5.7.14

এটাই আমার পথঃ অধ্যায় ৪ ~ খিলাফত প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি

অধ্যায় ~ খিলাফত প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি

দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) এর সীরাতে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করা ফরযঃ

مَّنْ يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ ٱللَّهَ

যে ব্যক্তি রাসূলকে মানলো, সে মূলত আল্লাহকেই মানলো..... [সূরা আন-নিসাঃ ৮০]

এক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের প্রকৃত অর্থ বুঝতে হবে।

৪.১ দারুল ইসলাম ও দারুল কুফর

‘দার’ শব্দটি আরবি ভাষায় বহু অর্থে ব্যবহার হয়, যেমনঃ এলাকা/মহল্লা, ঘর, বসতবাড়ি, ভূমি ইত্যাদি। শারী’আহ-র পরিভাষায়, দারুল ইসলাম বলতে এমন ভূমিকে বোঝায় যেটি ইসলামের আইন দ্বারা শাসিত হয় এবং যার নিরাপত্তা রক্ষিত হয় ইসলাম দ্বারা অর্থাৎ মুসলিমদের কর্তৃত্ব ও প্রতিরক্ষা দ্বারা। এমনকি যদি সেই ভূমির অধিকাংশ অধিবাসী অমুসলিমও হয়, তবুও সেটি দারুল ইসলাম।

দারুল কুফর বলতে এমন ভূমিকে বোঝায় যেটি কুফরের আইন দ্বারা শাসিত হয় এবং যার নিরাপত্তা ইসলাম দ্বারা রক্ষিত হয় না অর্থাৎ মুসলিমদের কর্তৃত্ব ও প্রতিরক্ষা দ্বারা এর নিরাপত্তা রক্ষিত হয় না। এমনকি যদি সেই ভূমির অধিকাংশ অধিবাসী মুসলিমও হয়, তবুও সেটি দারুল কুফর।

মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ আলেমগণ দারুল ইসলাম ও দারুল কুফরকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন।

ইমাম আল-কাসানী (রহ.) বলেনঃ “‘হানাফী আলেমগণের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে, ইসলামের আইন কর্তৃত্বশীল হলে দারুল কুফর দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়।’ আমাদের ইমাম (আবু হানিফা) বলেনঃ তিনটি ক্ষেত্রে দারুল ইসলাম দারুল কুফরে পরিণত হয়ঃ যখন আইনগুলো কুফরের আইনে পরিণত হয়, যখন কুফর রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ছাড়াই ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত থাকে অথবা যখন মুসলিম কিংবা যিম্মিদের জন্য আর কোনো নিরাপত্তা অবশিষ্ট থাকে না।’” [বাদাইস সানাই, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩১]

ইমাম আল-সারখাসী (রহ.) বলেনঃ ইসলামী আইনসমূহ কর্তৃত্বশীল হলে একটি ভূমি দারুল ইসলামে পরিণত হয়।’ [শরহে সীরাতুল কাবীর, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৯৭]

কাজি আবু ইয়া’লা (রহ.) বলেনঃ যে দেশে ইসলামের পরিবর্তে কুফর বাস্তবায়িত হয়, তা দারুল কুফর।’ [আল-মু’তামাদ ফী উসুলিদ-দ্বীন, পৃষ্ঠা ২৭৬]

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেনঃ জমহুর (অধিকাংশ) আলিমদের মতে, দারুল ইসলাম হলো সেই ভূমি যেখানে মুসলিমরা বসবাস করে ও ইসলামের আইনসমূহ কর্তৃত্বশীল।.... ইসলাম কর্তৃত্বশীল না হলে সেটি দারুল ইসলাম নয়।’ [কিতাব আহকাম আহলিল জিম্মাহ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৬]

