31.8.14

সমাজের পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থরক্ষার পুঁজিবাদী বাজেট এবং প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন

সূচনাঃ

প্রতি বছর জুন মাসে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবিত বাজেটকে বিভিন্ন চটকদার নামে বিশেষায়িত করা হয়। যেমনঃ ২০১০-১১ - “দিন বদলের সনদ”, ২০১১-১২ - “আগামীর চার বছরঃ স্বপ্নপূরণের সর্বশেষ”, ২০১৩-১৪ - “উন্নয়নের চার বছরঃ স্বপ্নপূরণের পথে বাংলাদেশ” কিন্তু গণমানুষের কতটুকু উন্নয়ন অর্জিত হয়েছে অথবা দিন বদল হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবি, স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে বাজেট দ্রব্যমূল্য ও জীবনধারনের ব্যয় বৃদ্ধির আতঙ্ক আর হতাশা ছাড়া কিছুই না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বাজেটকে উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। সরকারী দল বলে এই বাজেদেশকে উন্নয়নের পথে চালিত করবে, অন্যদিকে বিরোধীদল বলে বাজেট উন্নয়নবিমুখ ও পশ্চাদমুখী। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বাজেটের স্বরূপ ও ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত রাষ্ট্র কিভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে।

বাজেট কিঃ

বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্রের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা, যাতে আয় এবং ব্যয়ের (অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন) খাতগুলি সুনির্দিষ্টভাবে থাকে। বাজেট বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হয়। আইন সভা/সংসদ সদস্যরা তর্কবিতর্কের মাধ্যমে বিলটি পাশ করে।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের একটি মাধ্যম হচ্ছে বাজেট। পুঁজিবাদ মনে করে সম্পদ সীমিত কিন্তু মানুষের অভাব অসীম সেহেতু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উৎপাদন বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান মনে করে। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির সংস্থানের জন্য গণমানুষকে বিপদে ফেলতে এই ব্যবস্থা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। যার একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হচ্ছে ৪২ বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের বৃদ্ধির হার। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ ছিল ৬.৯ ডলার, যা ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৬২ (আনুমানিক) ডলার। যার অর্থ, একটি শিশু জন্ম নিচ্ছে ১৩৪৪৬ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে।

যাই হোক, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমান মোট লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা।

ব্যয়ের প্রধান খাতসমুহঃ

টেবিল ১ ~ বাজেটের ব্যয় বরাদ্দের খাতসমুহ

ক্রমিক নং
ব্যয় খাতসমুহ
বরাদ্দ (%)
সুদ
১২.
শিক্ষা ও প্রযুক্তি
১১.
জনপ্রশাসন
১০.
বিবিধ ব্যয়
.
পরিবহন ও যোগাযোগ
সেবা/ ভর্তুকি
.
স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন
.
প্রতিরক্ষা
.
সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যান
.
১০
বিদ্যুত ও জ্বালানী
.
১১
জনশৃংখলা ও নিরাপত্তা
.
১২
স্বাস্থ্য
.
১৩
কৃষি
৩.৬
১৪
পেনশন
১৫
শিল্প অর্থনৈতিক সার্ভিস
.
১৬
গৃহায়ন
০.৮
১৭
বিনোদন, সংস্কৃতি ধর্ম
০.৮


টেবিল ২ ~ বাজেটের আয়ের খাতসমুহ

ক্রমিক নং
খাতসমুহ
প্রত্যাশিত (%)


কর আয় (এনবিআর)
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)
৩৬.


৬১.
আয়কর
৩৫.
রপ্তানী শুল্ক
১৫.৩
আমদানী শুল্ক
১০.
বিবিধ
.
আভ্যন্তরীন অর্থায়ন
১৫.
কর-বহিঃর্ভূত আয়
১১.
বৈদেশিক ঋ
.
বৈদেশিক অনুদান
.
কর-আয় (নন-এন.বি.আর)
.

              ***তথ্যসূত্রঃ অর্থ মন্ত্রনালয়

প্রস্তাবিত বাজেটের সর্বোচ্চ আয় আসবে কর-আয় (৬১.২%) থেকে, যার সর্বোচ্চ ৩৬.৭% আসবে মূল্য সংযোজন কর থেকে। মূল্য সংযোজন কর (VAT) - পন্যের মূল্যের উপর নির্ধারিত কর, যা উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সবার নিকট থেকে সমহারে আদায় করা হয়; হাজার কোটি টাকার মালিক শাহ-আলম এবং ফুটপাতের চায়ের দোকানদার গণি মিয়া তীর চিনি কেনার সময় একই হারে কর (VAT) দিতে বাধ্য। VAT এর ফলে ধনী মানুষের ক্রয় ক্ষমতার পরিবর্তন না হলেও দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

