1.6.14

ভূমিকা

মানুষের চরিত্র (shakhsiyyah) তার চিন্তা (‘aqliyyah) ও কর্মের (nafsiyyah) সমন্বয়ে গঠিত। তার শারিরিক বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য দিকের এতে কোন ভূমিকা নেই - বরং এগুলো নিতান্তই বাহ্যিক বিষয়। সুতরাং মানব চরিত্র গঠনে এই দিকগুলোর কোন প্রাসঙ্গিকতা কিংবা প্রভাব রয়েছে এরূপ চিন্তা করা অর্থহীন।

কোন বিষয়বস্তুকে বুঝতে ব্যবহৃত প্রক্রিয়ার নাম চিন্তা (‘aqliyyah); অর্থাৎ মানুষের মৌলিক বিশ্বাস এবং আস্থা হতে উৎসারিত মানদন্ডের আলোকে কোন একটি বিষয়বস্তু কিংবা বাস্তবতা সম্পর্কে মতামত বা রায় প্রদানের প্রক্রিয়া। যদি তার মতামত বা রায় প্রদানের প্রক্রিয়াটি ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তবে সে ইসলামী চিন্তার অধিকারী, অন্যথায় সে ইসলামী চিন্তা ব্যতীত অন্য কোন চিন্তার অধিকারী মানুষ।

মানুষের প্রবৃত্তি ও জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতিটিই হচ্ছে তার কর্মের বা চরিত্রের ধরণ (nafsiyyah); অর্থাৎ তার মৌলিক বিশ্বাস এবং আস্থা হতে উৎসারিত মানদন্ডের আলোকে এই চাহিদাগুলোকে পূরণ করার পন্থা। যদি কেউ এই চাহিদাগুলোকে ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিতে পূরণ করে তবে সে ইসলামী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি অন্যথায় সে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

যদি কারও চিন্তা এবং কর্ম একই মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তার চরিত্রটি হবে স্বাতন্ত্র্য এবং সুনিয়ন্ত্রিত। সুতরাং যখন কারও চিন্তা এবং কর্ম উভয়ের ভিত্তি হয় ইসলামী আক্বীদা তখন সে ইসলামী চরিত্রের অধিকারী। অন্যথায় তার চরিত্রটি হবে ইসলাম ব্যতীত অন্যকিছু।

সুতরাং কেবল এটাই যথেষ্ট নয় যে, একজন ব্যক্তি ইসলামী চিন্তার অধিকারী, যেকোন বিষয়কে বা কর্মকান্ডকে শরী’আহ-র আলোকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, শরী’আহ প্রদত্ত হুকুম নিরূপণে সক্ষম, হালাল এবং হারাম সম্পর্কে জ্ঞানী এবং চিন্তা ও সচেতনতা দিক দিয়ে পরিণত ব্যক্তিত্ব। সুতরাং হয়তো সে শক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম এবং বিভিন্ন ঘটনাবলীর ব্যাপারে বিচক্ষণ বিশ্লেষণ প্রদানেও সক্ষম। কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট নয়, তার কর্ম বা আচরণের ধরণ অবশ্যই ইসলামী হতে হবে, অর্থাৎ সে তার প্রবৃত্তি ও জৈবিক চাহিদা পূরণে ইসলামকে অনুসরণ করে। সে নামায আদায় করে, রোযা রাখে, নিজেকে পরিশুদ্ধ করে এবং হজ্জ্ব পালন করে, হালালের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ও হারাম থেকে বিরত থাকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ইচ্ছানুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে, অর্থাৎ সে অর্পিত ফরয দায়িত্বসমূহ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার চেষ্টা করে এবং এমনকি আরও নৈকট্য অর্জনের তীব্র আকাঙ্খায় নফল কাজসমূহ পালনে মনোযোগী হয়। বিভিন্ন ঘটনাবলীতে সে সঠিক এবং সত্যনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে, আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ভালবাসে এবং আল্লাহর ওয়াস্তেই কাউকে ঘৃণা করে এবং মুগ্ধ ও ন্যায়পরায়ণ চরিত্রের দ্বারা মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে।

ঠিক একইভাবে ইসলামী চিন্তার অধিকারী না হয়ে শুধুমাত্র কর্ম বা আচরণের ধরণ ইসলামী হওয়াটাও যথেষ্ট নয়। অজ্ঞানতবশতঃ আল্লাহর ইবাদত মানুষকে সঠিক রাস্তা থেকে বিচ্যুত করতে পারে। কারণ অজ্ঞানতার কারণে সে হয়তো এমন দিনে রোযা রাখতে পারে যেদিন রোযা রাখা হারাম, এমন ওয়াক্তে নামায আদায় করতে পারে যখন তা মাকরুহ্। তার সামনে সংঘটিত কোন মুনকার দেখে জবাবদিহী এবং বাঁধা প্রদানের পরিবর্তে সে হয়তো বলে উঠতে পারে ‘লা হাওলা ওয়া’লা কু’ওয়াতা ইল্লা বিল্লা’। সুদের লেনদেন হতে উপার্জিত অর্থ দান-খয়রাতের মাধ্যমে আকণ্ঠ গুণাহ-তে নিমজ্জিত থেকে সে হয়তো দাবি করতে পারে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করছি। অন্যকথায়, খারাপ কাজ করে সে ভাববে আমি ভাল কাজ করছি। সুতরাং, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং রাসূল (সাঃ) কর্তৃক নির্দেশিত পথ ব্যতিরেকে অন্যপথে প্রবৃত্তি ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।

