22.8.14

প্রশ্নোত্তরঃ চীনকে মোকাবিলার জন্য ভারতের নীতিতে আমেরিকার প্রভাব

প্রশ্নঃ

০৭.০৪.২০১৪ তারিখে ভারতে সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছে যা ১২.০৫.২০১৪ তারিখ পর্যন্ত চলবে এবং এর ফলাফল ১৬.০৫.২০১৪ তারিখে ঘোষণা করা হবে। এই নির্বাচনে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক জোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যার একটি হচ্ছে আমেরিকাপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার সাথে শরীক দলসমূহ এবং অপরটি হচ্ছে বৃটেনপন্থী কংগ্রেস পার্টি, যেটা ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বৃটেনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে ও চীনকে মোকাবিলার ভীতির কারণে আমেরিকার সাথে নিষ্ক্রিয় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে... প্রশ্ন হচ্ছে যে, চীনকে মোকাবিলার জন্য ভারতের নীতিতে আমেরিকার কি ধরণের প্রভাব থাকবে? এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে আমেরিকার পরিকল্পনার সাথে এর সম্পর্ক কি এবং এই দ্বন্দ্বের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে অন্তর্ভূক্ত করার কি উদ্দেশ্য রয়েছে? এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কি বিজেপি কিংবা কংগ্রেস পার্টির বিজয় দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? ভারতের কি চীনকে মোকাবিলার সামর্থ্য রয়েছে? চীন এবং ভারতের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কেমন?

উত্তরঃ

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার হবেঃ

১. চীনকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্টভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আওতাধীন পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরণের জোট ও অংশীদারিত্বমূলক মৈত্রি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সম্পর্ক জোরদার করে চলেছে। এক দশকেরও অধিক সময় পূর্বে আমেরিকা এটা গুরুত্ব সহকারে শুরু করেছিল, কারণ সে অনুধাবন করতে পেরেছিল যে চীনকে নিয়ন্ত্রণের নীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে কিংবা স্থবিরতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর পূর্বাপেক্ষা অধিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না। এটা আরো প্রকট হয় যখন দেখা যায় যে, আমেরিকা চীনকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) যোগদানের আমন্ত্রণ জানায়, বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্প্রসারণ ঘটায় এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত সংলাপকে আর পূর্বের মতো স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে না...। যাই হোক, চীন আমেরিকার কক্ষপথে আবর্তিত হতে রাজি হয়নি, এমনকি তার নীতির সাথে একমত হতেও সম্মত হয়নি এবং পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের উপর চীনের আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্খাকেও আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অখন্ডতা, ঐক্য ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য কিছু অঞ্চলে শুধুমাত্র আর্থিক লাভের জন্য নয় বরং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মানসে নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে শুরু করেছে এবং এই অঞ্চলে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা আমেরিকার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিংবা আমেরিকার প্রভাবকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। চীন এই অঞ্চলের উপর নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায় এবং এটাকে সে তার নিয়তি মনে করে। চীন নিজের ভৌগলিক সীমারেখার অন্তর্গত অঞ্চলের উপর আধিপত্যকে পর্যাপ্ত মনে করে না এবং সে মনে করে যে কেবল এটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে বৃহৎ একটি রাষ্ট্রের পরিচিতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে... আমেরিকা চীনের সামুদ্রিক এলাকাকে নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং এই আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারণেই আমেরিকা নিজের আঞ্চলিক সীমানায় কর্তৃত্ব স্থাপন করে তৃপ্ত নয় বরং সমগ্র বিশ্বকেই সে তার নিজের এলাকা মনে করে। এজন্যই আমেরিকা আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের নিমিত্তে চীনের এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়... তাই আমেরিকা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন ও কৌশলগত সংলাপের মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এগুলোর কোনটিই চীনকে আমেরিকার কক্ষপথে আবর্তিত করাতে সক্ষম হয়নি; এমনকি জোটের অংশীদারও করতে পারেনি, বরং চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের নীতি আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে; ফলশ্রুতিতে এককভাবে চীনকে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা আর কার্যকর হচ্ছে না এবং আমেরিকা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। এজন্যই তার নৌবাহিনীর প্রায় ষাট ভাগ এই অঞ্চলে মোতায়েনের প্রয়োজন হয়েছে। চীনকে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলার নীতির পাশাপাশি আমেরিকা তার আঞ্চলিক সমস্যাগুলোর মধ্যেও নাক গলানো শুরু করেছে... ... চীনকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য আমেরিকা এই অঞ্চলের দেশগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই দেশগুলোর মধ্যে তিনটি দেশ এই বেষ্টনিকে কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, দেশগুলো হচ্ছেঃ ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া...।