কর-আয়ের ২য় সর্বোচ্চ খাত আয়কর, যা ব্যক্তির ব্যয় বিবেচিত না হয়ে আয়ের উপর নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে করযোগ্য আয়ের পরিমান বাৎসরিক ১,৮০,০০০ টাকা অর্থাৎ মাসিক আয় ১৫,০০০ টাকা। যদিও ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে মাসিক ২০,০০০ টাকা ৪ সদস্যের একটি পরিবারের ভরনপোষনের জন্য অপ্রতুল তথাপি সেই সকল নাগরিকের জন্যও আয়কর প্রদান বাধ্যতামুলক।

ব্যয়ের বরাদ্দ থেকে আমরা বলতে পারি প্রস্তাবিত বাজেট পশ্চাদমুখী এবং শোষণমুলক। বাজেটের সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় হবে ঋনের সুদ পরিশোধ করতে, যার পরিমান ২৭,৮১১ কোটি টাকা। এই সর্বোচ্চ ব্যয় শুধুমাত্র জনগনর বিন্দুমাত্র উন্নয়ন করতেই ব্যর্থ নয় বরং জনগনকে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

Ò...ছেড়ে দাও যা কিছু বকেয়া আছে সুদের তা...আর যদি তোমরা না ছাড়ো, তবে শুনে রাখ যুদ্ধের ঘোষনা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকেÓ [সূরা আল-বাক্বারাহঃ ২৭৮-২৭৯]

আল্লাহর নাফরমানী করে আল্লাহর রহমত পাবার সুযোগ থাকে না। আমরা দেখতে পাই প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্দশা। আল্লাহর নাফরমানীর বিনিময়ে জনগন পাচ্ছে ভ্যাট, আয়কর, টোলসহ ছদ্দবেশী নানাবিধ করের বোঝা, যা ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগনের জীবনকে করেছে দুর্বিসহ।

যেখানে প্রতিবছর বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ ডাইরিয়ার মতো সাধারণ রোগে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, সেখানে স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ৪.১% বরাদ্দ শুধু হাস্যকরই নয় বরং অবিবেচনা প্রসূতও বটে।

দ্বিতীয় বরাদ্দকৃত খাত শিক্ষা ও প্রযুক্তি। বাস্তবতা বিবর্জিত ও ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষিত বেকার ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারে নাই। কারন এই শিক্ষাব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসরন ও তাদের তৈরী। এই শিক্ষাব্যবস্থা যেমন একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তা থেকে দূরে ঠেলে দেয়, তেমনি অক্ষম করে জীবনধারনের জন্য জীবিকা অর্জনে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ানো হয় দর্শন, বাংলা সাহিত্য, ইংরেজী সাহিত্যের মতো বিষয় যার কোন না আছে ব্যবহারিক মুল্য, না আছে তাত্ত্বিক মুল্য। এই অর্থ ব্যয়িত হয় বিএনপির সময় জিয়ার ভূমিকা ও আওয়ামী লীগের সময় মুজিবের ভূমিকা পাঠ্যপুস্তকে অন্তঃর্ভূক্তকরনে। যার কোন উপকার জনগন পায় না। জনপ্রশাসন তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত; যার অর্থ ব্যয়িত হয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা মিটানোর জন্য।

জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সেখানে আমরা দেখতে পাই প্রতিরক্ষা বরাদ্দ মাত্র ৫.৬%বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সমস্যা সমাধানে নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। তদুপরী, আমরা দেখতে পাই যদিও বাজেটের সিংহভাগই আসে সাধারন মানুষের নিকট থেকে, কিন্তু তাদের জন্য বরাদ্দ খুবই নগন্য। এই ব্যবস্থায় সাধারন মানুষের সম্পদ দুর্নীতির মাধ্যমে পুঞ্জীভূত হয় পুঁজিপতি ও শাসকদের মধ্যে। বাজেটের ফলে জনগনের ভাগ্যের উন্নয়ন না হলেও রাজনীতিবিদ, আমলা ও পুঁজিপতিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। যে কারনে আমরা দেখতে পাই, যদিও ফুটপাতের ক্ষুদ্র কলা ব্যবসায়ী আবুল মিয়ার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় ৩০০ টাকা পুঁজির অভাবে, কিন্তু বৈধ কোন উপার্জন ছাড়াই তারেক-কোকো-জয়-পুতুলরা বিদেশের মাটিতে আলিসান জীবন-যাপন করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বাজেটঃ

