৬.১১ অন্তরের ঘৃণাই যথেষ্ট
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا
فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ
فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ
‘তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তার হাত দ্বারা তা পরিবর্তন করে। তার এই সামর্থ্য না থাকলে সে যেন তার মুখ দ্বারা তা করে। তার এই সামর্থ্যও না থাকলে সে যেন তার অন্তর দ্বারা তা করে (ঘৃণার মাধ্যমে), আর এটা হলো দুর্বলতম ঈমান।’ [মুসলিম, তিরমিযী]
এই হাদীসের ভিত্তিতে কোনো কোনো দল দাবি করে, বর্তমান যুগে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার প্রয়োজন নেই, কেবল অন্যায়ের প্রতি অন্তরের ঘৃণাই যথেষ্ট। কিন্তু এই হাদীসে অন্তরের ঘৃণাকে ঈমানের দুর্বলতম অবস্থা বলা হয়েছে। তাই এই অবস্থান কোনো মু’মিনের কাম্য হতে পারে না।
তাছাড়া এই হাদীসটি ব্যক্তির ব্যাপারে হুকুম বর্ণনা করছে, দলের কথা বলছে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি নিতান্ত অপারগ অবস্থায় মুনকারকে কেবল অন্তর থেকে ঘৃণা করলেও দুর্বলতম মু’মিন বলে গণ্য হবে। কিন্তু দলের ক্ষেত্রে এই হাদীসের কথা তোলা অপ্রাসঙ্গিক। দলকে সবসময়ই সূরা আল-ইমরানের ১০৪ নং আয়াতের হুকুম মোতাবেক সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে হবে এবং সেটা মনে মনে করার মতো কোনো কাজ নয়।
৬.১২ হিকমত
কেউ কেউ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে জায়েজ করার জন্য হিকমতের কথা বলেন।
‘হিকমত’ শব্দটি আরবি ‘হাকামা’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো শাসন করা বা রায় দেয়া। এই শব্দটি কুর’আনে বিশবার ব্যবহার হয়েছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ
নবুওয়্যত, কুর’আন, সুন্নাহ, বাস্তবজ্ঞান এবং বাস্তবজ্ঞানের আলোকে কাজ করা।
বিভিন্ন আয়াতে ‘হিকমত’ শব্দের কিছু প্রয়োগ নিম্নরূপঃ
رَبَّنَا
وَٱبْعَثْ
فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ
وَٱلْحِكْمَةَ
وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنتَ ٱلعَزِيزُ ٱلحَكِيمُ
‘হে রব, তাদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ১২৯]
এই আয়াতে ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ হলো ওহীর তিলাওয়াত ও সুন্নাহ দ্বারা রাসূল (সাঃ) কর্তৃক প্রদত্ত ওহীর ব্যাখ্যা।
يُؤّتِى
الْحِكْمَةَ مَن يَشَآءُ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِىَ خَيْراً
كَثِيراً وَمَا يَذَّكَّرُ إِلاَّ أُوْلُواْ ٱلأَلْبَابِ
‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয়, সে প্রভূত কল্যাণকর বস্তু প্রাপ্ত হয়। কিন্তু উপদেশ শুধু তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানবান।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৬৯]
এই আয়াতে ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ হলো কুর’আন-সুন্নাহর জ্ঞান ও বোধগম্যতা এবং বিশুদ্ধ ও সঠিক পদ্ধতিতে কথা ও কাজ করার সক্ষমতা। ইবনে আব্বাসের মতে, ‘এই আয়াতে হিকমত শব্দের অর্থ কুর’আনের জ্ঞান।’ [তাফসীরে ইবনে কাসীর]
لَقَدْ
مَنَّ ٱللَّهُ
عَلَى ٱلْمُؤمِنِينَ
إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ
وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ
وَإِن كَانُواْ مِنْ قَبْلُ لَفِى ضَلالٍ
مُّبِينٍ
‘আল্লাহ ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের জন্য তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ [কুর’আন] পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। বস্তুত তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।’ [সূরা আল-ইমরানঃ ১৬৪]
এই আয়াতে ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ হলো সুন্নাহ।
