সূচনাঃ
রাজনৈতিক সংগ্রাম (Political Struggle) হিযবুত তাহরীর এর কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে আমাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের (Cultural Stage) কাজের স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্যায়। এই নিবন্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিবে এবং পরবর্তীতে আমরা ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যান্য দিক নিয়ে আরো আলোচনা করব। সবার সুবিধার্থে আলোচনাকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১. রাজনৈতিক সংগ্রাম কি? (Definition of Political Struggle)
২. রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন দিক (Aspect of Political Struggle)
৩. ইসলামে রাজনৈতিক সংগ্রাম (Political Struggle in Islam)
৪. রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of those who Struggle for Islam)
রাজনৈতিক সংগ্রাম কি?
রাজনৈতিক সংগ্রামের মানে হচ্ছে শাসক বা যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, তাদের বিরোধিতা করা তথা সরকারের সাথে বিরোধে লিপ্ত হওয়া। পরিপূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন বিরোধিতার নামই রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রাম প্রাণঘাতী বা সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বিভিন্ন কর্মকান্ড বা কথার মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। একটি দেশের নাগরিকদের একটি অংশ সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকে।
মানব সভ্যতা যত পুরনো, রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসও ততো পুরনো। মানুষ যখনই সমাজবদ্ধ বা গোত্রবদ্ধ বা একটি দেশের মধ্যে বসবাস করা শুরু করেছে, তখন থেকেই রাজনৈতিক সংগ্রাম উৎপত্তি। পরিপূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তন কামনাকারী মানুষ একটি সমাজে সব-সময়ই থাকে। সমাজের একটি অংশ হয়তো পুরনো রীতিনীতি বা সামাজিক প্রথার মুলোৎপাটন চায়। অন্যরা হয়তো অবিচার, জলুম ও নিপীড়নের অবসান চায়। আরো কোন গোষ্ঠী হয়তো ক্ষমতায় আরোহণ করতে চায়। এদের মধ্যে কেউ হয়তো সশস্ত্র পন্থার আশ্রয় নেয়, কেউ হয়তো অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে বিশ্বাস করে। আবার কেউ হয়তো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এর মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে।
যে কোন রাজনৈতিক সংগ্রামের দু’টি পক্ষ থাকে। একটি পক্ষে থাকে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান তথা সরকার, যার হাতে থাকে ক্ষমতা, সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সকল যন্ত্র, যারা রাষ্ট্রীয় নীতি ও অবকাঠামো রক্ষায় সর্বাত্নক চেষ্টা চালায়। আর অন্য পক্ষে থাকে নবীন ও দূর্বলেরা, যারা সরকারবিরোধী পক্ষ। এরা জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করে। এই পক্ষ একটি আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার মাধ্যমে একটি কাংক্ষিত পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে।
রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন দিকঃ
রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করার তিনটি দিক রয়েছেঃ
§ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা
§ সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করা
§ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা
রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করাঃ
রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রথম ধাপ হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার মাধ্যমেই একটি দল রাজনীতির ময়দানে নিজের জন্য অবস্থান তৈরী করে নেয় এবং ধীরে ধীরে একটি দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী সবসময় রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্মকে তার ক্ষমতার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে। লেখক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবিদের লেখালেখি ও সমালোচনায় একটি সরকার তেমন উদ্বিগ্ন হয় না।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হলে রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সার্বক্ষনিক সচেতনতা থাকতে হবে এবং রাজনীতির ময়দানের আলোচিত ইস্যু সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। একটি দেশে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে এবং অসংখ্য ইস্যু জন্ম নেয়। এইসব ঘটনা আর ইস্যুই একজন রাজনীতিবিদের লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার। তাই রাজনীতিবিদকে সার্বক্ষনিকভাবে নিচের কাজগুলো করতে হয়ঃ
§ নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে
§ গভীর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার অধিকারী হতে হয়, যাতে রাজনৈতিক সংগ্রামের উপযোগী ইস্যু নির্বাচন করা যায় অথবা সংগ্রামের জন্য ইস্যু তৈরী করা যায়।
নিয়মিত ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনায় ব্যর্থ হলে সঠিক ইস্যু নির্ধারনে আমরা ব্যর্থ হবো। এর ফলে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হবে এবং পার্টির অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়বে। পার্টি যদি বারে বারে সঠিক ইস্যু নির্ধারনে ব্যর্থ হয়, তবে পার্টি তার উদ্দেশ্য হাসিলেও ব্যর্থ হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনীতির ময়দানে বিদ্যমান ইস্যুর প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা একজন রাজনীতিবিদের আসল কাজ নয় বরং প্রকৃত রাজনীতিবিদ রাজনীতির মাঠে নতুন ইস্যু তৈরী করে এবং ইস্যুকে সংগ্রামের জন্য উপযোগী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করে। ইস্যু নির্ধারনের পর রাজনীতিবিদের কাজ দু’টিঃ
§ ইস্যু সম্পর্কে নিজস্ব আঙ্গিকে বক্তব্য তুলে ধরা
§ ক্ষমতাসীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রদানের মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলন করা। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা যায় দু’ভাবেঃ
প্রত্যক্ষভাবে (Direct)
পরোক্ষভাবে (Indirect)
পরোক্ষ আন্দোলন হচ্ছে সরকারের সহযোগী শক্তি বা শাসকগোষ্ঠীর একাংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রথম আলো বিরোধী আন্দোলনে হিযবুত তাহরীরের সকল কর্মসূচী শুধুমাত্র পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল। এটি সরকারের বিরুদ্ধে একটি পরোক্ষ আন্দোলন। এটা প্রত্যক্ষ আন্দোলন হতো যদি দাবি আদায়ের জন্য আমরা আমাদের মনোযোগ সরকারের প্রতি নিবদ্ধ করতাম।
আমাদের সবার জন্য খুবই জরুরী বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ড (Political Action) আর কর্মপদ্ধতির (Method) মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করা। কর্মপদ্ধতি (Method) একটি স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় বাধ্যতামূলক (ফরয) দায়িত্ব। কর্মপদ্ধতি সুনির্দিষ্ট কিছু স্তরে বিন্যস্ত। কর্মপদ্ধতির প্রতিটি পর্যায় বা স্তরের নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচীর সমন্বিত রুপ। এর উদ্দেশ্য সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড বাস্তবতার নিরীখে পরিবর্তনীয়। তাই সুনির্দিষ্ট বাস্তবতার দিকে গভীর মনোনিবেশ করে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন হয়। উক্ত বাস্তবতার ঘটনা পরম্পরা ও কার্যকারন পর্যালোচনায় কোন যৌক্তিক অনুমান, তুলনা বা সাধারনিকীরণের (সাধারণশ্রেণী ভূক্তিকরণ) আশ্রয় নেয়া যাবে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক ঘটনা বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে শুধু অতীত ধারণা বা যৌক্তিক অনুমানের উপর নির্ভর করা যাবে না। এছাড়া রাজনৈতিক ইস্যুকে গড়পড়তা (Generalization) হিসেবের মধ্যেও ফেলা যাবে না। প্রত্যেকটি ঘটনা সুনির্দিষ্ট এবং এদের আঙ্গিকগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সবকিছুকে বর্তমান বাস্তবতার নিরীখে পর্যালোচনা করেই কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে এবং ময়দানে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করাঃ
