22.8.14

প্রশ্নঃ মুসলিমদের কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা কি শরী’য়াহ সম্মত?

প্রশ্নঃ

মুসলিমদের কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা যে নিষিদ্ধ তা নিয়ে গবেষণা করতে গেলে কেউ একজন আমাকে বলল, তিনি কোন একজন আলেমের কাছে শুনেছেন যে, ইউসুফ (আ.) মিশরের শাসকের অধীন শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেছেন; তাঁর উদাহরণ দিয়ে তিনি একে বৈধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অতঃপর, আবিসিনিয়ার শাসকের নাজ্জাশী একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কুফর ব্যবস্থায় শাসন করেছেন এবং রাসূল (সাঃ) তার জন্য জানাজা পড়েন। অন্যদিকে মাসলাহাও (উম্মাহর স্বার্থ) একটি শারী’আহ দলীল, যা এ অংশগ্রহণকে অনুমোদন দেয়। একজন মুসলিম, শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করলে তিনি একজন সেক্যুলার ব্যক্তির চেয়ে মুসলিমদের স্বার্থ বেশি নিশ্চিত করতে পারেন।

প্রশ্ন হলো এই দলিলগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত? এটা কি সত্য যে, এমন আলেমও আছেন যিনি এটাকে সমর্থন করেন? দয়া করে এর উত্তর দেবেন। আল্লাহ আপনাকে উত্তমরূপে পুরস্কৃত করুন।

উত্তরঃ

হ্যাঁ, সরকারপন্থী অনেক আলেম এ ধারণার পক্ষে। তারা দলিলের ওপর ভিত্তি করে কথা বলেন না। কেননা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার মাধ্যমে শাসনের পক্ষে সুষ্পষ্ট প্রমাণ ও সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা দ্বারা শাসন করা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ

“আর আপনি আল্লাহ যা অবতীর্ন করেছেন তা দিয়ে তাদের মাঝে ফায়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সত্য এসেছে, তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না।” [আল মায়িদাহঃ ৪৮]

এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ

“আর আপনি আল্লাহ্ যা অবতীর্ন করেছেন তা দিয়ে তাদের মাঝে ফায়সালা করুন, আর তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন; যেন তারা আপনার নিকট আল্লাহর প্রেরিত কোন বিধান থেকে আপনাকে বিচ্যুত করতে না পারে।” [আল মায়িদাহঃ ৪৯]

এ রকম একই অর্থ বহন করে এমন অনেক দলিল রয়েছে।

আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা কুফর, যদি শাসক এসবে বিশ্বাস করে। এটা জুলুম বা ফিসক (সীমালঙ্ঘন) শাসক যদি এতে বিশ্বাস না করে।

আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বক্তব্যে এটা স্পষ্ট,

“এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই কাফির।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৮]

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ

“এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই যালিম।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৫]

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ

“এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই ফাসেক।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৭]

সরকারপন্থী ওলামারা তাদের প্রমাণ হিসেবে যা তুলে ধরেন তার কোন ভিত্তি নেই। আমাদের বক্তব্যের প্রমাণ হলোঃ

১. ইউসুফ (আ.) এর কর্মকে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করে যুক্তি দেয়া হয় যে, তিনি মিশরের রাজার আইন অনুযায়ী শাসন করেছেন, অর্থাৎ আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে। কোন প্রেক্ষাপট ছাড়াই এই যুক্তির অবতারণা। কারণ আমরা রাসূল (সাঃ) কর্তৃক আনীত ও আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ইসলাম অনুসরণ করার জন্য আদিষ্ট। আমাদেরকে ইউসুফ (আ.) বা অন্য কোন নবীর শারী’আহ অনুসরণ করতে বলা হয়নি। কারণ আমাদের পূর্বের লোকদের আইন আমাদের জন্য নয়। ইসলাম এগুলোকে মানসূখ (রহিত) করে দিয়েছে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ

“আমি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি (হে মুহাম্মদ!) এর পূর্বে নাযিলকৃত কিতাবের সমর্থক ও অন্যগুলির ওপর মাপকাঠি। সুতরাং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা দিয়ে শাসন করুন এবং যে সত্য আপনার নিকট এসেছে তা ত্যাগ করে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট শারী’আহ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৮]

