20.11.13

অধ্যায় ৪ ~ যে ভাবে দারুল ইসলাম (ইসলামী রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠা করতে হয়

আমরা এখন শরীয়া কতৃক নির্ধারিত কর্মপদ্ধতি ও এর বিভিন্ন ধাপ নিয়ে আলোচনা করব যা দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

আমরা আলোচনাকে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করবঃ

§  একটি ভাগে থাকবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পরিবর্তনের পদ্ধতি।
§  দ্বিতীয় ভাগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পদ্ধতিতে একটি দলের পরিবর্তনের কাজের পদ্ধতি আলোচিত হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে গঠন/চিন্তার বিকাশের পর্যায়

যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে দাওয়াতের কাজের দায়িত্ব দেয়া হল তখন তিনি লোকদের সেদিকে আহ্বান জানাতে আরম্ভ করলেন। কেউ কেউ তার আহ্বানের উপর বিশ্বাস স্থাপন করল এবং কেউ কেউ অবিশ্বাস করল। যখন মক্কায় ইসলাম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করল তখন সাধারণ জনতা এটা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শুরুতে তাদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করতেন। মক্কায় তিনি লোকদের প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতেন আল্লাহর কিতাব অনুযায়ীঃ

হে চাদরাবৃত, উঠুন, সতর্ক করুন (সূরা আল মুদ্দাসসিরঃ ১-)

তিনি প্রথমে দলটিকে গোপনে সংঘটিত করেন। সাহাবাগন (রাঃ) তখন লোকালয় থেকে দূরে উপত্যকায় গিয়ে সালাত আদায় করতেন। নতুন কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তৎক্ষণাৎ কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য কাউকে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি যয়নব বিনতে আল খাত্তাব ও তার স্বামী সাইদকে কুরআন শিক্ষার জন্য খাব্বাব বিন আরাতকে তাদের বাড়িতে প্রেরণ করেন। এটি সেই হালাকা বা পাঠদানচক্র ছিল যেখানে সাইয়্যুদনা ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি (সাঃ) আল আরকামের বাড়ীটিকে বিশ্বাসীদের কেন্দ্র ও নতুন দাওয়াতের জন্য বিদ্যায়তন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ বাড়ীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরআন শিক্ষা দিতেন ও সাহাবীদের মুখস্থ ও উপলদ্ধি করবার পরামর্শ দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ততক্ষণ পর্যন্ত সাহাবীদের গোপনে শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত নিম্নের আয়াতটি নাজিল না হয়ঃ

অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না। (সূরা হিজরঃ ৯৪)

শুরুতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বয়স, সামাজিক পদমর্যাদা, নারী-পুরুষ, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশের আগে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ, বয়সের প্রায় চল্লিশজন নারী ও পুরুষ এ দলের সাথে যুক্ত হয়। তারা বিভিন্ন বয়সের হলেও অধিকাংশই ছিল তরুণ। ধনী, দরিদ্র, দূর্বল ও শক্তিশালী সব অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল।

যখন চিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে সাহাবাগন (রাঃ) পরিণত হল, তাদের মনস্তত্ত্ব (আকলিয়া) সুগঠিত হল অর্থাৎ সেটি ইসলামিক হয়ে গেল এবং তাদের নাফসিয়াও ইসলামিক হল ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন নিশ্চিত হলেন যে এ দলটি পুরো সমাজকে মোকাবেলা করবার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তখন তিনি আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে আর্বিভূত হলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে যেদিন দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল সেদিন থেকে ইসলামের দাওয়াত ছিল প্রকাশ্য। মক্কার লোকেরা জানত মুহম্মদ (সাঃ) নতুন দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন এবং অনেক লোক ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। তারা এটাও জানত যে, নবদীক্ষিত মুসলিমরা এই নতুন দ্বীনের সাথে তাদের সর্ম্পক ও এর প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টি গোপন করছে। এ তথ্য জানার অর্থ হল নতুন দাওয়াত ও দাওয়াত গ্রহণকারী নতুন লোকদের সর্ম্পকে মক্কাবাসীর একধরনের অনুভূতি ছিল, যদিও তারা জানত না কারা মিলিত হচ্ছে এবং কোথায় মিলিত হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইসলামের প্রতি দাওয়াত একেবারে নতুন ছিল না, বরং যা নতুন ছিল তা হল বিশ্বাসীদের নতুন এই দলটির প্রকাশ্যে আর্বিভাব।

যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এ আয়াতটি নাজিল হলঃ

অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না। বিদ্রূপকারীদের জন্যে আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য সাব্যস্ত করে, অতিসত্বর তারা জেনে নেবে। (সূরা আল হিজরঃ ৯৪-৯৬)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতের ঘোষণা দিলেন এবং এর মাধ্যমে দাওয়াত ব্যক্তি পর্যায় থেকে গনপর্যায়ে উন্নীত হল। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আগ্রহী লোকদের গোপনে দাওয়াত করবার পর্যায় থেকে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে গনসংযোগ পর্যায়ে নিয়ে আসলেন। এটা ছিল ঈমান ও কুফরের মধ্যকার দ্বন্দের সূত্রপাত এবং সঠিক চিন্তা ও ভুল চিন্তার মধ্যকার সংঘাত। সুতরাং দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হল। এটি হল গনসংযোগ ও সংগ্রাম করবার পর্যায় এবং সব সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভয়াবহ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাড়ীতে পাথর ছুড়ে মারা হল। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাড়ীর পথে ময়লা ফেলে রাখত। নবী (সাঃ) এগুলো পরিষ্কার করে সন্তুষ্ট থাকতেন। আবু জাহেল তাদের দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত ভেড়ার নাড়িভূড়ি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বরাবর ছুড়ে মারে। কিন্তু এসব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ধৈর্য্য এবং সহ্যক্ষমতাই বৃদ্ধি করছিল কেব। মুসলমানদের সতর্ক করা হচ্ছিল ও ক্ষতিসাধন করা হচ্ছিল। দ্বীন গ্রহণ করবার কারণে প্রত্যেক গোত্রই মুসলিমদের অত্যাচার ও যন্ত্রনা দিতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ অত্যাচারের শিকার হয়েছিল বিলাল, আম্মার, তার মা ও বাবা এবং আরও অনেকে, যারা দূর্ভোগ লাভ ও অকথ্য নির্যাতনের পরও দৃঢ়তার উত্তম দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল।

শুরুতে কাফেররা (কুরাইশগন) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কথা একজন নেহায়েত ধর্মপ্রচারক বা জ্ঞানী ব্যক্তির ভাবালুতা মনে করে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তারা মনে করত লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবে। সেকারণে তারা মুহম্মদ (সাঃ) কে দোষারোপ করেনি বা তার থেকে পালাতে চেষ্টা করেনি। যখন তাদের আড্ডার সামনে দিয়ে তিনি যেতেন তখন তারা বলত, ‘এই হল আবদুল মুত্তালিবের সন্তান যে আকাশ থেকে আগত বাণী প্রচার করে।রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের দেবতাদের কথা উল্লেখ করে এগুলোকে অসম্মান করলেন, তাদের চিন্তা ও পূর্বপুরুষদের পথভ্রষ্টতার জন্য দোষারোপ করার মাধ্যমে তিনি বিরোধিতা শুরু করলেন ও দ্বন্দে অবতীর্ণ  হলেন। অতঃপর তারা তাকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিল এবং বিরোধিতায়, শত্রুতায় এবং সহিংসতায় তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হল।