রাজনীতি বা দাওয়ার ক্ষেত্রে ‘হিকমত’ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে যে আয়াতে সেখানে নির্দেশ হলোঃ
ٱدْعُ
إِلِىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلْحِكْمَةِ وَٱلْمَوْعِظَةِ
ٱلْحَسَنَةِ
وَجَادِلْهُم بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ
‘আপনার পালনকর্তার পথের দিকে আহবান করুন হিকমত সহকারে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়।’ [সূরা আন-নাহলঃ
১২৫]
এই আয়াতে হিকমতের অর্থ কোনো কোনো তাফসিরবিদ কুর’আন, কেউ কেউ কুর’আন-সুন্নাহ এবং কেউ কেউ অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ স্থির করেছেন। [তাফসীরে মাআরেফুল কুর’আন, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১২]
রুহুল মা’আনিতে আল্লামা আলুসী (রহ.) আল-বাহরুল মুহীতের সূত্রে বলেছেনঃ
أَنَهَا
الْكَلام الصواب الواقع مِن النفس أجمع موقع
‘এমন বিশুদ্ধ বাক্যকে হিকমত বলা হয় যা মানুষের মনে আসন করে নেয়।’
সুতরাং দেখা যায়, পবিত্র কুর’আনে
‘হিকমত’ শব্দটি বহুবিধ অর্থে ব্যবহৃত হলেও প্রতিটি অর্থই কুর’আন ও সুন্নাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংশ্লিষ্ট। উপরিউক্ত কোনো একটি আয়াতেও ‘হিকমত’ শব্দটি কুর’আন-সুন্নাহর বিপরীত কাজের লাইসেন্স অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং যেসব কাজের পক্ষে কুর’আন-সুন্নাহতে অকাট্য প্রমাণ আছে, সেসব কাজ করার মধ্যেই হিকমত নিহিত। আর যেসব কাজ হারাম হওয়ার পক্ষে কুর’আন-সুন্নাহতে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, সেসব কাজ বর্জন করার মধ্যে হিকমত নিহিত। তাই কুর’আন-সুন্নাহতে অকাট্যভাবে হারাম প্রমাণিত কোনো কাজ বা মতবাদ গ্রহণ করার মধ্যে হিকমত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। যারা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র বা জাতীয়তাবাদের মতো কুর’আন-সুন্নাহ দ্বারা অকাট্যভাবে হারাম প্রমাণিত মতবাদের মধ্যে হিকমত খোঁজেন কিংবা যারা ধর্মনিরপেক্ষ বা জাতীয়তাবাদী শক্তি বা নারী নেতৃত্বের সাথে জোট করার জন্য হিকমতের দোহাই দেন, তারা সুসস্পষ্টভাবে ভুল পথে আছেন।
৬.১৩ তিহাত্তর ফিরকা
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
‘বনী ইসরাঈল (আহলে কিতাবীরা/ইহুদী-খ্রীষ্টানরা) বাহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আমার উম্মত তিহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে এই
জামা’আত ছাড়া বাকি সবাই জাহান্নামে যাবে।’ [আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, হাকিম]
তিরমিযীর অপর বর্ণনা হতে জানা যায়, ‘এই জামা’আত হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণের পদ্ধতির উপর যারা রয়েছেন তারা।’
এই সম্মানিত হাদীসে বর্ণিত ‘ফিরকা’ শব্দটি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে
আছেন।
‘ফিরকা’-কে এরা মাযহাব, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি নানা অর্থে বুঝে থাকেন। তাই ‘ফিরকা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ বোঝা খুবই প্রয়োজন।
আরবি ভাষায় ‘ফিরকা’ শব্দটি ‘লাফজ
মুশতারাক’ অর্থাৎ বহু ধরনের অর্থ প্রকাশকারী শব্দ। আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে
‘ফিরকা’ শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছেন। যেমনঃ
وَمَا
كَانَ ٱلْمُؤْمِنُونَ
لِيَنفِرُواْ كَآفَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ
لِّيَتَفَقَّهُواْ فِى ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ
قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوۤاْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ
يَحْذَرُونَ
