14.7.14

ইসলামী রাষ্ট্রঃ বদরের যুদ্ধ, বনু কুরাইযা গোত্রকে শায়েস্তা এবং বিদ্রোহ দমন

বদরের যুদ্ধ

হিজরী দ্বিতীয় সনের রমজান মাসের ৮ তারিখে রাসুল (সাঃ) তিনশত পাঁচ জন সাহাবী ও সত্তরটি উট নিয়ে কাফিরদের উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হন। এ সময় তিনি আমর ইবন উম্ম মাখতুমকে নামাজে ইমামতির দায়িত্ব এবং আবু লুবাবাহকে মদীনার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। উটের পিঠে চড়ে রাসুল (সাঃ) এর দলটি আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশদের এক বাণিজ্য কাফেলাকে খুঁজে ফিরছিলো। পথ চলতে চলতে তারা আবু সুফিয়ানের কাফেলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে থাকেন। সৈন্যদল দাফরান উপত্যকায় পৌঁছালে রাসুল (সাঃ) সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তাদের কাছে খবর পৌঁছে যে, মক্কার কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষা করার জন্য তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। মুসলিমদের কাছে এ খবর পৌঁছার সাথে সাথে অভিযানের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। কারণ, তখন ব্যাপারটি আর কাফেলাকে ধাওয়া করা নয়, বরং পৌত্তলিক কুরাইশদের সাথে মুসলিমরা মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হবে কি হবে না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর্যায়ে চলে যায়। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সাহাবাদের সাথে আলোচনা করেন। আবু বকর ও ওমর (রা.) যুদ্ধের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। আল-মিকদাদ ইবন আমর উঠে দাঁড়িয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল! আপনি সেখানে যান যেখানে আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন এবং এ যাত্রায় আমরা অবশ্যই আপনার সাথে থাকবো। বনী ইসরাল জাতির মতো আমরা কখনোই বলবো না যে, হে মুসা! তুমি আর তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আর আমরা ঘরে বসে থাকবো। বরং আমরা বলবোঃ (হে নবী) তুমি এবং তোমার আল্লাহ যুদ্ধ করো এবং তার সাথে আমরাও যুদ্ধ করবো।” তারপর মুসলিমরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। এ অবস্থায় রাসুল (সাঃ) আনসারদের উদ্দেশ্য করে বলেনঃ “এবার তোমরা আমাকে কিছু বলো।” একথার মাধ্যমে আসলে তিনি আনসারদের আকাবা উপত্যকায় কৃত তাদের শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

বস্তুতঃ আনসাররা আকাবার প্রান্তরে রাসুল (সাঃ)-কে নিরাপত্তা দেবার অঙ্গীকার করেছিলো যেভাবে তারা তাদের নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। আবার অঙ্গীকারের সাথে এ শর্তটিও ছিলো যে, মদীনার বাইরে সংঘটিত কোন যুদ্ধের জন্য তারা দায়ী হবে না। যখন আনসাররা বুঝতে পারলো যে, রাসুল (সাঃ) তাদের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছেন, তখন সা’দ ইবন মু’য়াজ ইসলামের পতাকা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ঘোষণা করলো যেঃ “হে আল্লাহর রাসুল! আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলছেন।” রাসুল (সাঃ) বললেনঃ “হ্যাঁ, আমি তোমাদের উদ্দেশ্য করেই বলছি।” উত্তরে সা’দ বললোঃ “আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনার সত্যতার ঘোষণা দিয়েছি এবং আপনি আমাদের কাছে যে সত্য এনেছেন তার সত্যতার সাক্ষী হয়েছি। এছাড়া আমরা আপনার কাছে এ মর্মেও অঙ্গীকার করেছি যে, আমরা আপনার আনুগত্য করবো। সুতরাং, আপনার যেখানে ইচছা আপনি সেখানেই যান, আমাদের আপনার সাথেই পাবেন। যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন সেই সত্ত্বার কসম! যদি আপনি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, তবে আমরা আপনার সাথে সমুদ্রেও ঝাঁপ দিব। আমাদের মধ্য হতে একজনও এ ব্যাপারে পেছনে পড়ে থাকবে না। আগামীকালও যদি আপনি আমাদের সহ শত্রুপক্ষকে মোকাবিলা করতে চান তবে তাতেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা যোদ্ধা জাতি, আমরা জানি কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়। এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা হয়তো আমাদের মাধ্যমে আপনাকে এমন কিছু দান করবেন যাতে আপনার অন্তর প্রশান্ত হবে। সুতরাং, আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে এগিয়ে যান।” আল্লাহর রাসুল (সাঃ) সা’দ ইবন মু’য়াজের কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং বললেনঃ “তোমরা পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যাও। আল্লাহ তা’আলা আমার কাছে দুটি দলের মধ্যে একটি দলের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর কসম, আমি যেন কাফিরদের বধ্যভূমি দেখতে পাচ্ছি।”

