দাওয়াহ করার প্রকৃত কারণ হলো ঈমান
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও রাসূল (সাঃ) এর প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্যই হলো যে, আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশ অনুযায়ী আমল করে যাওয়া। ঈমান ও আমল পরস্পর পরিপূরক। ঈমানের তাগিদেই বান্দা সৎকর্ম করে যাবে।
সাহাবীদের (রা.) ঈমান এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট উদাহরন। তাঁরা ঈমান আনা মাত্রই আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশের কাছে নিজেদেরকে সমর্পন করে দিয়েছেন। ঈমানের দাবি অনুযায়ী নেক আমল করার মধ্যেই তাঁরা ইসলামকে বুঝেছেন।
রাসূল (সাঃ) যখন থেকে ওহী পাওয়া শুরু করেন,
তখন থেকেই তিনি দাওয়াহ
করা শুরু করেন। ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবীগণও (রাঃ) একইভাবে দাওয়াহ
শুরু করেন। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর মহান সাহাবীগণ এভাবেই ঈমানকে বুঝেছিলেন। আমল ব্যতীত ঈমানের কোনো তাৎপর্য নেইঃ
وَالْعَصْرِ ﴿١﴾ إِنَّ الْإِنسَانَ
لَفِي خُسْرٍ ﴿٢﴾ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا
بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴿٣﴾
‘কসম যুগের। নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত - তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সত্যের ও সবরের।’ [সূরা আল-আসরঃ
১-৩]
এই সূরায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঈমানের সঙ্গে সৎকর্ম করা, সত্য ও সবরের উপদেশ প্রদান করাকে শর্তযুক্ত করেছেন। বস্তুতঃ
পবিত্র কুর’আনের বহু আয়াত থেকে একথা নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, ঈমানের তাড়নাতেই বান্দা সৎকর্ম তথা সত্যের উপদেশ প্রদান করতে বাধ্য। যেমনঃ
وَبَشِّرِ
ٱلَّذِين
آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ
جَنَّاتٍ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلأَنْهَارُ
‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ
২৫]
وَٱلَّذِينَ
آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ أُولَـٰئِكَ
أَصْحَابُ ٱلْجَنَّةِ
هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
‘পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাঁরা জান্নাতের অধিবাসী। তাঁরা সেখানেই চিরকাল থাকবে।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ৮২]
وَٱلَّذِينَ
آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ
جَنَّاتٍ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلأَنْهَارُ
‘আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, অবশ্যই আমি প্রবিষ্ট করাব তাদেরকে জান্নাতে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ।’ [সূরা আন-নিসাঃ
৫৭]
وَٱلَّذِينَ
آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ
جَنَّاتٍ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَآ
أَبَداً
‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, আমি তাদেরকে সত্বরই উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করাব, যেগুলোর তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা চিরকাল তথায় অবস্থান করবে।’ [সূরা আন-নিসাঃ ১২২]
وَأُدْخِلَ
ٱلَّذِينَ
آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِى
مِن تَحْتِهَا ٱلأَنْهَارُ
خَالِدِينَ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ
‘এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে এমন উদ্যানে প্রবেশ করানো হবে, যার পাদদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমুহ প্রবাহিত হবে। তারা তাতে পালনকর্তার নির্দেশে অনন্তকাল থাকবে।’ [সূরা ইবরাহীমঃ ২৩]
إِنَّ ٱلَّذِينَ
آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ
لَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে অগণিত প্রতিদান, যা কখনো রহিত হবার নয়।’ [সূরা হা-মীম-আস-সিজদাহঃ
৮]
ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ
سَافِلِينَ ﴿٥﴾ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ
أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ ﴿٦﴾
‘অতঃপর আমি তাকে ফিরিয়ে দিই হীন থেকে হীনতম অবস্থায়। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। তাদের জন্য রয়েছে অগণিত প্রতিদান, যা কখনো রহিত হবার নয়।’ [সূরা আত-ত্বীনঃ ৫-৬]
কুর’আনের আয়াতসমূহের এমন সুস্পষ্টতা সত্ত্বেও অনেকেই আজ ঈমানের প্রকৃত দাবি উপলব্ধি করতে পারছেন না। আমাদের পূর্ববর্তী যুগেও কারো কারো মধ্যে এরূপ বিভ্রান্তি ছিল।
মুহাম্মদ ইবন আবদুল মালিক আল মুসাইসি বলেনঃ
১৭০ হিজরিতে আমরা সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহর সাথে ছিলাম। এক ব্যক্তি তাকে ঈমান সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলো। তিনি জবাব দিলেনঃ
‘এটা হলো সত্যের স্বীকোরোক্তি ও আমল।’
লোকটি জিজ্ঞাসা করলোঃ
‘এটা কি বাড়ে-কমে?’
তিনি জবাব দিলেনঃ
‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে এটা বাড়ে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে এটা কমে; এমনভাবে কমে যে আর এতটুকুই বাকি থাকে [তিনি তার বাম হাত দিয়ে তা দেখান]।’
লোকটি প্রশ্ন করলোঃ
‘ঈমানকে যারা আমলহীন স্বীকরোক্তি বলে,
তাদেরকে
আমরা কিভাবে মোকাবেলা করবো?’
সুফিয়ান জবাব দিলেনঃ
ঈমানের বিধি-বিধান ও সীমাগুলো নির্ধারিত হওয়ার আগে তারা এই কথাটি বলতো। আসলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে মানবজাতির কাছে এই কথা বলার জন্য পাঠিয়েছেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারোই উপাসনা পাওয়ার অধিকার নেই এবং আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। মানুষ এটা বলার পর তাদের রক্ত ও সম্পদ (বৈধ কারণ ব্যতীত) নিরাপত্তা পেল এবং তাদের হিসাব হবে আল্লাহর সাথে। যখন আল্লাহ আল-হাইয়্যু আল-কাইয়্যুম,
এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন,
তখন তিনি রাসূল (সাঃ) কে বললেন তাদেরকে নামাযের নির্দেশ দিতে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে নামাযের নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলেন। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো,
তাহলে তাদের প্রথম কাজটা কোনোই উপকারে আসতো না।
যখন আল্লাহ আল-হাইয়্যু আল-কাইয়্যুম এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন,
তখন তিনি রাসূল (সাঃ) কে বললেন তাদেরকে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দিতে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলো। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো,
তাহলে তাদের প্রথম কাজ কিংবা নামায কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।
যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন,
তখন তিনি রাসূল (সাঃ)-কে বললেন তাদেরকে মক্কায় ফেরার নির্দেশ দিতে,
যেন তারা তাদের (কাফের) পিতা ও সন্তানদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করে,
যতক্ষণ না তারা (কাফেররা) সেই কালিমাটি বলে যেটি তারা নিজেরা
বলেছে, তাদের সাথে নামায পড়ে ও তাদের হিজরতের সাথে যুক্ত হয়। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলো। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো,
তাহলে প্রথম কাজ, নামায কিংবা হিজরত কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।
যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন,
তখন তিনি রাসূল (সাঃ) কে বললেন তাদেরকে নির্দেশ দিতে তারা যেন হিজরত করে এসে আল্লাহকে উপাসনার জন্য কাবা তাওয়াফ করে ও দীন-হীনভাবে মাথার চুল ছেটে ফেলে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলো। আল্লাহর শপথ, যদি তারা এটা না করত,
তাহলে তাদের প্রথম কাজ, তাদের নামায, তাদের হিজরত কিংবা পিতার সাথে যুদ্ধ করা কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।
যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন,
তখন তিনি রাসূল (সাঃ) কে বললেন তাদেরকে নির্দেশ দিতে তারা যেন হিজরত করে গিয়ে নিজেদের সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করে, যাতে সেই সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিল এবং তারা তা পালন করলো ... ...। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো,
তাহলে তাদের প্রথম কাজ, তাদের নামায, তাদের হিজরত, তাদের পিতাদের সাথে যুদ্ধ কিংবা তাদের তাওয়াফ কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।
যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন, যেটা ঈমানের বিধিবিধান ও সীমাগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলো, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বললেনঃ
ٱلْيَوْمَ
أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلأِسْلاَمَ
دِيناً
‘আজ হতে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, আমরা নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম তোমাদের প্রতি এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ [সূরা আল-মায়িদাহঃ
৩]
সুফিয়ান এরপর বললেনঃ
‘তাই কেউ যদি ঈমানের কোনো একটি অংশ বাদ দেয়, তাহলে আমাদের দৃষ্টিতে সে ঈমানহীন (কাফের)। অবশ্য যদি সে আলস্য বা অবহেলার কারণে তা ত্যাগ করে থাকে, তাহলে আমরা তাকে শুধরাবো এবং আমাদের দৃষ্টিতে সে দুর্বল/অপূর্ণ ঈমানের অধিকারী। এটাই সুন্নাহ। কেউ এ বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে এই কথাগুলো আমার বরাত দিয়ে বলবে।’
সুতরাং ঈমানকে আমাদের সেভাবেই বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবীগণ (রাঃ) বুঝেছিলেন। আর সেই ঈমানের তাগিদেই আমাদেরকে সাহাবীদের মতো দাওয়াহ-র মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সেই রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসলামকে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে।
No comments:
Post a Comment