‘আর সমস্ত মু’মিনের একত্রে অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ (ফিরকা) কেন বের হলো না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে?’ [সূরা আত-তাওবাহঃ ১২২]
এই আয়াতে ‘ফিরকা’ অর্থ দলের অংশবিশেষ।
وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقاً يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُمْ
بِٱلْكِتَابِ
لِتَحْسَبُوهُ مِنَ ٱلْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِنْدِ
اللًّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِندِ ٱللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
‘নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে এক দল (ফিরকা) রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তারা কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তা আদৌ কিতাব হতে নয় এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যা আরোপ করে।’ [সূরা আল-ইমরানঃ
৭৮]
এই আয়াতে ‘ফিরকা’ নিন্দাসূচক অর্থে দলকে বুঝিয়েছে, কেননা ওই দলটি ওহীকে বিকৃত করতো।
সুতরাং ‘ফিরকা’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ বোঝার জন্য শব্দটি কোন প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটির দিকে লক্ষ রাখা জরুরী। উপরে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সাঃ) ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইহুদীরা একাত্তরটি ও খ্রীষ্টানরা বাহাত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর তিনি জানান, এই উম্মতও তিয়াত্তরটি ফিরকায় বিভক্ত হবে। রাসূল (সাঃ) ও তার সাহাবাদের অনুসারী দলটি ছাড়া বাকি সবাই জাহান্নামে যাবে। এভাবে এই হাদীসে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের মতো করে মুসলিমদের বিভক্ত হওয়াকে নিন্দা করা হয়েছে। পবিত্র কুর’আনে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের এই ধরনের ফিরকার অনুসরণ করতে মুসলিমদেরকে নিষেধ করা হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ
آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ
إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আহলে কিতাবদের কোনো ফিরকাকে অনুসরণ কর, তাহলে ঈমান আনার পর তারা তোমাদেরকে কাফিরে পরিণত করে দেবে।’ [সূরা আল-ইমরানঃ
১০০]
তাই হাদীসে বর্ণিত ‘ফিরকা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝতে হলে ইহুদী-খ্রীষ্টানরা কোন ধরনের ইস্যুতে মতভেদ করে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে।
পবিত্র কুর’আন বারবার আমাদেরকে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের মতো মতভেদ করেতে নিষেধ করেছে। কুর’আনের বর্ণনা অনুযায়ী, যেসব ইস্যুতে তারা বিভক্ত হয়েছিল, সেগুলো হলোঃ
১. তারা নবী-রাসূলদের ব্যাপারে মতভেদ করেছিল। আল্লাহ বলেনঃ
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ
وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ
أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا
كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ
‘আমি মুসাকে কিতাব প্রদান করলাম, তারপর পর্যায়ক্রমে অনেক রাসূল পাঠালাম। আর মরিয়মের পুত্র ঈসাকে প্রকাশ্য প্রমাণাদি দিলাম এবং ‘রুহুল কুদুস’ (জিবারইল) দিয়ে তাঁকে সাহায্য করলাম, তবে কি যখনই কোনো রাসূল তোমাদের মনঃপুত নয় এমন বিধান নিয়ে আগমন করেছেন তখন তোমরা অহংকার করেছ, কতককে মিথ্যাবাদী বলেছ, আর কতককে হত্যা করেছ।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ৮৭]
وَآتَيْنَا
عِيسَى ٱبْنَ
مَرْيَمَ ٱلْبَيِّنَاتِ
... وَلَـٰكِنِ ٱخْتَلَفُواْ فَمِنْهُمْ مَّنْ آمَنَ
وَمِنْهُمْ مَّن كَفَرَ ..
‘আর মরিয়মের পুত্র ঈসাকে প্রকাশ্য প্রমাণ দান করেছি...