জনগনের মধ্যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করা একান্ত জরুরী। সব রাজনৈতিক কর্মসূচী সরকারবিরোধী আন্দোলনে রুপলাভ করবে না। পার্টি রাজনীতির ময়দানে যত বেশী গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরে পরিণত হবে, তত বেশী পার্টির কর্মসূচীকে সরকার হুমকি হিসেবে গণ্য করবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে পার্টি ও সরকার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার জনবিচ্ছিন্ন থাকে, যার ফলে সামান্য সমালোচনাও সরকার হুমকি হিসেবে গণ্য করে। এর বিপরীতে উন্মুক্ত সমাজে (যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়) সরকারের কিছুটা জনসমর্থন বা গণভিত্তি থাকে। এ ধরনের সমাজে সরকারকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে সমালোচনা ও সমর্থন করে থাকে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার মতো অবস্থান তৈরী করতে পার্টিকে অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে পার্টিকে অধিক সংখ্যক জনগণের কাছে পৌঁছে অধিকতর জনসমর্থন এবং ব্যাপক ও গভীরতর গণভিত্তি তৈরীর প্রয়োজন হয়। এভাবে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ বা উদ্বিগ্ন করার মাধ্যমে পার্টিকে সরকারের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরতে হবে।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য পার্টিকে বারে বারে তীব্রভাবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে – তা উন্মুক্ত বা অবরুদ্ধ সমাজ, যাই হোক না কেন। আমরা পার্টি রচিত বিভিন্ন বই-পুস্তকে দেখেছি সরকারবিরোধী আন্দোলনের স্বরুপ অবশ্যই তীব্র ও প্রায় যুদ্ধংদেহী (Fierce and Combative in Style) হতে হবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পাঁজর ক্ষত-বিক্ষত হবে, সরকারের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাভক্তি ধুলোর সাথে মিশে যাবে এবং গণমানুষ এমনভাবে জাগ্রত হবে যেন দিনের পর দিন বিক্ষুদ্ধ মানুষের হাত ও আঙ্গুলের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, যারা সরকারের গলা টিপে ধরবে এবং সরকারকে চিরতরে ধরাশয়ী করবে। এই সংগ্রামে অংশগ্রহনকারীকে অবশ্যই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুধা, ভয়-ভীতি, জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনের জন্য এবং নিজের সময়, শ্রম, সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। রাজনৈতিক সংগ্রামে পার্টির গভীর আন্তরিকতা, স্থির সংকল্প ও অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে জনগণ পার্টিকে নিজের পক্ষের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করবে এবং পার্টি জনগণের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হবে।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে দু’ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রয়োজনঃ
§ জনগণের স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচী
§ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম
জনগণের স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচীঃ
জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার মানে হচ্ছে সরকারের প্রজা প্রতিপালনকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এই বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে কর্মসূচী দেয়া। যখনই সরকার জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করবে অথবা সরকার জনগণের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবে অথবা কোন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উদাসীন থাকবে, তখনই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং সরকারের গণবিরোধী চেহারা জনগনের সামনে উন্মোচিত করতে হবে। জনস্বার্থের বিষয়টি দু’রকমের হতে পারেঃ
§ স্বল্প মেয়াদী সুযোগ সুবিধা বিষয়ক স্বার্থ (যেমন – দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি)
§ স্বল্প মেয়াদী রাজনীতি বিষয়ক স্বার্থ (যেমন – ডঃ ইউনুসের রাজনীতিতে নামার প্রচেষ্টা)
স্বল্প মেয়াদী জনগণের সুযোগ সুবিধা বিষয়ক স্বার্থ লংঘিত ও অবহেলিত হলে বাস্তবতার বর্ণনা করে যে ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায় তা হলোঃ
§ জুলুমের বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং শরী’য়াহ্ হুকুমের বর্ণনা না দিয়ে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা
§ বিদ্যমান সমাধানের মন্দ দিক তুলে ধরা, জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং শরী’য়াহ্ হুকুম ব্যাখ্যা করে সমাধানের পথ বাতলে দেয়া
আর স্বল্প মেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রে যে ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায় তা হলোঃ
§ চলমান বা প্রস্তাবিত সরকার গঠন পদ্ধতিকে সমালোচনার ইস্যু বানানো
§ সংসদের কার্যকারিতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা
§ সরকারের উপর পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী কোম্পানীর প্রভাব জনসমক্ষে তুলে ধরা
§ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী দূতাবাস সমূহের হস্তক্ষেপের বিষয়টি জনগণকে জানানো ইত্যাদি
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামঃ
রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে স্বতন্ত্রভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই সাম্রাজ্যবাদীরাই জনগণের আসল শত্রু।
সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অর্থ হচ্ছে তাদের আগ্রাসনের প্রতিবাদ করা, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক নিয়ন্ত্রনের বিরোধিতা করা, তাদের ষড়যন্ত্র ও কূটচালের স্বরুপ জনগণের সামনে তুলে ধরা যাতে করে উম্মাহ্কে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রনমুক্ত করা যায় এবং দেশে তাদের প্রভাবের মুলোৎপাটন করা যায়। এই সংগ্রামের জন্য আমাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবেঃ
§ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের সকল দালালদের গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে
§ তাদের দালালদের মুখোশ উম্মোচিত করতে হবে
§ তাদের তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র আগে থেকেই বিশ্লেষণ ও অনুমান করে তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে
§ তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে
§ তাদের সকল অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত বা সামরিক অনুদান বর্জন করতে হবে
§ তাদের অনুগত সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে ইত্যাদি
সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করাঃ
সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা। আর জনগণকে সংগঠিত করার মাধ্যমেই এই উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব। শাসকগোষ্ঠীর শক্তি বা সমর্থনের ভিত্তি হয় স্বাভাবিক সমর্থন (Natural Support) বা অস্বাভাবিক সমর্থন (Unnatural Support)।
স্বাভাবিক সমর্থন হচ্ছে জনগণের সমর্থন আর অস্বাভাবিক সমর্থন হচ্ছে বিদেশী শক্তির সমর্থন। এছাড়াও একজন শাসকের শাসনকার্জে সহায়তা করার জন্য থাকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। যদি শাসকের ক্ষমতার ভিত্তি হয় জনগনের সমর্থন, তবে অস্বাভাবিক সমর্থন তথা বিদেশী শক্তির সমর্থনে ক্ষমতায় থাকলে জনগণই শাসকের বিরুদ্ধে সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এছাড়া সরকার যে সব উপায়কে অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকে সেগুলোকে দূর্বল করে ফেলার জন্যও জনগণের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার অর্থ হচ্ছে একটি গণআন্দোলন পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে হিযবুত তাহ্রীর এর কাজ হচ্ছে পার্টির সাথে সরকারের বিরোধিতাকে জনগণের সাথে সরকার বিরোধিতায় পরিণত করা।