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বদরের প্রান্তরের কাছাকাছি পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। যখন মুসলিমরা বুঝলো যে, শত্রুপক্ষ কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছে, তখন কুরাইশ বাহিনীর খবর সংগ্রহের আশায় হযরত আলী, আল-জুবায়ের ইবন আওওয়াম এবং সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাসসহ কিছু সাহাবী খবরের আশায় বদরের কুপের কাছে গেলেন। তারা কুপের কাছ থেকে দুইজন তরুণ যুবককে পাকড়াও করে ছাউনীতে ফেরত আসলেন। বন্দীদের প্রশ্ন করে তারা জানলেন যে, কুরাইশদের নেতারা নয়শত কিংবা একহাজার সৈন্যদলের একটি বাহিনীসহ তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষায় বের হয়েছে। রাসুল (সাঃ) তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলেন যে, তাকে তার সেনাদল অপেক্ষা তিনগুন শত্তিশালী একটি দলকে মুকাবিলা করতে হবে এবং তাদের মুখোমুখি হতে হবে এক ভয়ানক সংঘর্ষের। তিনি (সাঃ) সাহাবীদের জানালেন যে, মক্কা তার কলিজার বড় বড় টুকরাগুলোকে (অর্থাৎ, সব চাইতে যোগ্য সন্তানদের) যুদ্ধের ময়দানে ছুঁড়ে ফেলেছে। সুতরাং, তারা (সাহাবীরা) যেন তাদের চেষ্টার কোন কমতি না করে।

মুসলিমরা শত্রুপক্ষকে দৃঢ়ভাবে মুকাবিলা জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। তারপর তারা বদরের কুপের কাছে অবস্থান গ্রহন করে সেখানে একটি পানির কৃত্রিম জলাশয় তৈরী করলো এবং যুদ্ধের কৌশল হিসাবে অন্য সব কুপগুলো বন্ধ করে দিলো, যাতে তাদের পান করার মতো পর্যাপ্ত পানি থাকলেও শত্রুপক্ষ পান করার জন্য পানি খুঁজে না পায়। সেই সাথে তারা আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর নিরাপদ অবস্থানের জন্য একটি ছাউনী তৈরী করলো। এরপর কুরাইশ যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দানে তাদের অবস্থান নিয়ে নিলো এবং পৌত্তলিক আসওয়াদ ইবন আবদ আল আসাদের ইন্ধনেই বদরের যুদ্ধের সূচনা হলো। আল-আসওয়াদ ইবন আবদ আল-আসাদ প্রথমে মুসলিমদের তৈরী জলাশয় ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে এলো। হামযাহ (রা.) তাঁর তলোয়ার দিয়ে সজোরে আঘাত করে আসওয়াদের পা দুটি উড়িয়ে দিলেন। পা হারিয়ে আসওয়াদ মাটিতে ধপাস করে পড়ে গেলো আর তার কর্তিত পা থেকে রক্তের বন্যা বইতে লাগলো। এ অবস্থায় হামযাহ (রা.) আবারও তাকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন এবং জলাশয়ের কাছে তাকে হত্যা করলেন। এরপর উতবাহ ইবন রাবি’য়াহ, তার ভাই শায়বা এবং তার পুত্র আল-ওয়ালিদকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। মুসলিমদের পক্ষ থেকে হামযাহ (রা.), আলী (রা.) এবং উবাইদাহ ইবন আল-হারিছ তাদের মুকাবিলা করতে এগিয়ে আসলেন। হামযাহ (রা.) খুব সহজেই তাঁর প্রতিপক্ষ শায়বাকে পরাস্ত করে ফেললেন, একইভাবে আলীও (রা.) তাঁর প্রতিপক্ষ আল-ওয়ালিদকে পর্যুদস্ত করলেন। তারপর হামযাহ ও আলী (রা.) উবাইদাহ (রা.) এর সাহায্যে এগিয়ে আসলেন, যিনি তখন কুরাইশ নেতা তবাহ র বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন। তবাকে খতম করে তারা তাদের আহত সহযোদ্ধা উবাইদাহকে (রা.) যুদ্ধের ময়দান থেকে উদ্ধার করলেন।