তার নবুয়্যতের দাবীকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করা হয়েছে। সেকারণে তারা তার আলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্নক উপায়ে অবগত হওয়ার চেষ্টা করল। তারা বলতঃ তাহলে মুহম্মদ কেন সাফা ও মারওয়া স্বর্ণে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে না?’ ‘কেন আকাশ থেকে একটি কিতাব নাজিল হচ্ছে না?’  কেন জিবরাইল তাদের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে না?’ ‘কেন সে মৃতকে জীবিত করে দেখাচ্ছে না?’ ধীরে ধীরে তারা আরও একগুয়ে হতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর প্রভুর নির্দেশের প্রতি লোকদের আহ্বান অব্যাহত রাখল। কুরাইশরা তাঁকে দাওয়াত থেকে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। সাহাবীদের উপর অত্যাচার, প্রপাগান্ডা ও বয়কট এবং এ ধরনের আরও অপচেষ্টা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে আল্লাহর রজ্জুকে আরও দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে সাহায্য করেছে এবং দাওয়াতের প্রতি প্রবল আগ্রহী করে তুলেছে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং তাঁর উপর অত্যাচারের খবর বিভিন্ন গোত্রের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এবং দাওয়াতের বিষয়টি সাধারণভাবে সবার জানা ছিল। পুরো উপদ্বীপ ইসলাম সর্ম্পকে জানত এবং আরোহীরা বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম নিয়ে কথা বলত। লোকদের সাথে পবিত্র মাসসমূহ ছাড়া মুসলিমদের যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবার কাছে এসে লোকদের আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানাতেন, তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) পক্ষ থেকে পুরষ্কারের সুসংবাদ জানাতেন এবং তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) শাস্তি ও ক্রোধ থেকে সতর্ক করতেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে গনসংযোগ পর্যায়

কুরাইশদের সাথে দাওয়াত নিয়ে সংঘাত ছিল স্বাভাবিক। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই দলটিকে সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পদ্ধতিতে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন। দাওয়াতের প্রকৃতির কারণে মক্কার সমাজ ও কুরাইশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এ দাওয়াত এক আল্লাহর উপাসনা ও তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেছিল এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বলেছিল ও যে দূর্নীতিগ্রস্ত নষ্ট শাসনব্যবস্থার মধ্যে তারা বসবাস করত তার সমূল উৎপাটন করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। তিনি তাদের স্রষ্টাকে উপহাস করতেন, সস্তা জীবনধারাকে আক্রমণ করতেন এবং তাদের জীবনব্যবস্থার অবৈধ দিকসমূহ উন্মোচন করতেন। তিনি সত্য দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতেন এবং তারাও করত মিথ্যে ও গুজব দ্বারা। তিনি লোকদের সুস্পষ্টভাবে আহ্বান জানাতেন এবং এ আহ্বানে কোন দ্ব্যর্থবোধকতা, নমনীয়তা বা বশ্যতার লেশমাত্রও ছিল না। সব অত্যাচার, প্রত্যাখান, বিতাড়ন, গুজব ও বয়কটকে তোয়াক্কা করে তিনি এসব কিছু করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লোকদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দিলেন এবং ইসলাম প্রসারিত হওয়া শুরু করল।

যখন তাঁর (সাঃ) স্ত্রী ও চাচা মারা গেলেন এবং কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা আরও ঘনীভূত হল তখন তিনি সমর্থন আদায় ও নিরাপত্তার জন্য তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন এই ভেবে যে, হয়ত তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু তারা অকল্পনীয়ভাবে মন্দ আচরণ ও শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে প্রত্যাখান করল। তিনি এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হলেন যখন নিরাপত্তা ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করতে পারছিলেন না। সেদিন তিনি আল মুতঈম বিন আদি এর প্রহরায় মক্কায় প্রবেশ করলেন। কুরাইশ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে লাগল এবং প্রত্যাখান এর মাত্রা আরও প্রবল হল। বিরোধীরা তার কথা শুনতে লোকদের বারণ করত এবং এটা খুব বেশী কার্যকর হয়নি। হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন গোত্রের কাছে তিনি যাওয়া শুরু করলেন এবং তাদের ইসলামের দিকে আহ্বান করা শুরু করলেন ও প্রচার করলেন যে, তিনি একজন আল্লাহ প্রেরিত রাসূল ও এতে তাদের বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। তাঁর চাচা আবু লাহাব সাধারণত তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনত এবং লোকদের তাঁর কথা না শুনবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করত। এ প্রচারণার একটা প্রভাব শ্রোতাদের উপর পড়ত, যেমনঃ তারা মাঝে মাঝে শুনত না। তারপর তিনি গেলেন বানু কিন্দা, বানু কাব, বানু হানিফা, বানু আমির বিন সাসা এর কাছে। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করল না। কেউ কেউ বিতৃষ্ণা নিয়ে খুব বাজেভাবে প্রত্যাখান করল। গোত্রসমূহের কাছ থেকে প্রত্যাখানের মাত্রা বেড়ে যাবার আরেকটি প্রধান কারণ হল কুরাইশরা মুহম্মদ (সাঃ) এবং তার সাহায্যকারীকে তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত। ব্যক্তি বা গোত্র হিসেবে লোকেরা আরও ক্রমবর্ধমান হারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রত্যাখান করা শুরু করল। তিনি ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছিলেন এবং মক্কা ও এর আশেপাশে দাওয়াতের কাজ করা কঠিনতর হয়ে যাচ্ছিল। মক্কার সমাজ কুফরী ব্যবস্থার উপর অটল থাকল এবং কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে দৃঢ় থাকল। যখন অত্যাচারের মাত্রা তীব্রতর হয়ে গেল তখন আবদুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) সহ আরও অনেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে অস্ত্র ধারণের অনুমতি প্রার্থনা করল। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আগে আমাদের মুশরিক হিসেবে সম্মান ও ক্ষমতা ছিল। আর যখন আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম তখন অপমানিত হচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের নিষেধ করে বললেনঃ অবশ্যই, আমাকে ক্ষমা করে দেবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সুতরাং লোকদের সাথে যুদ্ধ করো না। (আন নাসায়ী ও আল হাকিমে ইবনে আবি হাতিমের বর্ণণায়)

এইভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় দাওয়াতের দুটি পর্যায় অতিক্রম করেছেনঃ

§ শিক্ষণ, গঠন বা চিন্তার বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্নিক প্রস্তুতির পর্যায়। এটা হল চিন্তাকে উপলদ্ধি করতে পারা, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সে চিন্তাকে মজ্জাগত করা এবং তাদের সুসংগঠিত করার পর্যায়।
§ দাওয়াতের বিস্তৃতি ও সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পর্যায়। এটা হল চিন্তাকে সমাজ পরিচালনার শক্তি হিসেবে সরবরাহ করা, চিন্তাকে প্রয়োগ করে জীবনের মূল ধারায় স্থান করা যাতে সাধারণ জনগন এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, বহন করে এবং প্রতিষ্ঠার পথে সর্বাত্নক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।