গণআন্দোলনের অর্থ হচ্ছে জনগণকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করা। জনগণকে শাসকদের ক্ষতিকর কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক করা, শাসকের অপকর্মের বিরুদ্ধে জনগণকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলা এবং শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কর্মসূচী প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে হিযবুত তাহ্রীর জনগণের নেতৃত্বের আসন অর্জন করবে। গণআন্দোলন তৈরীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাতিয়ার হচ্ছেঃ
§ হালাকার (পাঠচক্র) মাধ্যমে জনগণকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিতে হবে
§ উন্মুক্ত জায়গায় সরাসরি, পরিষ্কার ভাষায়, খোলামেলাভাবে ও সাহসিকতার সাথে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। একজনের সাথে হলেও এভাবেই কথা বলতে হবে এবং একাজ কোন গোপন স্থানে করলে হবে না।
§ জনগণের সাথে গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে এবং মানুষের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক থাকতে হবে। লিফলেট, পোষ্টার ইত্যাদির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্ব বেশী। হিযবুত তাহ্রীর এর সকল সদস্য ও কর্মীকে জনগণের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন ও তা বজায় রাখতে হবে। মসজিদ, দোকানপাট, চায়ের ষ্টল এবং জনসমাগম হয় এরকম যে কোন স্থানই জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপযুক্ত স্থান।
গণআন্দোলন পরিচালনা করার আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা স্বতন্ত্রভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হলো জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের (Strong Personality) প্রয়োজনীয়তা। গণআন্দোলনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে জনগণ রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিবে। জনগণ শুধু উন্নততর চিন্তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নেয় না। জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হলে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। সুতরাং পার্টির সদস্য ও কর্মীবৃন্দকে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত করার জন্য গভীর মনোযোগ দিতে হবে এবং যত্নশীল হতে হবে। পার্টির সদস্যদেরকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইতিমধ্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তথা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে পার্টির চিন্তা চেতনার প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে; সম্ভব হলে তাদেরকে পার্টির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এটা সামগ্রিকভাবে পার্টির ব্যক্তিত্বকেও শাণিত করবে এবং পার্টিকে একটি ব্যাপক প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করবে। এমন একটি পার্টির নেতৃত্বেই জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এগিয়ে আসবে। রাসূল (সাঃ) দুই উমরের এক উমরকে (উমর ইবন্ খাত্তাব বা উমর ইবন্ হাকাম অর্থাৎ আবু জাহ্ল) ইসলামের সমর্থক হিসেবে চেয়ে আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) নিকট দু’আ করেছিলেন। এর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের দৃষ্টিতে ইসলামের দাওয়াতকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া।
শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব মানে হচ্ছে জনগণকে সংগঠিত ও নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা। একজন ব্যক্তি তখনই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় যখন সে জনগণের সমস্যা সমাধানে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে। এ ধরণের কাজ একজন ব্যক্তির মধ্যে তীব্র দায়িত্ববোধের জন্ম দেয় এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে সব ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যোগ্যতা তৈরী হয়। আর এইসব কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে সংগঠিত করার ও নেতৃত্ব দেয়ার গুনাবলী অর্জিত হয়। জনগণের জন্য কাজ করতে গিয়ে সমাজে বন্ধুর পাশাপাশি শত্রু ও প্রতিযোগী তৈরী হয়। এই বন্ধুত্ব, শত্রুতা বা প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হয়। সুতরাং পার্টির কর্মীদের এধরণের কাজ দিতে হবে যাতে করে গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও ধারাবাহিকভাবে জনগণের জন্য কাজ করার মাধ্যমে তা ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হতে পারে। সমাজে বিদ্যমান এধরনের ব্যক্তিত্বকে পার্টির সাথে জড়িয়ে ফেলার বিষয়টিও গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের সংগঠনে এই ধরনের ব্যক্তিত্বদের ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মানানসই করে সাজিয়ে নিতে হবে।
ইসলামে রাজনৈতিক সংগ্রামঃ
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিমরা রাজনৈতিক সংগ্রাম করে আসছে। এটি ইসলামের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ ফরয দায়িত্ব যে, প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য আদেশ করা হয়েছে। খিলাফত পূণঃপ্রতিষ্ঠা বা খলিফার প্রকাশ্য কুফরীর বিরোধিতার মতো বিষয়ে এ ধরনের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
ইসলামিক আকীদার দিকে গভীর মনোযোগ দিলে যে কারো কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ইসলাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন সুযোগই নেই। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মধ্যেই ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক সংগ্রাম নিহিত। একজন মুসলিমের বিশ্বাস তাকে একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে তৈরী করে। পৃথিবীতে মাত্র একজন মুসলিমও যদি বেঁচে থাকে তবে স্থান-কাল নির্বিশেষে তার উপর ফরয দায়িত্ব হবে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সংগ্রাম করা।
পবিত্র কুর’আনের অসংখ্য আয়াত এবং রাসূল (সাঃ) এর বাণীসমূহ রাজনৈতিক সংগ্রামকে গৌরবদীপ্ত ও সম্মানিত কাজ হিসেবে মহিমান্বিত করেছে। এই সমস্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ একজন মুসলিমকে তার দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে এবং শাসককে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। ইসলামে শাসকের জবাবদিহিতার বিষয়টি মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে এ কাজ করার ফল উচ্চ মর্যাদা ও পুরষ্কার আর একাজ করতে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করলে ফলাফল গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “অত্যাচারী শাসকের সামনে কথা বলা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।” রাসূল (সাঃ) শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের মহত্ত্ব ও উচ্চতর মর্যাদাকে তুলে ধরেননি। সংগ্রামরত রাজনৈতিক কর্মী, যে আল্লাহ্র ((সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) পথে জীবন বিলিয়ে দেয় তার মর্যাদার ও পুরষ্কার সম্পর্কেও রাসূল (সাঃ) নিশ্চিত করেছেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “শহীদদের সর্দার হামযা (রাঃ) আর ঐ ব্যক্তি যে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে তার কর্মের জবাবদিহিতা করতে বাধ্য করে এবং একারনে তাকে হত্যা করা হয়।” এই দু’টি হাদীস রাজনৈতিক সংগ্রামের উচ্চমর্যাদা শুধু নিশ্চিতই করে না বরং বলিষ্ঠভাবে অত্যাচারী শাসককে মোকাবেলা করতে উদ্বুদ্ধ করে। হাদীসে উল্লেখিত ‘অত্যাচারী শাসক’ বলতে তার মুখের উপর এবং তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে গিয়ে বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। আর ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে’ বলতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে সাবধান করা, পরামর্শ দেয়া এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহনকারীদের বৈশিষ্ট্যঃ