চরিত্র পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে না যতক্ষণ না চিন্তা ইসলামী হয়। সুতরাং বাধ্যতামূলক বা ফরয হুকুমসমূহের ব্যাপারে সে জ্ঞান অর্জন করবে এবং শরী’আহ প্রদত্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারে যতবেশী সম্ভব জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব, তাতে আত্মনিয়োগ করবে। একই সময়ে, সে শুধু শরী’আহ-র নিয়ম-কানুন জানার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না বরং তাকে শরী’আহ-র নিয়ম-কানুনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল ইসলামী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে। এসব হুকুমসমূহকে সে জীবনের সবক্ষেত্রে অর্থাৎ স্রষ্টার সাথে, নিজের সাথে ও সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করবে এবং এমন পন্থায় যাতে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন ও তার আমলকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

যখন কারও চিন্তা ও কর্ম ইসলাম অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয় তখনই কেবল তাকে ইসলামী চরিত্রের অধিকারী বলা যায়, যা তাকে একমাত্র আল্লাহর ভয়ে ভীত সৎকর্মশীলদের কাতারে ধাবিত করে।

তবে তার মানে এটা নয় যে কোন বিচ্যুতি ঘটবে না। তবে এই বিচ্যুতিগুলো যদি স্বাভাবিক রীতি বা অভ্যাস না হয়ে শুধু হঠাৎ ব্যতিক্রম হয় তবে তা ইসলামী চরিত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। কারণ মানুষ ফেরেশতা নয়। সে ভুল করতে পারে, ক্ষমা চাইতে পারে, অনুতপ্ত হতে পারে এবং যা শুধুমাত্র সঠিক তাই করতে পারে এবং করুণা, দয়া ও হেদায়েতের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রশংসাও করতে পারে।

একজন মুসলিম যতই তার ইসলামী জ্ঞানের পরিধিকে বৃদ্ধি করবে ততই তার চিন্তা উন্নত থেকে উন্নততর হবে এবং তার চরিত্রকে উন্নত করার লক্ষ্যে যতবেশী সে মুস্তাহাব হুকুমসমূহ পালন করবে ততবেশী সে সর্বোচ্চ চারিত্রিক আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার দিকে ধাবিত হবে। এমনকি এই উন্নত হওয়ার এই প্রক্রিয়ায় সে এক বিন্দুতে স্থির থাকবে না বরং আরও উপরে উঠার নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এটা তখনই সম্ভব যখন সে তার জীবনকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন করবে এবং একজন বিশ্বাসী হিসেবে আখিরাত প্রাপ্তির আশায় সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করবে। সে একদিকে যেমন মসজিদের মিহরাবের সাথে সংযুক্ত থাকবে ঠিক একইসময়ে সর্বশক্তিমান, সৃষ্টিকর্তা এবং সর্বপ্রণেতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার গোলাম হিসেবে শ্রেষ্ঠ গুণাবলী সম্বলিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জিহাদের ময়দানের বীরযোদ্ধা হবে।

এ বইয়ে আমরা মুসলিমদের জন্য বিশেষতঃ দাওয়াহ বহনকারীদের জন্য ইসলামী চরিত্রের অপরিহার্য উপাদানসমূহকে উপস্থাপন করবো যাতে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত দাওয়াহ বহনকারীগণের জিহ্বা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জিকিরে সিক্ত থাকে, অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সৎকাজের দিকে দ্রুতবেগে ধাবিত হয়। সে কুর’আন তিলাওয়াত করে, সে অনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) কে ভালবাসে, আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ভালবাসে ও আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ঘৃণা করে, আল্লাহর করুণার আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে, সে ধৈর্য্যশীল, আখেরাতে আল্লাহর পুরষ্কারের আশা করে, আন্তরিকভাবে ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখে। সে সত্যের উপর সুউচ্চ পর্বতের ন্যায় অটল, মু’মিনদের প্রতি সদয়, বিনম্র এবং দয়ালু কিন্তু কাফেরদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও কঠোর এবং আল্লার সন্তুষ্টি প্রাপ্তির রাস্তায় চলতে গিয়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও ভয়ে ভীত নয়। সে উন্নত চরিত্রের অধিকারী, মিষ্টভাষী কিন্তু যুক্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ, সে সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ প্রদান করে, সে দুনিয়ার জীবনে বসবাস ও কাজ করে কিন্তু তার চোখ সর্বদা জান্নাতের আকাঙ্খাতে ব্যাকুল থাকে, যার প্রশস্ততা জমীন থেকে আসমান পর্যন্ত ব্যাপ্তি এবং যা শুধুমাত্র মু’মিনদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

আমরা দাওয়াহ বহনকারীদেরকে বিশেষতঃ নবুয়্যতের আদলে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী জীবনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে তাদের বর্তমান বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। তারা আল্লাহর শত্রুদের দ্বারা সৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। সুতরাং, যদি তারা দিনে এবং রাতে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সান্নিধ্যে না থাকে, তাহলে কীভাবে তারা জীবনের কঠিনতর বিভিন্ন পথ পাড়ি দিবে? কীভাবে অভিষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছবে? কীভাবে উন্নত থেকে উন্নততর স্থানে পৌঁছাবে? কীভাবে? কীভাবে?

পরিশেষে, দাওয়াহ বহনকারীদের জীবনে দু’টি আলোকিত হাদীসের প্রতিফলন ঘটাতে হবে, যা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের পথকে উদ্ভাসিত করবেঃ

প্রথমতঃ

“তোমাদের দ্বীনের শুরু নবুয়্যত এবং করুণা দিয়ে এবং অতঃপর নবুয়্যতের আদলে খিলাফত দিয়ে... অতঃপর আবার আসবে খিলাফত নুবয়্যতের আদলে।” এ হাদীসে আল্লাহর ইচ্ছায় খিলাফত ফিরে আসার সুখবর রয়েছে। এটি প্রথম খিলাফতের মতোই ফিরে আসবে, খোলাফায়ে রাশেদীন অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবীদেরটির মতো। যে ব্যক্তি তা ফিরে আসাকে দেখতে ব্যাকুল এবং তা দেখার তামান্না অন্তরে পোষণ করে, তাকে অবশ্যই এর জন্য একজন মু’মিন হিসেবে কাজ করতে হবে, নবী (সাঃ)-এর সাহাবীদের (রা.) মতো হওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ

“আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ যে আমার ওয়ালীকে (তাক্ব’ওয়াবান বান্দা) অপমান করলো, সে আমার প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করলো। হে আদম সন্তান! আমার নির্দেশ পালনকারীর জন্য যা কিছু সংরক্ষণ করে রেখেছি তা কখনওই তুমি পাবে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত সম্পাদন করার মাধ্যমে নৈকট্য হাসিল করার চেষ্টা করবে যতক্ষণ না আমি তাকে ভালবাসি। অতঃপর আমি তার হৃদয় হয়ে যাব, যা দিয়ে সে চিন্তা করবে, জিহ্বা হয়ে যাব যা দিয়ে সে কথা বলবে, চোখ হয়ে যাব যা দিয়ে সে দেখবে। সুতরাং সে যখন ডাকবে তখন আমি সে ডাকে সাড়া দেব, যখন সে কোন কিছু চাইবে তখন আমি তাকে তা প্রদান করব, যখন সাহায্য চাইবে তখন আমি সাহায্য করব এবং বান্দার কাজসমূহের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দীয় হল সৎ উপদেশ (নসীহা)।”

আল-তাবারানী কর্তৃক আল-কাবীর এ বর্ণিত।

এই হাদীসটি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর সাহায্য অন্বষণের মাধ্যমে কিভাবে তাঁর পক্ষ থেকে বিজয়, তাঁর সান্নিধ্য ও তাঁর সাহায্য পাওয়া যায় সেই পথ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বক্ষমতাবান; তিনি যাকে সহায়তা করেন কেউ তাকে অপমানিত করতে পারবে না, আর তিনি যাকে অপমানিত করেন কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। যখন বান্দা তাকে ডাকেন তখন তিনি বান্দার খুব নিকটে পৌঁছে যান, যখন বান্দা তাঁর আনুগত্য করে তখন তিনি সাড়া দেন; তিনি অপ্রতিরোধ্য এবং বান্দার উপর সর্বাধিক দয়ালু এবং সব দিক দিয়ে অভাবমুক্ত।

সুতরাং, হে ভাইয়েরা! আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁর মাগফেরাত, জান্নাত, বিজয় ও উভয় জগতের সাফল্যের দিকে দ্রুতবেগে অগ্রসর হোন।

“এবং এই বিষয়ে প্রতিযোগীগণ প্রতিযোগীতা করুক।” [সূরা আল মুতাফ্ফীফীনঃ ২৬]


২১ জুলহজ্ব, ১৪২৪ হিজরী

১২-০২-২০০৪ ইং

No comments:

Post a Comment