৬.৩ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি
গণতন্ত্র হচ্ছে মানবরচিত (of the people, by the people) আইনের শাসন ব্যবস্থা। গণতন্ত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে বসে আইন বানায়। এই শাসনব্যবস্থায় স্বার্বভৌমত্ব দেশের জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকে।
কিছু বিভ্রান্ত ব্যক্তি গনতন্ত্রকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হিসেবে গ্রহন করেছে। তারা দাবি করে, ইসলামের সাথে গণতন্ত্র
সাংঘর্ষিক
নয়। এমনকি, এরা
‘ইসলামী গণতন্ত্র’ বলে একটি উদ্ভট তত্ত্বেরও উদ্ভাবন ঘটিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে গনতন্ত্র (Democracy)-এর জন্ম ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় এক হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে। তৎকালীন গ্রীসের মুশরিক (Pagan) দার্শনিকরা এই ব্যবস্থার জন্ম দেয়। ইসলাম সর্বতোভাবে এই ব্যবস্থা পরিত্যাগ করেছে।
এই ব্যবস্থার প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই সুস্পষ্টভাবে কুর’আন-সুন্নাহ পরিপন্থী। নিচে ধাপে ধাপে ইসলাম ও গনতন্ত্রের বৈসাদৃশ্য দেখানো হলো-
জনগনের আইনঃ ‘Demo’ অর্থ জনগন, ‘Cracy’ [যা গ্রীক ‘Cratus’ শব্দ হতে উদ্ভূত] অর্থ আইন। জনগন কর্তৃক আইন প্রনয়নই গনতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট। অথচ ইসলামের মূল আক্বীদাহ
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ ছাড়া আর আইন দেয়ার এখতিয়ারই নেই। পবিত্র কুর’আন সুস্পষ্টভাবে জানাচ্ছেঃ
إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلاَّ لِلَّهِ
‘আইন দেয়ার অধিকার কেবল আল্লাহরই।’ [সূরা ইউসুফঃ ৪০, ৬৭;
সূরা আল-আনআমঃ ৫৭]
জনগনের সার্বভৌমত্বঃ জনগনের সার্বভৌমত্ব গনতন্ত্রের অন্যতম মূলনীতি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব গনতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে আছে
- ‘জনগনই সকল ক্ষমতার উৎস।’ অথচ পবিত্র কুর’আনে বহুবার আছেঃ
‘আল্লাহই সার্বভৌমত্বের মালিক।’
যেমনঃ
أَلَمْ تَعْلَمْ
أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ مِن
وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ
‘তুমি কি জান না, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহরই? এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবকও নেই, সাহায্যকারীও নেই।’ [সূরা আল-বাক্বারাহঃ ১০৭]
وَلِلَّهِ
مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ وَإِلَى
اللَّهِ الْمَصِيرُ
‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই এবং আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তন।’ [সূরা আন-নূরঃ
৪২]
الَّذِي لَهُ
مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُن لَّهُ
شَرِيكٌ
‘যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের মালিক; তিনি কোন সন্তান গ্রহন করেননি; সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন শরীক নেই।’ [সূরা আল-ফুরক্বানঃ
২]
সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতঃ
সংখ্যাগরিষ্ঠ
জনগন/জনপ্রতিনিধির
মতামতের
ভিত্তিতে
গনতন্ত্রে
সিদ্ধান্ত
গ্রহন বা আইন প্রণয়ন হয়। কিন্তু অধিকাংশের মতামতের গনতান্ত্রিক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া বা আইন প্রনয়ন করার কোন ভিত্তি কুর’আন-সুন্নাহতে নেই। বরং কুর’আনে বহুবার এই তথাকথিত ‘অধিকাংশ’ মানুষের মতামতকে বাতিল করা দেয়া হয়েছে। যেমনঃ
وَإِن تُطِعْ
أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ
هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
‘যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো শুধু অনুমানের অনুসরন করে; আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে।’ [সূরা আল-আনআমঃ
১১৬]
إِنَّهُ
الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يُؤْمِنُونَ
‘...ইহা তো তোমার রব কর্তৃক প্রেরিত সত্য, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে না।’ [সূরা হুদঃ ১৭]
ذَٰلِكَ
الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘...এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা অবগত নয়।’ [সূরা ইউসুফঃ ৪০]
بَلْ جَاءَهُم
بِالْحَقِّ وَأَكْثَرُهُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُونَ
‘...বস্তুত সে তাদের কাছে সত্য এনেছে এবং তাদের অধিকাংশই সত্যকে অপছন্দ করে।’ [সূরা মু’মিনুনঃ ৭০]
وَإِنَّ رَبَّكَ
لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَشْكُرُونَ
‘নিশ্চয়ই তোমার রব মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ।’ [সূরা আন-নামলঃ ৭৩]
এভাবে কুরআনে সব ক্ষেত্রেই ‘অধিকাংশ’ শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত ইসলামে আইন বা সিদ্ধান্ত গ্রহনের ভিত্তি হতে পারে না। সীরাতে দেখা যায়, রাসূল (সাঃ) অধিকাংশ সাহাবীর মতামতকে উপেক্ষা করে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পন্ন করেছিলেন। যায়েদ (রা.) ও উসামা (রা.)-কে সেনাপতি নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও তিনি (সাঃ) অধিকাংশ সাহাবীর মত বর্জন করেছিলেন।
অবশ্য কুর’আন-সুন্নাহ সমর্থিত মুবাহ বিষয়সমূহ নির্বাচন হলো মতামত নেয়ার একটি মাধ্যম মাত্র, এটিই গনতন্ত্র মনে করার কোন কারন নেই। কেননা রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র ইত্যাদিতেও ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। যেমনঃ
জর্ডান, কাতার, মিশর এসব দেশেও বিভিন্ন পরিসরে নির্বাচন হয়। এমনকি, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও পলিট ব্যুরোর সদস্যরা ভোটাভুটিতে
অংশ নেন। তাই নির্বাচন আর গনতন্ত্র এক কথা নয়। খলীফা নির্বাচনের বিধান আছে বলেই ইসলাম গনতন্ত্র হতে পারে না। মোট কথা, নির্বাচন হলো একটি মাধ্যম যেটি গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র কিংবা ইসলামে ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তাই বলে এগুলো সব একই ব্যবস্থা/মতবাদ নয়।
নিদিষ্ট মেয়াদঃ গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ সংবিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। যেমনঃ
আমেরিকা
চার বছর, বৃটেন/ভারত/পাকিস্থান/বাংলাদেশে পাঁচ বছর, ফান্সে সাত বছর। কিন্তু ইসলামে বৈধভাবে বাই’আতকৃত খলীফার কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। প্রকাশ্য কুফর করা মাত্রই খলীফা বিদায় নেবেন। যেমনঃ
আব্বাসীয়
খলীফা আল-আমিন তিন মাস পরই ক্ষমতাচ্যুত হন।
আবার, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করলে খলীফা আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকবেন। যেমনঃ উসমান (রা.) বার বছর ক্ষমতায় ছিলেন।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, ইসলামী শাসনের অনুপস্থিতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশসহ প্রতিটি মুসলিম দেশই দারুল কুফর। এখন প্রশ্ন হলো, কুফর আইন ও শাসন ব্যবস্থার অধীনে কোনো মুসলিমের জন্য কি নির্বাচনে অংশ নেয়া জায়েজ হবে?
গণতান্ত্রিক সংবিধান ও শাসন কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া মানে ওই কুফরী ব্যবস্থাকে সহায়তা ও শক্তিশালী করা। অথচ আল্লাহর আদেশঃ
وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلْبرِّ وَٱلتَّقْوَىٰ وَلاَ تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلإِثْمِ وَٱلْعُدْوَانِ
‘সৎকাজ ও তাকওয়ায় পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যকে সাহায্য করবে না।’ [সূরা আল-মায়িদাহঃ ২]
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যারা কথা ও কাজ দিয়ে মানবরচিত শাসনকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আল্লাহর আইনের শাসন যাদের উদ্দেশ্য নয়, সেসব জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে
কোনো অবস্থাতেই ভোট দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সাহায্য করা যাবে না।
আবার কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, গণতন্ত্র হারাম হলেও তথাকথিত বৃহত্তর স্বার্থ বা লাভ-এর জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশ নেয়া যাবে; এই ব্যবস্থার অধীনে ক্ষমতায় গিয়ে পরে এই ব্যবস্থাটিকে পাল্টে দিলেই হলো!
