উপরে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এর অনুসৃত পদ্ধতি ছাড়া অপর সব পদ্ধতিই বাতিল, প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
مَنْ
عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ اَمْرُنا فَهُوَ رَدٌّ
‘যদি কেউ এমন কোনো কাজ করে যে ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশ নেই, তাহলে সেই কাজ প্রত্যাখ্যাত।’ [বুখারী, মুসলিম]
৬.১ রাজনীতি
বিবর্জিত
দাওয়াহঃ
রাসূল (সাঃ) মাক্কী জীবনে গোত্রীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নন, সকল নবী-রাসুলই তাদের স্ব-স্ব যুগের জালিম শাসক ফেরাউন-নমরুদ-জালুতদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। তাই রাজনীতি
বিবর্জিত
দাওয়াহ ইসলাম সম্মত হতে পারে না।
রাসূল (সাঃ) এর অনুসৃত পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক হওয়া সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তি
অরাজনৈতিক
ইসলামের
দিকে মানুষকে দাওয়াত দিয়ে থাকে। এরা রাজনৈতিক সংগ্রামের গুরুত্বকে অস্বীকার করে এবং তথাকথিত ‘ঈমানের দাওয়াত’ দিয়ে থাকে। এই বইয়ের পরিশিষ্টে
‘ঈমানের দাওয়াতের প্রকৃতস্বরূপ’
ও ২ নং অধ্যায়ে ‘রাজনীতির গুরুত্ব’ আলোচিত হয়েছে। তাই ‘ঈমানের দাওয়াত’ এর নামে মুসলিম উম্মাহকে রাজনৈতিক আন্দোলন বিমুখ করাটা সুস্পষ্টভাবে রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহর পরিপন্থী, একথা একান্ত নিশ্চিতভাবেই বলা চলে।
সীরাতে প্রমান রয়েছে যে, রাসূল (সাঃ) এর দাওয়াহ
ছিল শুরু থেকেই রাজনৈতিক এবং তিনি (সাঃ) শুরু থেকেই তাঁর অনুসারীদের বিশ্বজয়ের প্রেরনা দিতেন। ইদ্রিস কান্দলভী রচিত ‘সীরাতে মোস্তফা (সাঃ)’ গ্রন্থে সহীহ
সনদে বর্ণিত আছে, আব্বাস (রা.) বলেছেনঃ
‘যখন রাসূল (সাঃ) এর মাত্র দু’জন অনুসারী ছিল তখনো তিনি (সাঃ) বলতেন, তাঁর অনুসারীরা শীঘ্রই কায়সার ও কিসরার সস্পদের মালিক হবে।’
ইমাম গাযযালী (রহ.) রচিত ‘ফিকহুস সীরাত’ গ্রন্থে বর্ণিত আছেঃ
‘মক্কার মুশরিক আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব ও তার বন্ধুরা সাহাবায়ে কিরামকে দেখলেই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতো, তোমাদের কাছে সারা দুনিয়ার বাদশাহ এসে পড়েছে। ওরা খুব শীঘ্রই কিসরা-কায়সারকে পরাজিত করবে। এসব বলে তারা শিশ মারতো এবং হাততালি দিতো।’ [রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠাঃ
১৪২]
সীরাতে ইবনে হিশামে
বর্ণিত আছেঃ
‘মক্কার মুশরিকদের পক্ষ থেকে উতবা ইবনে রাবিয়া এসে রাসূল (সাঃ) কে মক্কার শাসক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত শাসন ইসলামের ভিত্তিতে হবে না বলে রাসূল (সাঃ) সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।’
ইতিপূর্বে ৪ নং অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে,
রাসূল (সাঃ) মক্কার মুশরিক নেতাদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আরব ও অনারবদের শাসক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর ঈমানের দাওয়াতের মধ্যেই রাজনীতি রয়েছে এবং রাজনৈতিক সংগ্রামকে এই দাওয়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোন সুযোগ নেই।
মদীনায় হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেনঃ
رَّبِّ
أَدْخِلْنِى مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِى مُخْرَجَ صِدْقٍ وَٱجْعَل
لِّى مِن لَّدُنْكَ سُلْطَاناً نَّصِيراً
‘...হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দাখিল করুন সত্যসহকারে এবং আমাকে বের করে নিয়ে যান সত্যসহকারে এবং দান করুন আমাকে আপনার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় শক্তি।’ [সূরা বনী ইসরাঈলঃ
৮০]
অর্থাৎ আমাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান কর, অন্যথায় কোনো রাষ্ট্রকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাহায্যে বিশ্বের মহাবিপর্যয়কে প্রতিরোধ ও সংশোধন করতে পারি, যেন অশ্লীলতা ও পাপের এই প্লাবনের মোকাবিলা করতে পারি, যেন সুবিচারপূর্ণ আইনকে কার্যকর করতে পারি। [হাসান বসরী, কাতাদাহ, ইবনে কাসীর ও ইবনে জারীর -