প্রথম পর্যায়ের ক্ষেত্রে, এটা হল লোকদের ইসলামের দিকে আহ্বানের পর্যায় এবং এর চিন্তা দিয়ে তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটানো, নিয়মকানুন শিক্ষা দেয়া এবং এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলা যারা ইসলামিক আক্বীদার ভিত্তিতে এ কাজগুলো করতে পারবে। এ পর্যায়ে দাওয়াতকে গোপনে সংগঠিত করতে হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াত থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তিনি যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাদেরকে দারুল আরকামে একত্রিত করে একটি সংগঠনের কাঠামোর ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন। এভাবে প্রতিদিন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তাদের মধ্যকার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। তাদের মধ্যে বাস্তবতাকে উপলদ্ধি করা এবং কর্মসূচী গ্রহণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে কারণে দাওয়াতের জন্য তারা নিজেদের উৎসর্গ করবার জন্য প্রস্তত ছিল। দাওয়াত তাদের হৃদয় ও মনে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। ধমনীতে রক্ত যেভাবে প্রবাহিত হয়েছিল সেভাবে ইসলাম তাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল। সেকারণে  লুকোচুরি, গোপন কাঠামো ও গোপন বৈঠকের মধ্যেও তাদের ভেতরে দাওয়াত লুক্কায়িত ছিল না। বিশ্বাসী ও দাওয়াত গ্রহণের জন্য আগ্রহী লোকদের সাথে তারা এ দাওয়াত নিয়ে যেত। এভাবে লোকেরা তাদের উপস্থিতি ও দাওয়াত বুঝতে পারত। এভাবে দাওয়াতের সূচনা হল। অতপর দাওয়ার প্রকাশ অত্যবশ্যকীয় হয়ে উঠল। কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল এর প্রকাশ ও লোকদের সম্বোধন করার জন্য।  এভাবে প্রথম ধাপ অতিক্রান্ত হল যেখানে গোপন কাঠামো তৈরি করা ও শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়, যা এই কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করে।

তারপর আরেকটি পর্যায় শুরু হল, যা ছিল গনসংযোগ ও সর্বাত্নক সংগ্রাম পর্যায়। লোকদের এসময় ইসলাম উপলদ্ধি করবার সুযোগ দেয়া হয়। সেকারণে তখন তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং এবিষয়ে আগ্রহী হয়েছে। আবার অন্যদিকে তারা এটাকে প্রত্যাখান ও পরবর্তীতে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং এভাবে এ চিন্তার সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। এ দ্বন্দ্ব কুফর ও কুচিন্তা পরাভূত হয়েছে, ঈমান ও সত্য বিজয় হয়েছে এবং সঠিক চিন্তাই প্রবলতর হয়েছে। এভাবে গনসংযোগ শুরু হল এবং একটি চিন্তা ও আরেকটির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল, অর্থাৎ এ প্রতিযোগিতা ছিল মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে। এর সূত্রপাত হয়েছিল যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গনমানুষের কাছে সাহস ও চ্যালেঞ্জের সাথে দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়া শুরু করলেন। তাওহীদের দাওয়াত, মূর্তিপূজা ও শিরকের চিন্তাকে আঘাত এবং কোন চিন্তা ছাড়া পূর্বপুরুষকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার বিষয়গুলোকে সমালোচনা করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর আয়াত নাজিল হতে লাগল। আয়াতসমূহতে ত্রুটিপূর্ণ বিনিময় ব্যবস্থা, বাণিজ্য এবং মাপে কম দেয়ার সমালোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দলে দলে লোকদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন, ইসলামকে গ্রহণ ও সাহায্য করবার জন্য আহ্বান জানালেন। কুরাইশ ও নবী (সাঃ) এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেল। দাওয়াতের মধ্যে বাড়িতে, পাহাড়ের পাদদেশে, দারুল আরকামে নিবিড় শিক্ষাদান পদ্ধতির পাশাপাশি তখন সামষ্টিক শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ফলে, এটা স্থানান্তরিত হল কিছু সংখ্যক মানুষ যাদের মাঝে কল্যাণ (goodness) ছিল তাদের আহ্বান জানানোর পর্যায় থেকে সমগ্র মানষকে আহবান জানানোর পর্যায়ে। এই সামষ্টিক দাওয়াত ও গনসংযোগ পর্যায় কুরাইশদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করল। সুতরাং তাদের ঘৃণা ঘনীভূত হল এবং তারা ইসলাম নিয়ে ভীত হয়ে পড়ল। দাওয়াতকে বিরোধিতা করবার জন্য তারা ভয়ংকর সব পরিকল্পনা আটতে থাকল; এ পর্যায়ের আগে তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দাওয়াতকে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেনি। সুতরাং মানুষিক ক্লেশ ও জুলুম বাড়তে লাগল। তবে এই সামষ্টিক দাওয়াত এর নিজের উপরে অনেক প্রভাব বিস্তার করল। এর কারণে অনেকে ইসলামের কথা শুনবার সুযোগ পেল এবং আল্লাহর দ্বীনের কথা মক্কাবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভবপর হল। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলসামষ্টিক দাওয়াতের কারণে এর কলেবর বাড়ানোর সুযোগ হল। যদিও এ কারণে দাওয়াত বহনকারীদের দূর্ভোগ, অত্যাচার ও নির্যাতন বাড়িয়ে দিল। যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরাইশদের অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, মক্কার সমাজের দাসত্ব, কাফেরদের করুণ অবস্থা ও কর্মকান্ডের মুখোশ উন্মোচন করছিলেন তখন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সব পর্যায়সমূহের মধ্যে এ পর্যায়টি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তার সাহাবীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল।

চিন্তা বিকাশের পর্যায় থেকে গনযোগাযোগ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর্যায়টি খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়, কারণ এর জন্য প্রজ্ঞা, ধৈর্য্য, চিন্তার যথার্থতা অপরিহার্য। তবে গনযোগাযোগ পর্যায়টি ছিল সবচেয়ে কঠিন। এর জন্য একজনকে সাহসী, স্পষ্টভাষী এবং ফলাফল বা প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনায় না নিয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। এ ধাপে মুসলিমদের দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ পর্যায়ে ঈমান ও দূর্ভোগ সহ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি বিকশিত হয় এবং সংঘাতের সময়গুলোতে ঐকান্তিকতা গড়ে উঠে।

একইভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবাদের (রাঃ) নিয়ে এমনভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন যাতে তারা অত্যাচার, দূর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করতে পারে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবিসিনিয়াতে হিজরত করেছেন, কেউ দ্বীন নিয়ে পালিয়েছেন, কেউ নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন এবং কেউ কেউ অত্যাচার সহ্য করেছেন। মক্কার সমাজকে পরিবর্তনের জন্য তাঁরা যথেষ্ট সময় নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তবুও অত্যাচারের ভয়াবহতা সফলতার পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। আরবদের অনেকে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কারণ তখন তারা ঈমান গ্রহণ করে কুরাইশদের চটাতে চায়নি। তৃতীয় ধাপে অর্থাৎ ইসলামকে বাস্তবায়নের স্তরে দাওয়াত মক্কার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নুসরাহ ও সুরক্ষা পাবার জন্য গোত্রসমূহের কাছে যাওয়া শুরু করেন, যাতে করে তিনি তার প্রভূ যা নাজিল করেছেন তা লোকদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক গোত্রসমূহকে ইসলামের দিকে আহ্বান

যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা আবু তালিব ও বিবি খাদিজা (রাঃ) একই বছরে ইন্তেকাল করলেন তখন তাদের মৃত্যুর কারণে তার ভাগ্যাকাশে দূর্যোগের মেঘ আরও ঘনীভূত হল। চাচার মৃত্যুর পর কুরাইশগন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর নির্যাতনের খড়গহস্ত আরও কঠিনভাবে চালাতে উদ্যত হল। এ ব্যাপারে তিনি (সাঃ) বলতেনঃ আবু তালিবের মৃত্যুর পর কুরাইশগন যত ঘৃণিত কাজ করেছিল ততটা আর কখনোই করেনি। (সীরাতে ইবনে হিশাম)