২. ভারতের ক্ষেত্রেঃ চীনের সাথে এই দেশটির প্রায় ৩৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং এদের মধ্যে সীমানা সম্পর্কিত সমস্যা অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। শতাব্দীর সিকিভাগ সময় ধরে তাদের মধ্যে অনেকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষটি ছিল চতুর্দশতম দ্বি-পাক্ষিক সীমানা নির্ধারণী বৈঠক। অতঃপর তারা বৈঠক স্থগিত করে এবং পঞ্চদশতম বৈঠকটি ১৫.০৪.২০১৩ তারিখের ঘটনার জন্য আর অনুষ্ঠিত হয়নি। উক্ত তারিখে চীনের সামরিক বাহিনী ভারতের সীমানা অতিক্রম করে এবং লাদাখ অঞ্চলের ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করে তাঁবু গেড়ে অবস্থান গ্রহণ করে, কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে ঐ এলাকা ছেড়ে চলে আসে। এটা ছিল একটা ক্ষমতার প্রদর্শণী, যার মাধ্যমে চীন ভারতের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছিল; বার্তাটি হচ্ছে যে, চীন ১৯৬২ সালের অক্টোবরের মত পুনরায় সীমানা অতিক্রম করতে ও যুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত রয়েছে। সেই সময়ে চীনের সামরিক বাহিনী অরুণাচল প্রদেশ আক্রমণ করে সেখান থেকে ভারতীয় সেনাদের বিতাড়িত করেছিল। ঐ হামলার এক মাস পরে চীন দ্বিতীয় বারের মতো ভারত আক্রমণ করে এবং প্রায় ২০০০ ভারতীয়কে হত্যা করে। এই ঘটনাটি অমীমাংসিতই থেকে যায় এবং তখন “প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা” প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ব্যাপকভাবে আলোচিত স্থায়ী একটি সমস্যা। ১৯৫০ সালে চীন কর্তৃক দখলকৃত তিব্বত অঞ্চল নিয়ে সমস্যা হতে সৃষ্ট উত্তেজনার পাশাপাশি এটি তাদের মধ্যকার বৈরীতাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। তাই এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত এই অঞ্চলের বৌদ্ধদেরকে এবং তাদের নেতা দালাইলামাকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে আমেরিকাকে সহযোগিতা করেছে ও নির্বাসিত সরকার হিসেবে দালাইলামার জন্য কেন্দ্রীয় তিব্বত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সকল কারণে ভারত ও চীনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ...।

৩. চীনকে মোকাবিলা করতে ভারতকে রাজি করানোর জন্য আমেরিকা চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিংবা ভারতকে উস্কে দিতে তাদের মধ্যকার সমস্যাগুলোকে খোঁচা দিয়ে আরও প্রকট করে তুলেছিল। এসবের পরও ভারত স্থলপথে চীনকে মোকাবিলা করতে ভয় পায় এবং চীনের আগ্রাসনমূলক আক্রমণাত্মক মনোভাব এই ভীতিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সেই জন্য চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হতে ও সীমান্ত বিষয়ক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রলোভন দেখানো প্রয়োজন ছিল, সুতরাং আমেরিকা ভারতের সাথে একটি কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করে এবং নিজেদের মধ্যে পরমাণু সহযোগিতামূলক একটি মতৈক্যে পৌঁছায়... সেই সাথে আমেরিকা ভারতের সাথে অনেকগুলো অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই লক্ষ্যে দেশ দুটি ২০০৫ সালে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং ২০০৮ সালে একটি বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতামূলক চুক্তিও সম্পাদন করে। এগুলোর সবকিছুই তাদের মধ্যকার নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগিতার দিগন্তকে আরও প্রসারিত করে। ফলশ্রুতিতে দেশ দু’টি বর্তমানে নজিরবিহীন সংখ্যক যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করছে; সেই সাথে ভারতে আমেরিকার তৈরি অস্ত্র বিপুল পরিমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে ...। সুতরাং যখন ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল দিপক কাপুর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ বলেছিল যে, “ভারতের সামরিক বাহিনী একটি দ্বিমুখী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে” (দি ইকোনোমিক, ১৫.০২.২০১০), তখন থেকেই আমেরিকা পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে চলেছে, যেন সে ভারতের সাথে তার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করে এবং পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আফগানিস্তান ও উপজাতীয় এলাকার মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোনিবেশ করে। এই সবকিছু করা হচ্ছে যাতে করে ভারত উত্তর ফ্রণ্টে চীনের সাথে যুদ্ধে মনোনিবেশ করতে পারে...। আমেরিকা ভারতের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যও উদ্যোগ নিয়েছে, কারণ গত ৫ বছরে অন্য যেকোন দেশের তুলনায় ভারতে আমেরিকার রপ্তানির পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের কনফেডারেশনের হিসাব মোতাবেক সেবা খাতে দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী ৬ বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে...। যাই হোক, ভারত চীনের সাথে ব্যাপক আকারে স্থলযুদ্ধের বিষয়ে ভীত, সেই সাথে কংগ্রেস পার্টির শাসকেরা আমেরিকার তুলনায় বৃটেনের প্রতি অধিকতর অনুগত এবং তারা আমেরিকার স্বার্থের জন্য চীনের সাথে পরাজয়ের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অনিচ্ছুক...!

