৬.৭ জরুরতঃ
জরুরত বা প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে কেউ কেউ শারী’আহ-র বিধান লঙ্ঘনকে জায়েজ বানানোর চেষ্টা করেন। এরা দাবি করে যে, যেহেতু আল্লাহ মরণাপন্ন ক্ষুধার সময় হালাল খাদ্য না থাকলে শুকর বা অন্যান্য হারাম খাদ্য খেয়ে প্রাণ বাঁচানোর অনুমতি দিয়েছেন, সেহেতু প্রয়োজনের তাগিদে নারী নেতৃত্ব, গণতন্ত্র, মার্কিন-বৃটিশ তথা কুফর শক্তির তাঁবেদারি করাও জায়েয। তারা আরো মনে করেন যে, প্রয়োজন বা জরুরতের তাগিদে যে কোনো হারাম কাজ করা যাবে। [নাউযুবিল্লাহ]
প্রকৃতপক্ষে এরা পবিত্র কুর’আনের আয়াতকে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করছে। কুর’আন যেটাকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অনুমতি দিয়েছে, এরা সেটাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করছে। এটা সত্য যে, আল্লাহ বলেনঃ
إِنَّمَا
حَرَّمَ عَلَيْكُمُ ٱلْمَيْتَةَ وَٱلدَّمَ
وَلَحْمَ ٱلْخِنزِيرِ
وَمَآ أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ ٱللَّهِ فَمَنِ ٱضْطُرَّ
غَيْرَ بَاغٍ وَلاَ عَادٍ فَلاۤ إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ ٱللَّهَ
غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর হারাম করে দিয়েছেন মৃত পশু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই হয় এমন পশু। কিন্তু যে অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে অনন্যোপায় হয়ে পড়ে তার কোনো পাপ হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৭৩]
সুতরাং যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই নিরুপায়, হারাম খাদ্য না খেলে মৃত্যুবরণ করবে, কেবল তার ক্ষেত্রে হারাম খাদ্যগ্রহণের অনুমতি আছে। এই আয়াতের বর্ণিত জরুরত বা প্রয়োজনের ব্যাপারে যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণের তাফসীর থেকে একথাই বোঝা যায়।
হানাফী মাযহাবের আলেম ইমাম আল রাজী (রহ.) বলেনঃ ‘এখানে জরুরত বলতে বোঝায়, হারাম খাদ্য গ্রহণ না করলে প্রাণহানী বা অঙ্গহানীর সম্ভাবনাকে।’ [আহকামুল কুর’আন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৯]
হাম্বলী মাযহাবের আলেম ইমাম ইবনে কুদামাহ (রহ.) বলেনঃ
‘জরুরত বলতে এমন পরিস্থিতিতে বোঝায় যখন এটা প্রতিষ্ঠিত যে, [হারাম] খাদ্য গ্রহণ না করলে ক্ষুধায় প্রাণহানী ঘটবে।’ [আল মুগনী, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩১]
শাফেই মাযহাবের আলেম ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেনঃ
‘জরুরত বলতে আমরা এমন অবস্থাকে বুঝি যেটা কোনো ব্যক্তিকে ধ্বংস করে ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি খাদ্য গ্রহণ না করে তাহলে সে এমন অসুস্থ হবে যে তার মৃত্যু ঘটবে।’ [ওয়াসিত, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮]
মালিকী মাযহাবের আলেম ইমাম ইবনে জাওযী (রহ.) বলেনঃ
‘জরুরত বলতে মৃত্যুর ভয়কে বোঝায়।’ [আল কাওয়ানিনুল ফিকহিয়া, পৃষ্ঠা ১১৬]
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মুফতি মুহাম্মদ শাফে’ঈ (রহ.) বলেনঃ
“এক্ষেত্রে কুর’আন-এ মরণাপন্ন অবস্থায়ও হারাম বস্তু খাওয়াকে হালাল বা বৈধ বলেনি; বলেছে ‘তার কোনো পাপ হবে না।’ এর মর্ম এই যে, এসব বস্তু তখনও যথারীতি হারামই রয়ে গেছে, কিন্তু যে খাচ্ছে তার অনন্যোপায় অবস্থার প্রেক্ষিতে হারাম খাদ্য গ্রহণের পাপ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।” [তাফসীরে মা’আরেফুল কুর’আন]
সুতরাং নিরুপায় ব্যক্তির মরণাপন্ন পরিস্থিতির