‘অন্যগুলির ওপর মাপকাঠি’ মানে, এটি অন্যসব কিতাবকে মানসূখ করে দিয়েছে। ইসলাম পূর্বের সকল কিতাবকে মানসূখ করে দিয়েছে, তাই পূর্বের লোকদের আইন আমাদের জন্য আইন নয়। উসূলবিদদের অনেক আলেম আছেন যারা এই নীতিকে অন্যভাবে গ্রহণ করেছেনঃ

“আমাদের পূর্বের লোকদের আইন আমাদের জন্য আইন হিসেবে থাকবে, যতক্ষণ না তা মানসূখ হয়ে যায়।”

এই নীতি, পূর্বের নবীদের আইনকে দলিল হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম কর্তৃক মানসূখ হয়ে যায়নি এমন বিষয়সমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে। যে সকল বিষয় ইসলাম কর্তৃক মানসূখ হয়ে গিয়েছে, সেসব পূর্বের আইন গ্রহণ নিষিদ্ধ। আমাদের শারী’আহ অনুযায়ী আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করা ইসলামের সুষ্পষ্ট হুকুম। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এমন পূর্বের সকল আইন রহিত। উসূলের সকল আলেম, হোক তারা প্রম নীতি “আমাদের পূর্বের লোকদের আইন আমাদের আইন নয়” অথবা দ্বিতীয় নীতি “আমাদের পূর্বের লোকদের আইন আমাদের জন্য আইন হিসেবে থাকবে, যতক্ষণ না তা মানসূখ হয়ে যায়” গ্রহন করুক, তারা সকলেই আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা দিয়ে শাসন করা বাধ্যতামূলক হিসেবেই দেখেন। কেননা এগুলো ইসলামে সুষ্পষ্টভাবেই রয়েছে, যার বক্তব্য সুষ্পষ্ট ও প্রমাণ অকাট্য। ইসলাম পূর্বের আইনসমূহ রহিত করে, যদি তা শারী’আহ দলিলের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।

ইউসুফ (আ.) কিছু বিষয়ে মিশরের শাসনকর্তার আইন অনুযায়ী শাসন করেছেন, সরকারপন্থী ওলামাদের এই অনুমান মেনে নিয়েই আমরা পূর্বের কথাগুলো বলেছি। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন নবী এবং নিষ্পাপ, সুতরাং তিনি আল্লাহ যা তাঁর প্রতি নাযিল করেছেন, তা দিয়েই শাসন করেছেন। যেমনি আল্লাহ জেলের মধ্যে তাঁর (আ.) দু’সহচরের সাথে কথোপকথোন বর্ণনা করেছেন, যেখানে তিনি (আ.) বলেছেনঃ আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন গ্রহণযোগ্য নয়।”

“হে কারা সংগীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তাঁকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতকগুলি নামের ইবাদত করছ, যেই নামগুলি তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ, এইগুলির কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠাননি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহই। তিনি আদেশ দিয়েছেন অন্য কারো ইবাদত না করতে, কেবল তাঁর ব্যতীত, ইহাই শ্বাশত দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ইহা অবগত নয়।” [সূরা ইউসুফঃ ৩৯-৪০]

ষ্পষ্টতঃ ইউসুফ (আ.) বললেনঃ “বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই।”

এজন্য শাসন কেবল বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহরই জন্য, যাকে মুসলিমরা ইবাদত করে এবং যার শারী’আহ গ্রহণ করেছে এবং যার সাথে অন্য কারো শরীক করেনা।

ইউসুফ (আ.) এর কর্ম তাঁর কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয়, এর কোন মানে নেই যে, তিনি বলবেন আল্লাহ ছাড়া কোন বিধান দাতা নেই এবং নিজে কুফর শাসনে পরিচালিত হবেন। এই যুক্তি হলো আল্লাহর অন্যতম নবীর নিষ্পাপতার প্রতি এক ধরণের আক্রমণ এবং আল্লাহর অবমাননা করা; যা একটি ভয়াবহ বিষয়। এ থেকে বলা যায়, ইউসুফ (আ.) কুফর দ্বারা শাসন করেননি, আল্লাহ তার প্রতি যা নাযিল করেছেন, তিনি তা দ্বারা শাসন করেছেন, তিনি আল্লাহর কাছে সত্যবাদী এবং নিষ্ঠাবান। তারপরও আমরা যদি আলোচনার স্বার্থে ধরেও নেই যে, আল্লাহ ইউসুফকে (আ.) তাঁর শারী’আহ-তে মিশরের শাসকের কিছু বিধান প্রয়োগ করার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন, এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইসলাম পূর্বের আইন বাতিল করে দিয়েছে, রাসূল (সাঃ) এর বার্তা পাবার পর অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করোনা, আমাদের জন্য শুধু রাসূল (সাঃ) প্রদর্শিত ইসলাম বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, অন্য কিছু নয়।