৪. তাই আমেরিকা ভারতের দৃষ্টি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে নিবদ্ধ করার প্রয়াস চালায় এবং তেল-গ্যাসের লোভ দেখিয়ে আমেরিকার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের অংশ হিসেবে চীনের সাথে মোকাবিলা করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং এই জন্যই চীনের সাথে বিরোধপূর্ণ স্প্র্যাটলি দ্বীপের উপকূলে ভিয়েতনামের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারত তেল-গ্যাসের জন্য খোঁড়াখূড়ি করতে রাজি হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিউ ওয়াইমিন বলেছে যে, “আমরা দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধে বহিঃশক্তির কোন হস্তক্ষেপ দেখতে চাই না এবং আমরা কোন বিদেশী কোম্পানীকে এমন কোন কাজে নিয়োজিত দেখতে চাই না, যা চীনের সার্বভৌমত্ব, অধিকার ও স্বার্থে আঘাত হানতে পারে।” (দি মিডল ইস্ট, ২৮.১১.২০১১)। এর পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দি পিপলস ডেইলী নিউজপেপার ভারত ও ভিয়েতনাম উভয়কেই চীনের সাথে দায়িত্বজ্ঞানহীন দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে অভিযুক্ত করেছে। আমেরিকা ভারতকে এই অঞ্চলে আরও আগ্রাসী হওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করে আসছে। সেই জন্য ২২.০৭.২০১৩ তারিখে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন ভারত সফরে যায় এবং সেই সফরের পূর্বে ওয়াশিংটনে সে মন্তব্য করেছিল যে, ভারতকে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বে অগ্রসর হতে প্রলুব্ধ করতে হবে। সে বলেছিল, “…..ভারত ক্রমবর্ধমান হারে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ও এর অগ্রবর্তী অঞ্চলে নিজের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের জন্য সুখবর।” সে আরও বলেছে যে, “আমরা ঐ অঞ্চলে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং স্থল ও সমুদ্রপথে নতুন বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরীর প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই” (আই.আই.পি ডিজিটাল, ২৩.০৭.২০১৩)। এর এক মাস পূর্বে ২৪.০৬.২০১৩ তারিখে কেরি তার ভারতীয় অংশীদার শ্রী সালমান খুরশীদের সাথে নয়াদিল্লীতে দেখা করেছে এবং মার্কিন-ভারত কৌশলগত সংলাপের চতুর্থ দফা বৈঠকে যুগ্মভাবে সভাপতিত্ব করেছে। সেখানে তারা এশিয়া এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের স্বপ্নকে দৃঢ়তাসহকারে পুনর্ব্যক্ত করে। সেই সাথে তারা আঞ্চলিক যোগাযোগকে শক্তিশালী করার বিষয়ে অব্যাহত সহযোগিতার উপর গুরুত্বারোপ করে এবং সমুদ্রযাত্রা বিষয়ক নিরাপত্তার গুরুত্বকে দৃঢ়তাসহকারে পুনর্ব্যক্ত করে...” (আই.আই.পি. ডিজিটাল ২৪.০৬.২০১৩)। এসবকিছু এটাই প্রমাণ করে যে, আমেরিকা ভারতকে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বে ঠেলে দিতে চায়, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকা নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের পরে ভারতের উপর অব্যাহত চাপ সৃষ্টির পরেও সে গত দু’বছর ধরে আমেরিকার চাহিদা মোতাবেক সাড়া দেয়নি। এর কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টির বৃটেনের প্রতি আনুগত্য এবং চীনের সাথে যুদ্ধভীতি...।

৫. অষ্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেঃ আমেরিকা তার নিজের কক্ষপথে আবর্তনকারী অষ্ট্রেলিয়াকে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ করার জন্য কাজ শুরু করেছিল এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার কৌশলগত পরিকল্পনা অনুসারে চীনকে মোকাবিলার জন্য অষ্ট্রেলিয়ার সাথে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। এই জন্য আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পররাষ্ট্র সচিব হিলারী ক্লিনটন, প্রতিরক্ষা সচিব লিওন প্যানেট্রা এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান মার্টিন ডিম্পসে অষ্ট্রেলিয়ার পার্থ সফরে গিয়েছিল এবং সেখানে তাদের অষ্ট্রেলিয় পক্ষের সাথে আলোচনায় বসেছিল। পার্থে অবস্থিত ওয়েষ্টার্ন অষ্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান আমেরিকান সেন্টারের উদ্বোধন দিবসে হিলারী ক্লিনটন বলেছিল যে, “অষ্ট্রেলিয়া হচ্ছে ভারত মহাসাগরের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযোগকারী সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও জ্বালানী পরিবহন রুটের প্রবেশদ্বার, অষ্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত জ্বালানী সম্পদ এই রুটগুলোর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে প্রবাহিত হয়ে থাকে।” সে আরো বলেছে, “এটা বিস্ময়কর নয় যে, বৈদেশিক বিনিয়োগ অষ্ট্রেলিয়াতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যার মধ্যে আমেরিকার বিনিয়োগের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, কারণ এটা বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এবং এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করা হচ্ছে আমেরিকার অন্যতম উদ্দেশ্য, যেটাকে আমরা কখনও কখনও Pivot to Asia’ বলে থাকি...”। সে আরো বলেছে, “আমেরিকা কখনো এশিয়াকে পরিত্যাগ করেনি, আমেরিকা এখনো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরাশক্তি এবং এটা বলবৎ থাকবে।” সে আরও উল্লেখ করে যে, “আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার ভবিষ্যতের জন্য এশিয়া-প্যাসিফিক ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে আমেরিকার চিন্তাধারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ” (আই.আই.পি. ডিজিটাল, ১১.১৫.২০১২)। এই সেন্টারে হিলারী ক্লিনটন ভারতের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারতের কাছ থেকে আমেরিকা কি চায় তা উল্লেখ করেছে। ভারতের “Look East” নীতিকে সমর্থন করা আমেরিকার কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সে বলেছে যে, “ভবিষ্যতে অষ্ট্রেলিয়া-ভারতের যৌথ নৌ-মহড়াকে আমেরিকা স্বাগত জানায় এবং ২০১৩ সালে অষ্ট্রেলিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে গঠিত ইন্ডিয়ান ওশেন রিম এসোসিয়েসনের সাথে আমেরিকা জোটবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসুক ও আমেরিকা এটাতে ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে যোগদান করেছে” (একই সূত্র)। এই পরিকল্পনাগুলো অঞ্চলটি নিয়ে আমেরিকার চিন্তাধারাকে পরিষ্কার করে। আমেরিকা এই অঞ্চলে চীনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য অষ্ট্রেলিয়াকে সক্রিয় খেলোয়ার হিসেবে দেখতে চায়। এটা আরো প্রমাণ করে যে, ভারতের মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেনি। দেশটি স্থলভাগে চীনের প্রতিবেশী এবং আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগরে ভারতের সাথে অষ্ট্রেলিয়াকে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে চায়। আমেরিকার নীতির সাথে অষ্ট্রেলিয়ার নীতি ভারতের চেয়ে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ পুঁজিবাদকে গ্রহণকারী একটি পশ্চিমাদেশ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর মতই উপনিবেশিকতার মাধ্যমে আধিপত্য করতে আগ্রহী। একারণেই অষ্ট্রেলিয়া যেভাবে বৃটেনের সাথে কাজ করেছে, সেভাবে সাম্রাজ্যবাদের স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকাকে সহযোগিতা করছে এবং অষ্ট্রেলিয়া বৃটেন-আমেরিকা উভয়ের সাথেই সম্পৃক্ত কারণ সে এই দুই দেশের কক্ষপথেই আবর্তিত হয়...।

