১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার মেহনতী শ্রমিকশ্রেণী
দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীসহ আরো কয়েকটি ন্যায্য দাবী ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে
শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল। মালিকরা
তাদের ইচ্ছামত শ্রমিকদের কাজ করতেও বাধ্য করত।
এমনকি দৈনিক ১৮-২০ ঘন্টা পর্যন্ত। এ অন্যায়, বঞ্চনা ও
জুলুমের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা পর্যায়ক্রমে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
এ আন্দোলনের অংশ হিসাবে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ -এর ১৮৮৫ সালের সম্মেলনের সিদ্ধান্তের
ভিত্তিতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকা ও কানাডার প্রায়
তিন লক্ষাধিক শ্রমিক শিকাগোর ‘হে মার্কেটে’ ঢালাই শ্রমিক তরুণ নেতা
এইচ সিলভিসের নেতৃত্বে এক বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক শ্রমিক
ধর্মঘট পালন করে। এতে ১১ জন শ্রমিক নেতা ও কর্মী নিহত হয় এবং
আহত ও বন্দী হয় অসংখ্য শ্রমিক নেতা ও কর্মী। শ্রমিক
নেতা ও কর্মী হত্যার এ দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই
প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১লা মে ‘শ্রমিক
হত্যা দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক
শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসাবে
পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মে দিবস শ্রমিক হত্যাযজ্ঞের পিছনে দায়ী ছিল পুজিবাদী
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাষ্ট্র শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী উপেক্ষা করে অবস্থান
নিয়েছিল পুজিপতিদের পক্ষে, কারণ পুজিবাদী ব্যবস্থায় যেই ক্ষমতায় থাকুকনা কেন ব্যবস্থার
নাটাই থাকে পুজিপতিদের হাতে।
মে দিবসের অর্জন কতটুকু?
১২৮ বছর আগে
ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের স্মরণে সারা
বিশ্বে আনন্দ উৎসবের মধ্যে মে দিবস পালিত হলেও
শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা আজও হয়নি। আজও শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রম
করিয়ে মালিকগন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক, বিলাসবহুল
তাদের জীবন ব্যবস্হা। তাদেরই কর্মচারী, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্হা, করুণ তাদের জীবন ইতিহাস। অধিক সময় কাজ, অস্বাস্থ্যকর
পরিবেশ, শ্রমিক-মালিক
তিক্ত সম্পর্ক, শ্রম চুরি করে বিত্ত বৈভব তৈরির প্রচেষ্টা
অব্যহত। অবশ্য এটা পুঁজিবাদের স্বভাব এবং তার ফসল। এ
ধরণের অর্থব্যবস্থার মধ্যে থেকে এর থেকে ভাল কিছু আশা করা যায় না। শ্রম উৎপাদনের
গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ,
শ্রমিক তার শ্রম বিক্রি করলেও সে একজন মানুষ। তার ভালভাবে বাঁচার অধিকার আছে।
কিন্তু পুঁজিবাদ শ্রমিককে শুধুমাত্র পণ্যে রুপান্তর মাধ্যম হিসাবে
দেখে এবং হরণ করে মানুষ হিসাবে সৃষ্টিকর্তা মহান রব্বুল আলামিন কর্তৃক প্রদত্ত অধিকার।
যার
ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি মালিকদের অতি মুনাফালোভী আচরণ, যেনতেনভাবে মুনাফা অর্জনের জন্য অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন সময়ে ঘটে
দূর্ঘটনা ও ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। অসংখ্য শ্রমিক হতাহত হয় ও মৃত্যুবরন করে। ফিনিক্স, স্পেকট্রাম, তাজরীন,
রানা প্লাজার মত বাংলাদেশের এই পোশাক তৈরীর কারখানা-ভবনগুলো কত না শ্রমিকের
মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু তাদের মৃত্যুর জন্য
দায়ী কোন ব্যক্তির শাস্তি আজ পর্যন্ত হয়নি। পুঁজিবাদী
অর্থব্যবস্থায় এসব মালিকরা পার পেয়ে গেছে আইনের ফাক-ফোকরে; দূর্বিষহ জীবনের কালো
ছায়া ছেয়ে গেছে হতাহতদের ও মৃত্যুবরনকারীদের পরিবারের উপর। লক্ষনীয় বিষয়
শ্রমিক দিবসের সূচনা ধর্মনিরপক্ষ গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং আমাদের দেশে
আজ যে শ্রমিক বিক্ষোভ হচ্ছে তা পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ফল। শ্রমিকদের
অধিকার প্রতিষ্ঠা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্ভব নয়, কারণ এই ব্যবস্থা মানুষের তৈরী এবং
এর নাটাই থাকে গুটি কয়েক পুজিপতিদের হাতে, যারা আইন তৈরী করে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। যেমটি আমরা দেখতে
পাই খোদ মার্কিনমূলুকে শতবছর পরেও
শ্রমিক বিক্ষোভ হয় ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য।
ইসলামে শ্রমিকের
মর্যাদা ও অধিকারঃ
ইসলামে
শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের কথা বিধৃত হয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সুবিচারের নির্দেশ
দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম শ্রমের প্রতি যেমন মানুষকে উৎসাহিত করেছে [আল্লাহ (সুবঃ) বলেনঃ “সালাত সমাপ্ত হইলে তোমরা পৃথিবীতে
ছড়াইয়া পড়িবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করিবে।” (সূরা আল-জুমু’আহঃ ১০)],