আবু তালিবের মৃত্যুর পর নিজের ও তাঁর লোকদের সুরক্ষা ও নুসরার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তায়েফ গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বানু সাকিফ গোত্রের কিছু নেতৃস্থানীয় লোকের সাথে দেখা করেছিলেন। তিনি তাদের সাথে ইসলামকে সমর্থন করা ও এর পাশে দাঁড়ানোর জন্য কথা বলেন, তার গোএের যে কেউ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার জন্য বললেন। তারা এ আহ্বান প্রত্যাখান করেছিল এবং বারণ করা সত্ত্বেও তাদের সাথে যোগাযোগের বিষয়টি গোপন না রেখে প্রকাশ করে দিয়েছিল। বিশেষ প্রহরা ছাড়া মুহম্মদ (সাঃ) মক্কায় প্রবেশ করতে পারেননি।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন গোত্রের দরজায় দাঁড়িয়ে আহ্বান জানিয়ে বলতেনঃ হে অমুক গোত্র! আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। এইসব মূর্তি থেকে যে কোন কিছু গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুন ও ঈমান আনুন। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করুন যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা লোক সামনে তুলে ধরছি। (সীরাত ইবনে হিশাম)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা আবু লাহাব ছায়ার মত তাঁর পেছনে লেগে থাকত এবং তিনি যা বলতেন তার জবাব দিত ও প্রত্যাখান করত। কেউ তার কথা গ্রহণ করত না, তারা সাধারণত বলততোমার লোকেরা যারা তোমাকে আরও ভাল জানে তারাই তোমাকে অনুসরণ করে না।

তারা কথা বলত ও তর্ক করত। অন্যদিকে তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন এবং আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতেন এই কথা বলেঃ

হে আমার প্রভু, যদি তোমার ইচ্ছা থাকত! তারা এটা অপছন্দ করত না।

সীরাত ইবনে হিশামে উল্লেখ আছে, আয-জুহরী বর্ণণা করেন যে, মিনাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বানু কিন্দা গোত্রের কাছে তাদের আবাসস্থলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ও প্রত্যাখাত হলেন। তিনি আরও বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বানু কাব গোত্রের কাছে যান এবং প্রস্তাব দেন। কিন্তু আগের মতই প্রত্যাখাত হন। তারপর তিনি বানু হানিফা গোত্রের কাছে গিয়ে একইভাবে প্রস্তাব দেন এবং তাদের প্রত্যাখান ছিল আরবদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। তিনি বানু আমির বিন বানু সাসাএর কাছে গিয়েছিলেন এবং তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন ও নিজেকে উপস্থাপন করেন। বহাইরা বিন ফিরাস নামে তাদের মধ্যকার একজন বললঃ আল্লাহর কসম, আমি যদি কুরাইশের এই তরুণকে নিতে পারতাম তাহলে পুরো আরবদের পরাজিত করতে পারতাম।সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রশ্ন করলঃ তুমি কি মনে কর, যদি আমরা তোমাকে অনুসরণ করি এবং স্রষ্টা তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমাকে বিজয় দান করে তবে তোমার পরে আমাদের হাতে ক্ষমতা আসবে?’ নবী (সাঃ) উত্তর দিলেনঃ ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এবং তিনি যাকে খুশী তাকে তা দান করেনবহাইরা উত্তর দিলঃ আমরা তোমাকে রক্ষা করবার জন্য আরবদের কাছে আমাদের গলা উন্মুক্ত করে দেব আর যখন তুমি বিজয়ী হবে তখন ক্ষমতা চলে যাবে অন্য কারও হাতে! তাহলে তোমার ক্ষমতার আমাদের প্রয়োজন নেই!’

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরকমই করে যেতে থাকলেন। যখন হজ্জের মৌসুমে লোকেরা জমায়েত হত, তিনি (সাঃ) সেখানে উপস্থিত হতেন এবং তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতেন। তিনি (সাঃ) নিজেকে উপস্থাপন করতেন এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা ও রহমত তুলে ধরতেন। যখনই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানতে পারতেন যে, কোন স্বনামধন্য ও সম্মানিত আরব এসেছেন তখনই তিনি কালবিলম্ব না করে তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দিকে আহ্বান জানাতেন ও তাঁর প্রতি নাজিলকৃত বাণীসমূহ উপস্থাপন করতেন।

ইতিবাচক সাড়া না দিলেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে সব গোত্রের সাথে দেখা করেছিলেন, ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং নিজেকে তাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তারা হলঃ

. বানু আমির বিন সাসা
. মুহারিব বিন খাসফাহ
. ফাজারাহ
. ঘাসান
. মুরাহ
. হানিফাহ
. সুলায়েম
. আবাস
. বানু নাদর
১০. বানু আল বুকা
১১. কিন্দা
১২. কা
১৩. আল হারিস বিন কা
১৪. উজরাহ
১৫. আল হাদারিমাহ

ইবনে সাদ এর আত তাবাকাতশীর্ষক বই অনুসারে এই তালিকা উল্লেখ করা হল।

দাওয়াতের আহ্বানে মদীনাবাসীর প্রতিক্রিয়া

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গোত্রসমূহকে প্রতিবছর মাজান্না, কাজ এবং মিনায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ও তার নিজের প্রতি ক্রমাগতভাবে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, যাতে করে তিনি তাঁর রবের বাণী নিরাপদে মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারেন এবং এর প্রতিদানে তারা জান্নাত অর্জন করতে পারে। আরবের একটি গোত্রও তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং তিনি নির্যাতিত ও চরিত্র হননের অপচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন যতক্ষণ না আল্লাহর ইচ্ছায় দ্বীন বিজয়ী হওয়া, প্রভূর মদদপুষ্ট হওয়া ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ার সময় এসেছিল। অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে আনসারদের একটি গোত্রের কাছে প্রেরণ করেন। তিনি (সাঃ) এমন একটি দলের সাথে বসলেন যারা তাদের মাথা মুন্ডন করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সাথে বসেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি আহ্বান করেন এবং তাদের কুরআন তেলাওয়াত করে শোনান। তারা খুব দ্রুত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ডাকে সাড়া দেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনেন। তারপর তারা মদীনায় ফিরে যান ও নিজের লোকদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতে থাকেন; এতে লোকজন ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করে।

পরের বছর হজ্জ্বের মওসুমে মদীনার আওস ও খাজরাজ গোত্রের বারজন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে আল-আকাবা নামক স্থানে দেখা করেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এটা ছিল আকাবার প্রথম সাক্ষাৎ, যেখানে বায়াতুন নিছা বা নারীদের শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মুসআব বিন উমায়ের (রাঃ) কে মদীনায় প্রেরণ করেন। তিনি (সাঃ) মুসআব (রাঃ) কে সেখানে কুরআন পাঠ করবার, মদীনাবাসীকে ইসলাম ও দ্বীন শিক্ষা দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি আল মুকরী (তেলাওয়াতকারী) হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং আসাদ বিন জুরারাহ এর সাথে থাকতেন। অতপর উসায়দ বিন হাদায়ের ও সাদ বিন মুয়াজ ঈমান আনেন। তারা ছিলেন মদীনায় নেতৃস্থানীয়। যখন পরেরজন ইসলাম গ্রহণ করল তখন তিনি তার জনগনের উদ্দেশ্যে বললেনঃ তোমাদের মাঝে আমাকে তোমরা কিভাবে দেখ?’ তারা প্রত্যুত্তরে বললঃ আমরা তোমাকে আমাদের অভিভাবক এবং প্রাজ্ঞব্যক্তি মনে করি এবং সত্য পথে একজন নেতা ভাবি।তিনি বললেনঃ তোমাদের পুরুষ এবং নারীগন ততক্ষণ আমার সাথে কথা বলতে পারবে না যতক্ষণ তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর।বিকেলের মধ্যে আবদুল আশ-শাল এর বাড়ীতে এমন একজন পুরুষ ও নারী খুঁজে পাওয়া গেল না যে মুসলিম হয়নি।