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, প্রথমতঃ
এরূপ দ্বিমুখী নীতি ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনো ইসলামী দল বা ব্যক্তি এভাবে কোনো হারাম পদ্ধতি থেকে স্বার্থ বা লাভ হাসিল করতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ কুর’আন-সুন্নাহ তথা শারী’আহ বহির্ভূত কোনো কিছু গ্রহণ করার মধ্যে কোনো লাভ বা কল্যাণ থাকতেই পারে না। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
الْخَيْرُ
اتِّبَاعِ القُرآنِ وَسُنَّتِي
“‘কল্যাণ’ হলো কুর’আন ও আমার সুন্নাহ অনুসরণ করা।” [তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর]
উসুল আল-ফিকহের প্রতিষ্ঠিত নীতি হলোঃ
‘সেটাই ভালো যেটাকে ইসলাম ভালো বলেছে। সেটাই খারাপ যেটাকে ইসলাম খারাপ বলেছে।’
গণতন্ত্র তথা মানবরচিত আইনে কোনো কল্যাণ থাকলে আল্লাহ কুর’আনে বলতেন নাঃ
إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلاَّ لِلَّهِ
‘আইন দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ।’ [সূরা ইউসুফঃ ৪০,৬৭; সূরা আল-আনআমঃ ৫৭]
فَٱلْحُكْمُ ِللَّهِ ٱلْعَلِـىِّ
ٱلْكَبِيرِ
‘আইন দেয়ার ক্ষমতা সর্বোচ্চ মহান আল্লাহর।’ [সূরা মু’মিনঃ ১২]
বস্তুতঃ এটি ইসলামের সুস্পষ্ট আক্বীদাহ
যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইনপ্রণয়ণের ক্ষমতা নেই। আল্লাহর ঘোষণাঃ
وَمَن
لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلْكَافِرُونَ
‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে যারা শাসন করে তারাই কাফের।’ [সূরা আল-মায়িদাহঃ
৪৪]
এই আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ
‘কোনো ব্যক্তি যদি শারী’আহভুক্ত আল্লাহর কোনো একটি নিশ্চিত হুকুমকে অস্বীকার করে, তাহলে সে ব্যক্তি কাফের। ইবনে জারীর আত-তাবারী বলেনঃ ‘এই বিষয়ে সকলের ঐকমত্য রয়েছে।’
এই
আয়াতের তাফসীরে ইবন আব্বাস (রাঃ) আরো বলেনঃ ‘কোনো
ব্যক্তি যদি আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করাকে অস্বীকার করে, তাহলে সে ব্যক্তি
কাফের এবং কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর যা নাজিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করাকে স্বীকার করে,
কিন্তু সেটা দিয়ে শাসন করে না, তাহলে সে জালিম, ফাসেক।’ [তাফসীরে
তাবারী]
ইবনে কাসীর (রহ.) তার তাফসীর গ্রন্থে সূরা নিসার ১৫১
নং আয়াতের তাফসীরে তাতারদের প্রসঙ্গে বলেনঃ
‘তারা ইহুদী, খ্রীষ্টান ও ইসলামের আইনের সমন্বয়ে একটি সংকলন তৈরী করলো। সেই সংকলনে তাদের নিজেদের মতামত ও ইচ্ছার ভিত্তিতে তৈরী অনেক আইনও স্থান পেল। পরবর্তীকালে জনগণ ওই আইন-সংকলনটিই অনুসরণ করতে লাগলো এবং একে কুর’আন-সুন্নাহর উপরে প্রাধান্য দেয়া হলো। যে শাসক এমনটা করলো, সে কাফের।’
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেনঃ
‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে না যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা দিয়ে শাসন করাটা ফরয, সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে কাফের। যে ব্যক্তি মনে করে যে, তার নিজের মতামত দিয়ে জনগণকে শাসন করা বৈধ এবং আল্লাহর আইন থেকে সরে যায় ও অনুসরণ করে না, সে ব্যক্তিও কাফের। সুতরাং সমগ্র উম্মাহর জন্য সাধারণ নিয়ম হলো, কুর’আন-সুন্নাহ ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে শাসন করা বা রায় দেয়া বৈধ নয়। কোনো জ্ঞানী বা নেতা বা শায়খ বা রাজার আদেশ মানতে জনগণকে বাধ্য করানোর অধিকার কোনো ব্যক্তিরই নেই। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, সে ওইরূপ কোনো কিছু দিয়ে মানুষের বিচার করতে পারবে এবং কুর’আন-সুন্নাহ দিয়ে বিচার করে না, সে ব্যক্তি কাফের।’ [মিনহাজুস সুন্নাহ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩০-১৩২]