সবাই আয়াতের এই তাফসীর করেছেন]
ইবন আব্বাসের এক বর্ণনায় এসেছে,
الإِسْلامُ
والسُّلْطَانُ أخوان تَوأمان لا يُصْلِحُ وَاحِدٌ مِنْهُمَا إلَّا بِصَاحِبِهِ فَالْاِسْلامُ
أُسٌّ وَالسُّلْطَانُ حَارِثٌ، وَمَا لا أُسٌ لَهُ يهدم وَمَا لا حَارِثٌ لَهُ ضَائِع
‘ইসলাম ও রাষ্ট্রীয় শক্তি হচ্ছে যমজ ভাই - একে অন্যকে সুদৃঢ় করে। ইসলাম হচ্ছে ভিত্তি আর রাষ্ট্রীয় শক্তি হচ্ছে নিরাপত্তারক্ষী। যার ভিত্তি নেই সে ধ্বংস হয়ে যায়। আর যার নিরাপত্তারক্ষী নেই, তা বিলীন হয়ে যায়।’ [কানজুল উম্মাল]
রাষ্ট্র থেকে কুর’আনের আইন উঠে গেলে কী করতে হবে, সে প্রসঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশ হলোঃ
...أَلا إِنَّ رَحَى الإِسْلامِ دَائِرَةٌ، فَدُورُوا
مَعَ الْكِتَابِ حَيْثُ دَارَ، أَلا إِنَّ الْكِتَابَ وَالسُّلْطَانَ سَيَفْتَرِقَانِ،
فَلا تُفَارِقُوا الْكِتَابَ، أَلا إِنَّهُ سَيَكُونُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ يَقْضُونَ
لأَنْفُسِهِمْ مَا لا يَقْضُونَ لَكُمْ، إِنْ عَصَيْتُمُوهُمْ قَتَلُوكُمْ، وَإِنْ
أَطَعْتُمُوهُمْ أَضَلُّوكُمْ"، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَيْفَ نَصْنَعُ؟ قَالَ: كَمَا صَنَعَ أَصْحَابُ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ، نُشِرُوا بِالْمَنَاشِيرَ،
وَحُمِلُوا عَلَى الْخَشَبِ، مَوْتٌ فِي طَاعَةِ اللَّهِ خَيْرٌ مِنْ حَيَاةٍ فِي مَعْصِيَةِ
اللَّهِ
“....জেনে রাখো, নিশ্চয়ই ইসলামের চাকা প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান আছে। অতএব, তোমরা কিতাবের (কুর’আনের) সঙ্গে ঘূর্ণায়মান হও যেদিকে তা ঘুরে। মনে রাখবে, কিতাব (কুর’আন) ও শাসনক্ষমতা অচিরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তবে সাবধান, তোমরা কিতাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। মনে রাখো, ভবিষ্যতে এমন কিছু শাসক আসবে যারা নিজেদের জন্য যে ফয়সালা করবে তোমাদের বিষয়ে সে ফয়সালা করবে না। যদি তোমরা তাদেরকে অমান্য কর তাহলে তারা তোমাদেরকে হত্যা করবে। আর যদি তোমরা তাদেরকে মেনে চলো, তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে। জিজ্ঞাসা করা হলোঃ ‘হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ), তখন আমরা কী করবো?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ ‘তোমরা তখন তাই করবে যা ঈসা (আ)-এর সঙ্গীরা করেছিলেন, তাদেরকে করাত দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছে, ফাঁসি দেয়া হয়েছে, (কেননা) আল্লাহর অবাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে মৃত্যুবরণ করা অনেক উত্তম।’” [মু’জাম আল কাবীর -
তাবারানী, আল জামে’ আস-সগীর]
এই হাদীসটি সুস্পষ্টভাবেই কুর’আনবিহীন শাসনের যুগে রাজনৈতিক সংগ্রামের নির্দেশ দেয় - যেমনভাবে সংগ্রাম করেছিলেন বনী ইসরাইলের সৎপথপ্রাপ্তগন।
তাফসীরে ইবনে কাসীরে উদ্বৃত ইবনে আবু হাতিম সূত্রে বর্নিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “বনী ইসরাঈলগন বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল। তার মধ্যে মাত্র তিনটি দল মুক্তি লাভ করবে। প্রথম দলঃ যারা ঈসার (আ.) পর বনী ইসরাঈলের অধঃপতন ও খোদাদ্রোহীতা দেখে লোকজনকে আল্লাহর দ্বীন ও ঈসা (আ.) এর আদর্শের পথে দাওয়াত প্রচারের কাজ শুরু করে। কিন্ত স্বৈরাচারী শাসকশ্রেনী তাদের নিমৃমভাবে হত্যা করে। এরা আল্লাহর দরবারে মুক্তি লাভ করবে। অতঃপর আরেকটি দলঃ যাদের কোন রণশক্তি ছিল না।
তারা শাসকদেরকে আল্লাহর দ্বীনের পথে দাওয়াত দেন। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকশ্রেনী এদেরকেও করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরা মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিতীয় দল। সবশেষে একদল লোক যাদের রনশক্তি তো দূরের কথা, বাতিলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলার শক্তি পর্যন্ত ছিল না। এরা লোকালয় ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন হয়।”