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যারা ইসলামের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম করবে তাদেরকে ইস্পাত কঠিন মনোবলের অধিকারী হতে হবে। এর কারন হচ্ছে সংগ্রামরত কর্মীকে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। অথচ শাসক ও তার অনুগত চক্রের হাতে রয়েছে সার্বিক রাষ্ট্রযন্ত্র এবং স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র শাসকচক্রের ক্ষোভ গিয়ে সংগ্রামরত মানুষের উপরই নিপতিত হবে। সত্যি কথা হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইচ্ছাশক্তির সংগ্রাম। আর ইচ্ছাশক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উন্নত চিন্তাশক্তির মানুষ দূর্বল চিত্ত হলে এর কোন ফলাফল নেই। একইভাবে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা স্বত্তেও যদি উন্নত ধ্যান-ধারনা না থাকে এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য সঠিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো না থাকে তবে সেই ইচ্ছাশক্তি থাকাটা হবে অর্থহীন। প্রবল ইচ্ছাশক্তির মানে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ মনোভাব এবং ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সংগ্রামের ময়দানে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া। এটা খুবই স্বাভাবিক যে শাসক তার সমস্ত শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে চাইবে বা আন্দোলনের শিকড় উপড়ে ফেলতে চাইবে। শাসক ঘুষ দিবে, লোভ দেখাবে, ভয় দেখাবে, অত্যাচার নির্যাতন করবে, ক্ষুধার্ত রাখবে; এমনকি এসব বিষয়ে শাসক রীতিমত দক্ষ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সংগঠনের কর্মীদেরকে এই অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করতে হবে এবং নিজেদের ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা দিতে হবে। যদি তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে আন্দোলন স্তিমিত ও নিঃশেষ হয়ে যাবে আর যদি তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, তবে তারা লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হবে। যারা এই সংগ্রামে দৃঢ় পদে দাঁড়িয়ে থাকতে ব্যর্থ হবে, তারাই আন্দোলনের প্রকৃত হতাহত।
সুতরাং, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরপঃ
১. উদ্দেশ্যের প্রতি শক্ত ও অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস
২. প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়া
৩. উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সর্বাবস্থায় স্থির সংকল্প ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকা
৪. সাহসিকতা ও দৃঢ়তা
৫. গৃহীত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলনীতির প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা এবং সার্বিকভাবে তা অনুসরন বা মেনে চলা
৬. রাজনৈতিক সংগ্রামে কোন ধরণের নমনীয়তা, আপোষকামীতা, প্রতারনা, আত্নপ্রসাদ লাভ বা অবহেলার সুযোগ নেই
এভাবেই একটি ইসলামিক সংগঠনের সদস্যদেরকে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যসমুহ শুধুমাত্র হিযবুত তাহরীর-এর বৈশিষ্ট্য নয় বরং পার্টির সকল সদস্যের বৈশিষ্ট্য হওয়া ঊচিত। একটি জাতিকে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নেতৃত্ব দেয়া যায় না কারন উম্মাহ পার্টির উন্নত চিন্তা বা তত্ত্ব দ্বারা সন্তুষ্ট নয়। উম্মাহ পার্টিকে তার নেতাদের ব্যক্তিত্বকে দিয়ে পরিমাপ বা বিচার করে। জাতি সংগ্রাম ও সাহসিকতার পূজারী। দুঃসাহসী ও বীরত্বপূর্ণ কাজ গল্পের মতো এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যায় তা চোর-ডাকাত যারই হোক না কেন। সুতরাং পার্টি এবং এর নেতৃত্বকে জনগণ সুক্ষাতিসুক্ষ পরীক্ষার পরই সমগ্র জাতির নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করবে। জাতি কখনোই কাপুরুষ, দুর্বল, প্রতারক বা আত্নতুষ্টিতে নিমগ্ন কাউকে নেতৃত্ব দেয় না।
যেহেতু ইসলামের দাওয়াতকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপরোক্ত গুনাবলী অপরিহার্য এবং এই গুনাবলীগুলো অর্জনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হচ্ছে হয় মৃত্যু, নয় নির্যাতন নতুবা ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষ্ট। আর এর জন্য আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তার পবিত্র কিতাবে এবং রাসুল (সাঃ) তার বর্ণনায় এ দায়িত্ব পালনে অপারগ ব্যক্তিদের তীব্র শাস্তির কথা ঠিক তেমনিভাবেই বলেছেন, যেমনিভাবে মু’মিন ও দৃঢ় ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করেছেন সেই জান্নাতের ব্যাপারে যা এই বিশ্বজগতের মতই বিশাল। কুর’আনের এই আয়াতগুলো জাহান্নাম এবং তার ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই বিস্তারিত যেমনিভাবে বিস্তারিত জান্নাত ও তার ঐশ্বর্যের ব্যাপারে। আর এভাবেই আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মু’মিন বান্দাদের আশ্বস্ত করেন উত্তম প্রতিদানের।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
“আলিফ-লা-মীম! মানুষ কি মনে করে যে তারা একথা বললেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমিতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন যারা সত্যবাদী ও যারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল-আনকাবুতঃ ১-৩)
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
“তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসে নাই? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল এবং তার সহিত ঈমান আনয়নকারীগণ বলেছিল ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ হ্যাঁ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (সূরা আল-বাক্বারাহঃ ২১৪)
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
“তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করিয়াছে এবং কে ধৈর্য্যশীল তা এখনও প্রকাশ করে নি।” (সূরা আল-ইমরানঃ ১৪২)
মুসলিম হোক বা না হোক যে কারো জন্যই সমাজের জীবনধারাকে বদলে দেয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে তাতে জয়লাভ করে নিজেরা ক্ষমতায় আসীন হওয়া। তবে কম্যুনিষ্ট পার্টির কর্মীরা জারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিল কিংবা ‘স্বাধীনতা’ ‘সাম্য’ এবং ‘মুক্তচিন্তা’র প্রচারকরা ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে বাস্তিল দূর্গে কীভাবে লাঞ্ছনা ভোগ করেছিল অথবা যারা ইউরোপের রাজাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল বা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তার গৌরবগাঁথা বর্ণনা করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। বরং আমাদেরকে তুলে ধরতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষ সেইসব সংগ্রামী বীর মুসলিমদের কথা, যারা এই ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, সম্মানহানি ও দারিদ্র-দূর্দশার শিকার হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক সংগ্রাম (Political Struggle) হিযবুত তাহরীর এর কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে আমাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের (Cultural Stage) কাজের স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্যায়। এই নিবন্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিবে এবং পরবর্তীতে আমরা ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যান্য দিক নিয়ে আরো আলোচনা করব। সবার সুবিধার্থে আলোচনাকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১. রাজনৈতিক সংগ্রাম কি? (Definition of Political Struggle)
২. রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন দিক (Aspect of Political Struggle)
৩. ইসলামে রাজনৈতিক সংগ্রাম (Political Struggle in Islam)
৪. রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of those who Struggle for Islam)
রাজনৈতিক সংগ্রাম কি?