আল আকাবার শপথ

মুসআব (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসলেন। আনসারদের মধ্য থেকে কিছু মুসলিম তাদের তীর্থযাত্রী মুশরিক লোকদের সাথে হজ্জ করবার জন্য এল। তাশরীকের (১০ জিলহজ্জ থেকে শুরু করে ৪ দিন) মাঝামাঝি এক দিনে তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে শপথবদ্ধ হলেন। তাদের মধ্যে তিয়াত্তর জন পুরুষ ও দুইজন নারী ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে কেবল তার চাচা ছিলেন। আসাদ বিন জুরারাহ বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা আল আব্বাস সর্বপ্রথম কথা বললেন। তিনি বললেনঃ হে খাজরাজের লোকেরা! তোমরা মুহম্মদ (সাঃ) সাথে দেখা করে তাকে আমন্ত্রন জানাচ্ছ। মুহম্মদ (সাঃ) তার গোত্রের লোকদের মধ্য থেকে সবচেয়ে সম্মানিত। আল্লাহর কসম! আমাদের মধ্য হতে যারা তাকে বিশ্বাস করে অথবা না করে, সবাই তার সম্মান ও বংশীয় ধারার জন্য সুরক্ষা দিয়েছে। তোমাদের জন্য মুহম্মদ সবাইকে প্রত্যাখান করেছে। আপনারা যদি ক্ষমতাবান, ধৈর্যশীল, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হন এবং সব আরবদের ঐক্যবদ্ধ বৈরীতা ও শত্রুতা মোকাবিলায় প্রস্তত থাকেন, তাহলে আপনাদের সদিচ্ছার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন এবং এর উপর দৃঢ় থাকুন। প্রকাশ্যে নিরঙ্কুশভাবে একমত পোষণ করবার পর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবেন না। কারণ সৎ সাক্ষী সর্বোৎকৃষ্ট সাক্ষী।

তারা বলল, ‘আপনি যা বললেন, তা আমরা শুনলাম। কিন্তু হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আপনি আমাদেরকে আপনার ও আপনার রবের জন্য পছন্দ করুন এবং বলুন আপনার যা ইচ্ছা হয়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সামনে বক্তব্য দিলেন, কুরআন তেলাওয়াত করে শুনালেন, লোকদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করলেন ও ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহী করলেন। তাঁর প্রভূকে উপাসনা করা ও তার সাথে কাউকে শরীক না করবার শর্ত দিলেন। তারপর তিনি বললেনঃআমি আপনাদের সমর্থন প্রত্যাশা করছি যে, আমাকে সুরক্ষা দিন যেভাবে আপনারা আপনাদের নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দিয়ে থাকেন। (সীরাত ইবনে হিশাম)

আসাদ বিন জুরারাহ আল বারাহ আরও বর্ণণা করেন যে, ‘মারুর শপথ গ্রহণের জন্য তার হাত তুলে নিয়ে বললেনঃ অবশ্যই, সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে একজন সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আপনাকে আমরা সেভাবে রক্ষা করব যেভাবে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানের সুরক্ষা প্রদান করি। হে রাসূলুল্লাহ, সুতরাং আমরা বাইআত প্রদান করলাম। আল্লাহর কসম, আমরা বংশ পরষ্পরায় নেতা থেকে নেতাতে যোদ্ধা ও অস্ত্রচালনায় পারদর্শী।

যখন আল বারা কথা বলছিল, তখন আবুল হায়সামি ইবনুল তাইহান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের অন্য লোকদের (ইহুদী) সাথেও সর্ম্পক রয়েছে। যদি আমরা তাদের প্রতি কঠোর হই এবং সম্ভবত সে সময় আল্লাহ যদি আপনাকে বিজয়ী করেন তাহলে কি আপনি আমাদের প্রত্যাখান করে নিজের লোকদের কাছে ফিরে আসবেন?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্মীত হেসে উত্তর দিলেনঃ না, রক্ত তো রক্তই; আর রক্তের বদলাও রক্তই। আমি তোমাদের জন্য আর তোমরাও আমার জন্য। তোমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করব আর তোমরা যাদের সাথে সন্ধি চাইবে আমার সন্ধিও তাদের সাথেই। (সীরাত ইবনে হিশাম)

আসাদ বিন জুরারাহ বর্ণণায় আরও উল্লেখ করেনঃ ‘‘অতপর তারা বলল, ‘সম্পদের ক্ষতি অথবা আমাদের মধ্যকার সম্ভ্রান্তগন উৎসর্গীকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তাঁকে (সাঃ) বাইয়াত দিলাম। তারপর আল বারা বললেনঃ হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আপনার হস্ত প্রসারিত করুন।এভাবে তিয়াত্তর জন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাতের উপর হাত রেখে বাইয়াত সম্পন্ন করল। যখন লোকেরা বাইয়াত দিল এবং তা সুসম্পন্ন হল তখন শয়তান আল আকাবায় চিৎকার করে বলে উঠলঃ হে আখাসীবের (কুরাইশ) লোকেরা, তোমরা কি মুহম্মদ ও তার সাহাবাগন (মুশরিকদের দৃষ্টিতে দ্বীনত্যাগী) কে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য একত্র হওয়া পছন্দ কর?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তোমাদের মধ্য হতে বারজন নেতা নিয়ে আস যারা তাদের লোকদের দায়িত্ব নিবে, যেমন ঈসা বিন মারিয়মের হাওয়ারীয়ন (শীষ্যগন); আর আমি আমার লোকদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল।তারা দুপক্ষ থেকে নুকাবা (নেতা) নির্বাচন করল। এভাবেই পূর্ণাঙ্গ ঈমানী পরিবেশে বাইয়াত সুসম্পন্ন হল। এ বিষয়ে আল আব্বাস বিন উবাদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলেনঃ সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে একজন সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনার ইচ্ছা তাই হয় তাহলে আগামীকালই আমরা মীনাবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে প্রস্তত।রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আমরা এ ব্যাপারে আদিষ্ট হইনি, সুতরাং তোমরা তোমাদের বাহন উটসমূহের কাছে ফিরে যাও।’ (সীরাত ইবনে হিশাম)

হজ্জের মৌসুম শেষ হতে চলল। মক্কার লোকদের কাছে যখন বাইয়াত খবর পৌছাল তখন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ইবনে সাদ তার আত তাবাকাতগ্রন্থে উরওয়ার বরাতে আয়েশা (রাঃ) এর কাছ থেকে বর্ণণা করেন যে, তারা বললঃ যখন সত্তর জন লোক রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ত্যাগ করল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন আল্লাহ তাঁর জন্য সুরক্ষা, যোদ্ধা ও সমর্থন প্রদান করেছেন। তবে মুসলিমদের উপর পরীক্ষা বেড়ে গেল। এ ব্যাপারে সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে অভিযোগ করলেন এবং তিনি তাদের হিজরতের অনুমতি দিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবা (রাঃ) কে হিজরতের জন্য যে ভূমির কথা জানালেন তা হল ইয়াসরীব বা মদীনা এবং যে হিজরতে আগ্রহী তাকেই অনুমতি দিলেন। তিনি (সাঃ) বললেনঃ

আমি স্বপ্নে দেখলাম, মক্কা থেকে এমন এক ভূমিতে হিজরত করছি যেখানে খেজুর জাতীয় গাছ রয়েছে। আমার মন বলছিল আল ইয়ামা অথবা হাজারের কথা, কিন্তু এটা ছিল আল ইয়াসরীব। (বুখারী ও মুসলিম)