পুঁজিবাদী গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিবছর বাজেট প্রনয়ন করে সংসদে উত্থাপিত হয়। সাংসদরা প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষে ভোটের মাধ্যমে বিল আকারে পাশ করে। বাজেট কিছু ধারা-উপধারায় বিভক্ত থাকে যেখানে প্রতিটি খাতের জন্য কিছু বরাদ্দ থাকে। সংসদে বিল আকারে পাশ করার পর বাজেট আইনে প্রণিত হয়। অর্থাৎ বাজেট একটি আইন যার কার্যকারিতা এক বছর। ইসলামে আইন প্রনয়নের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার

Òইনিল হুক্‌মু ইল্লা লিল্লাহ্‌Ó
অর্থঃ Òহুকুম এর অধিকারী একমাত্র আল্লাহÓ [সুরা ইউসুফঃ ৪০]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা শরীয়াহতে অর্থ আয় এবং ব্যয়ের খাতকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সেহেতু খিলাফাত রাষ্ট্রে বাৎসরিক বাজেট প্রনয়নের সুযোগ বা প্রয়োজন নেই। খলীফা অর্থ আদায় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনার জন্য দায়িত্বশীল। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই ইমাম হচ্ছে দায়িত্বশীল। খলিফা কর্তৃক গৃহীত ইস্তিহাদের মাধ্যমে অর্থ আয় ও বন্টনের খাতসমুহ নির্দিষ্ট হবে। অর্থ আয় ও বন্টন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বায়তুল মালের উপর।

বায়তুল মালের আয়ের খাতসমুহঃ

. আনফাল, গনিমত, আল-ফাঈ (টীকাঃ ১-৩)
.  ভূমি কর
. খারাজ (টীকাঃ ৪)
খ. উশর (টীকাঃ ৫)
. জিযিয়া (টীকাঃ ৬)
৪. গণ মালিকানাধীন সম্পত্তি থেকে উপার্জিত বিভিন্ন প্রকার আয় (টীকাঃ ৭)
. জরিমানা (টীকাঃ ৮)
. গুপ্তধন এবং ছোট খনির এক পঞ্চমাংশ
. উত্তরাধিকারীবিহীন সম্পদ
. মুরতাদের সম্পদ
৯. বিভিন্ন প্রকার করঃ দারুল হারবের সাথে কৃত ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর আরোপিত কর।
১০. যাকাতঃ সম্পদশালী মুসলিমদের জন্য অর্থ এক বছর থাকলে তার জন্য যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক। (টীকাঃ ৯)

বায়তুল মালের ব্যয়ের খাতসমুহঃ

১. যাকাতঃ খলীফা যাকাত আদায় করা ও শুধুমাত্র আটটি খাতেই বন্টনের জন্য দায়িত্বশীল। যদি এই আটটি খাতে ব্যয় করা সম্ভব না হয়, তবে যাকাতের অর্থ বায়তুল মালে গচ্ছিত থাকবে এবং যখন প্রয়োজন হবে তখন ব্যবহার করা হবে।

Òযাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী, যাদের চিত্ত আকর্ষন করা প্রয়োজন, দাস মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এটাই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।Ó [সুরা আত-তাওবাহঃ ৬০]
২. অভাবী মানুষের মৌলিক চাহিদা পুরনরে জন্য রাষ্ট্রর্কতৃক প্রদত্ত ভাতা
৩. ইসলামের দাওয়াহ ও জিহাদের ব্যয়
৪. রাষ্টের কর্মচারী, সৈনিক ও বিচারকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যয়
৫. জনসাধারণের কল্যাণার্থে নির্মিত রাস্তা, সেতু, বিদ্যুতকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ব্যয়
৬. আপদকালীন (দূর্ভিক্ষ, বন্যা, ভূমিকম্প) সময়ের জরুরী ব্যয়
৭. উন্নয়ন ব্যয়

ইসলামী অর্থনৈতিক নীতি ও উন্নয়নঃ

পুঁজিবাদী আদর্শ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে পরিমাপ করে মোট দেশজ উৎপাদন (জি.ডি.পি/ Gross Domestic Product), মোট জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয়ের মাধ্যমে। যদিও দেখা যায়, অনেক দেশের ক্ষেত্রে মাত্র ১০% লোক আয় করে মোট জাতীয় আয়ের ৯০%মোট জাতীয় আয়ের হিসেবে কোটি টাকা আয়ের শাহ-আলম ও একশ টাকার আয়ের গণী মিয়ার আয়কে সমভাবে বিবেচনা করা হয়। যদিও শাহ-আলমের আয় বৃদ্ধির কারনে গণী মিয়ার ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না কিন্তু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু লোকের হাতে সম্পদের পাহাড় জমছে আর অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধির ধারনাটি শুধু ত্রুটিপূর্ণই নয়, হাস্যকরও বটে। প্রবৃদ্ধির অংক গনমানুষের প্রকৃত অবস্থাকে গোপন করে ও উন্নয়নের নামে জনগনকে প্রতারিত করে। ইসলাম উন্নয়নকে প্রতারনামুলক ও স্থুলভাবে না দেখে সার্বিকভাবে বিবেচনা করে।