এক্ষেএে প্রাসঙ্গিকভাবে মনে রাখতে হবে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
‘সব নবীর আমলেই সন্ন্যাসবাদ ছিল, আর আমরা উম্মতের সন্ন্যাসবাদ হলো আল্লাহর পথে জিহাদ।’
[মুসনাদে আহমদ।]
সুতরাং, এটা সুস্পষ্ট যে, কুর’আনবিহীন শাসনের বর্তমান যুগে জালিম শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ
অনুসারে
প্রবল রাজনৈতিক সংগ্রামই ঈমানের দাবী। যারা এই সত্যকে অস্বীকার করে রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাহকে কেবল মানুষের
ব্যক্তিগত
কিছু কাজের
মধ্যে সীমাবদ্ধ
করতে চান, তারা ইসলামকে খন্ডিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। আর মহান আল্লাহর (সুব.) হুঁশিয়ারিঃ
أَفَتُؤْمِنُونَ
بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا
جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ
أَشَدِّ الْعَذَابِ ۗ وَمَا
اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরকম করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে অপমান এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে।’ [সূরা আল-বাক্বারাহঃ
৮৫]
এছাড়া, রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ
أَفْضَلُ
الْجِهَادِ كَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ
‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’ [শু’আবুল ঈমান - বায়হাকী]
سَيِّدُ
الشُّهَدَاءِ حَمْزَةُ بن عَبْدِ الْمُطَّلِبِ
وَرَجُلٌ قَامَ إِلَى إِمَامٍ جَائِرٍ فَأَمَرَهُ وَنَهَاهُ فَقَتَلَهُ
‘শহীদদের সর্দার হামযা বিন আবদুল মুত্তালিব এবং ওই ব্যক্তিও, যে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে (সৎকাজে) আদেশ ও (অসৎকাজে) নিষেধ করার পর (ওই শাসক) তাকে হত্যা করে ফেলে।’ [কানজুল উম্মাল]
এসব হাদীসে রাসূল (সাঃ) পরিষ্কারভাবেই কুর’আনবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের নির্দেশ দিয়েছেন।
তাছাড়া শাসকদের জবাবদিহিতার ফরযটি বাদ দিয়ে যারা দাড়ি-টুপি-পাঞ্জাবীর মতো সুন্নাহ-মুস্তাহাব-মুবাহ নিয়ে ব্যস্ত, তারা কখনোই সূরা আলে ইমরানের ১০৪ নং আয়াতে প্রদত্ত দাওয়াহকারী দলের ‘সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’-এর ফরয দায়িত্ব পালন করছে না। মুফতি মুহাম্মদ শাফে’ঈ (রহ.)-এর মতে, “ওয়াজিব কাজের বেলায় ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ ওয়াজিব এবং মুস্তাহাব কাজের ক্ষেত্রে তা মুস্তাহাব। উদাহরনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। সুতরাং বেনামাযীকে নামাযের আদেশ করা প্রত্যেকের উপর ফরয। নফল নামায মুস্তাহাব, এর জন্য উপদেশ দেওয়াও মুস্তাহাব। এছাড়া আরেকটি জরুরি শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য করতে হবে। তা হল এই যে, মুস্তাহাব কাজের বেলায় সর্বাবস্থায় নম্রতার সাথে কথা বলতে হবে এবং ওয়াজিব কাজের বেলায় প্রথমে নম্রতার সাথে এবং প্রয়োজনে কঠোর হওয়ারও অবকাশ আছে। অথচ আজকাল মুস্তাহাব ও মুবাহ কাজের বেলায় বেশ কঠোরতা প্রদর্শন করা হয় কিন্তু ওয়াজিব ও ফরয পালন না করলে কেউ টু শব্দটিও করে না।” [তাফসীরে মা’আরেফুল কুর’আন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২০]
৬.২ সশস্ত্র সংগ্রামঃ
সশস্ত্র পন্থায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অনুমোদন করেননি। তাই সশস্ত্র সংগ্রাম খিলাফত প্রতিষ্ঠার সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না।
নবুওয়্যতের দ্বাদশ সনে পঁচাত্তর জন ইয়াসরিববাসী আকাবাতে গভীর রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সঙ্গে মিলিত হন। তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আনুগত্য করার শপথ নেন। এই ঘটনাকে বলা হয় দ্বিতীয় বাই’আতে আকাবা। এসময় ইয়াসরিববাসীরা মিনাতে সমবেত জালিম-মুশরিকদের উপর হামলা চালাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইয়াসরিববাসীদের অন্যতম লড়াকু ব্যক্তি আব্বাস ইবনে উবাদা বলেনঃ
“হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ), যে আল্লাহ আপনাকে সত্য জীবন-বিধানসহ পাঠিয়েছেন তার শপথ করে বলছি, আপনি চাইলে আমরা আগামীকালই মিনায় অবস্থানকারীদের উপর হামলা চালাব।”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ
لَمْ نُؤمَر بِذَلِك، وَلَكِن ارْجِعُوْا إِلَى رحالِكُمْ
‘আমাদের এরূপ কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়নি, তোমরা নিজ নিজ কাফেলায় ফেরত যাও।’ [সীরাতে ইবনে হিশাম]
মাক্কী জীবনে মু’মিনদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল - كُفُّوۤاْ أَيْدِيَكُمْ কুফ্ফু আইদিয়াকুম অর্থাৎ “তোমাদের হাতসমূহ গুটিয়ে রাখ।” এই নির্দেশনাটি দেয়া হয়েছিল ওহীয়ে গাইরে মাতলু বা হাদীসের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে,
সূরা নিসার ৭৭ নাম্বার আয়াতে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
তাফসীরে ইবনে কাসীরে বর্ণিত আছে, উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বলেনঃ
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم وأصحابه يعفون عن المشركين وأهل الكتاب،
كما أمرهم الله، ويصبرون على الأذى، قال الله: { فَاعْفُوا وَاصْفَحُوا حَتَّى يَأْتِيَ
اللَّهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ } وكان رسول الله صلى
الله عليه وسلم يتأوَّل من العفو ما أمره الله به
“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ মুশরিকীন ও আহলে কিতাবদের আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ক্ষমা করে যেতেন এবং অত্যাচার সহ্য করে যেতেন। [কারণ] আল্লাহ বলেছেনঃ ‘অতএব তোমরা আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের ক্ষমা কর ও উপেক্ষা কর।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ১০৯] এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক এক্ষেত্রে ক্ষমার ব্যাপারে সর্বাগ্রে থাকতেন।”
মক্কার কাফেরদের দুর্ব্যবহারের জবাবে অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের মোকাবেলা করার অনুমতি প্রার্থনা করলে আবদুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
أِنِّي أُمِرْتُ بِالْعَفْوِ، فَلا تُقَاتِلُوا الْقَوْم
‘প্রকৃতপক্ষে আমি ক্ষমার জন্য আদিষ্ট, অতএব তোমরা লোকজনের সাথে যুদ্ধ করো না।’ [আল-হাকিম, নাসাঈ]
মাক্কী জীবনে সাহাবীগণ নির্মমভাবে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বলতেনঃ
اِصْبِرُوا فَإِنِّي لَمْ أُؤْمَرْ
بِالْقِتَال
‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, আমাকে এখনো যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়
নি।’ [আল-কাশফ ওয়াল বায়ান]
নবুওয়্যতের ত্রয়োদশ সনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতি লাভ করেন। মহানবী (সাঃ) ইয়াসরিবে হিজরত করার পর এর নাম হয় মদীনাতুর রাসূল। মদীনা একটি রাষ্ট্রের রূপ লাভ করে। আর নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রধান হন রাসূল (সাঃ)।
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নাযিল হয় সূরা হজ্জের ২৫ থেকে ৭৮ নম্বর আয়াত। আর এই অংশটির একাংশে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন,
রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেনঃ
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُواْ وَإِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ الَّذِينَ أُخْرِجُوا
مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ
“লড়াইয়ের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে, যাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে, আর আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন, যাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এই জন্য যে, তারা বলেছিলঃ ‘আল্লাহ আমাদের রব।’” [সূরা হাজ্জঃ ৩৯-৪০]
এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহ.) বর্ণনা করেনঃ