তারপর রমজান মাসের ১৭ তারিখ শুক্রবার সকালে উভয়পক্ষ পরস্পরের নিকটবর্তী হলো। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মুসলিমদের কাতার সোজা করলেন এবং তাদের যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকলেন। রাসুল (সাঃ) এর কথায় উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর লড়াই। লড়াইয়ের তীব্রতা এতো বেশী ছিলো যে, মুসলিমদের তলোয়ারের আঘাতে কুরাইশদের মাথা তাদের দেহ থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং তাদের আহাদ! আহাদ! (আল্লাহ এক) ধ্বনিতে বদরের আকাশ, বাতাস ও প্রান্তর মুখরিত হচ্ছিল।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝামাঝি এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে একমুঠো নুড়ি পাথর নিয়ে কুরাইশদের দিকে নিক্ষেপ করে বললেনঃ “তোমাদের মুখ ধুলি-ধুসরিত হোক!” তারপর তিনি (সাঃ) সাহাবাদের প্রবল পরাক্রমের সাথে শত্রুকে আঘাত করার নির্দেশ দিলেন, যে পর্যন্ত না শত্রুরা সম্পূর্নভাবে পরাস্ত হয়। অবশেষে, পৌত্তলিকরা পরাজিত হলো। আর বিজয় নির্ধারিত হলো মুসলিমদের জন্য। মুসলিমদের হাতে বহু সংখ্যক কুরাইশ যোদ্ধা ও কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রের নেতা নিহত হলো। বন্দী হলো আরও অনেকে। বাকী কুরাইশরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচলো। আর মুসলিমরা বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে আসলো ।


বনু কুরাইযা গোত্রকে শায়েস্তা

বদরের যুদ্ধের পূর্ব হতেই ইহুদীরা মুসলিমদের প্রতি সবসময়ই তীব্র হিংসা-বিদ্বেষ পোষন করতো। বদরের প্রান্তরে মুসলিমদের নাটকীয় বিজয়ের পর তাদের বিদ্বেষের মাত্রা চরম আকার ধারণ করলো। মুসলিমদের সাথে কৃত চুক্তির কোন তোয়াক্কা না করেই তারা মুসলিমদের অপদস্ত করার জন্য নিত্য-নতুন ষড়যন্ত্র ও হীন পরিকল্পনা করতে থাকলো। মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্রকে দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করেছিলো এবং অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় এর জবাব দিয়েছিলো। বনু কুরাইযার বাজারে সংঘটিত জঘন্য ঘটনাটিই প্রমাণ করে দেয় যে, মদীনার ইহুদীরা মুসলিমদের উক্তত্য করার জন্য কত হীনপন্থা অবলম্বন করতো।

বনু কুরাইযার বাজারে একবার এক মুসলিম নারী সোনার দোকানে তার গয়না নিয়ে বসেছিলো। এ সময় পেছন থেকে এক ইহুদী এসে তার কাপড়ের একপ্রান্ত খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়। মুসলিম নারীটি যখন উঠে দাঁড়ায় তখন তার কাপড় শরীর থেকে খুলে যায়। মুসলিম নারীকে এরকম একটি অপ্রস্তত অবস্থায় ফেলে উক্ত ইহুদীসহ আশেপাশের ইহুদীরা নির্লজ্জের মতো হাসিতে ফেটে পড়ে। এ অবস্থায় অপমানিত নারীটি সাহায্যের আশায় চিৎকার করতে থাকে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে এক মুসলিম সেই বদমাশ ইহুদীকে হত্যা করে ফেলে। এ ঘটনার প্রতিশোধ হিসাবে ইহুদীরা একত্রিত হয়ে উক্ত মুসলিমকে হত্যা করে। পরবর্তীতে, শহীদ হয়ে যাওয়া সে মুসলিমের পরিবার মদীনার মুসলিমদের ব্যাপারটি অবহিত করে তাদের শাস্তির দাবী করে। পরিণতিতে মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধ হয়।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বহুবার তাদের এ ধরনের জঘণ্য প্ররোচনামূলক কাজ করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন। কিন্তু তারা সে আদেশ-নিষেধের কোন তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যেই আল্লাহর রাসুলের বিরোধিতা ও তাঁর আদেশ অমান্য করতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে রাসুল (সাঃ) বনু কুরাইযাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং চারদিক থেকে তাদের আবাসস্থল ঘিরে ফেলেন। মুসলিমদের সাথে পরামর্শ করে তিনি এ গোত্রের সকলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। মূলতঃ এটা ছিলো তাদের মুসলিমদের সাথে ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা করার উপযুক্ত শাস্তি। এ পর্যায়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবন সালুল, যার ইহুদী ও মুসলিম দু’পক্ষের সাথেই সুসম্পর্ক ছিলো, বারবার ইহুদীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করার জন্য রাসুল (সাঃ)-কে অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু, মুহাম্মদ (সাঃ) তার এ কাতর আবেদনে কোন সাড়া না দিয়ে তাকে উপেক্ষা করেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালুল ইহুদীদের প্রাণরক্ষার জন্য ক্ষমা ভিক্ষার আবেদন করতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত তার আবেদনে সাড়া দিয়ে রাসুল (সাঃ) বনু কুরাইযাকে মদীনা ত্যাগ করে চলে যাবার নির্দেশ দেন। এরপর বনু কুরাইযা গোত্র মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে উত্তরে আদরা’ত আল-শামের দিকে চলে যায়।


বিদ্রোহ দমন

বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো অতি নগন্য এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের দিক থেকেও তারা ছিলো খুবই দূর্বল। কিন্তু তারপরও কাফিরদের সাথে মুসলিমের এ প্রথম মুকাবিলায় মুসলিমরা বীরের মতো বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো। মুসলিমদের এ বীরত্বপূর্ণ বিজয় কাফিরদের আত্মবিশ্বাসের ভীত এতো সাংঘাতিকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো যে, তারা শোকে-দুঃখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলো। এছাড়া, কুফরশক্তির উপর মুসলিমদের এ বিজয় মদীনার অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধসহ ইহুদীদের নানারকম চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকেও অনেকটা দমিয়ে দিয়েছিলো। এ ঘটনার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ, কিছু ইহুদী গোত্র মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়, আর কিছু গোত্র মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়। মদীনাতে মুসলিমদের শক্তিসামর্থ্য ক্রমশ বাড়ছিলো, আর কুরাইশরা এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে অপমানের প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা আঁটছিলো। পরের বছর ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিম তীরন্দাজরা (যারা মুজাহিদদের পেছন থেকে পাহারা দেবার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো) রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ অমান্য করে গণীমতের মালামাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে গেলো, ঠিক তখনই কুরাইশদের হাতে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার সুবর্ণ সুযোগ এসে গেলো। যুদ্ধে জয়ী হয়ে কুরাইশরা আনন্দে উৎফুল্ল হলো। আর মুসলিম যোদ্ধারা ভগ্ন হৃদয়ে পরাজিত হয়ে মদীনায় ফিরে আসলো। যদিও যুদ্ধ শেষ হবার পর মুসলিমরা কুরাইশদের হামরা’ আল-আসাদ পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলো (এটি ছিলো মদীনা থেকে প্রায় আট মাইল দূরে)।

ওহুদের প্রান্তরে মুসলিমদের এই পরাজয়ে আরব ভূ-খন্ডে নানারকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মদীনার অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল মুসলিমদের শক্তিসামর্থ্য ও শাসন-কর্তৃত্বকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে প্রকাশ্যেই বিদ্রোহ ঘোষনা করে। মদীনার বাইরের কিছু গোত্র, যারা ওহুদের যুদ্ধের পূর্বে কোনদিন মুসলিমদের সাথে কৃত চুক্তির সীমা অতিক্রম করার কথা চিন্তাও করেনি, তাদের মাঝেও বিদ্রোহের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। ইহুদী ও মদীনার মুনাফিকদের মতো মদীনার বাইরের আরবরাও মুহাম্মদ (সাঃ)-কে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবতে থাকে। এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্নভাবে মুসলিমদের প্ররোচিত করতে থাকে।

মদীনার ভেতরে-বাইরে শত্রুপক্ষের এসব পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে রাসুল (সাঃ) শত্রুপক্ষকে মুকাবিলা করার বিষয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মুসলিমের প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা ও শক্তিসামর্থ্য পুরুদ্ধারকল্পে তিনি (সাঃ) মুসলিমদের প্রতি অমুসলিমদের যেকোন ধরনের তুচ্ছতাচ্চিল্য ও বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।

ওহুদ যুদ্ধের একমাস পর আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছে যে, বনু আসাদ গোত্র মদীনা আক্রমণ করে শহরের চারিপার্শস্থ চারণভূমির পশুগুলো লুট করার পরিকল্পনা করেছে। এমতাবস্থায়, রাসুল (সাঃ) বনু আসাদ গোত্রকে মদীনা আক্রমণ করার কোন সুযোগ না দিয়ে তার আগেই তাদের আস্তানায় আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শত্রুপক্ষের আক্রমণের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দেয়াই ছিলো এ আক্রমণের উদ্দেশ্য। তিনি (সাঃ) আবু সালামাহ ইবন আবদ আল-আসাদের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুসলিমের একটি দলকে এ অভিযানে প্রেরণ করেন। এ দলে আবু উবাইদাহ ইবন আল-জাররাহ, সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস এবং উসাইদ ইবন হুদাইরসহ অনেক খ্যাতনামা যোদ্ধা ছিলো। এ অভিযানকে গোপন রাখা এবং শত্রুপক্ষকে চমকে দেবার জন্য আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের দিনে লুকিয়ে থেকে রাতে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। সেইসাথে প্রচলিত পথে যাত্রা না করে ভিন্ন পথ ধরে চলার আদেশ দেন। আবু সালামাহ বনু আসাদ গোত্রের ঘাঁটিতে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত যাত্রা করতে থাকেন। লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর তিনি ভোরবেলায় দলবলসহ বনু আসাদ গোত্রকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং তার সঙ্গীদের জিহাদের নির্দেশ দিয়ে শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ চালান। মুসলিম সৈন্যদল খুব সহজেই বনু আসাদকে পরাজিত করে এবং যুদ্ধলব্ধ মালামালসহ বীরের বেশে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে মুসলিমদের শৌর্য-বীর্য আবারও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ ঘটনার মাধ্যমে প্রকারান্তরে মুসলিমরা অমুসলিমদের ইসলামের শক্তি-সামর্থ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এরপর রাসুল (সাঃ) এর কাছে সংবাদ পৌঁছে যে, খালিদ ইবন সুফিয়ান আল-হানদালি নামে এক পৌত্তলিক উরনাহ বা নাখলাহর কাছে অবস্থান গ্রহন করেছে এবং মদীনা আক্রমণের জন্য লোকবল সংগ্রহ করছে। এ সংবাদ শোনার পর, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবন আনিছকে খালিদ ইবন সুফিয়ান সম্পর্কে খোঁজখবর নেবার জন্য প্রেরণ করেন। আবদুল্লাহ যাত্রা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই খালিদের দেখা পেয়ে যান। খালিদ তাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে কে? উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমি আবদুল্লাহ। আমি একজন আরব। আমি শুনতে পেয়েছি যে, তুমি মুহাম্মদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য লোক সংগ্রহ করছো। আর এ কারনেই আমি এখানে এসেছি।” খালিদ তার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে। তারপর তারা দু’জন কথাবার্তা বলতে বলতে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। যখন তারা দু’জন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে আসে, তখন আবদুল্লাহ ইবন আনিছ তলোয়ার দিয়ে খালিদকে তীব্রভাবে আঘাত করে তাকে হত্যা করেন। তারপর তিনি মদীনায় ফিরে এসে রাসুল (সাঃ)-কে তার অভিযানের কথা বর্ণনা করেন। খালিদের মৃত্যুর সাথে সাথে হাদায়েলের বনু লিহইয়ান গোত্র মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করে। আর এভাবেই রাসুল (সাঃ) অত্যন্ত সফলতার সাথে খালিদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেন এবং সেইসাথে মদীনার বিভিন্ন প্রান্তরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা বিদ্রোহেরও অবসান হয়।

কিন্তু এ ঘটনার পরেও কিছু আরব গোত্র মুসলিমদের শাসন-কর্তৃত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহে লিপ্ত হয়। হাদায়েলের আশেপাশের এলাকার কোন গোত্র থেকে একবার একদল লোক মদীনায় আসে। তারা মুহাম্মদ (সাঃ) বলে যে, তারা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জানার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। সুতরাং তিনি (সাঃ) যেন তাদেরকে কুর’আন শেখানোর জন্য কিছু সাহাবাকে তাদের গোত্রে পাঠান। একথা শুনে রাসুল (সাঃ) বয়োজেষ্ঠ্য ছয়জন সাহাবীকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। যাত্রা শুরু করার পর তারা হাদায়েলের কুপগুলোর কাছাকাছি আল-রাজি নামক এলাকায় পৌঁছালে উক্ত গোত্রের লোকেরা সাহাবীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তারা হাদায়েলের অধিবাসীদেরকে সাহাবীদের আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়। তারপর সেখানকার অধিবাসীরা সাহাবীদের ঘেরাও করে ফেলে এবং তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুসলিমরাও জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করতে থাকে এবং তাদের মধ্যে তিনজন সাহাবী সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন। বাকী তিনজনকে তারা বন্দী করে মক্কার কুরাইশদের কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। মক্কা যাত্রাকালে বন্দী সাহাবীদের মধ্য হতে আবদুল্লাহ ইবন তারিক তার তলোয়ারের নাগাল পেয়ে যায় এবং নিজেকে মুক্ত করার জন্য কাফিরদের আক্রমণ করে। কিন্তু শীঘ্রই কাফিররা তাকে হত্যা করে। অন্য দু’জন বন্দীকে তারা মক্কার পৌত্তলিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এদের মধ্যে যায়িদ ইবন আল-দাছনাহকে সাফওয়ান ইবন উমাইয়াহর কাছে বিক্রি করা হয়, যেন সে তার পিতা উমাইয়া ইবন খালফের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে। আবু সুফিয়ান যায়িদকে বলেঃ “আল্লাহর কসম, তুমি কি চাও না যে, আজ তোমার পরিবর্তে যদি মুহাম্মদ আমাদের হাতে বন্দী থাকতো, আমরা তার মাথা কেটে নিতাম আর তুমি তোমার পরিবারের সাথে থাকতে?” এর উত্তরে যায়িদ বলেনঃ “আল্লাহর কসম, আমি কক্ষনো ভাবতে পারি না যে, মুহাম্মদ যদি আজ আমার জায়গায় থাকতো। আমি ঘরে নিরাপদে বসে থাকবো আর এ অবস্থায় তাঁর গায়ে একটা কাঁটার আঘাতও লাগবে এটা আমি সহ্য করবো না।” একথা শুনে আবু সুফিয়ান আশ্চর্য হয়ে যায়। সে প্রায়ই বলতো, মুহাম্মদের ছাড়া আমি আর কোন মানুষ দেখিনি, যে তার সঙ্গী-সাথীদের এতো ভালোবাসা পেয়েছে। এরপর যায়িদ ইবন আল-দাছনাহকে কুরাইশরা হত্যা করে।

দ্বিতীয় বন্দী খুবাইবকে মক্কায় আনার পর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়, যে পর্যন্ত না কুরাইশরা তাকে নির্মমভাবে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। মৃত্যুর আগে খুবাইব কুরাইশদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে। অত্যন্ত চমৎকারভাবে নামাজ আদায় করার পর তিনি কুরাইশদের উদ্দেশ্য করে বলেনঃ “যদি না তোমরা ভাবতে আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে নামাজ দীর্ঘ করছি, তবে আমি আমার নামাজকে আরও দীর্ঘায়িত করতাম।” এরপর কুরাইশরা তাকে কাঠের সাথে শক্ত করে বাঁধে, এ সময় খুবাইব তাদের দিকে তাকিয়ে ক্রোধান্বিতভাবে চিৎকার করে বলেঃ “হে আল্লাহ! এদের প্রত্যেককে তুমি গুনে গুনে স্মরণে রেখো, তাদের প্রত্যেককে তুমি উপযুক্ত শাস্তি দিও, এদের মধ্যে কাউকে তুমি ছেড়ে দিও না।” উপস্থিত কুরাইশরা খুবাইবের এ কান্না জড়িত প্রার্থনায় ভীত হয়ে পড়ে, তারপর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ ছয়জন সাহাবীর এ নির্মম মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে পড়েন। মূলতঃ হাদায়েলের অধিবাসীদের জঘন্য পদ্ধতিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ও সাহাবীদের প্রতি ভয়ঙ্কর অসম্মান প্রদর্শন করাই ছিলো মুসলিমদের তীব্র মনোকষ্টের আসল কারণ।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এইসব বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন। ভাবতে থাকেন বিদ্রোহ দমনের উপায়। এ সময়ে আবু বারা’ আমির ইবন মালিক (বর্শার খেলোয়ার) নামে এক ব্যক্তি মদীনায় আগমন করে। রাসুল (সাঃ) সত্য দ্বীনকে তার কাছে ব্যাখ্যা করেন এবং তাকে দ্বীন ইসলামের দিকে আহবান করেন। আবু বারা’ ইসলাম গ্রহন না করলেও ইসলাম গ্রহনের খুব কাছাকাছি পর্যায়ে চলে যায়। এছাড়া ইসলামের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষও তার মাঝে কখনো দেখা যায়নি। সে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে অনুরোধ করে যে, “আপনি যদি আপনার সাহাবীদের মধ্য থেকে একদল মুসলিমকে নাজদ এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠান, তাহলে আশা করা যায় তারা এ আহবানে সাড়া দেবে।” কিন্তু সম্প্রতি হাদায়েলের অধিবাসীদের হাতে ছয় সাহাবীর নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণ করে রাসুল (সাঃ) তার প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করেন। আবু বারা’ শেষ পর্যন্ত নিজে সাহাবীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলে রাসুল (সাঃ) তার প্রস্তাব মেনে নেন। আবু বারা’ রাসুল (সাঃ)-কে বলেঃ “আপনার পক্ষ থেকে একদল মানুষকে আপনি আপনার দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য পাঠিয়ে দেন, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার।” আরব ভূ-খন্ডে আবু বারা’র যথেষ্ট সুনাম ছিলো এবং তার কথার গুরুত্বও ছিলো যথেষ্ট। তাই তার কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা করা কিংবা তার দেয়া নিরাপত্তায় কারো কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিলো না।

এসব বিষয় বিবেচনা করে রাসুল (সাঃ) চল্লিশ জন প্রথম শ্রেনীর মুসলিমকে আল-মুনদির ইবন আমর এর নেতৃত্বে নাজদ এলাকায় পাঠিয়ে দেন। দলটি পথ চলতে চলতে মা’নার কুপের কাছে পৌঁছালে মুসলিমদের পক্ষ হতে একজন রাসুল (সাঃ) এর চিঠিসহ আমির ইবন তুফাইলের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আমির ইবন তুফাইল দূতকে দেখার সাথে সাথে চিঠি না পড়েই তাকে হত্যা করে। তারপর সে বনু আমির গোত্রকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আহবান করে। কিন্তু বনু আমির গোত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অসম্মতি জানিয়ে বলে যে, আবু বারা’ মুসলিমদেরকে নিরাপত্তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা তা ভঙ্গ করবে না। তখন আমির সেখানকার অন্য গোত্রগুলোকে যুদ্ধের জন্য আহবান করলে তারা উটের পিঠে চড়ে চারদিক থেকে মুসলিমদের ঘিরে ফেলে। এ অবস্থায় মুসলিমরা যার যার অস্ত্র বের করে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমৃত্যু কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এ ভয়ঙ্কর ঘটনা দু’জন ছাড়া বাকী সমস্ত মুসলিম শহীদ হয়ে যায়। এ সংবাদ মদীনায় পৌঁছানোর পর আল্লাহর রাসুল (সাঃ) মানসিকভাবে সাংঘাতিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং সেই সাথে শোকের সাগরে নিমজ্জিত হন তাঁর সাহাবীরাও।

মদীনার বাইরের আরব গোত্রগুলোর বিদ্রোহ কিভাবে দমন করা যায় তা নিয়ে রাসুল (সাঃ) গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। ভাবতে থাকেন কিভাবে বদরের যুদ্ধে অর্জিত মুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও শৌর্য-বীর্য ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়। একসময় তিনি (সাঃ) অনুভব করেন যে, মদীনার অভ্যন্তরেই আসলে অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। তাই তিনি (সাঃ) প্রথমে ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধানের দিকে মনোযোগী হন। তিনি (সাঃ) সিদ্ধান্ত নেন যে, অভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধান করার পরই তিনি মদীনার বাইরের গোত্রগুলোর বিদ্রোহ দমনে চিন্তা-ভাবনা করবেন।

ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পর হাদায়েলের অধিবাসী কর্তৃক ছয় সাহাবীর হত্যাকান্ড এবং বীরে মা’নার নৃশংস ঘটনার পর মদীনার মুনাফিক ও ইহুদী গোত্রগুলোর ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তারা পুরায় মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং মুসলিমদের কর্তৃত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শুরু করে। তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে কিভাবে মুসলিমদের একহাত দেখে নেয়া যায়। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ধীরে ধীরে তাদের মনোভাব বুঝতে পারেন এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও অবহিত হন। এরপর রাসুল (সাঃ) সাহাবী মুহাম্মদ ইবন মাসলামাহকে ইহুদীদের কাছে পাঠান। ইবন মাসলামাহ ইহুদীদেরকে রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ জানিয়ে দিয়ে বলেনঃ “আল্লাহর রাসুল আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন এবং তোমাদের মদীনা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, তোমরা তাঁর সাথে কৃত চুক্তির ওয়াদা ভঙ্গ করেছো এবং বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা করেছো। তোমাদের মদীনা ত্যাগের জন্য দশদিন সময় দেয়া হলো, এরপর যদি তোমাদের মধ্য হতে কাউকে মদীনায় দেখা যায় তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে।”

আবদুল্লাহ ইবন উবাই জোর করে আটকে না রাখলে বনু নাদির গোত্র এ নির্দেশের পরই মদীনা ত্যাগ করতো। এছাড়া ইহুদীদের নেতা হুবাই ইবন আখতাবও তাদের দূর্গে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করার জন্য তাদের পরামর্শ দিতে থাকে। দশদিন অতিক্রম হয়ে যাবার পরও যখন বনু নাদির তাদের দূর্গ ত্যাগ করলো না, তখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) দলবলসহ তাদের ঘেরাও করেন এবং যে পর্যন্ত না বনু নাদির রাসুল (সাঃ) এর কাছে তাদের প্রাণ ভিক্ষা চায় সে পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করেন। মদীনা ত্যাগের সময় আল্লাহর রাসুল (সাঃ) উটের পিঠে করে যতোটা মালামাল নিয়ে যাওয়া যায় ততোটা নেয়ার অনুমতিও তাদের দেন। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের জমিজমা, খেজুর বাগান ও অস্ত্রসস্ত্র পেছনে ফেলে মদীনা ত্যাগ করে। রাসুল (সাঃ) তাদের ফেলে যাওয়া সম্পদ মুহাজিরদের ভেতরে ভাগ করে দেন। আনসারদের মধ্য হতে শুধু আবু দুজানাহ এবং সাহল ইবন হানিফ নামে দু’জন সাহাবীকে দরিদ্রতার কারণে বনু নাদিরের সম্পদের অংশ দেয়া হয়েছিলো। বনু নাদির গোত্রকে মদীনা থেকে বিতারনের মাধ্যমে রাসুল (সাঃ) মদীনার অভ্যন্তরীন বিদ্রোহকে সাফল্যের সাথে দমন করেন এবং মুসলিমদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করেন।

আল্লাহর রাসু(সাঃ) এবার ইসলামের পররাষ্ট্রনীতির দিকে নজর দিয়ে কুরাইশদের কাছে প্রতিশ্রুত বদর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু বদরের প্রান্তরে তিনি (সাঃ) শত্রুপক্ষের দেখা পেলেন না। এটা ছিলো ওহুদের যুদ্ধের একবছর পরের ঘটনা। ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের দুঃখজনক পরাজয়ের পর পৌত্তলিকদের সর্দার আবু সুফিয়ান সদর্পে ঘোষণা দিয়েছিলো যে, “এটা হলো বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ, আগামীবছর বদর প্রান্তরে তোমাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ হবে।” রাসুল (সাঃ) আবু সুফিয়ানের এ উক্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই তিনি (সাঃ) যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে তিনি (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবন আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালুলকে (মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্র) মদীনার দায়িত্বে রেখে বদরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বদরের প্রান্তরে পৌঁছানোর পর তারা কুরাইশদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশরা দুই হাজার যোদ্ধাসহ মক্কা ত্যাগ করলেও খুব শীঘ্রই আবার তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফিরে যায়।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বদরের প্রান্তরে কুরাইশদের জন্য দীর্ঘ আট দিন অপেক্ষা করলেন। কিন্তু কুরাইশরা আর ফিরে আসলো না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা খবর পেলেন যে, কুরাইশরা দলবলসহ মক্কায় ফিরে গেছে। এ সংবাদ পাবার পর তিনি (সাঃ) তাঁর সাহাবীদেরসহ মদীনায় ফিরে আসলেন, সাথে করে আনলেন বদরের প্রান্তরে ব্যবসা থেকে অর্জিত পর্যাপ্ত মুনাফা। এ যাত্রায় মুসলিমরা কুরাইশদের সাথে কোন যুদ্ধ না করেই বিজয়ীর বেশে উৎফুল্ল চিত্তে মদীনায় ফিরে এলো। এর পরপরই রাসুল (সাঃ) তাঁর দলবল নিয়ে নাজদ এলাকার গাতাফান গোত্রকে আক্রমণ করেন। আক্রমণে হতবিহবল হয়ে গাতাফান গোত্রের লোকেরা তাদের সহায়-সম্পদ ও নারীদের রেখেই পালিয়ে যায়। এসব কিছুসহ মুসলিমরা মদীনায় ফিরে আসে। এরপর রাসুল (সাঃ) সিরিয়া ও হেজাজের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুমাত আল-জান্দাল গোত্রকে আক্রমণ করেন। এটা আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো অন্যান্য গোত্রগুলোকে সর্তক সংকেত দেয়া, যারা প্রায়ই মুসলিমদের কাফেলার উপর হামলা করতো। কিন্তু জুন্দাল গোত্র মুসলিমদের সাথে কোনরকম সংঘর্ষে না গিয়ে ধন-সম্পদ পেছনে ফেলে পালিয়ে যায়। আর মুসলিমরা সেগুলো নিয়ে মদীনায় ফেরত আসে।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর এসমস্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত ও গৃহীত পদক্ষেপ মূলতঃ মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিলো এবং সমস্ত আরব ও ইহুদী গোত্রগুলোর নিকট মুসলিমদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছিলো। আর নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের সকল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।

No comments:

Post a Comment