সৃষ্টিকর্তা হিসেবে দুনিয়ার সবকিছুর মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। সুতরাং সম্পদের মালিকানা, ব্যবহার ও বন্টনপ্রক্রিয়া নির্ধারণ করার বৈধ ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার। আল্লাহর হুকুমেই সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সমাজের কল্যাণ নিহিত। এই ব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ

“তিনি সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু আছে যমীনে তার সবই...।” [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৯]

“হে আদম সন্তান! প্রত্যেক নামাজে তোমরা সুন্দর পোশাক পরিধান কর, খাও এবং পান কর কিন্তু অপব্যয় করবে না...।” [সূরা আল-আ’রাফঃ ৩১]

ইসলামের দৃষ্টিতে মূল সমস্যা সম্পদের উৎপাদন নয়, বরং সমস্যা হচ্ছে সম্পদের বন্টন। সম্পদ ও সেবা সকল নাগরিকের মাঝে বন্টন করার বিষয়। ইসলামী অর্থনীতি প্রতিটি নাগরিকের সকল মৌলিক চাহিদা পূরনের গ্যারান্টি দেয়।

রাসুল (সাঃ) বলেনঃ “আদম সন্তানের অধিকার খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান।”

এছাড়া অতিরিক্ত কিছু/ বিলাস সামগ্রী চাহিদা পূরণের পথও সুগম করে। তবে একথা প্রত্যেক নাগরিককে মেনে নিতে হবে যে, সে ইসলামী সমাজে বাস করছে এবং এর একটি বিশেষ জীবন পদ্ধতি আছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, শর’ঈ আইন প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার গ্যারান্টি দেয়। এর প্রক্রিয়া হলো এই যে, কোন ব্যক্তি যদি কর্মক্ষম হয় তাহলে ইসলাম তার নিজের এবং তার উপর যাদের ভরণপোষনের দায়িত্ব রয়েছে, তাদের জীবিকা উপার্জনার্থে কাজ করা তার জন্য আবশ্যক করে দেয়। তাই পিতার উপর ফরয হয়ে যায়, তার সন্তানের জীবিকার ব্যবস্থা করা। যদি কোন ব্যক্তি কাজ করতে অক্ষম হয়, তখন তার দায়িত্ব অর্পন করা হয় তার ওয়ারিশদের উপর। তবে যদি তার দায়িত্ব পালন করার মত উপযুক্ত কাউকে না পাওয়া যায়, তখন তার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় বাইতুল মালের উপর। এভাবেই ইসলাম সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পালন করে।

আমরা যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করি আমরা দেখতে পাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে চারটি খাতের উপরঃ

১. কৃষি
২. শিল্প
৩. ব্যবসা-বানিজ্য
৪. জনসাধারনের প্রচেষ্টা

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনে ও দেশের সম্পদ রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে খিলাফত সরকার নিম্নলিখিত বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেঃ

১. কৃষিঃ খিলাফত রাষ্ট্র জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং বৃহত্তর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসাবে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিবে। কৃষিকে অর্থনীতির মেরুদন্ড ধরে কৃষিনীতি ঘোষণা করা হবে ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হবে। কিভাবে খিলাফত সরকার কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন নিশ্চিত করেছিল তার একটি উদাহরণ হচ্ছে আব্বাসীয় খিলাফত। দামেস্কের পরিবর্তে বাগদাদকে খিলাফতের রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করার পর তারা কৃষি উন্নয়নে মনোযোগ দেয়। প্রথমে তারা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী শাসন নিশ্চিত করে। এরপর তারা এই দুই নদীর মধ্যে অসংখ্য সংযোগ খাল কেটে পুরো এলাকার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সৃষ্টি করে। তারা খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদির পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ পানির চ্যানেলগুলোকে সংযুক্ত করে, ফলে বিশাল এলাকায় পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। আব্বাসীয় খিলাফতের আমলে ব্যাপক আর্থিক উন্নতির অন্যতম কারণ ছিল কৃষি উৎপাদন থেকে সরকারী আয় এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ব্যাপক প্রসার। একটি শক্ত ভিত্তির উপর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্বাভাবিকভাবে তাঁতশিল্প, চামড়াশিল্প, ধাতবশিল্প ইত্যাদি তখনকার সময়ের ভারী শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে এবং এক দশকের মধ্যে বাগদাদ তৎকালীন সময়ে জানা পৃথিবীতে কনস্টান্টিনোপলের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরীতে পরিণত হয়। কৃষির মূল ভিত্তি ভূমি। প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম উৎপাদন বৃদ্ধির উপায়। ভূমি ব্যবস্থাপনাই কৃষির উন্নয়নের মূল শর্ত। খিলাফত রাষ্ট্র কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভূমিসর্বোচ্চ ব্যবহারকে নিশ্চিত করবে।