তেমনি শ্রমিকের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রত্যয়
ব্যক্ত করেছে। মুহাম্মাদ (সাঃ) শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে অত্যন্ত সম্মানের
দৃষ্টিতে দেখতেন।
শ্রমের
মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনঃ
‘কারো জন্য স্বহস্তের উপার্জন
অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আর আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ
করতেন।’ (বুখারী, মিশকাত)
শ্রমিকের
অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। আর একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবী
হ’ল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত
পারিশ্রমিক লাভ করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনঃ
‘তোমরা শ্রমিককে তার
শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ (ইবন মাজাহ, মিশকাত)
পৃথিবীর
সভ্যতার বিকাশে শ্রমিকদের কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কিন্তু আক্ষেপ! সভ্যতার কারিগর এ
শ্রেণীটি সর্বদাই উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত। উদয়াস্ত উষ্ণ
ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে খেটে যে শ্রমিক পুজিবাদের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, সেই পুজিঁবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই
তাদের জীবনকে করে রেখেছে দুর্বিষহ। এই ব্যবস্থার
কারনেই শ্রমিকরা হচ্ছে নানা নির্যাতন, জুলুম ও শোষণের শিকার, পুজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীরা সুযোগ পাচ্ছে তাদের ওপর নির্যাতন-জুলুম
চাপিয়ে দেয়ার।
সমাজতন্ত্র
ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মালিক-শ্রমিকের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে
ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত শ্রমনীতি
বাস্তবায়ন করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এজন্য দরকার ইসলাম
প্রদর্শিত নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন। আর এটি বাস্তবায়ন করতে হলে
লাগবে খিলাফত ব্যবস্থা। কারন একমাত্র খিলাফত ব্যবস্থায় খলীফাই পারে ইসলামকে
পৃথিবীর বুকে সুউচ্চে তুলে ধরতে, ইসলামের সমস্ত হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করতে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা খিলাফত রাষ্ট্রের উপর জাতি-ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র,
বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এইসব মৌলিক চাহিদা পূরণকে ফরয বা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ “বাস করার জন্য একটি গৃহ, আব্রু রক্ষার জন্য এক টুকরা কাপড়, আর খাওয়ার
জন্য এক টুকরা রুটি ও একটু পানি এসবের চেয়ে অধিকতর জরুরী কোন অধিকার আদম সন্তানের
থাকতে পারে না।” (তিরমিযী)
যদি
খলীফা এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে অথবা ব্যর্থ হয়, তবে তার জন্য রয়েছে কঠোর
হুঁশিয়ারী। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই
দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্বন্ধে জবাবদিহি করতে হবে।” ইমাম (খলীফা) যিনি সর্বসাধারণের উপর শাসক হিসেবে নিয়োজিত তিনিও
দায়িত্বশীল, তাকেও তার দায়িত্ব সম্বন্ধে জবাবদিহি করতে
হবে। মা’কিল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলল্লাহ
(সাঃ) বলেনঃ “এমন আমীর যার উপর মুসলিমদের শাসনভার
অর্পিত হয় অথচ এরপর সে তাদের কল্যাণ সাধনে চেষ্টা না করে বা তাদের মঙ্গল কামনা না
করে; আল্লাহ তাকে তাদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না।”
(মুসলিম)
অতএব,
এই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে হবে; মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল হাসিনা সরকার ও তার মদদপুষ্ট
দূর্ণীতিবাজদের জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার এছাড়া কোন বিকল্প নাই। এই ব্যবস্থার পতন
ঘটিয়ে আমাদের প্রয়োজন সেই খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যার ভিত্তি হবে ইসলাম এবং
যা নিশ্চিত করবে মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই পুঁজিবাদী গনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে পরিহার
করে আল্লাহর মনোনীত শাসন ব্যবস্থা খিলাফত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এর পক্ষে জনমত গড়ে
তোলাই এখন আমাদের মূল দায়িত্ব। আমাদের খিলাফাহর বাণী পৌঁছে দিতে হবে পৃথিবীর
প্রতিটি প্রান্তে প্রান্তে, বিশেষ করে নিষ্ঠাবান সেনা
অফিসারদের নিকট যারা খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পালন করবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
একমাত্র রাষ্ট্রের নিষ্ঠাবান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নুসরাহ’র (ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা) মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়েই
মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে।
আল্লাহ
আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।।।
No comments:
Post a Comment