রাজনৈতিক সংগ্রামের মানে হচ্ছে শাসক বা যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, তাদের বিরোধিতা করা তথা সরকারের সাথে বিরোধে লিপ্ত হওয়া। পরিপূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন বিরোধিতার নামই রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রাম প্রাণঘাতী বা সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বিভিন্ন কর্মকান্ড বা কথার মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। একটি দেশের নাগরিকদের একটি অংশ সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকে।
মানব সভ্যতা যত পুরনো, রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসও ততো পুরনো। মানুষ যখনই সমাজবদ্ধ বা গোত্রবদ্ধ বা একটি দেশের মধ্যে বসবাস করা শুরু করেছে, তখন থেকেই রাজনৈতিক সংগ্রাম উৎপত্তি। পরিপূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তন কামনাকারী মানুষ একটি সমাজে সব-সময়ই থাকে। সমাজের একটি অংশ হয়তো পুরনো রীতিনীতি বা সামাজিক প্রথার মুলোৎপাটন চায়। অন্যরা হয়তো অবিচার, জলুম ও নিপীড়নের অবসান চায়। আরো কোন গোষ্ঠী হয়তো ক্ষমতায় আরোহণ করতে চায়। এদের মধ্যে কেউ হয়তো সশস্ত্র পন্থার আশ্রয় নেয়, কেউ হয়তো অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে বিশ্বাস করে। আবার কেউ হয়তো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এর মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে।
যে কোন রাজনৈতিক সংগ্রামের দু’টি পক্ষ থাকে। একটি পক্ষে থাকে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান তথা সরকার, যার হাতে থাকে ক্ষমতা, সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সকল যন্ত্র, যারা রাষ্ট্রীয় নীতি ও অবকাঠামো রক্ষায় সর্বাত্নক চেষ্টা চালায়। আর অন্য পক্ষে থাকে নবীন ও দূর্বলেরা, যারা সরকারবিরোধী পক্ষ। এরা জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করে। এই পক্ষ একটি আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার মাধ্যমে একটি কাংক্ষিত পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে।
রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন দিকঃ
রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করার তিনটি দিক রয়েছেঃ
§ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা
§ সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করা
§ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা
রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করাঃ
রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রথম ধাপ হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার মাধ্যমেই একটি দল রাজনীতির ময়দানে নিজের জন্য অবস্থান তৈরী করে নেয় এবং ধীরে ধীরে একটি দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী সবসময় রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্মকে তার ক্ষমতার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে। লেখক, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবিদের লেখালেখি ও সমালোচনায় একটি সরকার তেমন উদ্বিগ্ন হয় না।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হলে রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সার্বক্ষনিক সচেতনতা থাকতে হবে এবং রাজনীতির ময়দানের আলোচিত ইস্যু সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। একটি দেশে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে এবং অসংখ্য ইস্যু জন্ম নেয়। এইসব ঘটনা আর ইস্যুই একজন রাজনীতিবিদের লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার। তাই রাজনীতিবিদকে সার্বক্ষনিকভাবে নিচের কাজগুলো করতে হয়ঃ
§ নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে
§ গভীর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার অধিকারী হতে হয়, যাতে রাজনৈতিক সংগ্রামের উপযোগী ইস্যু নির্বাচন করা যায় অথবা সংগ্রামের জন্য ইস্যু তৈরী করা যায়।
নিয়মিত ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনায় ব্যর্থ হলে সঠিক ইস্যু নির্ধারনে আমরা ব্যর্থ হবো। এর ফলে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হবে এবং পার্টির অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়বে। পার্টি যদি বারে বারে সঠিক ইস্যু নির্ধারনে ব্যর্থ হয়, তবে পার্টি তার উদ্দেশ্য হাসিলেও ব্যর্থ হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনীতির ময়দানে বিদ্যমান ইস্যুর প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা একজন রাজনীতিবিদের আসল কাজ নয় বরং প্রকৃত রাজনীতিবিদ রাজনীতির মাঠে নতুন ইস্যু তৈরী করে এবং ইস্যুকে সংগ্রামের জন্য উপযোগী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করে। ইস্যু নির্ধারনের পর রাজনীতিবিদের কাজ দু’টিঃ
§ ইস্যু সম্পর্কে নিজস্ব আঙ্গিকে বক্তব্য তুলে ধরা
§ ক্ষমতাসীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রদানের মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলন করা। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা যায় দু’ভাবেঃ
প্রত্যক্ষভাবে (Direct)
পরোক্ষভাবে (Indirect)
পরোক্ষ আন্দোলন হচ্ছে সরকারের সহযোগী শক্তি বা শাসকগোষ্ঠীর একাংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রথম আলো বিরোধী আন্দোলনে হিযবুত তাহরীরের সকল কর্মসূচী শুধুমাত্র পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল। এটি সরকারের বিরুদ্ধে একটি পরোক্ষ আন্দোলন। এটা প্রত্যক্ষ আন্দোলন হতো যদি দাবি আদায়ের জন্য আমরা আমাদের মনোযোগ সরকারের প্রতি নিবদ্ধ করতাম।
আমাদের সবার জন্য খুবই জরুরী বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ড (Political Action) আর কর্মপদ্ধতির (Method) মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করা। কর্মপদ্ধতি (Method) একটি স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় বাধ্যতামূলক (ফরয) দায়িত্ব। কর্মপদ্ধতি সুনির্দিষ্ট কিছু স্তরে বিন্যস্ত। কর্মপদ্ধতির প্রতিটি পর্যায় বা স্তরের নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচীর সমন্বিত রুপ। এর উদ্দেশ্য সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড বাস্তবতার নিরীখে পরিবর্তনীয়। তাই সুনির্দিষ্ট বাস্তবতার দিকে গভীর মনোনিবেশ করে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন হয়। উক্ত বাস্তবতার ঘটনা পরম্পরা ও কার্যকারন পর্যালোচনায় কোন যৌক্তিক অনুমান, তুলনা বা সাধারনিকীরণের (সাধারণশ্রেণী ভূক্তিকরণ) আশ্রয় নেয়া যাবে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক ঘটনা বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে শুধু অতীত ধারণা বা যৌক্তিক অনুমানের উপর নির্ভর করা যাবে না। এছাড়া রাজনৈতিক ইস্যুকে গড়পড়তা (Generalization) হিসেবের মধ্যেও ফেলা যাবে না। প্রত্যেকটি ঘটনা সুনির্দিষ্ট এবং এদের আঙ্গিকগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সবকিছুকে বর্তমান বাস্তবতার নিরীখে পর্যালোচনা করেই কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে এবং ময়দানে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করাঃ