§  খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টনঃ খলীফা খাস জমি হিসেবে চিহ্নিত ভূমি ভূমিহীন কৃষক, নদী ভাঙ্গনে সর্বহারা মানুষ ও দরিদ্র বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করবে। বুখারী কর্তৃবর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেনঃ “যদি কেউ অনাবাদী জমি উৎপাদনক্ষম করে, তবে সেই জমির মালিকানা তার।” যেহেতু খাস ভূমির মালিকানা সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের, তাই খলীফা একে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন।

§  অব্যবহৃত কৃষি জমি পুনর্বন্টনঃ খিলাফত সরকার চাষযোগ্য জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন অব্যবহৃত জমির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে অনেক জমির মালিক নিজেরা নিজেদের জমি ব্যবহার করেন না, অন্যের কাছে ‘বর্গা’ দেন বা ফেলে রাখেন। জমি ধরে রাখার এই পদ্ধতি ইসলাম অনুমোদন করে না। মালিককে তার জমি হয় নিজে সরাসরি ব্যবহার করতে হবে অথবা নিজে ব্যবহার করা কিংবা বিক্রি করার যোগ্যতা অর্জন করার আগ পর্যন্ত কাউকে তা ব্যবহার করার অনুমতি দিতে হবে। কেউ যদি নিজ জমি এক নাগাড়ে তিন বছর চাষ না করে, তাহলে খিলাফত সরকার তার জমি এমন কাউকে দিয়ে দেবে, যে তা ব্যবহার করতে সক্ষম। ভূমি সংস্কার ও পুনর্বন্টন খিলাফত সরকারের একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার ফলে সর্বোচ্চ পরিমাণ জমির আবাদ বা ব্যবহার নিশ্চিত হয়।

§  সেচের পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণঃ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। আর খিলাফত সরকারও আয়ের জন্য কৃষিখাতের উপর নির্ভরশীল। কৃষিজ জমি যদি প্রাকৃতিকভাবে সেচের পানি পায় তবে সরকার উৎপাদিত ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে। আর যদি সরকার প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থা করে, তবে সরকার উৎপাদিত ফসলের আরও অধিক অংশ পাবে। অর্থাৎ সেচের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য খিলাফত সরকার স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহী হবে।

§  সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎঃ কৃষি উৎপাদনে এই তিনটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। এগুলোর উৎপাদন নির্ভর করে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর যা গণমানুষের অধিকার হিসেবে ইসলামে স্বীকৃত। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মানুষ তিনটি বিষয়ে শরিক। পানি, বিস্তীর্ণ চারণভূমি ও আগুন।” জনগণের দোরগোড়ায় ডিজেল ও বিদ্যু সরবরাহ করা খিলাফত সরকারের দায়িত্ব এবং এগুলো পাওয়া জনগণের অধিকার। একই কথা সারের জন্যও প্রযোজ্য, কারণ সার প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ উপাদান থেকে তৈরী করা হয়। এক্ষেত্রেও শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক ডিলার নিয়োগ করে সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।

§  উচ্চ ফলনশীন বীজঃ পেটেন্ট এর নামে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোকে বীজের মালিকানা-নির্ভর ব্যবসা ইসলাম অনুমোদন করে না। ফলে উচ্চ ফলনশীন ধানের বীজ সকলের কাছে সহজলভ্য হবে এবং সামগ্রিকভাবে দেশে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

§  প্রযুক্তিঃ খিলাফত সরকার জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি পদ্ধতি ও প্রযুক্তির আধুনিকায়ন করবে এবং তা কৃষকদের হাতে তুলে দিবে। কৃষিতে প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রসমূহ আমদানী না করে সেগুলোকে দেশে তৈরী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খিলাফত রাষ্ট্র কোন মধ্যযুগীয় যাজকতন্ত্র (theocratic state) নয় যা সমাজে নতুন নতুন জিনিসের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। বরং খিলাফত সরকার সর্বোত্তম উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করবে এবং কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ “তিনি সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু আছে যমীনে তার সবই...।” [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৯] খিলাফতের শাসনকালে কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। যেমনঃ সেচের ক্ষেত্রে বাঁধ, জলাধার, পানির কল ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শুষ্ক আরব মরুভূমি ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কৃষি বিজ্ঞানীরা চাষাবাদের জন্য এমন ম্যানুয়াল (দিক-নির্দেশনা/ পরিকল্পনা) তৈরি করেছিলেন যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে কখন কোন জমিতে কিভাবে চাষাবাদ করলে এবং ফসলের যত্ন নিলে সর্বোত্তম উৎপাদন সম্ভব। ইবনে আল বাইতার এর মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন প্রজাতির শস্য, গবাদিপশু ইত্যাদি পরিচিত করে তুলেছিলেন।

§  অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণঃ খিলাফত সরকার গরিব কৃষকদেরকে অনুদান বা সুদমুক্ত ঋণ দিবে, যাতে করে তারা জমির যথাযথ ব্যবহার করতে পারে। এছাড়াও দেশের খনিজ সম্পদ বিশেষ করে তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি জ্বালানী সম্পদ উত্তোলন ও জনগণের মধ্যে এর সুবিধা বিতরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে খিলাফত সরকার। এর ফলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের জনগণ উপকৃত হবে।

২. শিল্পায়নঃ খিলাফত রাষ্ট্র অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে অবশ্যই শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিবে এবং নিম্নলিখিত বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেঃ

§  খলীফা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে শিল্পায়নের জন্য যে ক্ষেত্রগুলো অগ্রাধিকার দিবেন তা হলো ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, লৌহ ও ইস্পাত শিল্প, গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক শিল্প (বিদ্যুৎ, সার ইত্যাদি), মোটর তৈরী শিল্প (ট্রাক্টর, ট্যাংক, জাহাজ, উড়োজাহাজ ইত্যাদি)
§  প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির উৎপাদন, ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ- তিনটি পর্যায়েই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে খিলাফত সরকার গুরুত্ব দিবে
§  বাংলাদেশের শিল্পায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণ ও ষড়যন্ত্র খিলাফত সরকার শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে। কৌশলগত শিল্প, যেমনঃ লৌহ ও ইস্পাত শিল্প কখনোই বিদেশীদের মালিকানাধীনে দেয়া হবে না
§  যেহেতু দেশের ব্যাপক শ্রমবাজার, সুলভ জ্বালানী ও বিশাল পণ্যবাজার শিল্পায়নের জন্য অনুকূল, সেহেতু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের নিজস্ব সম্পদ-নির্ভর বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলা হবে এবং শ্রমঘন শিল্পকে উৎসাহিত করা হবে।
§  খিলাফত ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজিকে রাষ্ট্রের পরিকল্পনার সাথে সংযুক্ত করবে এবং প্রধান প্রধান শিল্পপতিদেরকে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট থাকবে। রাষ্ট্রকে শিল্পোন্নত করতে একটি ফোরাম গড়ে তোলা হবে যারা সুনির্দিষ্টভাবে শিল্পপতিদেরকে নিয়ে কাজ করবে এবং সবসময় তাদেরকে উৎসাহ যোগাবে। ভারী শিল্পের প্রয়োজনে সাপোর্ট ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করার সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় পলিসি থাকবে।

খিলাফত তিনভাবে শিল্পে বিনিয়োগ করবেঃ

§  সরাসরি বিনিয়োগঃ যে সব শিল্প সাধারণত লাভজনক ভিত্তিতে চালানো সম্ভব নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশের জন্য অপরিহার্য সেগুলোকে অবশ্যই রাষ্ট্রের নিজস্ব বিনিয়োগে স্থাপন করবে ও চালু রাখবে। যেমনঃ মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, সাবমেরিন ও যুদ্ধ জাহাজ নির্মান ইত্যাদি।    
§  যৌথ বিনিয়োগঃ যেসব শিল্পের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে রাষ্ট্র তথা জনগণ লাভবান হবে অথবা যেসব শিল্প সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া গড়ে উঠতে পারবে না, যেমনঃ খনিজ সম্পদ উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ইত্যাদিতে রাষ্ট্র ব্যক্তিখাতের সাথে যৌথ বিনিয়োগ করবে।     
§  ব্যক্তিখাতের শিল্পে ভর্তুকি বা সুবিধা প্রদানঃ যারা রাষ্ট্রের চাহিদামতো পণ্য উৎপাদন করবে, যেমনঃ কোন গাড়ি কারখানা যদি সামরিক যান বা ট্যাঙ্ক উৎপাদন করে, তবে তাকে যথাযথ আর্থিক সুবিধা দেয়া হবে। যারা অন্যান্য শিল্পের জন্য কাঁচামাল উৎপাদন করে তাদেরকে প্রয়োজনে ভর্তুকি বা ঋণ সুবিধা দেয়া হবে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ শিল্প (যেমন লোহা, কেমিক্যাল, অস্ত্র কারখানা ইত্যাদি) স্থাপনকারীদেরকে দরকার হলে বিনামূল্যে সরকারী জমি বরাদ্দ, কর রেয়াত ও ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হবে। 

৩. ব্যবসা-বানিজ্যঃ দেশের অভ্যন্তরে বা বহির্বিশ্বে পন্য ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়াকে বানিজ্য বলে। আভ্যন্তরিন ব্যবসা-বানিজ্যের জন্য কোন প্রকার কর বা অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক স্বার্থ অনুযায়ী শরীয়াহ সম্মতভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ব্যবসাকে উৎসাহিত করেন।

“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন...” [সুরা আল-বাক্বারাহঃ ২৭৫]

ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য নয়, ব্যবসায়ীর নাগরিকতার বিষয়টি বিবেচনায় আসবে। বৈদেশিক বানিজ্যে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা দুই ভাগে বিভক্তঃ

১. খিলাফাত রাষ্ট্রের নাগরিক- মুসলিম ও অমুসলিম
২. চুক্তিবদ্ধ অথবা যুদ্ধরত রাষ্ট্রের নাগরিক

খিলাফাত রাষ্ট্রের নাগরিকরা আভ্যন্তরিন বানিজ্যের মত কোন প্রকার বাধা-নিষেধ ছাড়া বৈদেশিক বানিজ্য (আমদানী-রপ্তানী) পরিচালনা করতে পারবেন। যুদ্ধরত দেশের নাগরিকরা খলীফার অনুমতিক্রমে খিলাফাহ রাষ্ট্রে প্রবেশ ও আমদানী-রপ্তানি করতে পারবে। চুক্তিভুক্ত দেশের নাগরিকরা চুক্তি অনুযায়ী আমদানী-রপ্তানী করার সুযোগ পাবে। খলীফা ওমর (রাঃ) এর সময় যুদ্ধরত দেশের নাগরিকদের নিকট থেকে কর আদায় করা হত। যেমনটি খিলাফাত রাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা সেই সব দেশে ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে দিতে বাধ্য থাকতেন। কোন সাহাবা খলীফা ওমর (রাঃ) সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। এটা থেকে প্রমাণিত হয় যুদ্ধরত দেশের নিকট থেকে কর আদায় অনুমোদিত কিন্তু বাধ্যতামুলক নয়। খলীফা মুসলিম জনগনের কল্যান বিবেচনা করে কর নির্ধারন কিংবা বাতিল করার অধিকার রাখেন।

৪. জনসাধারনের প্রচেষ্টাঃ ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ

“তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করিয়া দিয়াছেন; অতএব তোমরা উহার দিগ-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁহার প্রদত্ত জীবনোপকরণ হইতে আহার্য গ্রহণ কর; পুনরুত্থান তো তাঁহারই নিকট।” [সুরা মুলকঃ ১৫]

“বল, আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব শোভাময় বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করিয়াছেন তাহা কে হারাম করিয়াছে? বল, পার্থিব জীবনে, বিশেষ করিয়া কিয়ামতের দিনে এই সমস্ত তাহাদের জন্য, যাহারা ঈমান আনে।” [সূরা আল-আ’রাফঃ ৩২]

“হে মু'মিনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য উৎকৃষ্ট যেসব বস্তু হালাল করিয়াছেন সেই সমুদয়কে তোমরা হারাম করিও না এবং সীমালংঘন করিও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-মায়িদাহঃ ৮৭]

“হে মু'মিনগণ! তোমরা যাহা উপার্জন কর এবং আমি যাহা ভূমি হইতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করিয়া দেই, তন্মধ্যে যাহা উৎকৃষ্ট তাহা ব্যয় কর এবং উহার নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করিও না; অথচ তোমরা উহা গ্রহণ করিবার নও, যদি না তোমরা চক্ষু বন্ধ করিয়া থাক।” [সূরা আল-বাক্বারাহঃ ২৬৭]

রাসুল (সাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ থেকে আমরা সম্পদ অর্জনের চেষ্টাকে উৎসাহিত করার বিষয়টি দেখতে পাইঃ

“সাদ বিন মু’আয (রাঃ) এর সাথে করমর্দনের সময় রাসুল (সাঃ) দেখতে পেলেন তার হাত ভীষন রুক্ষ। রাসুল (সাঃ) কারন জিজ্ঞেস করলেন, সাদ (রাঃ) বললেনঃ আমি শাবল দিয়ে মাটি খনন করি পরিবারের ভরনপোষণের জন্য। রাসুল (সাঃ) তার হাতে চুমু দিলেন এবং বললেনঃ এই দুই হাতকে আল্লাহ্‌ ভালোবাসেন। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ দুই হাতের উপার্জিত রিজিক সর্বোত্তম।Ó

ওমর (রাঃ) একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা কুরআন তিলাওয়াতকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি (রাঃ) দেখলেন যে, তারা মাথা গুজে বসে ছিলেন। তখন তিনি (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কারা? তাকে (রাঃ) বলা হলঃ এরা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। তিনি (রাঃ) উত্তর দিলেনঃ না বরং এরা জনগনের সম্পদের ভক্ষক। তোমরা কি জানতে চাও কারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। অতঃপর তিনি (রাঃ) বললেনঃ সে হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে জমীনে বীজ ফেলে এবং ফসলের জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করে।

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছসমুহ মুসলিমদের উপার্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে উৎসাহিত করে। আজ মুসলিমরা জীবিকা অর্জনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, যেখানে তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবিকা অর্জন; অথচ তাদের মৌলিক চাহিদাও পূরন হচ্ছে না। আদর্শিক মুসলিমের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। খলীফা এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে মুসলিমদের জীবিকা অর্জনের পথকে সহজতর করতে সচেষ্ট হবে।

দূর্ণীতিগ্রস্ত ও প্রতারণামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপহার বিশ্বব্যপী কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ। পুঁজিবাদের জুলুমে গণমানুষ দিশেহারা। আল্লাহ আমাদের খিলাফতের জন্য কবুল করুন, যে ব্যবস্থা পুঁজিবাদীর জুলুম থেকে রক্ষা করবে মুসলমি তথা সমগ্র মানবজাতিকে। আল্লাহ আমাদের কবুল করুক।


আমীন


***টীকাঃ

.ত্রুর নিকট থেকে প্রাপ্ত যুদ্ধলব্ধ (পূর্বে ও পরে) সম্পদকে বলা হয় আনফাল।
. যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদকে বলা হয় গনীমত।
৩. যুদ্ধ ব্যতীত প্রাপ্ত কাফিরদের সম্পত্তিকে বলা হয় ফা’ঈ
. খারাজ এক ধরনের কর যা আদায় করা হয় খারাজী ভূমি থেকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে।
. উশরী জমিন বলা হয় এমন ভূমিকে, যেখানকার বাসিন্দারা নিজে থেকেই মুসলমান হয়েছে। যেমন- হিজাজ ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান। এমন অনাবাদী জমিনকেও উশরী জমিন বলা হয়, যা মানুষ নিজে আবাদ করে।
. খিলাফত রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা ইসলামের প্রতি আনুগত্য ও নিরাপত্তা প্রাপ্তির স্বার্থে বাৎসরিক অর্থ (জিযিয়া) প্রদান করবে।
৭. গণমালিকানা হয় ঐসব সম্পদের যেগুলোকে ইসলামিক শারী’আহ সমস্ত মুসলমানের মালিকানায় দিয়ে দিয়েছে এবং একে মুসলমানদের যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি বলে স্থির করেছে।
৮. শাসক ও সরকারী কর্মচারীদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ অবৈধ। শারী’আহ অনুযায়ী অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
ü লঘু পাপের জন্য জরিমানার বিধান রয়েছে। আমর বিন শুয়াইব তার দাদা আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল-আস থেকে বর্ণনা করেনঃ “রাসুল (সাঃ) কে গাছে ঝুলে থাকা ফলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। রাসুল (সাঃ) উত্তর দেনঃ কেহ যদি প্রয়োজনের তাগিদে ভক্ষন করে এবং সাথে করে না নিয়ে যায়, তার কোন শাস্তি হবে না। কিন্তু সাথে করে নিয়ে গেলে দ্বিগুন মুল্য জরিমানা করো শাস্তিস্বরুপ।
ü যাকাত ফরজ হওয়ার পর যারা যাকাত দিবে না, তাদের নিকট হতে যাকাত আদায় করার পর অবশিষ্ট সম্পদের অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে। রাসুল (সাঃ) বলেনঃ ‘এবং যে ইহা (যাকাত) দেয়া থেকে বিরত থাকবে, তার নিকট হতে ইহা (যাকাত) এবং সম্পত্তির অর্ধেক নিবে।’
. যাকাতের নিসাব ৭.৫ ভরি সোনা বা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য বা তার সমপরিমান অর্থ। বাংলাদেশের বাজারে ১ ভরি সোনার মূল্য ৫১,৫০০। সেই হিসেবে যাকাত ফরয হবার শর্ত ৩,৮৬,২৫০ টাকার সম্পদ থাকা।