قال ابن العربي : قال علماؤنا كان رسول الله صلى الله عليه
وسلم قبل بيعة العقبة لم يؤذن له في الحرب ولم تحل له الدماء؛ إنما يؤمر بالدعاء
إلى الله والصبر على الأذى والصفح عن الجاهل
“ইবনুল আরাবী বলেনঃ ‘আমাদের আলেমগণ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আকাবার বাই’আত এর আগে কখনো যুদ্ধের ডাক দেননি এবং রক্তপাতকে হালাল করেননি, [বরং] তিনি আদেশ করেছেন আল্লাহর কাছে দু’আ করার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধৈর্য ধরার এবং জাহেলদেরকে উপেক্ষা করার।’”
এই পরিস্থিতি দীর্ঘ বারো বছর অব্যাহত রইল। এ আয়াতটি নাযিল হওয়া প্রসঙ্গে কুরতুবী বর্ণনা করেনঃ
قال ابن عباس وابن جبير : نزلت عند هجرة رسول الله صلى الله عليه وسلم
إلى المدينة. وروى النسائي والترمذي عن ابن عباس قال : (لما أخرج النبي صلى الله
عليه وسلم من مكة قال أبو بكر : أخرجوا نبيهم ليهلكن؛ فأنزل الله تعالى]
أذن للذين يقاتلون بأنهم ظلموا وإن الله على نصرهم لقدير[
“ইবন আব্বাস ও ইবন জাবীর বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করার সময় এটি নাযিল হয়। ইবন আব্বাস হতে নাসাঈ ও তিরমিযী বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ ‘যখন রাসূল (সাঃ) কে মক্কা থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছিল তখন আবু বকর (রাঃ) বলেন, ‘এরা এদের নবীকে বহিষ্কার করেছে, এদের ধ্বংস অনিবার্য।’ অতঃপর আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেনঃ ‘লড়াইয়ের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে, যাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে, আর আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন।’” [সূরা হাজ্জঃ
৩৯]
নাসায়ী, ইবন হিব্বান, হাকিম প্রভৃতি গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ
هِيَ أَوَّل آية نَزَلَتْ في القِتَالِ
“যুদ্ধের ব্যাপারে এটিই প্রথম নাযিলকৃত আয়াত।” ইমাম কুরতুবীও একই মত প্রকাশ করেছেন।
আল-বাহরুল মুহীত, তাফসীরুল কাবীর, আল-কাশশাফ প্রভৃতি তাফসীর গ্রন্থে আছেঃ
وهي
أوَّلُ آيةٍ نزلتْ في القتالِ بعد ما نُهيَ عنه في نَيِّفٍ وسبعينَ آيةً
‘যুদ্ধের ব্যাপারে এটিই প্রথম নাযিলকৃত আয়াত যা [যুদ্ধ] ইতিপূর্বে সত্তরেরও বেশি আয়াতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।’
৬.২.১ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগের ও পরের পদ্ধতি
ক. ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.)-এর সিয়াসা শারী’আহ হতে জানা যায়, ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মহানবীর (সাঃ)-এর প্রতি কেবল ইসলামী দাওয়াত পৌঁছানোর আদেশ ছিল, জিহাদের (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তিনি যখন মদীনায় হিজরত করলেন এবং সেখানে ইসলামের দুশমনেরা তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল তখন আল্লাহ
তা’আলা মহানবী (সাঃ) ও সাহাবীদেরকে জিহাদের (যুদ্ধের) অনুমতি দান করলেন।
খ. হাফিজ ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)-এর যাদুল মা’আদ হতে জানা যায়, এইভাবে প্রায় তের বছরকাল পর্যন্ত তিনি প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনে আল্লাহভীতি সৃষ্টির প্রয়াস পান। এই সময় তিনি কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করেননি এবং কাউকে জিযিয়া দিতেও বলেননি। বরং ঐ সময় হাত গুটিয়ে রাখা, ধৈর্য ধারণ করা এবং সহনশীলতার পথ অবলম্বন করার জন্যই তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপর তিনি হিজরতের নির্দেশ লাভ করেন। হিজরতের পর সশস্ত্র সংগ্রামের অনুমতি দেওয়া হয়। তারপর যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ (যুদ্ধ) করার এবং যারা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে তাদের ওপর হস্তক্ষেপ না করার
নির্দেশ
অবতীর্ণ
হয়। পরবর্তীকালে আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়।
No comments:
Post a Comment