২. নাজ্জাশীর ঘটনা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারও প্রেক্ষাপটের বাইরে। কেউ যদি এ বিষয়ে সঠিকভাবে গবেষণা করে, তাহলে দেখতে পাবে নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণের পূর্বে রাজা ছিলেন। তিনি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন ও অল্প কিছুদিন পরেই মারা যান। তিনি ইসলাম বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি এবং তার ইসলাম গ্রহণ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেবার সাহস পাননি কেননা তার জনগণ ছিল কাফির। এই ঘটনা এমন কোন মুসলিমের ক্ষেত্রে করা প্রয়োগ যায় না যেখানে সে সকলের কাছে মুসলিম বলে পরিচিত। বিস্তারিত আলোচনা নিম্নে তুল ধরা হলোঃ

ক. আবিসিনিয়ার শাসকের নাম নাজ্জাশী নয়, আবিসিনিয়ার শাসকদের উপাধি নাজ্জাশী ছিল। তাকে নাজ্জাশী বলা হতো, যেমনি পারস্যের শাসকদের কিসরা এবং রোমানদের বলা হতো কায়সার। যে নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করে ও রাসূল (সাঃ) যার জন্যে দু’আ করেন, তার ইসলাম গ্রহণের সময়কাল খুব বেশি দিন ছিলনা, যেমনি উল্লেখিত প্রশ্নে অনুমান করা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করার পর তার বেঁচে থাকার সময়কাল ছিল খুবই কম Ñ দিন কয়েক বা এক-দু’ মাস। তিনি সেই নাজ্জাশী নন যার কাছে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিযরত করে গিয়েছিল, তিনি সেই নাজ্জাশীও নন যার কাছে রাসূল (সাঃ) হুদাইবিয়ার সন্ধির পর আমর বিন উমাইয়া আয-যামিরিকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অন্য এক নাজ্জাশী, যার কাছে রাসূল (সাঃ) দূত পাঠিয়েছিলেন, তার পরে এই নাজ্জাশী ক্ষমতায় এসেছিলেন।

এই বিষয়ে বর্ণনা বুখারী ও মুসলিম শরিফে পাওয়া যায়। যারা মনে করেন মক্কা থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করে নাজ্জাশীর দরবারে গিয়েছিল, তিনি সেই নাজ্জাশী যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তারা ভুল করছেন। অথবা যারা মনে করেন রাসূল (সাঃ) যার কাছে হুদাইবিয়ার সন্ধির পর চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি সেই নাজ্জাশী, তারাও ভুল করছেন কেননা এগুলো বুখারী ও মুসলিম শরিফের বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক। তার প্রমাণ হলোঃ

মুসলিম বর্ণনা করেন কাতাদা থেকে, যিনি বর্ণনা করেন আনাস (রা.) থেকেঃ “রাসূল (সাঃ) কায়সার, কিসরা, নাজ্জাশী এবং সকল অত্যাচারী শাসকের কাছে চিঠি লিখেছিলেন আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেবার জন্য এবং সেই নাজ্জাশী নয়, যার জন্য রাসূল (সাঃ) দু’আ করেছিলেন।”

তিরমিযি বর্ণনা করেন কাতাদা থেকে, যিনি বর্ণনা করেন আনাস (রা.) থেকেঃ “রাসূল (সাঃ) তাঁর ইন্তিকালের পূর্বে কিসরা, কায়সার, নাজ্জাশী এবং সকল অত্যাচারী শাসককে আল্লাহর আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন এবং সেই নাজ্জাশী নয়, যার জন্য তিনি দু’আ করেছিলেন।”

মুসলিম ও তিরমিযির হাদিস থেকে স্পষ্ট রাসূল (সাঃ) যে নাজ্জাশীর জন্য দু’আ করেছিলেন ও যার কাছে চিঠি লিখে দূত পাঠিয়েছিলেন, এরা এক নাজ্জাশী নয়।

খ. রাসূল (সাঃ) হুদাইবিয়াহ থেকে ফিরে এসে শাসকদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন, যা ছিল হিযরতের ৬ষ্ঠ বছরের জিলক্বদের পরে। যে নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সে নাজ্জাশীর কাছে তিনি (সাঃ) চিঠি পাঠাননি। তিনি সেই নাজ্জাশী, যিনি হিযরতের ৭ম বছরের দিকে ক্ষমতায় এসেছিলেন।