শায়খ তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানী (রহ.) বলেনঃ

والحق أن اعتبار الدار دار إسلام أو دار كفر، لا بد أن ينظر فيه إلى أمرين: أحدهما الحكم بالإسلام، والثاني الأمان بأمان المسلمين أي بسلطانهم، فإن توفر في الدار هذان العنصران، أي أن تحكم بالإسلام، وأن يكون أمانها بأمان المسلمين، أي بسلطانهم كانت دار إسلام، وتحولت من دار كفر إلى دار إسلام، أما إذا فقدت أحدهما فلا تصير دار إسلام

দারুল ইসলাম বা দারুল কুফর বিবেচনা করার ক্ষেত্রে শুদ্ধ পদ্ধতি হলো দুটো বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রাখাঃ এক. ইসলামী আইনের শাসন, দুই. মুসলিমদের কর্তৃত্ব দ্বারা নিরাপত্তা। কোনো দেশ যদি এ দুটো উপাদান অর্জন করে অর্থাৎ ইসলামী শাসন ও মুসলিমদের কর্তৃত্বে নিরাপত্তা লাভ করে, তাহলে দেশটি দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়। আবার যদি দেশটিতে এ দুটো উপাদানের কোনো একটি না থাকে, তাহলে সেটি আর দারুল ইসলাম থাকে না।’ [আশ-শাকসিয়্যাহ আল-ইসলামীয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৯]

বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর কোথাও বর্তমানে ইসলামী আইনের পরিপূর্ণ শাসন বা ইসলামী কর্তৃত্বে নিরাপত্তার বিধান নেই। সুতরাং নিঃসন্দেহে বাংলাদেশসহ প্রতিটি মুসলিম দেশ তথা সারা পৃথিবী বর্তমানে দারুল কুফর। বর্তমান বিশ্বে বিপর্যয়ের মূল কারণও হলো এই ইসলামী আইনের অনুপস্থিতি। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) যথার্থই বলেছেনঃ

الْفِتْنَةُ إذَا لَمْ يَكُنْ إمَامٌ يَقُومُ بِأَمْرِ النَّاسِ

জনগণের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করার জন্য কোনো ইমাম না থাকলে ফিতনা [বিপর্যয় ও পাপাচার] সৃষ্টি হয় [আল ফুরু’ লি ইবনে মুফলিহ]

বিপর্যয় ও পাপাচারপূর্ণ এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদেরকে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে দারুল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

৪.২ সঠিক পদ্ধতি

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাক্কী জীবনে দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত করার অনুসৃত পদ্ধতিই খিলাফত প্রতিষ্ঠার একমাত্র সঠিক পদ্ধতি। কেননা এটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার ওহী দ্বারা নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি।

قُلْ هَـٰذِهِ سَبِيلِيۤ أَدْعُو إِلَىٰ ٱللَّهِ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَاْ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِى

“বলঃ এটাই আমার পথ, আমি আল্লাহর দিকে সজ্ঞানে মানুষকে আহবান করি এবং আমার অনুসারীরাও...।” [সূরা ইউসুফঃ ১০৮]

রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ উত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মদ (সাঃ) এর পথ।’ [মুসলিম]

সীরাত বিশ্লেণ করলে দেখা যায় যে, রাসূল (সাঃ) তিনটি ধাপে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন।

§  প্রথম ধাপঃ দল গঠন - ব্যক্তিপর্যায়ে দাওয়া শুরু (دور التثقيف)

يٰأَيُّهَا ٱلْمُدَّثِّرُ  قُمْ فَأَنذِرْ  وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ

হে বস্ত্রাবৃত, উঠুন ও সতর্ক করুন এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।’ [সুরা আল-মুদ্দাসসিরঃ ১-৩]

এই আয়াতসমূহ নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন। প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীদেরকে নিয়ে তিনি একটি দাওয়াকারী দল গঠন করেন। আল্লামা শফিউর রহমান মোবারকপুরী বলেনঃ ‘তিন বছর যাবৎ দ্বীনের কাজ গোপনভাবে চললো। এ সময় ঈমানদারদের একটি দল তৈরি হয়ে গেল। এরা ভ্রাতৃত্ব এবং সহায়তায় ওপর কায়েম ছিল। তারা আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাচ্ছিল এবং এ পয়গামকে একটা পর্যায়ে উন্নীত করতে চেষ্টা করেছিলেন।’ [আর-রাহীকুল মাখতুম, আল কুর’আন একাডেমী লন্ডন, পৃষ্ঠা ৯২]

