21.8.14

হিযবুত তাহরীর-এর দ্বিতীয় আমীর শাইখ আবদুল কাদিম যাল্লুম

তাঁর নাম শাইখ আবদুল কাদিম বিন ইউসুফ বিন ইউনিস বিন ইবরাহীম আল শাইখ যাল্লুম এবং তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত মনীষী। হিজরী ১৩৪২ অর্থাৎ ১৯২৪ সালে ফিলিস্তিনের আল-খলিল শহরে তাঁর জন্ম। দ্বীন চর্চার জন্য তাঁর পরিবারের অনেক খ্যাতি ছিল। তাঁর পিতা একজন কুরআনের হাফিজ ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কুরআন তিলাওয়াতে নিমগ্ন ছিলেন। উসমানী খিলাফতের সময় তাঁর পিতা একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পিতার চাচা আবদুল গাফফার ইউনিস যাল্লুম উসমানী খিলাফতের সময়ে আল খালিল শহরে মুফতি ছিলেন।

যাল্লুম পরিবার মূলতঃ সেসব পরিবারের অন্তর্ভূক্ত যারা ইবরাহীমী মসজিদের অভিভাবক এবং এই পরিবার ইয়াকুব (আঃ) এর অন্যতম খাদেম। এই পরিবার শুক্রবারসহ অন্যান্য বিশেষ দিনে মসজিদের মিম্বরে ইসলামী পতাকা উত্তোলনের দায়িত্ব পালন করতো। উসমানি খিলাফত আল-খলিল শহরের বিখ্যাত পরিবারগুলোকে ইবরাহীমী মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক নিয়োজিত করত এবং তাঁরা এ দায়িত্বকে অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের বিষয় মনে করত।

শাইখ আবদুল কাদিম যাল্লুমের জীবনের প্রথম পনের বছর আল-খালিল শহরে অতিবাহিত হয়। আল খালিলের ইবরাহীমী মাদ্রাসা হতে তিনি মৌলিক শিক্ষা অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর পিতা তাঁকে ইসলামী আইনশাস্ত্র বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য আল আযহারে প্রেরণ করেন। তাই ১৫ বছর বয়সে তিনি আল আযহারের উদ্দেশ্যে কায়রো শহরে পাড়ি জমান। হিজরী ১৩৬১ তথা ১৯৩৯ সালে তিনি আল আযহার থেকে তাঁর প্রথম ডিগ্রি শাহাদাত আল আহলিয়াত আল ঊলাঅর্জন করেন। হিজরী ১৩৬৬ বা ১৯৪৭ সালে তিনি আল আযহার হতে আল আলিয়া লি কুলইয়াত আল শারীআহএবং হিজরী ১৩৬৮ বা ১৯৪৯ সালে তিনি শাহাদাত আল আলামিয়াডিগ্রি অর্জন করেন এবং ইসলামী আইন শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হন, যা পিএইচডি ডিগ্রির সমতুল্য।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের সময় তিনি মুসলিমদের একটি দল সংগঠিত করেন এবং মিশর ছেড়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে ফিলিস্তিনে গমন করেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছার পর তিনি জানতে পারেন যে, যুদ্ধ থেমে গিয়েছে এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। যার ফলে ফিলিস্তিনে তাঁর জিহাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। শাইখ যাল্লুম আল আযহারে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিলেন এবং তাঁকে রাজা (মুলক) বলে ডাকা হত। তিনি একজন সুপরিচিত ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৯ সালে আল খালিলে ফিরে এসে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। বেথলেহেম মাদ্রাসার সাথে তিনি দুবছর সংযুক্ত ছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯৫২ সালে আল খালিলে স্থানান্তরিত হন এবং উসামা বিন মাআকিজনামক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।

১৯৫২ সালে তিনি শাইখ তাক্বি উদ্দীন আন-নাবাহানির সংস্পর্শে আসেন এবং আল কুদসে একটি হিযব (দল) গঠনের বিষয়ে শাইখ তাক্বি উদ্দীন আন-নাবাহানির সাথে তাঁর অনেক তর্ক-বিতর্ক এবং জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। এরপর থেকে তিনি এই পবিত্র শহরে প্রায়ই আসতে থাকেন। যেদিন থেকে হিযবুত তাহরীর-এর কাজ শুরু হয় সেদিন থেকেই তিনি হিযব-এ যোগদান করেন। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত বক্তা এবং মানুষ তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসত। শুক্রবারে যখন তিনি ইবরাহীমী ইউসুফিয়া মসজিদে খুতবা দিতেন, তখন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সংখ্যক লোক এসে জড়ো হতো তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য। শুক্রবারের নামাজের পর যখন তিনি ইবরাহীমী মসজিদে বয়ান করতেন তখনও প্রচুর লোক সমাগম হত। ১৯৫৪ সালের জনপ্রতিনিধি সভার নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। এইভাবে ১৯৫৬ সালেও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু সরকার নির্বাচনে কারচুপি করে তাঁকে পরাজিত ঘোষণা করে। অতঃপর তাঁকে গ্রেফতার করে আল জাফর আল সাহারায়ী কারাগারে প্রেরণ করে। সেখানে তিনি বহু বছর কাটানোর পর আল্লাহর সহায়তায় মুক্তি পান।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর প্রতি সদয় হন, তিনি ছিলেন হিযব-এর প্রতিষ্ঠাতা নেতৃত্বের ডান হাত। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতার ধনুকের তীর, উচ্চ পর্যায়ের ঝটিকা সফরে তিনি তাঁর ওপর আস্থা রাখতেন। তিনি নির্দ্বিধায় সর্বদা ইসলামের দাওয়াহর কাজকে তাঁর পরিবার ও এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বিলাসিতা থেকে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। একদিন হয়তো তাঁকে তুরস্কে পাওয়া গেল, পরের দিনই তিনি চলে গেলেন ইরাকে, তার পরদিন আবার গেলেন মিশরে, এরপর গেলেন জর্ডানে বা লেবাননে, এভাবেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। যেখানেই তাঁর প্রয়োজন পড়েছে, হক কথা বলার জন্য তিনি সর্বদা আমীরের সঙ্গি হয়েছেন। ইরাকের সফর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একজন সত্যিকারের সাহসী ব্যক্তিই এ গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে সক্ষম ছিলেন। আমীরের প্রদত্ত দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন ও সুচারুরূপে তা পালন করেন। আমীরের তত্ত্বাবধানে তিনি তাঁর দায়িত্ব দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন।