জনগনের মধ্যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করা একান্ত জরুরী। সব রাজনৈতিক কর্মসূচী সরকারবিরোধী আন্দোলনে রুপলাভ করবে না। পার্টি রাজনীতির ময়দানে যত বেশী গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরে পরিণত হবে, তত বেশী পার্টির কর্মসূচীকে সরকার হুমকি হিসেবে গণ্য করবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে পার্টি ও সরকার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার জনবিচ্ছিন্ন থাকে, যার ফলে সামান্য সমালোচনাও সরকার হুমকি হিসেবে গণ্য করে। এর বিপরীতে উন্মুক্ত সমাজে (যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়) সরকারের কিছুটা জনসমর্থন বা গণভিত্তি থাকে। এ ধরনের সমাজে সরকারকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে সমালোচনা ও সমর্থন করে থাকে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার মতো অবস্থান তৈরী করতে পার্টিকে অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে পার্টিকে অধিক সংখ্যক জনগণের কাছে পৌঁছে অধিকতর জনসমর্থন এবং ব্যাপক ও গভীরতর গণভিত্তি তৈরীর প্রয়োজন হয়। এভাবে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ বা উদ্বিগ্ন করার মাধ্যমে পার্টিকে সরকারের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরতে হবে।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য পার্টিকে বারে বারে তীব্রভাবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে – তা উন্মুক্ত বা অবরুদ্ধ সমাজ, যাই হোক না কেন। আমরা পার্টি রচিত বিভিন্ন বই-পুস্তকে দেখেছি সরকারবিরোধী আন্দোলনের স্বরুপ অবশ্যই তীব্র ও প্রায় যুদ্ধংদেহী (Fierce and Combative in Style) হতে হবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পাঁজর ক্ষত-বিক্ষত হবে, সরকারের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাভক্তি ধুলোর সাথে মিশে যাবে এবং গণমানুষ এমনভাবে জাগ্রত হবে যেন দিনের পর দিন বিক্ষুদ্ধ মানুষের হাত ও আঙ্গুলের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, যারা সরকারের গলা টিপে ধরবে এবং সরকারকে চিরতরে ধরাশয়ী করবে। এই সংগ্রামে অংশগ্রহনকারীকে অবশ্যই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুধা, ভয়-ভীতি, জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনের জন্য এবং নিজের সময়, শ্রম, সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। রাজনৈতিক সংগ্রামে পার্টির গভীর আন্তরিকতা, স্থির সংকল্প ও অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে জনগণ পার্টিকে নিজের পক্ষের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করবে এবং পার্টি জনগণের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হবে।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে দু’ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রয়োজনঃ
§ জনগণের স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচী
§ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম
জনগণের স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচীঃ
জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার মানে হচ্ছে সরকারের প্রজা প্রতিপালনকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এই বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে কর্মসূচী দেয়া। যখনই সরকার জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করবে অথবা সরকার জনগণের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবে অথবা কোন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উদাসীন থাকবে, তখনই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং সরকারের গণবিরোধী চেহারা জনগনের সামনে উন্মোচিত করতে হবে। জনস্বার্থের বিষয়টি দু’রকমের হতে পারেঃ
§ স্বল্প মেয়াদী সুযোগ সুবিধা বিষয়ক স্বার্থ (যেমন – দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি)
§ স্বল্প মেয়াদী রাজনীতি বিষয়ক স্বার্থ (যেমন – ডঃ ইউনুসের রাজনীতিতে নামার প্রচেষ্টা)
স্বল্প মেয়াদী জনগণের সুযোগ সুবিধা বিষয়ক স্বার্থ লংঘিত ও অবহেলিত হলে বাস্তবতার বর্ণনা করে যে ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায় তা হলোঃ
§ জুলুমের বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং শরী’য়াহ্ হুকুমের বর্ণনা না দিয়ে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা
§ বিদ্যমান সমাধানের মন্দ দিক তুলে ধরা, জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং শরী’য়াহ্ হুকুম ব্যাখ্যা করে সমাধানের পথ বাতলে দেয়া
আর স্বল্প মেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রে যে ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায় তা হলোঃ
§ চলমান বা প্রস্তাবিত সরকার গঠন পদ্ধতিকে সমালোচনার ইস্যু বানানো
§ সংসদের কার্যকারিতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা
§ সরকারের উপর পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী কোম্পানীর প্রভাব জনসমক্ষে তুলে ধরা
§ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী দূতাবাস সমূহের হস্তক্ষেপের বিষয়টি জনগণকে জানানো ইত্যাদি
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামঃ
রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে স্বতন্ত্রভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই সাম্রাজ্যবাদীরাই জনগণের আসল শত্রু।
সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অর্থ হচ্ছে তাদের আগ্রাসনের প্রতিবাদ করা, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক নিয়ন্ত্রনের বিরোধিতা করা, তাদের ষড়যন্ত্র ও কূটচালের স্বরুপ জনগণের সামনে তুলে ধরা যাতে করে উম্মাহ্কে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রনমুক্ত করা যায় এবং দেশে তাদের প্রভাবের মুলোৎপাটন করা যায়। এই সংগ্রামের জন্য আমাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবেঃ
§ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের সকল দালালদের গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে
§ তাদের দালালদের মুখোশ উম্মোচিত করতে হবে
§ তাদের তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র আগে থেকেই বিশ্লেষণ ও অনুমান করে তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে
§ তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে হবে
§ তাদের সকল অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত বা সামরিক অনুদান বর্জন করতে হবে
§ তাদের অনুগত সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে ইত্যাদি
সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করাঃ
সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা। আর জনগণকে সংগঠিত করার মাধ্যমেই এই উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব। শাসকগোষ্ঠীর শক্তি বা সমর্থনের ভিত্তি হয় স্বাভাবিক সমর্থন (Natural Support) বা অস্বাভাবিক সমর্থন (Unnatural Support)।
স্বাভাবিক সমর্থন হচ্ছে জনগণের সমর্থন আর অস্বাভাবিক সমর্থন হচ্ছে বিদেশী শক্তির সমর্থন। এছাড়াও একজন শাসকের শাসনকার্জে সহায়তা করার জন্য থাকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। যদি শাসকের ক্ষমতার ভিত্তি হয় জনগনের সমর্থন, তবে অস্বাভাবিক সমর্থন তথা বিদেশী শক্তির সমর্থনে ক্ষমতায় থাকলে জনগণই শাসকের বিরুদ্ধে সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এছাড়া সরকার যে সব উপায়কে অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকে সেগুলোকে দূর্বল করে ফেলার জন্যও জনগণের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার অর্থ হচ্ছে একটি গণআন্দোলন পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে হিযবুত তাহ্রীর এর কাজ হচ্ছে পার্টির সাথে সরকারের বিরোধিতাকে জনগণের সাথে সরকার বিরোধিতায় পরিণত করা।