... ...কিন্তু তারা মতভেদ করলো, ফলে কেউ ঈমান আনলো, কেউ কুফরী করলো...’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৫৩]
২. তারা আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করেছেঃ
وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ
الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ
الْحِسَابِ
‘...এবং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও তারা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশত। কেউ আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণে তৎপর।’ [সূরা আল-ইমরানঃ
১৯]
৩. তারা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে ‘কাফির’ ডাকতোঃ
وَقَالَتِ
ٱلْيَهُودُ
لَيْسَتِ ٱلنَّصَارَىٰ
عَلَىٰ شَيْءٍ وَقَالَتِ ٱلنَّصَارَىٰ لَيْسَتِ ٱلْيَهُودُ
عَلَىٰ شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ ٱلْكِتَابَ كَذٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ
لاَ يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَٱللَّهُ يَحْكُمُ
بَيْنَهُمْ يَوْمَ ٱلْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُواْ فِيهِ
يَخْتَلِفُونَ
‘ইহুদীরা বলে, খ্রীষ্টানরা কোনো ভিত্তির উপরেই নয় এবং খ্রীষ্টানরা বলে, ইহুদীরা কোনো ভিত্তির নয়। অথচ ওরা সবাই কিতাব পাঠ করে। এমনিভাবে যারা মূর্খ, তারাও ওদের মতো উক্তি করে। অতএব, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে ফায়সালা দেবেন, যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছিল।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ১১৩]
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইহুদী-খ্রীষ্টানরা দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয়গুলো নিয়ে মতভেদ করেছিল। নবী-রাসূল, কিয়ামত দিবস, আল্লাহর একত্ব, পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নামের মতো ঈমানের ভিত্তিসমূহ নিয়ে তারা মতভেদে জড়িয়ে পড়েছিল। রাসূল (সাঃ) আলোচ্য ‘ফিরকা’ বিষয়ক হাদীসে আমাদেরকে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের মতো মতভেদ করতে নিষেধ করেছেন। এর মানে হলো, দ্বীনের ভিত্তিসমূহ নিয়ে মতভেদ করা এই হাদীস মোতাবেক নিষিদ্ধ। যেমন, পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছেঃ
وَٱعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعاً وَلاَ تَفَرَّقُواْ
‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ [সূরা আল-ইমরানঃ
১০৩]
এই আয়াতের প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেনঃ
‘ইহুদী-খ্রীষ্টানদের মতো দ্বীনের ব্যাপারে বিভক্ত হয়ো না ... ... ... এবং এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, নিজের বাসনা ও স্বার্থের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ো না।’ [তাফসীরে কুরতুবী]
অতএব, দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে যারা মতভেদ করবে, তারাই ‘ফিরকা’। এধরনের বিষয় নিয়ে মতভেদ ইসলামে বৈধ নয়। কিন্তু দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের বাইরের শাখা-প্রশাখায় মতভেদ করলে সেটা জাহান্নামী ফিরকা বলে গণ্য হবে না, কেননা দ্বীনের শাখা-প্রশাখামূলক বিষয়গুলোতে মতভেদ বৈধ।
ইমাম শাফে’ঈ (রহ.) বলেনঃ ‘মতভেদ দুই ধরনেরঃ এক ধরনের মতভেদ হারাম এবং অন্যটি হারাম নয়। যেসব বিষয়ে আল্লাহ তাঁর কিতাবে নিশ্চিত প্রমাণ (হুজ্জত) দিয়েছেন বা যেসব বিষয়ে রাসূল (সাঃ) সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন, সেসব বিষয়ে জেনেশুনে মতভেদ করা হারাম। ওইসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের বাইরের বিষয়গুলোতে যেখানে ভিন্নার্থ প্রকাশ হয় বা কিয়াস করা যায়, সেক্ষেত্রে মতভেদের সুযোগ আছে।’ [আর রিসালাহ]
শায়খ তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানী (রহ.) বলেনঃ
“[আইনপ্রণেতার] বক্তব্যটি হতে পারে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত (ক্বাতঈ উসুবুত) অর্থাৎ কোনো মতভেদের অবকাশ নেই, যথা কুর’আন ও মুতাওয়াতির হাদীস অথবা বক্তব্যটি হতে পারে অমীমাংসিতভাবে প্রমাণিত (জন্নিঈ উসুবুত) অর্থাৎ মতভেদের অবকাশ রয়েছে, যথা অ-মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ। যদি বক্তব্যটি ক্বাতঈ উসুবুত হয় তবে এর অর্থ নির্দিষ্ট (ক্বাতঈ উদালালাহ) ও হুকুমটি চূড়ান্ত অর্থাৎ এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। এরূপ উদাহরণ হচ্ছে, ফরয সালাতের রাকাতের সংখ্যা - কারণ তা মুতাওয়াতির হাদীসে উল্লেখ রয়েছে... ...।
যদি আইনপ্রণেতার বক্তব্য ক্বাতঈ উসুবুত অথচ একটিমাত্র নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশক না হয় (জন্নিই উদালালাহ), তবে হুকুমটি অমীমাংসীত (অর্থাৎ এ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে)। উদাহরণস্বরূপ, কুরআনে উল্লেখিত জিযিয়াসংক্রান্ত আয়াতটি উল্লেখ্য। আয়াতটি ক্বাতঈ উসুবুত কিন্তু তার অর্থ নির্দিষ্ট নয়। হানাফী মাযহাবের শর্তানুসারে, একে জিযিয়া বলা বাধ্যতামূলক... ...। শাফে’ঈ মাযহাবের শর্তানুযায়ী এটিকে জিযিয়া বলা বাধ্যতামূলক নয় এবং একে দ্বৈত যাকাত বলা যায়... ...।
যদি আইনপ্রণেতার বক্তব্য জন্নিই উসুবুত হয়, যেমন অ-মুতাওয়াতির হাদীস, তখন অর্থ ক্বাতঈ উদালালাহ হোক বা না হোক, এ-সংক্রান্ত হুকুম চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হবে না, অর্থাৎ এ বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা কিংবা কৃষিভূমি ইজারা (লীজ) দেয়ার নিষিদ্ধতার বিষয়টি।” [নিযামুল ইসলাম]
সুতরাং হানাফী, মালিকী, শাফে’ঈ, হাম্বলী ইত্যাদি মাযহাবগুলোকে ‘ফিরকা’ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। মাযহাবগুলোর মতভেদ কেবল শাখা-প্রশাখায়। একইভাবে রাসূল (সাঃ) ও সাহাবাগণের পথ অনুসরণকারী কোনো রাজনৈতিক দলকেও ‘ফিরকা’ ভাবার ন্যূনতম কোনো কারণ নেই।
তবে যারা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে শেষ নবী হিসেবে অস্বীকার করেছে [কাদিয়ানী], যারা হযরত আলী (রাঃ)-কে আল্লাহর অংশ মনে করে [আলাওয়ি শিয়া], যারা আখিরাতের শাস্তিকে অস্বীকার করে, তারা অবশ্যই জাহান্নামী ‘ফিরকা’। কেননা তারা দ্বীনের সুনিশ্চিত (ক্বাতঈ) বিষয়ে মতভেদ করেছে। কোনো দল যদি কুর’আনের যে কোনো আয়াতের সুনিশ্চিত অর্থকে অস্বীকার করে, তবে তারা জাহান্নামী ফিরকায় পরিণত হবে। একইভাবে কোনো দল যদি কোনো সুস্পষ্ট হারামকে হালাল মনে করে তারা অবশ্যই জাহান্নামী ফিরকা -
তাদের আকৃতি যত বড়ই হোক না কেন। কেননা রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
سَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى بِضْعٍ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً
أَعْظَمُهَا فِرْقَة قَوْمٌ يَقِيْسُوْنَ الأُمُوْرَ بِرَأْيِهِمْ فَيُحَرِّمُوْنَ
الْحَلالَ وَيحللون الْحَرَامَ
‘সত্ত্বরই আমার উম্মত ৭০-এরও কিছু বেশি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফিরকা হবে একদল যারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত দেবে এবং তারা হালালকে হারাম করবে ও হারামকে হালাল করবে।’ [হাকিম]
No comments:
Post a Comment