হিযব-এর প্রতিষ্ঠাতা আমীর তাক্বি উদ্দীন আন-নাবাহানির মৃত্যুর পর দলের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। তিনি এই সংগ্রামের বোঝা নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং দাওয়াহ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দাওয়াহর ধরন পরিষ্কার হয়, এর পরিধি প্রসারিত হতে থাকে এবং এটি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হয়। এই আহ্বানের ধ্বনি ইউরোপেও অনুরণিত হতে থাকে।

৮০ বছর বয়স পর্যন্ত এই দৃঢ়চেতা আমীর দাওয়াহর পতাকাবাহী হিসেবে তাঁর জীবন পার করেছিলেন; আমীরের ডান হাত হিসেবে ২৫ বছর এবং স্বয়ং আমীর হিসেবে প্রায় ২৫ বছর - যা তাঁর জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ। আসন্ন মৃত্যু অনুমান করতে পেরে তাঁর দায়িত্বের পরিপূর্ণতা বিধানে তিনি তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করে পরবর্তী আমীর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তাঁর অনুমানই সঠিক হয়েছিল। সোমবার, ১৪ মহররম, ১৪২৪ হিজরী মোতাবেক ১৭ মার্চ, ২০০৩ তিনি নিজে নেতৃত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং নতুন আমীর নির্বাচনের কয়েক দিন পরেই তাঁর আত্মা অনন্ত জীবনের পথে পাড়ি জমায়।

এরূপে, হিযবুত তাহরীর-এর আমীর, শাইখ আবদুল কাদিম যাল্লুম ৮০ বছর বয়সে ২৭ সফর, ১৪২৪, মঙ্গলবার রাত্রে (২৯ এপ্রিল, ২০০৩) তাঁর সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাত লাভ করেন, ন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর মৃত্যুতে অসংখ্য লোক আল খালিলের আবু গারবিয়া আল শারায়ীতে সমবেদনা জানাতে এসেছিল, যা ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। লোকজন বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে এসেছিল। লেখক ও কবিরা তাঁর জীবন নিয়ে গদ্য ও কবিতা রচনা করেছিল। সমগ্র বিশ্ব থেকে টেলিফোন ও রেডিওতে শোকবার্তা এসেছিল। সুদান, কুয়েত, ইউরোপ, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, জর্ডান, ইরাক, মিশর ও অন্যান্য দেশ থেকে অসংখ্য শোকবার্তা এসেছিল। একই সময়ে বৈরুত (লেবানন) ও আম্মানে (জর্ডান) অসংখ্য লোক জমায়েত হয়েছিল।

শাইখ যাল্লুম রাহীমুল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে একজন সাহসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি কারোর তিরস্কারকে তোয়াক্কা করেননি। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন সক্রিয় ব্যক্তি যিনি কখনও ক্লান্ত ও হতাশ হননি। তিনি ছিলেন উঁচু স্তরের নাফসিয়া (মানসিকতা) ও মানবিকতার মূর্ত প্রতীক। হারাম থেকে তিনি নিজেকে অনেক দূরে রাখতেন। তাঁর ছিল অতিমাত্রায় সহ্যক্ষমতা, ধৈর্য্য ও অমায়িকতা। তাঁর অত্যন্ত কাছের বন্ধুরা বলেছেন যে, তিনি রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করে কাঁদতেন। তিনি দাওয়াহর ক্ষেত্রে ছিলেন সুদৃঢ় ও অবিচল। তিনি তাঁর জীবন অখ্যাত হিসেবে কাটিয়েছেন, এ ক্ষণস্থায়ী জীবন ছেড়ে বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত অত্যাচারী শাসকরা সর্বদা তাঁর পেছনে লেগে ছিল। একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই তার সংগ্রামের উত্তম প্রতিদান দিতে পারেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর ওপর অসীম রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।

নিম্নোক্ত পুস্তক ও পুস্তিকাগুলো তাঁর দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে হিযবুত তাহরীর কর্তৃক প্রকাশিত হয়ঃ

. খিলাফত রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থাপনা
. ইসলামের শাসন ব্যবস্থাবইয়ের সংযোজন
. গণতন্ত্র একটি কুফর ব্যবস্থা
. ক্লোনিং ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনে শারীআহ-এর বিধান
. পরিবর্তনের জন্য হিযবুত তাহরীর-এর কর্মপদ্ধতি
. হিযবুত তাহরীর
. ইসলাম ধ্বংসে আমেরিকার প্রচারণা
. জর্জ বুশ কর্তৃক মুসলিমদের ওপর ক্রুসেড আক্রমণ
. শেয়ার বাজারের সংকট ও ইসলামী সমাধান
১০. সভ্যতার দ্বন্দ্বের অবশ্যম্ভাবীতা

No comments:

Post a Comment