৬. জাপানের ক্ষেত্রেঃ আমেরিকা জাপানে তার শক্তি বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং চীনের নিয়ন্ত্রণ হতে অঞ্চলটি রক্ষার জন্য জাপানকে আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ০৬.০৪.২০১৪ তারিখে আমেরিকা ঘোষণা দিয়েছে যে, সে জাপানে অতিরিক্ত মিসাইল প্রতিরক্ষা জাহাজ প্রেরণ করছে এবং আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব চাক হেগেল বলেছে যে, “২০১৭ সালের মধ্যে আমেরিকা জাপানে দুটি অতিরিক্ত এ.ই.জি.আই.এস ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা জাহাজ প্রেরণ করবে এবং এই পদক্ষেপটি হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার নতুন ধরনের পরমাণু পরীক্ষার হুমকির জবাব।” সে চীনকে তার বিপুল ক্ষমতা অপব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে, “মহান জাতির কখনো শক্তি প্রয়োগ এবং ভীতি প্রদর্শন করা উচিত নয়, কারণ এগুলো সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করে।” সে আরো বলেছে যে, “চীনের নিজস্ব সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে সে তার সাথে কথা বলতে চায় এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চায়” (রয়টার্স, ০৬.০৪.২০১৪)। সে চীনকে সতর্ক করার জন্য রাশিয়ার দিকে ইংগিত করে বলেছে যে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিয়ে যা করেছে চীনও জাপানের সাথে বিরোধপূর্ণ দ্বীপ নিয়ে একই ধরনের আচরণ করছে; সে বলেছে যে, “তোমরা সমগ্র বিশ্বে অভিযান পরিচালনা করতে পারনা এবং ভৌগলিক সীমারেখাগুলোকে পূনরায় নির্ধারণ করতে পারনা এবং শক্তি প্রয়োগ, চাপ প্রয়োগ ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে অগ্রাহ্য করতে পারনা, সেটা হোক প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট কোন দ্বীপ কিংবা ইউরোপের বড় কোন দেশ।” সে আরো বলেছে যে, “এছাড়াও ... আমি চীনের সাথে তার প্রতিবেশীদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে কথা বলব, শক্তি প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন খুবই মারাত্মক জিনিস, যা শুধুমাত্র সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়।” গত সপ্তাহে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেছে। বৈঠকে সে দক্ষিণ চীন সমুদ্র অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকার অধিকতর উদ্বেগের বিষয়ে সতর্ক করেছে (একই সূত্র)। জাপানের কিয়োডো নিউজ ০৫.০৪.২০১৪ তারিখে উল্লেখ করেছে, “এটা খুবই সম্ভাবনাময় যে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব এবং জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইটসুনারী ওনোডেরা সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে জাপানের আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়টি অনুমোদনের জন্য আলোচনা করবে। এর সাথে ওনোডেরা অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি হস্তান্তরের বিষয়েও আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিবের সাথে বৈঠকে আলোচনা করবে এবং উভয়পক্ষ প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদির বিষয়ে তাদের পারষ্পরিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছতে পারে।” এর অর্থ হচ্ছে যে, আমেরিকা চীনের নিয়ন্ত্রণ হতে এ অঞ্চল রক্ষার্থে জাপানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখতে চায়, যাতে করে তার উপর থেকে বোঝা লাঘব হয় এবং আমেরিকা এজন্যই জাপানীদের মাঝে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে চায়, যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে জাপানীরা আমেরিকা ব্যতিরেকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ক্ষমতা অর্জনের স্বপ্নকে লালন করবে।