গ. আবু হুরায়রা (রা.) রাসূল (সাঃ) এর সাথে ছিলেন যখন তিনি নাজ্জাশীর জন্য দু’আ করছিলেন, যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, হাদিসের বর্ণনা মোতাবেক। আবু হুরাইরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং দাওস থেকে ৭০-৮০ জনের প্রতিনিধি নিয়ে মদীনায় এসছিলেন যখন রাসূল (সাঃ) খাইবারে ছিলেন। তাই তিনি সেখানে গিয়ে তাঁর (সাঃ) সাথে দেখা করলেন। রাসূল (সাঃ) খাইবারের গণিমতের মালের কিছু অংশ তাদের দিলেন। খাইবারের যুদ্ধ হিজরী ৭ম সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার মানে নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণ করেন ও শাসক হন হিজরী ৭ম সালের মধ্যেই এবং সে বছরই মারা যান। তিনি বেশি দিন বেঁচে থাকেননি।

ঘ. আবিসিনিয়া ছিল কুফর খৃষ্টানদের আবাসভূমি। তাদের শাসক ইসলাম গ্রহণ করেছিল সকলের অজান্তে, এমনকি নবী (সাঃ) এর অজান্তে, তিনি নাজ্জাশীর মৃত্যুর খবর ওহীর মাধ্যমে জেনেছিলেন। তার জন্য দু’আ করার বিষয়ে যে হাদিস এসেছে, তা এর দলিল।

বুখারী আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণনা করেনঃ “আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নাজ্জাশীর মৃত্যুর খবর ঐদিনই সাথে সাথে জানিয়ে দিলেন। তিনি (সাঃ) মুসাল্লায় (নামাজের জায়গা) গেলেন এবং সকলে তাঁর পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি ৪ তাকবির পাঠ করলেন (জানাজার নামাজ)।”

অন্য বর্ণনায়ঃ “আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নাজ্জাশীর মৃত্যুর পর ঐদিনই আমাদের জানালেন। তিনি বললেনঃ তোমাদের ভাইয়ের গুণাহ মাফের জন্য দু’আ কর।”

বুখারী জাবির বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “‘আজ এক সৎকর্মশীল লোক মারা গেছে, তাই তার জন্য দু’আর উদ্দেশ্যে জড়ো হও।’ তিনি বলেনঃ আমরা রাসূল (সাঃ) এর পেছনে লাইনে দাঁড়ালাম এবং জানাজা পড়লাম’”; জাবির থেকে আবু আয-যুবাইর বলেনঃ “আমি ছিলাম দ্বিতীয় সারিতে।” জাবির এর অন্য এক বর্ণনায়ঃ যখন নাজ্জাশী মারা গেল তখন রাসূল (সাঃ) বলেনঃ আজ এক সৎ লোক মারা গেছে, তাই আসামার (নাজ্জাশীর নাম) জন্যে জড়ো হও’”

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নাজ্জাশীর মৃত্যুর খবর ঐদিনই সাথে সাথে জানিয়ে দিলেন। তিনি বললেনঃ “তোমাদের ভাইয়ের গুণাহ মাফের জন্য দু’আ কর। আজ এক সৎকর্মশীল লোক মারা গেছে, তাই তার জন্য দু’আর উদ্দেশ্যে জড়ো হও।” অর্থাৎ নাজ্জাশী যেদিন মারা গেলেন, তার মৃত্যুর ঘোষণা হল কিন্তু তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ায় এবং রাসূল (সাঃ) ছিলেন মদিনায়, যার মানে তিনি ওহীর মাধ্যমে জানলেন এবং রাসূল (সাঃ) এর বক্তব্যঃ “তোমার ভাইয়ের গুণাহ মাফের জন্য দু’আ কর আজ এক সৎকর্মশীল লোক মারা গেছে” এর মানে তাদের কাছে নাজ্জাশীর মৃত্যু ও ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে সংবাদ জানা ছিলনা। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাধারণত যখন কোন সাহাবী (রা.) মারা যেতেন তখন তাদের জানাযার নামাজের জন্য এভাবে আহ্বান করতেন না।