উপরিউক্ত মতামতসমূহ থেকে পরিষ্কার যে, কুর’আন-সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে আইনপ্রণয়ন করা বা শাসন করা সম্পূর্ণ হারাম। সুতরাং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দিয়ে মানুষকে সংসদে বসে আইন বানানোর ক্ষমতা দেয়াটা সুস্পষ্ট হারাম। এক্ষেত্রে কোনো রকম লাভ/স্বার্থ ইত্যাদি অন্বেষন
করা ইসলামী আক্বীদাহ-র সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইমাম শাতিবী (রহ.) বলেনঃ
শারী’আহ-র উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিকে স্বীয় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সত্যিকারের দাসে পরিণত করা আর এটাই একমাত্র বৈধ লাভ/স্বার্থ [মাসলাহা]। [মুওয়াফাকাত]
৬.৩.১ নির্বাচন ও গণতন্ত্র এক কথা নয়
এখানে অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া হারাম হলেও, নির্বাচন কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই একক সম্পত্তি নয়। অন্য যে কোনো শাসন ব্যবস্থার অধীনেও নির্বাচন হতে পারে। যেমনঃ
রাজতন্ত্র
বা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও নির্বাচন হয়। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অধীনেও নির্বাচন হতে পারে। রাসূল (সাঃ) আকাবার বাই’আতের সময় আউস ও খাজরাযের বারটি গোত্র থেকে বারজন নাকীব (প্রতিনিধি) নিযুক্ত করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ওই বারটি গোত্র রাসূল (সাঃ)-কে সবার পক্ষ থেকে নুসরাহ ও আনুগত্যের শপথ দিয়েছিলেন। সুতরাং মুসলিমদের নেতা তথা খলীফা নিয়োগ করার ক্ষেত্রে নির্বাচনকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা বৈধ। তৃতীয় খলীফা হিসেবে উসমান (রাঃ)-কে নিয়োগের সময় খলীফা নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী আবুদর রহমান বিন আউফ (রাঃ) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই উসমান (রাঃ)-কে বেছে নিয়েছিলেন।
অর্থাৎ মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন/ভোটাভুটি তখনই বৈধ, যখন সেটা ইসলামী শাসনব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য কুর’আন-সুন্নাহ সমর্থিত মুবাহ বিষয়সমুহে জনগনের মতামত নেয়ার জন্য নির্বাচন পদ্ধতি ইসলামে গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন হলো মতামত নেয়ার একটি মাধ্যম মাত্র - এটিকে
গনতন্ত্র
মনে করার কোন কারন নেই। কেননা রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র ইত্যাদিতেও ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। যেমনঃ
জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব এসব দেশেও বিভিন্ন পরিসরে নির্বাচন হয়। এমনকি, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও পলিট ব্যুরোর সদস্যরা ভোটাভুটিতে
অংশ নেন। তাই নির্বাচন আর গনতন্ত্র এক কথা নয়। খলীফা নির্বাচনের বিধান আছে বলেই ইসলাম গনতন্ত্র হতে পারে না। মোট কথা, নির্বাচন হলো একটি মাধ্যম সেটি গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র কিংবা ইসলামে ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তাই বলে এগুলো সব একই ব্যবস্থা/মতবাদ নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়া হারাম, কেননা ওই শাসন ব্যবস্থাসমূহ কুর’আন-সুন্নাহ পরিপন্থী।
৬.৩.২ সংসদ (Parliament) ও মজলিসে শুরা এক বিষয় নয়
কেউ কেউ পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পার্লামেন্টের সঙ্গে খিলাফত ব্যবস্থার মজলিসে শুরাকে গুলিয়ে ফেলেন। এরা মনে করে, পার্লামেন্ট ও মজলিসে শুরা একই দায়িত্ব পালন করে, তাই গণতন্ত্র ও খিলাফতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
অথচ প্রকৃত সত্য হলো, পার্লামেন্ট (Parliament) বলতে আইন সভাকে বুঝায় (বাংলা একাডেমীর ডিকশনারি দ্রষ্টব্য)। আর মজলিসে শুরা বলতে বুঝায় পরামর্শ সভাকে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্টের কাজ হলো, সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে আইন প্রনয়ন করা। অন্যদিকে, খিলাফত শাসন ব্যবস্থায় মজলিসে শুরার কাজ হলো আল্লাহর নির্দেশিত আইনের মাধ্যমে খলীফাকে পরামর্শ দেয়া। শুরা সদস্যরা আইন প্রণয়ন করেন না। মজলিশ-ই-শুরার আইন প্রনয়নের কোন এখতিয়ারই নেই।
আবার সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী পার্লামেন্ট যেকোনো বিষয়েই আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু মজলিসে শুরা কেবলমাত্র মুবাহ বিষয়সমূহে খলীফাকে পরামর্শ দিতে পারে, ফরয-ওয়াজিব-হারাম-হালাল ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা মজলিসে শুরার নেই।
সংসদের সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যদের দ্বারা প্রণীত আইন মানতে গণতান্ত্রিক শাসক বাধ্য থাকেন। কিন্তু শুরা সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের পরামর্শ মানতে খলীফা সর্বাবস্থায় বাধ্য নন, বরং খলীফা চাইলে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের মাধ্যমে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপঃ খলীফা আবু বকর (রাঃ) অধিকাংশ সাহাবীর পরামর্শ গ্রহণ না করে উসামা বিন যাইদ (রাঃ)-কে রোম সীমান্তের যোদ্ধাদলের সেনানায়ক হিসেবে প্রেরণ করেন।
পার্লামেন্ট গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। পার্লামেন্ট না থাকলে গণতন্ত্রও নেই। কিন্তু মজলিসে শুরা খিলাফত শাসনব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ নয়। শুরা জনগনের অধিকার। খলীফা যদি শুরা (পরামর্শ) না নেন, তাহলে তিনি জনগনের অধিকার প্রদান করেননি; কিন্তু এ কারনে তার শাসন অবৈধ হয়ে যায় না। যেমনঃ
কোন গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগন তার কোন একটি অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেই সে দেশের নির্বাচিত সরকারটি অবৈধ হয়ে যায় না।
শায়খ তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানী (রহ.) বলেনঃ
... أَنَّهُ مِنْ أَجْهِزَةِ الْحُكْمِ وَلَيْسَ
مِنْ قَواعِدِهِ، فَالشُّوْرَى حَقٌّ مِنْ حُقُوْقِ الرعيةِ على الراعي، فَإِنْ
لَمْ يفْعلْ بِهَا يَكُونُ قَدْ قصّرَ، وَلَكِنَّ الْحُكْم يَبْقَى حُكْما
إِسْلامِيا. وَذَلِكَ لِأَنَّ الشُّوْرَى هِيَ لِأَخذ الرأي وَلَيْسَتْ
لِلْحُكْمِ، بِخِلافِها في مجالس النُوَّابِ الديمقراطيَّة
‘এটি (মজলিসে শুরা) শাসন কাঠামোর একটি অংশ মাত্র, প্রধান কোনো স্তম্ভ নয়। শুরা হচ্ছে খলীফার উপর জনগণের অধিকার। কাজেই তিনি এ ব্যপারে অবহেলা করলে তিনি অবহেলাকারী হবেন, কিন্তু তারপরও শাসনব্যবস্থাটি থাকবে ইসলামী। কারণ ইসলামে শুরার প্রয়োজন মতামত গ্রহণের জন্য, শাসনের জন্য নয়। এটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সংসদীয় পদ্ধতির বিপরীত।’
No comments:
Post a Comment