৭. এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্র অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেস পার্টি কিংবা ভারতীয় জনতা পার্টির বিজয়ের ভূমিকার ক্ষেত্রেঃ সন্দেহ নেই যে এর ভূমিকা রয়েছে, কারণ কংগ্রেস পার্টি হচ্ছে এমন একটি দল যেটা সুদীর্ঘ সময় ধরে বৃটেনের প্রতি অনুগত। এর রাজনৈতিক বুদ্ধি বিবেচনা ওল্ড লেডি বৃটেনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এজন্য কংগ্রেস পার্টি আমেরিকার জন্য সমস্যা তৈরি করে এবং এটা বৃটেনের মতই পলায়নপর মনোভাবসম্পন্ন। যদিও দলটি কিছু কিছু সামরিক চুক্তি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাস্তবায়ন করে, তথাপি বিভিন্ন রাজনৈতিক সম্পর্ক ও কৌশলগত বিষয় মানতে চায় না, উদাহরণস্বরূপঃ কংগ্রেস পার্টি ২০০৪ সালে যে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, সেই নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারণায় আমেরিকার প্রতি তার মনোভাব স্পষ্ট করে বক্তব্য প্রদান করেছিল এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির নীতির সমালোচনা করেছিল। সেই বক্তব্যে বলা হয়েছিল, “এটা দুঃখজনক যে ভারতের মত একটি মহান রাষ্ট্র আমেরিকার আনুগত্য করার মত নিচু স্তরের সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যেখানে আমেরিকা ভারত সরকারের আনুগত্যকে নিজেদের পাওনা মনে করে। এজন্যই বিজেপি সরকার ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাজনিত স্বার্থের বিষয় জলাঞ্জলি দিয়ে আমেরিকার স্বার্থ ও নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে।” এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় যে কংগ্রেস পার্টি আমেরিকার জন্য কতটা সমস্যা সৃষ্টিকারক। এরপরও আমেরিকা-ভারত কৌশলগত সংলাপ বন্ধ হয়ে যায়নি এবং জুন ২০১০-এ তারা সংলাপে ফিরে যায়, যা ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে শুরু হয়েছিল। সংলাপ ফোরামে আমেরিকার প্রতিনিধিদলের প্রধান পররাষ্ট্র সচিব হিলারী ক্লিনটনের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়: “ভারত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং বিশ্বস্ত বন্ধু।” এজন্য যখন কংগ্রেস পার্টি আমেরিকার আনুগত্যকারী বিজেপিকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আরোহন করে তখন থেকেই চীনকে মোকাবিলায় আমেরিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতকে নিয়োজিত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, যদি না আমেরিকা ভারতকে বিশাল প্রাপ্তির দিকে প্রলুব্ধ করতে পারে এবং এটা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। যাই হোক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর ব্যাপারে ভারতের অনীহা নতুন কোন বিষয় নয়। বিজেপির সময়ও এমনটা ঘটেছিল, যদিও বিজেপি আমেরিকার নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি সামনে আনেনি। এটা জানা উচিত যে, কংগ্রেস পার্টি পুরোপুরি বৃটেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তার কাছেই তা হস্তান্তর করে যায় এবং আংশিকভাবেও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেনা। এর ব্যতিক্রম হয়েছে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নাতিদীর্ঘ সময়ে যখন আমেরিকার আনুগত্যকারী বিজেপি জয়লাভ করেছিল, এরপর আবার কংগ্রেস পার্টি ২০০৪-২০০৯ এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়।

০৭.০৪.২০১৪ তারিখে শুরু হওয়া নির্বাচনের ফলাফল ১৬.০৫.২০১৪ তারিখে ঘোষণা করা হবে। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল অনুযায়ী এমনটাই অনুমান করা যাচ্ছে যে, এ নির্বাচনে বিজেপি জোটই বিজয়ী হবে। যদি জনমত জরিপ সঠিক হয়ে থাকে তাহলে, বিজেপি জয়লাভ করে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারবে। তখন চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আমেরিকার পরিকল্পনা কংগ্রেস পার্টির শাসনামলের তুলনায় অধিকতর কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। যেরূপভাবে অতীতে আমেরিকা বিজেপির শাসনামলে সহজে তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল এবং কংগ্রেস পার্টির কয়েক দশকের শাসন অবসানের পরে আমেরিকা বিজেপির আমলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিল। আবার যখন ২০০৪ সালে কংগ্রেস পার্টি ক্ষমতায় আসে তখন তা ভারতকে ঘিরে আমেরিকার পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিতে থাকে এবং কংগ্রেস পার্টি আমেরিকার পরিকল্পনায় সহায়তা করার পরিবর্তে সুবিধাজনক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে কৌশলে আমেরিকাকে পরিহার করতে থাকে।

৮. চীন এবং ভারতের মধ্যে তুলনায়, চীন অনেকগুলো ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেঃ চীন যদিও রাষ্ট্র হিসেবে তার আদর্শ বাস্তবায়ন করে না এবং পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক নীতিতে তার আদর্শকে অন্তর্ভূক্ত করে না, সেই সাথে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়েও সে তার আদর্শকে পরিত্যাগ করে থাকে, তথাপি চীন তার শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে কমিউনিষ্ট পার্টির নাম ব্যবহার করে, যাতে করে পার্টির ও পার্টির সদস্যদের স্বার্থ এবং রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। এগুলোই চীনকে একটি অবিভক্ত রাষ্ট্রে কিংবা শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রের কক্ষপথে আবর্তিত পরনির্ভর দেশে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে চলেছে এবং স্বাধীনভাবে নিজস্ব নীতিসমূহ বাস্তবায়নে সক্ষম রেখেছে। ফলশ্রুতিতে এটি এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যেটি বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হওয়ার আকাঙ্খা করে। জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং যুবক অফিসারদের প্রশিক্ষণ দানকারী কর্ণেল লি. মিনগো তার লেখা “দি চাইনিজ ড্রিম” নামক বইতে এটা প্রকাশ করেছে। সে চীনকে সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করার আহ্বান জানিয়ে বর্তমান বিশ্বের নায়ক আমেরিকাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য দ্রুত অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দিয়েছে, চাইনিজদের অপমানকর অবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়ে সম্মানজনক অবস্থায় আরোহণ করে বিশ্বের এক নম্বর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সে বলেছে যে, চীন যদি একুশ শতকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত হতে না পারে এবং একটি পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের উত্থান ঘটাতে না পারে, তাহলে এটি সুনিশ্চিতভাবেই একটি নিম্নস্তরের রাষ্ট্রে পরিণত হবে…… চীনের শক্তি ও চ্যালেঞ্জ করার মনোভাব দু’টিই রয়েছে। চীনের উদ্দেশ্য যদি শুধুমাত্র নিজের এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং কেবলমাত্র নিজস্ব অঞ্চলে আমেরিকার গতিবিধির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আমেরিকাকে মোকাবেলা করার চিন্তায় সীমাবদ্ধ না থাকে এবং চীন যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুঁজিবাদকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে শুরু না করে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে... তাহলে সে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি জোড়ালো ভূমিকা রাখার ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হতে পারে এবং এটা আমেরিকার স্বার্থের উপর খুব শক্তিশালী আঘাত হবে। যা হোক, চীনের একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে এবং সে তার নিজস্ব অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, ভারতের রাষ্ট্র হিসেবে কোন আদর্শ নেই এবং আদর্শ থেকে উৎসারিত কোন চিন্তাধারাও নেই। শুধুমাত্র পশ্চিমাদের, বিশেষ করে বৃটেনের আনুগত্য নিশ্চিতের জন্য সে পুঁজিবাদ বাস্তবায়ন করে এবং এই আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, ভারত জেগে উঠবে কিংবা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোতে যেভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাদ বাস্তবায়িত হয়েছে, ঠিক একইরকম ভাবে ভারতেও সেটা ঘটেছে এবং এখনও চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই কারণে তারা স্বাধীন হওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করছে না এবং শক্তিশালীভাবে, দ্রুততার সাথে ও নিজস্ব বিচার বিবেচনার সাথে কাজ করার কোন আগ্রহও তাদের নেই। ভারত একটি অধঃস্তন তাবেদার রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে এবং এর পরিকল্পনা ও নীতি স্বাধীন বা অন্যের প্রভাবমুক্ত নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর গতিবিধি খুবই ধীরগতিসম্পন্ন, যা সবসময় অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা নেই এবং এর উদ্যোগ নিতেও সে সক্ষম নয়, বরং এটি হয় বৃটেনের নতুবা প্রথম প্রভূ আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন। এজন্যই এই ক্ষেত্রে ভারত চীনের চেয়ে ব্যতিক্রম; ভারত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনগ্রসরমান এবং যে কোন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তির মাপকাঠিতে তারা বিশৃঙ্খল ও যেসব ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে কাজ করছে, তারাও কোন ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। তাই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি সর্বক্ষেত্রে আসন গেড়ে বসেছে এবং সকল রাজনীতিবিদদের গ্রাস করে যাচ্ছে। ভারতের পক্ষে একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া খুবই কঠিন এবং এটা ভবিষ্যতে সর্বোচ্চভাবে আমেরিকা বা বৃটেন কিংবা উভয়ের মতো কোন বৃহৎ আদর্শিক রাষ্ট্রের কক্ষপথে আবর্তিত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।

উপরোক্ত আলোচনাটি ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত-চীনের তুলনামুলক বাস্তবতা; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বলা যায় যে, চীনের অর্থনীতি ভারতের অর্থনীতির তুলনায় চার গুণ বৃহৎ, যেখানে চীন তার দেশের দারিদ্র সীমা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে বিশ্বের ৬৬% গরীব লোক ভারতের নাগরিক। ভারত চীনের সাথে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারবে না। চীন একটি বৃহৎ শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে, যা তাকে বিপুল পরিমান নগদ টাকার সঞ্চয় এনে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে সে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। চীনের তুলনায় ভারত উৎপাদন সক্ষমতা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ভারী যন্ত্রপাতি তৈরী এবং আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর মানে এটা নয় যে, ভারতে এসবের কিছুই নেই বরং তারা চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে...

সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, চীনের আনুষ্ঠানিক সামরিক বাজেটের পরিমান হচ্ছে ১১৯ বিলিয়ন ডলার, যেটা ভারতের ৩৮ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় তিন গুণ বেশি। চীন তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এখন তারা নিজেদের জন্য বিশালাকৃতির সামরিক গুদাম তৈরী করছে, যেখানে জাহাজ, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমানের মতো সামরিক সরঞ্জামাদি তৈরী ও সংরক্ষনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং নিজস্ব নৌ-বহর সম্প্রসারণ করেছে, যা এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যাই হোক, ভারত সম্প্রতি সামরিক আধুনিকায়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকল্পে অর্থের সংস্থানে সক্ষমতা অর্জনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যদিও তা অনেক ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। ভারত এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলোর অন্যতম এবং ভারতের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা অর্জনের দুই দশকের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ষ্টকহোমের আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইন্সটিটিউটের একজন উচ্চপদস্থ গবেষক পিটার ডি. ওয়াইজম্যান বলেছেন, “আমি মনে করি না বিশ্বে এমন কোন দেশ রয়েছে যেটা ভারতের মতো আন্তরিকভাবে অস্ত্র তৈরীর চেষ্টা করে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে” (‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারত আভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অস্ত্র কিনতে চায়’, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, মার্চ ২০১৪)। সুতরাং, চীন ভারতের তুলনায় ক্ষমতার মাপকাঠিতে অনেকখানিই এগিয়ে রয়েছে ...

৯. পরিশেষে, পাকিস্তানের সাথে ভারতের পশ্চিম সীমানা সুরক্ষিত করে দেয়ার পরে চীনের সাথে বিরোধপূর্ণ উত্তর ফ্রন্টে যুদ্ধ করার জন্য ভারতকে ঠেলে দিতে আমেরিকা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, পাকিস্তানের আমেরিকাপন্থী শাসকেরা বিজেপির আমলে ভারতকে অনেক সুবিধা প্রদান করেছিল, কারণ বিজেপিও আমেরিকাপন্থী একটি দল। যখন কংগ্রেস পার্টি ক্ষমতায় ফিরে আসে তখন এই উদ্যোগে ভাটা পড়ে এবং ভারতের চীনকে মোকাবিলা করার ভীতি ও সাম্প্রতিক সময়ের চীনের হুমকির প্রেক্ষিতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠিত হয়। আরও কারণ হচ্ছে যে, এই পার্টি বৃটেনের প্রতি অনুগত এবং বৃটেন কংগ্রেসকে আমেরিকার পরিকল্পনা অনুসরণ করতে নিরুৎসাহিত করে। আমেরিকা ভারতকে পূর্ব দিকে, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দক্ষিণ চীন সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হতে চাপ প্রয়োগ করে এবং সেখানকার তেল-গ্যাস জ্বালানী সম্পদের ভাগ নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ভিয়েতনামের সাথে একজোট হয়ে কাজ করার ব্যাপারে রাজি করায় এবং ভিয়েতনামেরও সেই সম্পদের উপর দাবি রয়েছে ও স্প্র্যাটলি দ্বীপ নিয়েও চীনের সাথে তার বিরোধ চলছে... আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়াকেও অনেকগুলো দেশের সমন্বয়ে জোট গড়ে তোলার মাধ্যমে চীনকে মোকাবিলার নিমিত্তে এই অঞ্চলের দিকে ধাবিত করছে... আমেরিকা জাপানকে তার প্রতিরক্ষার বিষয়ে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে করে তার বোঝা লাঘব হয়। যদি নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করে এবং আবার ক্ষমতায় পৌছায়, তাহলে পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার সাথে ভারতের কার্যক্রম আরও বেগবান হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। চীন-ভারতের তুলনার ক্ষেত্রে: চীন শক্তির তুলনায় ভারতের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে... এবং চীনের উদ্দেশ্য যদি শুধুমাত্র নিজের এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং কেবলমাত্র নিজস্ব অঞ্চলে আমেরিকার গতিবিধির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আমেরিকাকে মোকাবেলা করার চিন্তায় সীমাবদ্ধ না থাকে... এবং চীন যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুঁজিবাদকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে শুরু না করে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে... তাহলে সে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি জোড়ালো ভূমিকা রাখার ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হতে পারে এবং এটা আমেরিকার স্বার্থের উপর খুব শক্তিশালী আঘাত হবে।

No comments:

Post a Comment