ধবন্দী ও প্রাপ্ত মালামালের ব্যাপারে কোনরকম সিদ্ধান্ত গ্রহনে
বিরত থাকেন। অপরদিকে, কুরাইশরা এ ঘটনাকে ইসলাম ও মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে অপপ্রচার করার মোক্ষম
সুযোগ হিসাবে লুফে নেয়। তারা সমস্ত আরব গোত্রগুলোর মধ্যে প্রচার করতে থাকে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) ও সঙ্গীরা
নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা নষ্ট করেছে, তারা পবিত্র মাসে রক্তপাত করেছে, সম্পদ লুট করেছে
এবং কুরাইশদের বন্দী করেছে। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে মক্কায় অবস্থিত মুসলিম ও পৌত্তলিক
কুরাইশদের মধ্যে বাকবিতন্ডা শুরু হয়। মক্কার মুসলিমরা তাদের মদীনার মুসলিম ভাইদের এ
বলে রক্ষা করার চেষ্টা করে যে, মুসলিমরা রজব মাসে নয় বরং শাবান মাসে কাফেলা আক্রমণ
করেছে। কিন্তু, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারনা দমনে
তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অপরদিকে, ইহুদীরাও এ সুযোগের সদ্বব্যবহার
করতে থাকে এবং তারা আবদুল্লাহ ইবন জাহশের কাজের ব্যাপক সমালোচনা ও তাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন
করতে শুরু করে। পৌত্তলিক ও ইহুদীদের মিলিত এ অপপ্রচারে মুসলিমরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত
হয়। আর আল্লাহর রাসুল (সাঃ) নীরব থেকে এ ব্যাপারে আল্লাহর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা
করতে থাকেন। অবশেষে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এ বিষয়কে কেন্দ্র করে সুরা
বাকারাহ এর কয়েকটি আয়াত নাজিল করেনঃ
“সম্মানিত মাস সম্পর্কে তোমার কাছে (তারা) জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা
কেমন? বলে দাও, এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা
এবং কুফরী করা, মসজিদে হারামের পথে বাঁধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদের বহিষ্কার করা, আল্লাহর নিকট
তার থেকেও বড় পাপ। আর ফিতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ। বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই
তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি
তা সম্ভব হয়।” [সুরা
আল-বাকারাহঃ ২১৭]
এই
আয়াতটি নাজিল হবার পর মুসলিমরা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে এবং রাসুল (সাঃ) তারপর
যুদ্ধলদ্ধ মালামাল
মুসলিমদের মাঝে বিতরণ করে দেন এবং সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস আল জুহরী এবং উতবাহ ইবন গাজওয়ান
এর মুক্তির বিনিময়ে কুরাইশ যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেন। বস্তুতঃ কুর’আনের এই আয়াতটি
কুরাইশদের ইসলামের বিরুদ্ধে সমস্ত অপপ্রচারকে একনিমিষে স্তদ্ধ
করে দেয়। পবিত্র মাসে
যুদ্ধের ব্যাপারে এ আয়াতটি কুরাইশদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে এবং একই সাথে এটাও
ঘোষণা করে যে, পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা পাপ, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষকে মসজিদুল
হারাম থেকে ফিরিয়ে দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদের বহিষ্কার করা, পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা ও হত্যা
করা হতেও গুরুতর পাপ।
দ্বীন
ইসলাম গ্রহন করার কারণে মুসলিমদের উপর কুরাইশদের নির্মম অত্যাচার ও চরম নির্যাতনমূলক
আচরন আল্লাহর দৃষ্টিতে ছিলো পবিত্র মাস কিংবা অন্য কোন মাসে যুদ্ধ ও হত্যা অপেক্ষাও
গুরুতর ব্যাপার। বস্তুতঃ মক্কায় অবস্থানকালে কুরাইশরা মুসলিমদেরকে দ্বীন ইসলাম থেকে
ফেরানোর জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে
যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। এ অবস্থায় মুসলিমদের কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ব্যতীত
আর কোন পথই খোলা ছিলো না। যদি তা হারাম মাসে হয় তবুও। কুরাইশরাই বস্তুতঃ ইসলামী দাওয়াতের
পথে চুড়ান্ত রকমের বাঁধা সৃষ্টি করেছিলো, তারা আরবের জনসাধারনকে ইসলাম গ্রহন করা থেকে
বিরত রেখেছিলো, নিজেরা জেনেশুনে আল্লাহকে অস্বীকার করেছিলো, মসজিদুল হারামের পবিত্র
এলাকা থেকে সেখানকার অধিবাসীদের বহিষ্কার করেছিলো এবং সর্বোপরি ইসলাম গ্রহনের কারনে
মুসলিমের উপর প্রচন্ড
নির্যাতন চালিয়েছিলো। নিষিদ্ধ মাস কিংবা অন্য যে কোন মাসে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করাই ছিলো তাদের কর্মফলের উপযুক্ত প্রতিদান। সুতরাং, আবদুল্লাহ ইবন জাহশ পবিত্র মাসে
কুরাইশদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, তা তাকে বা কোন মুসলিমকেই আসলে হেয়
প্রতিপন্ন করতে পারেনি।
আর
এভাবেই, আবদুল্লাহ ইবন জাহশের নেতৃত্বে মুসলিমদের এ অভিযান হয়ে গেল ইসলামের ইতিহাসের
একটি মাইলফলক। এ ঘটনাই মূলতঃ ইসলামী দাওয়াতী কার্যক্রম প্রচার-প্রসারে গৃহীত পদ্ধতির
ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য একটি দিকনির্দেশনা হয়ে থাকলো। এ অভিযানে ওয়াকিদ ইবন আবদুল্লাহ
আল-তামিমি তীর ছুঁড়ে কুরাইশ কাফেলার সর্দারকে হত্যা করে এবং এটাই ছিলো আল্লাহর পথে
কোন মুসলিমের হাতে প্রথম রক্তপাত। জিহাদের আয়াত নাজিলের পূর্ব পর্যন্ত পবিত্র মাসে
যুদ্ধ করা নিষিদ্ধই থাকে। যদিও এ ঘটনার পর এ ব্যাপারে হুকুমটি পরিবর্তিত হয়ে যায়। বস্তুতঃ
উপরোক্ত আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র মাসে যুদ্ধ করার উপর থেকে পূর্ববর্তী
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
No comments:
Post a Comment