পরবর্তীতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা সূরা আল-ইমরানের ১০৪ নম্বর আয়াতে দল গঠনের নির্দেশ দেনঃ

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে আর অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং এরাই সফলকাম।’

এ আয়াতের তাফসীরে আবু জা’ফর আত তাবারী (রহ.) বর্ণনা করেনঃ দাহ্হাক বলেছেনঃ

هم خاصة أصحابِ رسول الله

তারা বিশেষভাবে রাসূলের সাহাবীগণ।’ [তাফসিরে ইবনে জারীর]

একইভাবে ইবন কাসীর (রহ.) এ আয়াতের তাফসীরে দাহ্হাক থেকে বর্ণনা করেনঃ

هم خاصّة الصحابة

তারা বিশেষভাবে সাহাবীগণ।’

ব্যক্তিপর্যায়ে দাওয়াতের এই পর্বটি তিন বছর স্থায়ী ছিল। এসময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদেরকে দারুল আরকামে নিয়মিত শিক্ষা দিতেন।

সে সময় গঠিত ঈমানদারদের দলটি অবশ্য সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কেননা তখনো সূরা আল-ইমরানের ১০৪ নং আয়াতটি [ইতিমধ্যে ৬নং অধ্যায়ে আলোচিত] নাযিল হয়নি। বর্তমানে মুসলিমদের দল গঠনের দলীল এই আয়াতটি।

§  দ্বিতীয় ধাপঃ সমাজ পরিবর্তনের প্রকাশ্য আন্দোলন (دور التفاعل)

ইমাম আবু জাফর আত-তাবারী (রহ.) বলেনঃ “নবুয়্যতের তিন বছর পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রকাশ্যে দাওয়া করার নির্দেশ দেন এই আয়াতের মাধ্যমেঃ

فَٱصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ ٱلْمُشْرِكِينَ

অতএব, আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদেরকে উপেক্ষা করুন।’ [সূরা আল-হিজরঃ ৯৪] [তারিখে তাবারী, ষষ্ঠ খণ্ড]

শফিউর রহমান মোবারকপুরী বর্ণনা করেনঃ ‘এরপর রাসূল (সাঃ) পৌত্তলিকদের নোংরামি ও অকল্যাণসমূহ প্রকাশ্যে তুলে ধরে মিথ্যার পর্দা উন্মোচিত করেন। তিনি মূর্তিসমূহের অন্তঃসারশূন্যতা ও মূল্যহীনতা তুলে ধরে তাদের স্বরূপও উদঘাটন করেন।’ [আর-রাহীকুল মাখতুম, আল কুর’আন একাডেমী লন্ডন, পৃষ্ঠা ৯৫]

তৎকালীন কুফর সমাজব্যবস্থা ও চিন্তাসমূহ তথা মূর্তিপূজা, পরনিন্দা, ইয়াতীমের সম্পদ লুট, কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া, ব্যবসায় প্রতারনা, অর্থলোভ, প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা, দুনিয়াপ্রীতি ইত্যাদিকে আক্রমন করে বহু আয়াত নাযিল হতে থাকে।

যেসব গোত্রপতির হাতে মক্কার শাসন ব্যবস্থা ন্যস্ত ছিল, যেমনঃ ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান, আবু লাহাব, উবাই বিন খালফ, উমাইয়া বিন খালফ - এদেরকে আক্রমণ করেও কুরআনে একের পর এক আয়াত নাযিল হতে থাকে।

রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীগন এসব আয়াত নিয়ে সমাজে ব্যাপক দাওয়া চালিয়ে যেতেন। এভাবে তাঁরা মক্কার নেতৃত্ব ও সমাজব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেন।

এসব কাফের নেতাও রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীদের ওপর ভীষণ জুলুম-নির্যাতন চালায়। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল (সাঃ) অভিশাপ দিয়েছিলেনঃ

اللَّهُمَّ عَلَيْكَ بِأَبِي جَهْلٍ وَعَلَيْكَ بِعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِي مُعَيْطٍ

হে আল্লাহ, আবু জাহল, উতবাহ ইবন রাবিয়া, শায়বাহ ইবন রাবিয়া, উমাইয়া ইবন খালফ, উবাই ইবন খালফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’ [বুখারী]

শত নির্যাতন-দমন-নিপীড়ন সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীগণ দৃঢ়ভাবে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। কুরাইশ নেতারা কয়েকবার সমঝোতার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। অবশেষে নবুয়্যতের দশম বর্ষে আবু তালিব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আবু জাহল, উমাইয়া, আবু সুফিয়ানসহ পঁচিশজন কুরাইশ নেতা সমঝোতার জন্য আবু তালিবের শরণাপন্ন হয়। [আর-রাহীকুল মাখতুম, আল কুর’আন একাডেমী লন্ডন, পৃষ্ঠা ১৩১]

ইবনে হিশাম বর্ণনা করেনঃ আবু তালিব রাসূল (সাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলে তাঁকে বললেনঃ ‘ভাতিজা, এরা তোমার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তারা এসেছে তোমার নিকট থেকে একটা কথা নিতে এবং বিনিময়ে তোমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিতে।’ [সীরাতে ইবনে হিশাম, বাংলাদেশ ইসলামী সেন্টার সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১০৬]

শফিউর রহমান মোবারকপুরী বর্ণনা করেনঃ একথা শুনে রাসূল (সাঃ) কুরাইশ প্রতিনিধি দলকে বললেনঃ

أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَعْطَيْتكُمْ كَلِمَة تكلمتُمْ بِهَا، ملكتم بِهَا العرب، ودانت لكُمْ بِهَا العجم

‘আপনারা বলুন, আমি যদি এমন কোনো কথা পেশ করি, যে কথা গ্রহণ করলে আপনারা আরবের শাসক হবেন এবং অনারবরাও আপনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তখন আপনারা কী করবেন?’......

আবু জাহেল বললোঃ ‘বলো সেই কথা। তোমার পিতার শপথ, এধরনের কথা একটি কেন দশটি বললেও আমরা মানতে প্রস্তুত রয়েছি।’ রাসূল (সাঃ) বললেনঃ আপনারা বলুন,

لا إله إلا الله، وَتخلعُوْنَ مَا تعْبدُوْنَ مِنْ دُوْنِه

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো আনুগত্য উপাসনা পরিত্যাগ করুন

একথা শুনে কুরাইশরা হাতে তালি দিয়ে বললোঃ মুহাম্মদ! আমরা এক খোদা মানবো! আসলেই তোমার ব্যাপার-স্যাপার বড়ো অদ্ভুত! [আর-রাহীকুল মাখতুম, আল কুর’আন একাডেমী লন্ডন, পৃষ্ঠা ১৩২]

§  তৃতীয় ধাপঃ প্রভাবশালীদের সমর্থনে শাসনকর্তৃত্ব অর্জন (دور الحكم)

হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ

لَمَّا أَمَرَ اللَّهُ نَبِيّه أَنْ يَعْرِض نَفْسَه عَلَى قَبَائِل الْعَرَب، خَرَجَ وَأَنَا مِنْهُ وَأَبُو بَكْر إِلَى مِنًى، حَتَّى دَفَعَنَا إِلَى مَجْلِس مِنْ مَجَالِس الْعَرَب

“যখন আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে আরব গোত্রগুলোর সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার নির্দেশ দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে ও আবু বকর (রাঃ) কে সঙ্গে নিয়ে মিনায় আরব গোত্রগুলোর কাছে যেতেন।” [ফাতহুল বারী, হাকিম, বায়হাকী, আবু নুআইম]

অনুরূপ রেওয়ায়াত রয়েছে ইবনে কাসীর-এর বিদায়া ওয়ান নিহায়ার তৃতীয় খণ্ডে।

এই ধাপে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নুসরাহ (সামরিক সমর্থন) আদায় করার চেষ্টা করেন। ইমাম যুহুরী (রহ.) বলেনঃ রাসূল (সাঃ) যেসব গোত্রের কাছে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন, তারা হচ্ছে বানু আমের ইবনে সা’সা’আহ, মুহারিব ইবনে খাসফাহ, ফাজারাহ, গাসান, মুররাহ, হানিফা, সুলাইম, আবাস, বানু নার, বানু আল বুকা, কিনদাহ, কালব, আল-হারিস বিন কা, উযরাহ ও হাদারিমা। কিন্তু কেউই ইসলাম গ্রহণ করেনি। [ইবনে সাদ এর আত তাবাকাতশীর্ষক বই অনুসারে এই তালিকা উল্লেখ করা হল]

ইমাম তিরমিযি (রহ.) বর্ণনা করেনঃ উকাজ মেলার সময় রাসূল (সাঃ) যারা ইসলাম গ্রহণ করবে ও প্রচার করবে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন এবং সাফল্যের প্রতিশ্রুতি দিতেন। তিনি (সাঃ) প্রকাশ্যে বলতেনঃ তারা যদি তাওহীদ গ্রহণ করে ও তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নেয়, তাহলে তারা নিশ্চিত সাফল্য পাবে, আরবের শাসক হবে এবং পারস্যকে পরাভূত করবে।’ [তিরমিযি]

চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর পর রাসূল (সাঃ) নবুওয়্যাতের দশম বর্ষে মক্কা থেকে তায়েফ যান এবং সেখানকার গোত্রীয় নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মোবারকপুরীর বর্ণনায়, রাসূল (সাঃ) তাদের কাছে পৌঁছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ইসলামের সাহায্য করার আহ্বান জানান। [রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠাঃ ১৪৩]

তায়েফের নেতৃবৃন্দও রাসূল (সাঃ) কে সাহায্য করতে সম্মত হয়নি। এরপর রাসূল (সাঃ) একে একে প্রায় ৪০ টি গোত্রের কাছে নুসরাহ চান। কিন্তু কোন গোত্রই তাঁকে নিঃশর্ত নুসরাহ দিতে রাজি হননি। সীরাত গ্রন্থসমুহে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবর রয়েছে। যেমনঃ আমের ইবনে সা’সা’আহ গোত্রের কাছেও রাসূল (সাঃ) গিয়েছিলেন। জবাবে এ গোত্রের বুহায়রাহ বিন ফারাস নামক এক ব্যক্তি বলেছিলেনঃ আল্লাহর শপথ, যদি আমি কুরায়শের এ যুবককে সঙ্গে রাখি, তবে সমগ্র আরবকে খেয়ে ফেলবো। এরপর সে বললোঃ একটা কথার জবাব দিন। যদি আমরা আপনার দ্বীন গ্রহন করি এবং আপনি প্রতিপক্ষের ওপর জয়লাভ করেন, এরপর কি নেতৃত্ব আমাদের হাতে আসবে? রাসূল (সাঃ) বললেনঃ নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব তো আল্লাহর হাতে। তিনি যেখানে ইচ্ছা করেন, সেখানে রাখবেন। এ কথা শুনে সেই লোক বললোঃ চমৎকার কথা! আপনার নিরাপত্তার জন্য আমরা আমাদের বুককে আরবদের নিশানা করবো, অথচ আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন নেতৃত্ব হবে অন্যদের হাতে, এটা হয় না।’ [রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠাঃ ১৪৮]

অবশেষে রাসূল (সাঃ) তাঁর প্রত্যাশিত নুসরাহ লাভ করেন মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের কাছ থেকে। নবুওয়্যাতের ত্রয়োদশ বর্ষে আউস ও খাযরাজ গোত্রের ৭৫ জন গোত্রীয় নেতা মক্কায় এসে আকাবা নামক স্থানে রাসূল (সাঃ) কে আনুগত্যের শপথ (বায়াত) প্রদান করেন।

ইবনে হিশাম (রহ.) বর্ণনা করেনঃ রাসূল (সাঃ) আউস ও খাজরায গোত্রের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ আামি তোমাদের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার চাই যে, তোমরা তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের যেভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকো, আমাকেও সেভাবে রক্ষা করবে।’

তৎক্ষণাৎ বারা ইবনে মা’রুর (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর হাত ধরে বললেনঃ ‘হ্যাঁ। যে মহান সত্তা আপনাকে নবী করে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আমরা স্বজন ও স্ত্রী-সন্তানদের যেভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকি, আপনাকেও সেভাবে রক্ষা করবো। হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার আনুগত্য করার শপথ গ্রহণ করলাম। আল্লাহর শপথ, আমরা যুদ্ধ ও অস্ত্রের মধ্যেই লালিত পালিত। আমরা পুরুষাণুক্রমে যোদ্ধা জাতি।’ [সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১১৯]

এভাবেই রাসূল (সাঃ) মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের নিঃশর্ত সামরিক সমর্থন লাভ করার পর হিজরত করে মদীনায় গিয়ে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়ন শুরু করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র। হিজরতের সময় রাসূল (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশে দোয়া করতেনঃ

وَقُل رَّبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَل لِّي مِن لَّدُنكَ سُلْطَانًا نَّصِيرًا

বল, হে রব! আমাকে প্রবেশ করাও কল্যানের সাথে এবং আমাকে বের করাও কল্যানের সাথে এবং তোমার নিকট থেকে আমাকে দান কর রাষ্ট্রীয় সাহায্য।’ [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮০]

নিষিদ্ধ অবস্থায়ও দাওয়াহ চালিয়ে যাওয়ার দলীল

নবুওয়তের সপ্তম বর্ষে মক্কার কুফর শাসকগোষ্ঠী একটি লিখিত অঙ্গীকারনামার মাধ্যমে রাসূল (সাঃ), সাহাবীগন ও রাসূল (সাঃ) কে সাহায্যকারী গোত্রীয় ব্যক্তিদেরকে শিয়াবে আবু তালিব’ উপত্যকায় আটকে রেখে সর্বাত্নকভাবে বয়কট করতে থাকে। মুশরিক নেতৃবৃন্দ ওই বয়কটের অঙ্গীকারনামা কাবাঘরে ঝুলিয়ে দেয়।

সেই বয়কট চলাকালে রাসূল (সাঃ) এর কর্মতৎপরতা সম্বদ্ধে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ অবস্থায়ও নিজ সম্প্রদায়কে রাত-দিন, প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বাবস্থায় হিদায়াতের পথে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, এভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালন করে যাচ্ছিলেন। এতে কোন মানুষকে তিনি একবিন্দু পরওয়া করতেন না। [সীরাতে ইবনে হিশাম, খন্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ৩০]

মোবারকপুরীর বর্ণনায়, এ ধরনের কঠিন অবরোধ সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) এবং অন্যান্য মুসলিম হজ্বের সময় বাইরে বের হতেন এবং হজ্বের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। [রাহীকুল মাকতুম, পৃষ্ঠাঃ ১২৮-১২৯]

***********
১. সুরা মুদ্দাসছিরঃ ১১-২৫, সুরা কালামঃ ১০-১৬
২. সুরা আলাকঃ ১৬-১৯, সুরা মুদ্দাসছিরঃ ৩১
 ৩. সুরা মাউনঃ ১-৩
 ৪. সুরা লাহাব
 ৫. সুরা ইয়াসিনঃ ৭৬-৭৯
 ৬. সুরা হুমাযাহঃ ১-৯

No comments:

Post a Comment