অবশ্যই গোত্রসমূহের কাছ থেকে নুসরাহ পাবার প্রচেষ্টা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বায়াতের ঘটনা এসবই প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এমন ক্ষমতার অধিকার খুঁজছিলেন যা তাঁর দ্বীনকে সহায়তা এবং সুরক্ষা দিতে পারবে। বিষয়টি কেবলমাত্র দাওয়াত বহন বা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর সাথে এমন এক ক্ষমতার বিষয় বিজড়িত ছিল যার মাধ্যমে মুসলিমগন আত্নরক্ষা করতে পারবে। বরং এর কলেবর আরও বেড়ে যায়, এটি এমন একটি নিউক্লিয়াস ছিল যাকে কেন্দ্র করে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, সমাজে ইসলাম বাস্তবায়িত হবে, যা মানবতার কাছে শাশ্বত বাণী বহন করে এবং সে ক্ষমতা লালন করে যা ইসলামকে সুরক্ষা দেয় এবং এর বিস্তারের পথে আরোপিত সব বস্তুগত প্রতিবন্ধকতাকে অপসারণ করে। এভাবে সম্প, স্বদেশ, স্ত্রী ও পরিবার ছেড়ে হিজরত সম্পন্ন হয়। মদীনার হিজরত আবিসিনিয়ার হিজরত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।

আবিসিনিয়ায় হিজরত ছিল দ্বীন ও অত্যাচারের ভয়ে কিছু ব্যক্তির নিজ ভূমি থেকে পলায়ন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মক্কায় নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য এমন এক নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে করে তারা নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত না হয়ে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং তাদের অন্তরাত্মাসমূহ পুনরায় শক্তিশালী ও দৃঢ়তার সাথে দাওয়াত বহনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এটা দাওয়াতের পদ্ধতির কোন ধাপ নয় যেখানে মুহাজিরনগণ প্রবাসে থেকে দাওয়াত বহন করতে পারে অথবা প্রবাসী শাসকদের সহায়তা নিয়ে তার মূল ভূমির শাসককে উৎখাত করতে পারে।

মদীনায় হিজরত

মদীনায় হিজরত দাওয়াতের ক্ষেত্রে আলোচনা ও সহিষ্ণুতার পর্যায় থেকে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম বাস্তবায়নের পর্যায়ে উন্নীত হবার একটি ধাপ। এটা দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে উন্নীত হওয়া যা মদীনাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ইসলাম বহন করেছিলেন। আর তা করা হয়েছিল ইসলাম দ্বারা শাসিত একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমে। এ রাষ্ট্র ইসলামকে বাস্তবায়ন করে এবং এর দিকে দলিল প্রমাণসহ আহ্বান করে ও দাওয়াতকে ক্ষমতার সাথে বহন করে, যাতে করে বাতিলের অত্যাচার ও ক্ষতির হাত থেকে একে সুরক্ষা দেয়া যায়।

যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনাতে পৌঁছলেন তখন সেখানকার অনেক লোক তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম একটি মসজিদ ণির্মাণ করেছিলেন। এ মসজিদে সালাত আদায় করা হত, পরামর্শ করা হত, লোকদের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা ও বিবাদ নিরসন করা হত। তিনি (সাঃ) মদীনাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তত করতে লাগলেন। তিনি মদীনার বাইরে অভিযান পরিচালনা করেন ও তাদের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে দেনইহুদীদের সাথে চুক্তি করেন। সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনাতে একজন শাসকের ভূমিকা পালন করেন অর্থাৎ তিনি ছিলেন সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধান।

দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার আগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ কাজগুলো করেছিলেন। সুতরাং এ থেকে আমরা কী বাধ্যবাধকতার নির্দেশ পাই?

আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে পুরোপুরি অনুসরণ করতে বাধ্য এবং তিনি যেভাবে অগ্রসর হয়েছেন আমরাও একইভাবে অগ্রসর হতে বাধ্য। যেহেতু ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ফরয, সেহেতু এক্ষেত্রেও তাঁর (সাঃ) পদাঙ্ক আমাদের অনুসরণ করতে হবে। তার (সাঃ) ব্যাখ্যামুলক কার্যাবলীতে যে হুকুম পাই তা একই ব্যাখ্যামুলক বিষয়ের জন্য বাধ্যতামুলক হুকুম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এ সর্ম্পকে বলেনঃ

বলে দিনঃ এই আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝে শুনে দাওয়াত দেই- আমি এবং আমার অনুসারীগণও। (সূরা ইউসুফঃ ১০৮)

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সীরাত অনুসরণ করলে আমাদের কাজগুলোকে দুই ধাপে ভাগ করতে বাধ্যঃ

§ ব্যক্তিত্ব গঠন ও (দল) প্রতিষ্ঠার ধাপ
§ গনযোগাযোগ এবং সংগ্রামের ধাপ

প্রথম ধাপে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কর্মপন্থা আমরা অনুসরণ করতে বাধ্য। এ ধাপে যারা ইসলামী দাওয়াতের বোঝা বহন করবে তাদেরকে ইসলাম দিয়ে গভীরভাবে বিকাশের ব্যবস্থা ও বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে হবে। এটা সম্ভব হবে খুব ভাল ইসলামী আকলিয়া (মানসিকতা/ধ্যান-ধারনা) ও নাফসিয়া (ঝোঁক/প্রবণতা) গড়ে তুলবার মাধ্যমে। যা করতে হবে গভীরতাসমৃদ্ধ পাঠচক্র বা হালাকা প্রদানের মাধ্যমে, যা রাসূলুল্লাহ করেছিলেন। যাদের মাঝেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইসলাম গ্রহণের উপযোগীতা দেখতে পেতেন, বয়স, পদমর্যাদা, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে তিনি তাদেরকে আহ্বান করতেন এবং তাদের একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্রমপ্রসারমান হিযবের মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদেরকে উপরোক্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবেঃ

§ বিকাশের পরিণত অবস্থা (maturity in culture), অর্থাৎ তাদের মনস্তত্ত্ব বা আকলিয়া এবং নাফসিয়াহ বা প্রবণতা গড়ে উঠেছে ইসলাম অনুসারে। সুতরাং তারা এখন সমাজের দূষিত চিন্তাগুলোর মোকাবেলা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
§ কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যে গন্ডীভূত রাখবার জন্য তারা দাওয়াতকে গ্রহণ করবে না। সুতরাং তারা যাই জানে তাই ছড়িয়ে দিতে থাকবে। যার মধ্যেই তারা কল্যাণ (খায়ের) দেখতে পাবে তার কাছেই তারা এ দাওয়াত নিয়ে যাবে।
§ লোকেরা দাওয়াতকে হৃদয়ঙ্গম করবে, এর উপস্থিতি ও সামষ্টিকতাকে অনুভব করবে।

যখন সাহাবীদের মত এ তিনটি বৈশিষ্ট্য কোন হিজবের মধ্যে দেখা যাবে, তখন সেটি দ্বিতীয় ধাপে অগ্রসর হবে।

এ ধাপে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত দাওয়াতকে জনগনের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং বর্তমান সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে ও তাদের চিন্তা, ঐতিহ্য ও ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাদের চিন্তার দেউলিয়াত্বের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে এবং বিকল্প ইসলামী চিন্তা, ধারণা ও ব্যবস্থাকে উপস্থাপন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত জড়তাহীনভাবে, অসম সাহসিকতা ও শক্তিমতার সাথে লোকদের আহ্বান করতে আমরা বাধ্য। আমরা এ দাওয়াত পরিত্যাগ করব না ও আত্নসমর্পণও করব না। আমরা তোষামোদ বা আপোষ করব না এবং রীতিনীতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, জীবনাদর্শ, শাসক অথবা জনতার ভয়কে উপেক্ষা করব। আমরা এমনভাবে দাওয়াহ বহন করব যাতে নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব ইসলামের জন্য হয়ে যায়। জনগন এর সাথে একমত বা দ্বিমত পোষণ করুক না কেন অথবা এটা তাদের ঐতিহ্যের সাথে যাক বা সাংঘর্ষিক হোক এবং জনগন গ্রহণ, প্রত্যাখান বা বিরোধিতা করুক। যতক্ষণ না আদর্শ অনুসারে কাঙ্খিতভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত এর সাথে সংযুক্ত থাকব এবং ধৈর্যধারণ করব। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত এ সময়েও শাসকগন এ লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে সেহেতু এ দলটিকে এই শাসকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর এটা তখনই সংঘটিত হবে যখন তাদের মুখোশ, দুরভিসন্ধি এবং দালালি ও ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত এসবকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। যেভাবে পবিত্র কুরআন আবু লাহাবকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলঃ

আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে, কোন কাজে আসেনি তার ধন-সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। সত্বরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে। (সূরা লাহাবঃ ১-)

বানু হাশিম গোত্রে সে সম্মানিত হওয়া সত্ত্বেও এ আয়াত নাজিল হয়েছিল। একইভাবে কুরআনে বানু মাখদুম আল ওয়ালিদ বিন মুগীরাকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

যাকে আমি একা সৃষ্টি করেছি, তাকে একাকী আমার হাতে ছেড়ে দিন। আমি তাকে বিপুল ধন-সম্পদ দিয়েছি। (সূরা আল মুদ্দাসসিরঃ ১১-১২)

তঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

আমি তাকে দাখিল করব প্রজ্জলিত জাহান্নামের আগুনে। (সূরা আল মুদ্দাসসিরঃ ২৬)

তার সর্ম্পকে সূরা ক্বলমে বলা হয়েছেঃ

কঠোর স্বভাব, তদুপরি কুখ্যাত (সূরা ক্বলমঃ ১৩)

যখন তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আবু জাহেলের ব্যাপারে বলেনঃ

কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই- মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ। (সূরা আল আলাকঃ ১৫-১৬)

আমাদের দাওয়াতের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত লোকদের নির্দেশনা দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগুতে হবে। এ ধাপে তিনি (সাঃ) ইসলাম যাতে তাদের জীবনাদর্শ হয়ে যায় ও মুহম্মদ (সাঃ) মিশন যাতে তাদের মিশন হয়ে যায়- সে জন্য সর্বাত্মকভাবে তাদের কাছে ইসলামী আদর্শ ব্যাখা করেছেন। অর্থাৎ আমরা যা বুঝাতে চাই তা যেন লোকেরা গভীর উপলদ্ধির সাথে গ্রহণ করে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত আজকেও আমরা প্রত্যাখান, প্রতিবন্ধকতা, মিথ্যা অপবাদ, বিতাড়ন, প্রোপাগান্ডা, বয়কটের শিকার হতে পারি।

সাহাবাগন (রাঃ) সেসময় অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন এবং তখন তিনি (সাঃ) প্রত্যুত্তরে বলেছিলেনঃ

আমি ক্ষমা করে দেবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি; সুতরাং লোকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করো না।

একইভাবে নুসরাহ খুঁজে পাবার পূর্বে আমরা অস্ত্রধারণ ও ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকব।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেমনিভাবে তৃতীয় ধাপে উন্নীত হবার জন্য নুসরাহর সন্ধান করেছিলেন তেমনিভাবে আমরাও ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন করবার জন্য নুসরাহ বা বস্তুগত সমর্থন অনুসন্ধান করতে বাধ্য। এ ধাপ হল ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসন করবার ধাপ।

নুসরাহ বা বস্তুগত সমর্থন অনুসন্ধান 

এবার আসা যাক পদ্ধতিগত নিয়মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান প্রসঙ্গে আর তা হল নুসরাহ বা বস্তুগত সমর্থন। এটা নিয়ে সাবধানতার সাথে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক আমাদের কী অনুসরণ করা উচিত, বিশেষ করে আমরা যখন দেখতে পাই যে, ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যারা কাজ করেন তারা নুসরাহ-র বিষয়টি অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। তারা মনে করে এটি একটি গুরুত্বহীন বিষয় বা এর ইসনাদ (বর্ণণার সূত্র) ততটা শক্তিশালী নয় বিধায় এটি গ্রহণ করবার প্রয়োজন নেই। তারা কেবল এখানেই থেমে থাকে না। বরং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সবগুলো সীরাতে সামান্য কিছু ব্যত্যয় ছাড়া সুস্পষ্ট বর্ণণা থাকা সত্তেও এ বিধান ও যারা এর অনুসরণ করে তাদের কটাক্ষ করা হয়। যদিও সীরাতের এসব লেখকগণের কারোরই বর্তমানে অস্তিত্বশীল দলগুলোর সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না।

পবিত্র কুরআন তাদের সর্ম্পকে বলেছেঃ

সাহায্য সহায়তা দিয়েছে (সূরা আল আনফালঃ ৭২)

এবং তাদের আখ্যায়িত করেছে

আনসার (সাহায্যকারী)’ (সূরা আত তাওবাহঃ ১০০)

এ বর্ণণা ছিল অত্যন্ত প্রশংসার ও উন্নত আঙ্গিকের, যার মাধ্যমে তাদের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সীরাত বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব যে, তিনি ক্ষমতাধর নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে নুসরাহ অনুসন্ধান করেছিলেন। একটির পর একটি গোত্রের কাছ থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা পাওয়া সত্তেও তিনি এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বারংবার নুসরাহ অনুসন্ধান করছিলেন এবং এ ব্যাপারে দমে যাননি। ইবনে সাদ তার তাবাকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, যতগুলো গোত্রের কাছে তিনি (সাঃ) গিয়েছিলেন তার সংখ্যা পনের এর কম নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এই অধ্যাবসায় থেকে আমরা যা পাই তা হল, নুসরাহ অনুসন্ধান করা ছিল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে নবী (সাঃ) এর প্রতি একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা।

পবিত্র কুরআন এ সাহায্যকারীদের আনসারবলে আখ্যা দিয়েছে, যা এর আরেকটি দলীলকুরআনে একাধিক জায়গায় তাদের প্রশংসা করা হয়েছে ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। মুহাজেরীন’ (অভিবাসী) দের পরেই তাদের অবস্থান।

নুসরাহ সর্ম্পকিত বর্ণণা থেকে বুঝা যায় যে, এটি একটি শরীয়াগত বাধ্যবাধকতা। সে কারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

হে অমুক ও অমুক গোত্র। আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ইবাদত করবার ও তার সাথে কাউকে শরীক না করবার...আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে ও আস্থা রাখবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে সমর্থন প্রদান করবে যতক্ষণ না আমি আল্লাহ প্রদত্ত হুকুমসমূহ লোকদের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছি (সীরাত ইবনে হিশাম)

এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি নির্দেশনা, যা শর’ঈ একটি হুকুম। আর এর বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ রীতি অনুসরণ করতে হবে। এটা এমন কোন ঠুনকো বিষয় নয় যে, চাইলেই পরিবর্তন করা যাবে।

এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও যাদের কাছে নুসরাহ অনুসন্ধান করা হয়েছিল তাদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিল অথবা দ্বিতীয় আকাবার শপথে তার (সাঃ) ও বাইয়াত প্রদানকারীদের মধ্যকার যে সংলাপ হয়েছিল তা থেকে বুঝা যায় নবী (সাঃ) একটি লক্ষ্যে এ কাজে (নুসরাহ অনুসন্ধান) অগ্রসর হয়েছিলেন ও এ কাজের উপর দৃঢ় ছিলেন;  অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও এমন এক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যা দ্বীনকে বাস্তবায়ন, সুরক্ষা প্রদান ও বিস্তারের কাজ করবে। সুতরাং কীভাবে আমরা এটিকে অবজ্ঞা করি যখন এর মাধ্যমে দাওয়াত একটি পর্যায় থেকে আরেকটি পর্যায়ে উন্নীত হয় ও একটি ভূমিতে একটি ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন ও প্রসারের সুযোগ সৃষ্টি করে। তাহলে এ অবজ্ঞা কার স্বার্থে?