গণআন্দোলনের অর্থ হচ্ছে জনগণকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করা। জনগণকে শাসকদের ক্ষতিকর কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক করা, শাসকের অপকর্মের বিরুদ্ধে জনগণকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলা এবং শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কর্মসূচী প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে হিযবুত তাহ্রীর জনগণের নেতৃত্বের আসন অর্জন করবে। গণআন্দোলন তৈরীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাতিয়ার হচ্ছেঃ
§ হালাকার (পাঠচক্র) মাধ্যমে জনগণকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিতে হবে
§ উন্মুক্ত জায়গায় সরাসরি, পরিষ্কার ভাষায়, খোলামেলাভাবে ও সাহসিকতার সাথে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। একজনের সাথে হলেও এভাবেই কথা বলতে হবে এবং একাজ কোন গোপন স্থানে করলে হবে না।
§ জনগণের সাথে গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে এবং মানুষের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক থাকতে হবে। লিফলেট, পোষ্টার ইত্যাদির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্ব বেশী। হিযবুত তাহ্রীর এর সকল সদস্য ও কর্মীকে জনগণের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন ও তা বজায় রাখতে হবে। মসজিদ, দোকানপাট, চায়ের ষ্টল এবং জনসমাগম হয় এরকম যে কোন স্থানই জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপযুক্ত স্থান।
গণআন্দোলন পরিচালনা করার আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা স্বতন্ত্রভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হলো জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের (Strong Personality) প্রয়োজনীয়তা। গণআন্দোলনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে জনগণ রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিবে। জনগণ শুধু উন্নততর চিন্তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নেয় না। জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হলে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। সুতরাং পার্টির সদস্য ও কর্মীবৃন্দকে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত করার জন্য গভীর মনোযোগ দিতে হবে এবং যত্নশীল হতে হবে। পার্টির সদস্যদেরকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইতিমধ্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তথা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে পার্টির চিন্তা চেতনার প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে; সম্ভব হলে তাদেরকে পার্টির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এটা সামগ্রিকভাবে পার্টির ব্যক্তিত্বকেও শাণিত করবে এবং পার্টিকে একটি ব্যাপক প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করবে। এমন একটি পার্টির নেতৃত্বেই জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এগিয়ে আসবে। রাসূল (সাঃ) দুই উমরের এক উমরকে (উমর ইবন্ খাত্তাব বা উমর ইবন্ হাকাম অর্থাৎ আবু জাহ্ল) ইসলামের সমর্থক হিসেবে চেয়ে আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) নিকট দু’আ করেছিলেন। এর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের দৃষ্টিতে ইসলামের দাওয়াতকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া।
শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব মানে হচ্ছে জনগণকে সংগঠিত ও নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা। একজন ব্যক্তি তখনই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় যখন সে জনগণের সমস্যা সমাধানে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে। এ ধরণের কাজ একজন ব্যক্তির মধ্যে তীব্র দায়িত্ববোধের জন্ম দেয় এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে সব ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যোগ্যতা তৈরী হয়। আর এইসব কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে সংগঠিত করার ও নেতৃত্ব দেয়ার গুনাবলী অর্জিত হয়। জনগণের জন্য কাজ করতে গিয়ে সমাজে বন্ধুর পাশাপাশি শত্রু ও প্রতিযোগী তৈরী হয়। এই বন্ধুত্ব, শত্রুতা বা প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হয়। সুতরাং পার্টির কর্মীদের এধরণের কাজ দিতে হবে যাতে করে গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও ধারাবাহিকভাবে জনগণের জন্য কাজ করার মাধ্যমে তা ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হতে পারে। সমাজে বিদ্যমান এধরনের ব্যক্তিত্বকে পার্টির সাথে জড়িয়ে ফেলার বিষয়টিও গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের সংগঠনে এই ধরনের ব্যক্তিত্বদের ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মানানসই করে সাজিয়ে নিতে হবে।
ইসলামে রাজনৈতিক সংগ্রামঃ
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিমরা রাজনৈতিক সংগ্রাম করে আসছে। এটি ইসলামের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ ফরয দায়িত্ব যে, প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য আদেশ করা হয়েছে। খিলাফত পূণঃপ্রতিষ্ঠা বা খলিফার প্রকাশ্য কুফরীর বিরোধিতার মতো বিষয়ে এ ধরনের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
ইসলামিক আকীদার দিকে গভীর মনোযোগ দিলে যে কারো কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ইসলাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন সুযোগই নেই। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মধ্যেই ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক সংগ্রাম নিহিত। একজন মুসলিমের বিশ্বাস তাকে একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে তৈরী করে। পৃথিবীতে মাত্র একজন মুসলিমও যদি বেঁচে থাকে তবে স্থান-কাল নির্বিশেষে তার উপর ফরয দায়িত্ব হবে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সংগ্রাম করা।
পবিত্র কুর’আনের অসংখ্য আয়াত এবং রাসূল (সাঃ) এর বাণীসমূহ রাজনৈতিক সংগ্রামকে গৌরবদীপ্ত ও সম্মানিত কাজ হিসেবে মহিমান্বিত করেছে। এই সমস্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ একজন মুসলিমকে তার দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে এবং শাসককে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। ইসলামে শাসকের জবাবদিহিতার বিষয়টি মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে এ কাজ করার ফল উচ্চ মর্যাদা ও পুরষ্কার আর একাজ করতে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করলে ফলাফল গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “অত্যাচারী শাসকের সামনে কথা বলা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।” রাসূল (সাঃ) শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের মহত্ত্ব ও উচ্চতর মর্যাদাকে তুলে ধরেননি। সংগ্রামরত রাজনৈতিক কর্মী, যে আল্লাহ্র ((সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) পথে জীবন বিলিয়ে দেয় তার মর্যাদার ও পুরষ্কার সম্পর্কেও রাসূল (সাঃ) নিশ্চিত করেছেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “শহীদদের সর্দার হামযা (রাঃ) আর ঐ ব্যক্তি যে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে তার কর্মের জবাবদিহিতা করতে বাধ্য করে এবং একারনে তাকে হত্যা করা হয়।” এই দু’টি হাদীস রাজনৈতিক সংগ্রামের উচ্চমর্যাদা শুধু নিশ্চিতই করে না বরং বলিষ্ঠভাবে অত্যাচারী শাসককে মোকাবেলা করতে উদ্বুদ্ধ করে। হাদীসে উল্লেখিত ‘অত্যাচারী শাসক’ বলতে তার মুখের উপর এবং তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে গিয়ে বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। আর ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে’ বলতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে সাবধান করা, পরামর্শ দেয়া এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহনকারীদের বৈশিষ্ট্যঃ