ঙ. এজন্য নাজ্জাশীর ঘটনা এই বাস্তবতার সাথে মিল নেই। নাজ্জাশী গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তার জনগণ ছিল কাফির, তিনি কিছুদিনের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন, ওহী ছাড়া কেউ তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানত না। এই ঘটনা, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ভিন্ন অন্য কিছু দিয়ে একজন মুসলিমের কুফর শাসনে অংশ্রহণের সাথে মিল নেই। যারা একে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে থাকেন, তাদের কোন প্রমাণ নেই, এমনকি কোন সন্দেহযুক্ত প্রমাণও।

৩. মাসলাহাকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার প্রেক্ষাপটের বাইরে, আমরা যেভাবে বিষয়টি দেখি Ñ কিছু উসূলের আলেম যারা মাসলাহাকে (উম্মাহর স্বার্থ) প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, তারা এর সাথে এক শর্ত যুক্ত করেন তা হলো, মাসলাহা গ্রহণ করা যাবে যদি শারী’আহ এ ব্যাপারে আদেশ বা নিষেধ না করে থাকে। যদি এ ব্যাপারে শারী’আহ-এর আদেশ অথবা নিষেধ বিদ্যমান থাকে তাহলে মাসলাহার নিয়ম কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে শারী’আহতে উল্লেখিত বিধানই গ্রহণযোগ্য। উসূলের কোন বিখ্যাত আলেমই আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত আয়াত বা বিধান রহিত করে উম্মাহর স্বার্থ গ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি দেননি।

সুদ হারাম, যা শারী’আহ-এর দলিল দ্বারা প্রমাণিত। উম্মাহর স্বার্থের কারণে যদি সুদ দরকার হয়, এটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কেননা শারী’আহ একে হারাম ও পরিত্যাগ করেছে। এমনকি যদি কোন তথাকথিত আলেম সুদ গ্রহণযোগ্য বলে ফাতওয়া দেয়, তাদের ফাতওয়া অগ্রহণযোগ্য, কেননা এটা আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক।

আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ভিন্ন অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা সুষ্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, ঠিক হারাম হওয়া সুদের মতই, কেননা এটা ওহীর মাধ্যমে এসেছে। সুতরাং এখানে উম্মাহর স্বার্থের কোন স্থান নেই, বরং শারী’আহ যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে তাই উম্মাহর জন্য স্বার্থ, এর উল্টোটা নয়।

এমনকি উসূলের আলেমরা, যারা ভুলবশত মাসালিহ মুরসালাকে গ্রহণ করেছেন, তাদের মাযহাবে একে কোথাও উৎস হিসেবে পেশ করেননি। বাস্তবে মাসালিহ মুরসালা বলতে কিছু নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন শারী’আহ কিছু বিষয়ের আইন দেয়নি এবং এসব ক্ষেত্রেই তারা মাসলাহা ব্যবহার করে থাকেন। বাস্তবে ইসলাম কোন বিষয়কে ব্যাখ্যা করা ছাড়া ছেড়ে দেয়নি, সব বিষয়ের ওপরই ইসলামের নিয়ম রয়েছেঃ

“এবং আমি এই কিতাব সকল কিছুর ব্যাখ্যা হিসেবেই পাঠিয়েছি।” [সূরা আন নাহলঃ ৮৯]

“আমরা এ কিতাবে কোন কিছুই অব্যক্ত রাখিনি।” [সূরা আল আনআমঃ ৩৮]

“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৩]

৪. উপসংহারে বলা যায়, কুফর ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ এবং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা কুফর, যদি শাসক এসব কুফর বিধানে বিশ্বাস করে। শাসক যদি কুফর বিধানে বিশ্বাস না করে, তা দিয়ে শাসন করে, তাহলে তা হবে অন্যায়-অবিচার ও সীমালঙ্ঘন।

“এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই কাফির।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৮]

“এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই জালিম।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৫]

“এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারাই ফাসেক।” [সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৭]

যারা বলে যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য শাসনব্যবস্থায় মুসলিমদের অংশগ্রহণ বৈধ, তাদের কোন দলীল নেই। এমনকি কোন সন্দেহযুক্ত দলিলও। কেননা যে দলিল এ বিষয়টিকে নিষিদ্ধ করে তা প্রমাণ ও বক্তব্যের দিকে থেকে সন্দেহাতীত।

আশা করি এই উত্তর সম্পূর্ণ, পরিষ্কার এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তোষজনক।


৪ রজব, ১৪৩৫ হিজরী
৩ মে, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ

No comments:

Post a Comment