মাস’আলা ব্যবহার করে নিতান্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে শারী’আহ-কে পাশ কাটিয়ে নারী নেতৃত্ব, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র ইত্যাদিকে মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে দেননি। বরং কুর’আন-সুন্নাহতে আমরা দেখতে পাই কঠিন ও দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও শারী’আহ-র আনুগত্য করার শিক্ষা। যেমন, আল্লাহ বলেনঃ
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ ٱلْخَوفْ
وَٱلْجُوعِ
وَنَقْصٍ مِّنَ ٱلأَمَوَالِ وَٱلأَنفُسِ
وَٱلثَّمَرَاتِ
وَبَشِّرِ ٱلصَّابِرِينَ
‘আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং ধন, প্রাণের ক্ষতি ও ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের।’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৫৫]
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ
فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا
أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنْ الدُّنْيَا
‘অন্ধকার রাতের ন্যায় ফিতনা আসার আগেই দ্রুত সৎকর্ম সেরে ফেল। সেসময় একজন ব্যক্তি সকালে মুসলিম ও সন্ধ্যায় কাফের বা সন্ধ্যায় মু’মিন ও সকালে কাফের হয়ে যাবে এবং দুনিয়ার সামগ্রীর জন্য সে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দেবে।’ [মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, ২১৩]
৬.৮ হুদায়বিয়ার সন্ধি
কেউ কেউ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে জায়েজ করার জন্য হুদায়বিয়ার সন্ধির দোহাই দেন। প্রথমত, হুদায়বিয়ার সন্ধি একটি পররাষ্ট্র চুক্তি, যেটি মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। এটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো মাধ্যম ছিল না। দ্বিতীয়ত, হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কোনো হারাম শর্ত থাকার প্রশ্নই উঠে না, কেননা সন্ধিটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর ইচ্ছায় সম্পাদিত হয়েছিল। তাই গণতন্ত্র
বা নারী নেতৃত্বের মতো কুফরী বিষয়ের সঙ্গে সেই মহান চুক্তির কোনো তুলনা হতে পারে না।
সুতরাং যেসব চুক্তি/জোট দ্বারা গণতন্ত্র, নারী নেতৃত্বকে বৈধতা দেয়া হয়, জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় বসানো হয়, সেসব চুক্তি/জোট শারী’আহ-র অকাট্য দলিল দ্বারা নিশ্চিতভাবে হারাম। কতিপয় মুফাসসির,
শায়খ, আল্লামা, মুফতি, মাওলানা দ্বারা এসব চুক্তি বা জোট গঠিত হলেই তা বৈধ হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর সুস্পষ্ট নির্দেশ হলোঃ
الصُّلْحُ
جَائِزٌ بَيْنَ الْمُسْلِمِينَ إِلَّا صُلْحًا حَرَّمَ حَلَالًا أَوْ أَحَلَّ
حَرَامًا
‘মুসলিমদের মধ্যে চুক্তি বৈধ - যদি চুক্তিতে এমন শর্ত না থাকে, যা হালালকে হারাম করে বা হারামকে হালাল করে।’ [তিরমিযী]
৬.৯ মন্দের ভালো
দুটো মন্দের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত কম মন্দ অর্থাৎ যেটি মন্দের ভালো সেটি গ্রহণ করা যাবে - এই অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়ে আমাদের দেশে কেউ কেউ জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে জোট গড়েছেন, সমর্থন দিয়েছেন, ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন। এই একই যুক্তি দেখিয়ে কেউ ভিড়েছেন ধর্মনিরপেক্ষ নারী নেতৃত্বের সঙ্গে, কেউ ভিড়েছেন জাতীয়তাবাদী নারী নেতৃত্বের সঙ্গে। প্রত্যেকের কাছে তাদের নিজ নিজ পক্ষের কুফর দলটি মন্দের ভালো!
কিন্তু ‘মন্দের ভালোকে গ্রহণ করা যাবে’ - এটি একটি মনগড়া নীতি ছাড়া কিছু নয়। ইসলামের সঙ্গে এর ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। আল্লাহ বলেনঃ
وَلاَ
تَسْتَوِى ٱلْحَسَنَةُ
وَلاَ ٱلسَّيِّئَةُ
ٱدْفَعْ
بِٱلَّتِى
هِىَ أَحْسَنُ
‘আর ভালো ও মন্দ কখনো সমান নয়। মন্দকে ভালো দিয়ে আঘাত কর...’ [সূরা হা-মীম-আস-সিজদাহঃ ৩৪]
সুতরাং মন্দ সবসময়ই মন্দ। কোনো মন্দই গ্রহণ করা যায় না। পরিণতি ও ভয়াবহতার বিচারে কোনোটি কম মন্দ বা কোনোটি বেশি মন্দ হতে পারে। তবে সবধরনের মন্দ থেকেই দূরে থাকা হলো ইসলামের শিক্ষা। যেমন, হাদীসে গীবতকে ব্যভিচার থেকে মন্দ বলা হয়েছেঃ
الغِيْبَةُ أَشَدُّ عِنْدَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنَ الزِّنَى
‘আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল-এর নিকট গীবত জিনার চাইতেও মন্দ।’ [বায়হাকী]
তাই বলে কেউ যদি গীবতকে বেশি মন্দ ভেবে কেবল সেটি থেকে দূরে থাকেন, আর ব্যভিচারকে কম মন্দ ভেবে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকেন, তাহলে এই ব্যক্তির ফাসেকী সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকবে কি?
একইভাবে, বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীস শরীফে প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারকে বড় গুনাহ বলা হয়েছে। তাই বলে কেউ যদি প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারকে বেশি মন্দ ভেবে সেটা থেকে বিরত থাকেন, আর দূরবর্তী কোনো নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হন, তাকে আমাদের দেশের ওইসব শায়খ, মুফতি, মাওলানারা কি ‘পাপী’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারবেন?
৬.১০ নিয়ত
‘নিশ্চয়ই কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল’ - হাদীসের এই মহান বাণীর প্রকৃত তাৎপর্যকে বিকৃত করে কিছু লোক দাবি করে যে, খারাপ কাজ ভালো নিয়ত নিয়ে করলে সমস্যা নেই। এই বিখ্যাত হাদীসটি নিয়ে এধরনের বিভ্রান্তি একেবারেই ইদানিং কালের। অতীতে কেউ এই হাদীসটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর কথা বলেননি। কেননা এই হাদীসের পুরো রেওয়ায়াতটি পড়লেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এটি অসৎকাজের নিয়ত
সংক্রান্ত
কোনো হাদীস নয়। বরং এটি সৎকাজের নিয়ত
সংক্রান্ত
হাদীস। পুরো রেওয়ায়াতটি হলোঃ
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ
وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ
فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا
أَوْ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ
‘নিয়তের উপরই সমস্ত কাজ নির্ভর করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়ত করেছে। সুতরাং যে হিজরত করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিয়তে, তার হিজরত পরিগণিত হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিয়তে। আর যে হিজরত করে দুনিয়া লাভ করা বা কোনো নারীকে বিবাহ করার নিয়তে, তার হিজরত হয় তার দিকেই, যার নিয়তে সে হিজরত করেছে।’ [বুখারী, মুসলিম]
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, ভালো কাজও অবশ্যই ভালো নিয়তে করতে হবে। খারাপ নিয়তে করলে ভালো কাজেরও সওয়াব পাওয়া যাবে না। আর খারাপ কাজের ভালো নিয়ত বা মন্দ নিয়ত সম্বন্ধে এই হাদীস কিছুই বলা হয়নি।
সাম্প্রতিককালের কিছু লোকের এই বিভ্রান্তির জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের সুখ্যাত আলেম মাওলানা আবদুর রহীম। তিনি উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ
‘যে কাজ মূলত খারাপ, যে কাজ আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলই (সাঃ) নিষেধ করিয়াছেন, তাহাতে ভালো নিয়তের তো কোনো প্রশ্নই হইতে পারে না। কারণ তাহা তো মূলত খারাপ এবং পাপের কাজ। এমতাবস্থায় উহার সহিত সৎ উদ্দেশ্য যোগ করা এবং তাহা হইতে সওয়াবের আশা করাই বরং অধিকতর অন্যায় ও পাপের কাজ। কেননা এইরূপ করিলে তাহাতে আল্লাহর দ্বীনের সহিত তামাশা ও বিদ্রূপ করা হয়।’ [হাদীস শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩, খায়রুন প্রকাশনী]
No comments:
Post a Comment