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যারা ইসলামের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম করবে তাদেরকে ইস্পাত কঠিন মনোবলের অধিকারী হতে হবে। এর কারন হচ্ছে সংগ্রামরত কর্মীকে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। অথচ শাসক ও তার অনুগত চক্রের হাতে রয়েছে সার্বিক রাষ্ট্রযন্ত্র এবং স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র শাসকচক্রের ক্ষোভ গিয়ে সংগ্রামরত মানুষের উপরই নিপতিত হবে। সত্যি কথা হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইচ্ছাশক্তির সংগ্রাম। আর ইচ্ছাশক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উন্নত চিন্তাশক্তির মানুষ দূর্বল চিত্ত হলে এর কোন ফলাফল নেই। একইভাবে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা স্বত্তেও যদি উন্নত ধ্যান-ধারনা না থাকে এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য সঠিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো না থাকে তবে সেই ইচ্ছাশক্তি থাকাটা হবে অর্থহীন। প্রবল ইচ্ছাশক্তির মানে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ মনোভাব এবং ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সংগ্রামের ময়দানে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া। এটা খুবই স্বাভাবিক যে শাসক তার সমস্ত শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে চাইবে বা আন্দোলনের শিকড় উপড়ে ফেলতে চাইবে। শাসক ঘুষ দিবে, লোভ দেখাবে, ভয় দেখাবে, অত্যাচার নির্যাতন করবে, ক্ষুধার্ত রাখবে; এমনকি এসব বিষয়ে শাসক রীতিমত দক্ষ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সংগঠনের কর্মীদেরকে এই অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করতে হবে এবং নিজেদের ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা দিতে হবে। যদি তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে আন্দোলন স্তিমিত ও নিঃশেষ হয়ে যাবে আর যদি তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, তবে তারা লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হবে। যারা এই সংগ্রামে দৃঢ় পদে দাঁড়িয়ে থাকতে ব্যর্থ হবে, তারাই আন্দোলনের প্রকৃত হতাহত।
সুতরাং, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরপঃ
১. উদ্দেশ্যের প্রতি শক্ত ও অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস
২. প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়া
৩. উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সর্বাবস্থায় স্থির সংকল্প ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকা
৪. সাহসিকতা ও দৃঢ়তা
৫. গৃহীত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলনীতির প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা এবং সার্বিকভাবে তা অনুসরন বা মেনে চলা
৬. রাজনৈতিক সংগ্রামে কোন ধরণের নমনীয়তা, আপোষকামীতা, প্রতারনা, আত্নপ্রসাদ লাভ বা অবহেলার সুযোগ নেই
এভাবেই একটি ইসলামিক সংগঠনের সদস্যদেরকে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যসমুহ শুধুমাত্র হিযবুত তাহরীর-এর বৈশিষ্ট্য নয় বরং পার্টির সকল সদস্যের বৈশিষ্ট্য হওয়া ঊচিত। একটি জাতিকে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নেতৃত্ব দেয়া যায় না কারন উম্মাহ পার্টির উন্নত চিন্তা বা তত্ত্ব দ্বারা সন্তুষ্ট নয়। উম্মাহ পার্টিকে তার নেতাদের ব্যক্তিত্বকে দিয়ে পরিমাপ বা বিচার করে। জাতি সংগ্রাম ও সাহসিকতার পূজারী। দুঃসাহসী ও বীরত্বপূর্ণ কাজ গল্পের মতো এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যায় তা চোর-ডাকাত যারই হোক না কেন। সুতরাং পার্টি এবং এর নেতৃত্বকে জনগণ সুক্ষাতিসুক্ষ পরীক্ষার পরই সমগ্র জাতির নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করবে। জাতি কখনোই কাপুরুষ, দুর্বল, প্রতারক বা আত্নতুষ্টিতে নিমগ্ন কাউকে নেতৃত্ব দেয় না।
যেহেতু ইসলামের দাওয়াতকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপরোক্ত গুনাবলী অপরিহার্য এবং এই গুনাবলীগুলো অর্জনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হচ্ছে হয় মৃত্যু, নয় নির্যাতন নতুবা ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষ্ট। আর এর জন্য আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তার পবিত্র কিতাবে এবং রাসুল (সাঃ) তার বর্ণনায় এ দায়িত্ব পালনে অপারগ ব্যক্তিদের তীব্র শাস্তির কথা ঠিক তেমনিভাবেই বলেছেন, যেমনিভাবে মু’মিন ও দৃঢ় ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করেছেন সেই জান্নাতের ব্যাপারে যা এই বিশ্বজগতের মতই বিশাল। কুর’আনের এই আয়াতগুলো জাহান্নাম এবং তার ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই বিস্তারিত যেমনিভাবে বিস্তারিত জান্নাত ও তার ঐশ্বর্যের ব্যাপারে। আর এভাবেই আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মু’মিন বান্দাদের আশ্বস্ত করেন উত্তম প্রতিদানের।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
“আলিফ-লা-মীম! মানুষ কি মনে করে যে তারা একথা বললেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমিতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন যারা সত্যবাদী ও যারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল-আনকাবুতঃ ১-৩)
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
“তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসে নাই? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল এবং তার সহিত ঈমান আনয়নকারীগণ বলেছিল ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ হ্যাঁ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (সূরা আল-বাক্বারাহঃ ২১৪)
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
“তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করিয়াছে এবং কে ধৈর্য্যশীল তা এখনও প্রকাশ করে নি।” (সূরা আল-ইমরানঃ ১৪২)
মুসলিম হোক বা না হোক যে কারো জন্যই সমাজের জীবনধারাকে বদলে দেয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে তাতে জয়লাভ করে নিজেরা ক্ষমতায় আসীন হওয়া। তবে কম্যুনিষ্ট পার্টির কর্মীরা জারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিল কিংবা ‘স্বাধীনতা’ ‘সাম্য’ এবং ‘মুক্তচিন্তা’র প্রচারকরা ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে বাস্তিল দূর্গে কীভাবে লাঞ্ছনা ভোগ করেছিল অথবা যারা ইউরোপের রাজাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল বা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তার গৌরবগাঁথা বর্ণনা করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। বরং আমাদেরকে তুলে ধরতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষ সেইসব সংগ্রামী বীর মুসলিমদের কথা, যারা এই ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, সম্মানহানি ও দারিদ্র-দূর্দশার শিকার হয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment