অধ্যায়
১ ~ খিলাফত
যে
রাষ্ট্রব্যবস্থা আহকাম শারী’আহ-র প্রয়োগ ও ইসলাম প্রচারের জন্য দায়িত্বশীল, তাই হচ্ছে
খিলাফত। ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকেই খিলাফত নামে অভিহিত করা হয়। ইমামত বলতেও একই ব্যবস্থাকেই
বোঝায়। খিলাফতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) বলেনঃ
هِيَ الريَاسَةُ العَمَّة فِي التصدي
لِاِقَامَةِ الدِّيْن
‘খিলাফত হচ্ছে এমন এক সাধারণ রাষ্ট্র
যা দ্বীন বাস্তবায়ন করার প্রতি মনোযোগী থাকে।’ [ইযালাতুল খীফা আন খিলাফাতিল খুলাফা,
লাহোর, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ২]
আল
মাওয়ার্দী (রহ.) বলেনঃ
الْإِمَامَةُ
مَوْضُوعَةٌ لِخِلَافَةِ النُّبُوَّةِ فِي حِرَاسَةِ الدِّينِ وَسِيَاسَةِ الدُّنْيَا
‘ইমামত গঠিত হয় নবুয়্যতের প্রতিনিধিত্ব,
দ্বীন ইসলামের হিফাজত ও দুনিয়ার শাসনের জন্য।’ [আল-আহকামুস সুলতানিয়া, পৃষ্ঠা ১]
ইবনে
খালদুন (রহ.)-এর মতেঃ
أنَّ
حَقِيْقَةَ الْخِلافَة نِيَابَة
عَنْ صَاحِبِ الشَّرْعِ فِي حِفْظِ الدِّيْنِ وَسِيَاسَة الدُنْيَا
‘খিলাফতের বাস্তবতা
হলো আইন প্রণয়নের অধিকারীর [আল্লাহ] প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে দ্বীনের রক্ষা
ও পৃথিবীর শাসন।’ [আল মুকাদ্দিমাহ]
শায়খ
তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানী (রহ.) বলেনঃ
الْخِلافَةُ هِيَ رِئَاسَةٌ عَامَّةٌ لِلْمُسْلِمِيْنَ
جَمِيْعاً فِي الدُّنْيَا لِإِقَامَةِ أَحْكَم الشَّرْعِ الْإِسْلامِي، وَحمل
الدَّعْوَة الْإِسْلامِية إِلَى الْعَالَم
খিলাফত
হলো পৃথিবীর সকল মুসলিমের জন্য সাধারণ নেতৃত্ব। এর দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামী শরীয়তের আইন
বাস্তবায়ন করা ও সারা বিশ্বের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। [আল খিলাফাহ]
সারা
বিশ্বের সমস্ত মুসলমানের উপর খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। সমষ্টিগতভাবে
মুসলিমদের এই দায়িত্বের প্রতি উদাসীন থাকা কিংবা একে উপেক্ষা করা কবীরা গুনাহ যা আল্লাহর
কিতাব, রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাহ, সাহাবাদের (রাঃ) ইজমা ও শ্রেষ্ঠ আলেমদের বক্তব্যে সুস্পষ্ট।
আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তা’আলা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেনঃ
أَنْ أَقِيمُوا
الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং এতে মতোভেদ
করো না’... [সূরা
আশ-শুরাঃ ১৩]
فَاحْكُم
بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ
أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ
‘আর আপনি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন
তা দিয়ে তাদের মাঝে ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সত্য এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির
অনুসরণ করবেন না।’ [সূরা আল মায়িদাহঃ
৪৮]
وَأَنِ احْكُم
بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن
يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ مَا أَنزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ
‘আর আপনি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন
তা দিয়ে তাদের মাঝে ফয়সালা করুন, আর তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে
সতর্ক থাকুন; যেন তারা আপনার নিকট আল্লাহর প্রেরিত কোনো বিধান থেকে আপনাকে বিচ্যুত
করতে না পারে।’ [সূরা আল মায়িদাহঃ
৪৯]
وَمَن لَّمْ
يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই তো
কাফের।’ [সূরা আল মায়িদাহঃ
৪৪]
وَمَن لَّمْ
يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী
যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই তো জালিম।’ [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৫]
وَمَن لَّمْ
يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী
যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই তো ফাসেক।’ [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৭]
إِنَّا
أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا
أَرَاكَ اللَّهُ
‘আমি তো তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল
করেছি, যাতে তুমি আল্লাহ তোমাকে যা জানিয়েছেন সেই অনুসারে মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা
কর...’ [সূরা আন-নিসাঃ ১০৫]
উপরোক্ত আয়াতগুলোসহ
আরো বহু আয়াতে মুসলিমদেরকে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা
সুস্পষ্ট আদেশ করেছেন যে, সমাজে মানুষের সমস্ত বিষয়াদি যেন তাঁর নাযিলকৃত বিধানমতো
পরিচালনা করা হয় এবং এটা করতে হলে নিশ্চিতভাবেই একজন শাসক বা খলীফা থাকতে হবে যিনি
এটার বাস্তব প্রয়োগ করবেন। ইসলামী শাসক তথা খলীফা ছাড়া ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়ন
সম্ভব নয়। যেহেতু আল্লাহর আদেশ অনুসারে সমাজে ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়ন একটি ফরয
বিষয়, অতএব খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং খলীফা থাকাও একটি ফরয বিষয়।
রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বলেছেনঃ
مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِىَ اللَّهَ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ حُجَّةَ لَهُ
وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ في عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً
‘যে ব্যক্তি
তার হাত (খলীফার) আনুগত্য হতে সরিয়ে নেবে, সে আল্লাহর সাথে কিয়ামতের দিন এমন
অবস্থায় দেখা করবে যে, তার কাছে কোনো প্রমাণ থাকবে না। আর
যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, তার কাঁধে (কোনো খলীফার) বা’ইআত
(আনুগত্যের শপথ) নেই, তবে তার মৃত্যু হচ্ছে জাহিলিয়্যাতের
(যুগের) মৃত্যু।’ [মুসলিম]
ইমাম
আহমদ (রহ.) বর্ণনা করেনঃ
مَنْ مَاتَ بِغَيْرِ
إمَام مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِية
‘রাসূল
(সাঃ) বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি কোনো ইমাম (খলীফা) ব্যতিত মারা গেল, সে জাহিলিয়্যাতের
মৃত্যুবরণ করলো।’
রাসূল
(সাঃ) বলেছেনঃ
‘যে রাষ্ট্রশক্তি
(সুলতান) হতে এক বিঘত দূরে গিয়ে মরবে, সে জাহিলিয়্যাতের মধ্যে মরলো।’ [বুখারী, মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বলেছেনঃ
كَانَتْ
بَنُوْ إسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُم الأنْبِياء كُلَّمَا هَلَكَ نَبِي خَلَفَهُ نَبِي
وَإنَّهُ لا نَبِي بَعْدِي وَسَتَكُوْن خُلَفَاء تَكْثُر قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ
فَالأَوَّلِ وَأَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ
‘বনী ইসরাইলকে
শাসন করতেন নবীগণ। যখনই এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তার স্থলে অন্য নবী আসতেন। কিন্তু আমার
পরে আর কোনো নবী নেই। শীঘ্রই খলীফারা আসবেন এবং তারা সংখ্যায় হবেন অনেক। তাদের বাই’আত
পরিপূর্ণ কর, (একের পর এক) প্রথম জন, অতঃপর পরের জন এবং তাদের হক পরিপূর্ণ
কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।’ [বুখারী,
মুসলিম]
প্রথম,
দ্বিতীয় ও তৃতীয় হাদীসে খলীফাবিহীন অবস্থায় মুত্যুকে জাহেলি যুগের মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ
করায় বোঝা যায় যে, খিলাফত একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় এবং ৪ নং হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পর কিয়ামত
পর্যন্ত আর কোনো নবী না আসায় কার তত্ত্বাবধানে মুসলিমদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত
হবে, সেটা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে এবং সেটা হচ্ছে খিলাফত ব্যবস্থা ও খলীফার তত্ত্বাবধান।
কাজেই একজন খলীফার উপস্থিতি ফরয।
ইজমা
আস-সাহাবাঃ
সাহাবীরা
(রাঃ) এই বিষয়টির গুরুত্ব সুস্পষ্টরূপে বুঝতেন। তাই তাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) এর ওফাতের পর তারা তাঁর (সাঃ) দাফনকাজকে বিলম্বিত করে আগে খলীফা নির্বাচন করে
নিয়েছিলেন। হযরত উমর (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর সময় পরবর্তী খলীফা নিযুক্ত করার জন্য ছয়জনের
প্যানেল গঠন করেছেন। এই ছয়জনের ভেতর উসমান (রাঃ), আলী বিন আবু তালিব (রাঃ) ও আবদুর
রহমান বিন আউফ (রাঃ) ছিলেন। এই ছয়জন সাধারণ ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন
রাসূল (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠ সাহাবীদের (রাঃ) ছয়জন - যাঁরা
পৃথিবীতে থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। উমর (রাঃ) তখন আদেশ জারি করেছিলেন যে,
তিনদিনের ভেতর খলীফা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যদি মতৈক্যে পৌঁছানো না যায়, তবে যে মতভেদ
করতে থাকবে তাকে হত্যা করতে হবে। যদিও যথাযথ কারণ ছাড়া যে কোনো হত্যাকান্ড
হারাম, তবু উমর (রাঃ) এর এই আদেশের
বিরোধিতা সাহাবীরা (রাঃ) কেউ করেননি। এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় সাহাবীরা (রাঃ) খলীফা
ও খিলাফত ব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যমান থাকাটা কতটা গুরুত্বের সাথে বুঝেছিলেন। খলীফা
নিয়োগের ব্যাপারে সাহাবীদের ঐকমত্য (ইজমা আস-সাহাবা) একটা সুস্পষ্ট ও দৃঢ় প্রমাণ যে,
খলীফা নিয়োগ করা ফরয।
ইমাম
আল হাইসামী (রহ.) বলেনঃ ‘নবুয়্যত যুগের সমাপ্তির পর খলীফা নির্বাচন
করা একটি বাধ্যবাধকতা - এ ব্যাপারে সাহাবীরা একমত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অন্য
দায়িত্বগুলোর চেয়ে এটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যখন তারা রাসূল (সাঃ) এর দাফন
নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।’ [সাওয়াইক আল হারাকাহ, পৃষ্ঠা ১৭]
ইমাম
তাফতাজানী (রহ.) বলেনঃ ‘এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে যে ইমাম নিয়োগ
দেয়া বাধ্যতামূলক। উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে এটা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুর
পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব - এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সাহাবীরা এটাকে
তাঁর দাফনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছিলেন।’ [শরহে
আল আকাইদ আল নাসাফিয়্যা, পৃষ্ঠা ১৪২-১৪৩]
সাহাবীদের
(রাঃ) এই ইজমা থেকে বোঝা যায়, খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজের প্রতি উদাসীনতা দেখানো
রাসুল (সাঃ)-এর দাফনকাজের প্রতি উদাসীনতা করার শামিল।
একইভাবে
বিভিন্ন যুগের ইসলামী বিশেষজ্ঞগণও বিভিন্নভাবে খিলাফতের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে
উল্লেখ করেছেন।
আবু
বকর (রাঃ) বলেনঃ ‘মুসলিদের জন্য দুইজন (একের অধিক) আমীর
গ্রহণ করা নিষিদ্ধ, কারণ এতে তাদের কার্যাবলী ও চিন্তাতে মতভিন্নতা দেখা দিবে, তাদের
ঐক্য বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়বে। তখন সুন্নত পরিত্যক্ত হবে,
বিদআত ছড়িয়ে পড়বে এবং ফিতনা বেড়ে চলবে...’ [সীরাতে ইবন ইসহাক]
হযরত
উমর (রাঃ) বলেনঃ
وَاللهِ مَا يزع الله بِسُلْطانٍ أعظم مِمَّا يزع
بِالْقُرْآن
“আল্লাহর শপথ! কুরআন দিয়ে আল্লাহ যতটুকু
রক্ষা ও প্রতিহত করেন, রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে আল্লাহ তার চেয়েও বেশি রক্ষা ও প্রতিহত
করেন।” [কানজুল উম্মাল,
হাদীস নং- ১৪২৮৪,
তারিখে ইমাম আল-খাত্তাবি]
হযরত
উসমান (রাঃ) বলেনঃ
إِنَّ الله لَيَزَعُ
بِالسُّلْطَانِ مَا لَا يَزَعُ بِالْقُرْآنِ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ শাসনক্ষমতা দিয়ে যা
করেন, কুরআন দিয়েও তা করেন না।” [মাজমু’ ফতওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৩]
হযরত
আলী (রাঃ) বলেনঃ
لا يُصْلِحُ
النَّاس إِلا أَمِيْر بر أَوْ فَاجِر
“একজন আমীর (খলীফা) ছাড়া জনগণ কখনোই
পরিশুদ্ধ হবে না - (সেই আমীর) ভালো বা মন্দ (যা-ই হোক
না কেন)।” [কানজুল
উম্মাল/১৪২৮৬, বায়হাকী/৭৫০৮]
ইমাম
কুরতুবী (রহ.) বলেনঃ
وَأَنَّهَا
رُكْنٌ مِنْ أَرْكَانِ الدِّيْنِ
“এবং এটা (খিলাফত) হচ্ছে দ্বীনের স্তম্ভসমূহের
মধ্যে একটি স্তম্ভ (যার উপর অন্য সব স্তম্ভ দাঁড়িয়ে থাকে)।” [তাফসীরে কুরতুবী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা
২৬৪]
ইমাম
ইবন হাযম (রহ.) বলেনঃ
اتفق
جَمِيع أَهْل السنة وجَمِيع
الْمُرْجِئة وجَمِيع الشيعة وجَمِيع الخَوارِج على وُجُوبِ الإمامَة
‘আহলুস
সুন্নাহর সবাই, মুরজিয়াদের সবাই, শিয়াদের সবাই, খারিজীদের সবাই ইমামতের বাধ্যবাধকতার
বিষয়ে একমত হয়েছেন।’ [আল ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়ায়ী
ওয়ান নাহল]
ইমাম
গাযালী (রহ.) খিলাফত হারানোর সম্ভাব্য পরিণতি সম্বন্ধে বলেছিলেনঃ
القضاة
معزولون والولايات باطِلَة... وجَمِيع تصرفات الولاة في أَقْطارِ العالَم غَير نافِذَة،
وإِنَّما الْخَلْق كُلُّهُمْ مقدمون على الْحَرام
“বিচারকরা বরখাস্ত হয়ে যাবে, প্রদেশগুলো
অবৈধ হয়ে যাবে, ... কর্তৃত্বশীলদের নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন হবে না এবং সমগ্র সৃষ্টি
হারামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।” [আল ইকতিসাদ ফিল ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ২৪০]
ইমাম
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেনঃ
أَن
ولاية أمر النَّاسِ مِنْ أَعْظَم وَاجِبَات الدِّيْن بَلْ لا قيام لِلدِّيْنِ وَلا
لِلدِّنْيَا إِلا بِهَا
“জনগণের শাসক (খলীফা) নিয়োগ দেয়া দ্বীনের
গুরুত্বপূর্ণ ফরযগুলোর অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে এটি ছাড়া দ্বীন ও দুনিয়া প্রতিষ্ঠিত থাকে
না।” [সিয়াসা শারী’আহ]
ইবনে
খালদুন (রহ.) বলেনঃ
الْخِلافَةُ
وَالْإِمَامَةُ لَمَّا كَانَتْ حَقِيْقَة الْمُلْك أَنَّهُ الْاِجْتِمَاع الضروري
لِلْبَشَر
“খিলাফত ও ইমামত হলো বাস্তব রাষ্ট্র
যা জনসাধারণের জন্য জরুরী।” [আল মুকাদ্দিমাহ]
ইমাম
আল মাওয়ার্দী (রহ.) বলেনঃ
وَعَقْدُهَا
لِمَنْ يَقُومُ بِهَا فِي الْأُمَّةِ وَاجِبٌ بِالْإِجْمَاعِ
“(ইমামতের নেতৃত্ব) এর সাথে
(আনুগত্যের) চুক্তি করা উম্মতের জন্য ইজমা দ্বারা ফরয।” [আল-আহকামুস সুলতানিয়া]
ইমাম
নববী (রহ.) বলেছেনঃ
وَأَجْمَعُوا
عَلَى أَنَّهُ يَجِب عَلَى الْمُسْلِمِينَ نَصْب خَلِيفَة
“(ইসলামী বিশেষজ্ঞদের) এ ব্যাপারে
ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, একজন খলীফা নির্বাচন করা মুসলিমদের উপর ফরয বিষয়।” [শরহে সহীহ মুসলিম]
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী
(রহ.) বলেনঃ “খিলাফতের শর্তাবলী বিদ্যমান এমন শাসক নিয়োগ করা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিমদের
ওপর ফরয-ই-কিফায়া।”
[ইযালাতুল খীফা আন খিলাফাতিল খুলাফা]
ভারতবর্ষের
জনপ্রিয় আলেম মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (রহ.) [যিনি ভারতবর্ষে খিলাফত আন্দোলনের অন্যতম
নেতা ছিলেন] খিলাফত ধ্বংসের প্রাক্কালে ১৯২০ সালে তাঁর লিখিত মাসালা-ই-খিলাফত গ্রন্থে
বলেনঃ “খিলাফত ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব অসম্ভব। তাই ভারতের মুসলিমদের তাদের সমস্ত
প্রচেষ্টা ও শক্তি নিয়ে এর জন্য কাজ করতে হবে।”
মুফতি
মুহাম্মদ শাফী (রহ.) এর মতেঃ “পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা
করাই মুখ্যত মুমিনদের যাবতীয় চেষ্টা-চরিত্রের লক্ষ্য।” [তাফসীরে মা'আরেফুল কোরআন, ইফাবা
সংস্করণ, ২০০৬, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৯]
সুতরাং
যদি মুসলিমরা তাদের ভেতর থেকে একজন খলীফা নির্বাচন থেকে বিরত থাকে, তবে সামগ্রিকভাবে
পুরো মুসলিম জাতি খুব বড় কবীরা গুনাহর কাজ করে। যদি তারা এই দায়িত্ব পালন না করার সিদ্ধান্ত
নেয়, তবে পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তের প্রতিটা মুসলমানের উপর এই দায়িত্ব পালন না করার
গুনাহ আরোপিত হবে। যদি মুসলিমদের কোনো দল এই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে এবং অন্যরা
তা থেকে বিরত থাকে, তবে যারা সচেষ্ট থাকে তারা ব্যতীত অন্যান্যদের উপর এই গুনাহ আরোপিত
হবে। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাদেরকে এমন একটা দায়িত্ব দিয়েছিলেন যা তারা পালন করেনি
কিংবা পালনের চেষ্টাও করেনি। এভাবে তারা এই পৃথিবীর জীবনে ও পরকালে কঠিন শাস্তি ও লজ্জার
ভাগী হবে।
No comments:
Post a Comment