কুফফারগণ বুঝতে পেরেছিল যে, এ কাজের পেছনে রয়েছে একটি অঙ্গীকার ও দ্বীন বিজয়ের বীজ। একারণে আমরা দেখতে পাই বানু আমীর গোত্র বুঝতে পেরেছিল এ বিষয়টি ক্ষমতার সাথে বিজড়িত। মক্কার কুফফারগণের কাছে যখন দ্বিতীয় আকাবার খবর পৌঁছায় তখন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল। তারা বলেছিলঃ হে খাজরাজের লোকেরা! আমাদের কাছে খবর আছে যে, তোমরা আমাদের সাথীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছ এবং তাকে আমাদের থেকে নিয়ে গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছ।আমরা দেখতে পাই শয়তান সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলেছিলঃ হে আখাসীবের (কুরাইশ) লোকেরা, তোমরা কি মুহম্মদ ও তার সাহাবাগন (মুশরিকদের দৃষ্টিতে দ্বীনত্যাগী) কে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য একত্র হওয়া পছন্দ কর?’

দ্বিতীয় আকাবার শপথের সময় আল বারা বলেনঃ হে রাসূলুল্লাহ, সুতরাং আমরা বাইআত প্রদান করলাম। আল্লাহর কসম, আমরা বংশ পরষ্পরায় নেতা থেকে নেতাতে যোদ্ধা ও অস্ত্র চালনায় পারদর্শী ও সুসজ্জিত।আবুল হায়সামি ইবনুল তাইহান বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের অন্যদের লোকদের (ইহুদী) সাথেও সর্ম্পক রয়েছে। যদি আমরা তাদের প্রতি কঠোর হই এবং সম্ভবত সে সময় আল্লাহ যদি আপনাকে বিজয়ী করেন তাহলে কি আপনি আমাদের প্রত্যাখান করে নিজের লোকদের কাছে ফিরে আসবেন?’ আসাদ বিন জুরারাহ বলেনঃ আজ তাকে নেওয়া মানে সকল আরবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করা, তোমাদের মধ্যকার সম্ভ্রান্তগন কতল হওয়া এবং তলোয়ারের তিক্ত স্বাদ নেওয়া। এ বিষয়ে আল আব্বাস বিন উবাদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলেনঃ সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে একজন সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনার ইচ্ছা তাই হয় তাহলে আগামীকালই আমরা মীনাবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে প্রস্তত। আল হায়সামীর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তর দিলেনঃ না, রক্ত তো রক্তই; আর রক্তের বদলা রক্তই। আমি তোমাদের জন্য আর তোমরাও আমার জন্য। তোমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করব আর তোমরা যাদের সাথে সন্ধি চাইবে আমার সন্ধিও তাদের সাথেই।

আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্ম্পকে বলেন যে, তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সাহায্য, ক্ষমতাশালী লোক, সমরাস্ত্র ও সমর্থন দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন।

ইবনে হিশাম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নুসরাহ অনুসন্ধান নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ আল্লাহ যখন তার নবী (সাঃ) কে শক্তিশালী ও দ্বীনকে বুলন্দ করতে চাইলেন তখন আনসারদের মধ্য হতে এই লোকগুলোকে দিয়ে সহায়তা করলেন।

এসব মন্তব্য থেকে এই হুকুমের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় এবং একজন ইসলামের দিকে আহ্বান করার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে সে দ্বীনকে সমর্থন করল এরূপ ব্যাখ্যা বা নির্দেশনার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত রাখে। বাইআত, ইজাহার উদ দীন (দ্বীনের বিজয় কবুল করা); নাসর (সমর্থন), যুদ্ধ; বিশিষ্টজনেরা হত্যার সম্মুখীন হবে; তলোয়ারের আঘাতে তারা ঘায়েল হবে; এটা সব আরবের বিরুদ্ধে যাবে; তাদের এমনভাবে সুরক্ষা দেয়া উচিত যেভাবে নারী ও শিশুদের দেয়া হয় -এসব অভিব্যক্তি থেকে বুঝা যায় কীভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নুসরাহ অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনি তা করেছিলেন সুরক্ষার খাতিরে এবং এমনকি প্রয়োজনে দ্বীন বহনের জন্য শক্তি প্রয়োগের নিমিত্তে ও এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার জন্য যা দ্বীন ও এর অনুসারীদের রক্ষা করবে। সাথে সাথে এর হুকুমসমূহ বাস্তবায়ন ও বিশ্বের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেবার কাজ করবে।

এ বাস্তবতায় একজন বুঝতে পারবে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিম্নলিখিত কাজগুলো করেছিলেনঃ  

§ তিনি ব্যক্তির নিরাপত্তা ও দাওয়াতের সুরক্ষার জন্য সমর্থন অনুসন্ধান চেয়েছিলেন। এটা মুশরিকদের কাছ থেকে চাওয়া যায় যেমনিভাবে তার চাচা তাকে সুরক্ষা প্রদান করেছিলেন অর্থাৎ তার উপর আপতিত যে কোন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। এটা মুতঈম বিন আদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা তিনি (সাঃ) তায়েফ থেকে আদির সহায়তায় মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। সুরক্ষার বিষয়টিকে মুসলিমদের দ্বীনের সাথে আপোষ করবার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। দাওয়াতের গতি কিছুটা শ্লথ করতে অনুরোধ করায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার চাচাকে বলেছিলেনঃ আল্লাহর কসম, হে আমার চাচা! যদি তারা দাওয়াতকে পরিত্যাগ করবার জন্য আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয়, তারপরেও আমি দ্বীনকে পরিত্যাগ করব না যতক্ষণ না আল্লাহ এ দ্বীনকে বিজয়ী করে বা এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি নিহত হই। (সীরাত ইবনে হিশাম)
§ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাধারণত নেতাদের সাথে যোগাযোগ করতেন এই কামনায় যে, তারা ঈমান আনলে তাদের অনুসরণকারী সাধারণ লোকেরাও ঈমান আনবে। দাওয়াত প্রসারণকে সহজতর করা ও গ্রহযোগ্য করবার জন্য তিনি এটা করেছিলেন। এটা দাওয়াতের জনপ্রিয়তার ভিত্তি (কাইদাহ শাবিয়্যাহ) তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিল।
§ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ক্ষমতাধর লোকদের কাছে নুসরাহ অনুসন্ধান করেছিলেন এই শর্তে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে, যে রকমটি ঘটেছিল আল আকাবার দ্বিতীয় শপথের ক্ষেত্রে। 

নুসরাহ অনুসন্ধান করা হয়েছিল ক্ষমতাধর লোকদের কাছ থেকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় এমনসব ক্ষমতাবান লোকদের কাছে নুসরাহ সন্ধান করা হয়েছিল যাদের রয়েছে নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা। সেসময় নেতারাই শাসক ছিল; তারা আবার সেনাবাহিনীর প্রধানও ছিল এবং তাদের মতামতের উপর জনগন আস্থাশীল ছিল। 

আজকের দিনে শাসকেরা বলপ্রয়োগে ক্ষমতায় আসীন হয় এবং তারা অজনপ্রিয়। আবার অনেকসময় জনপ্রিয়তা যা দেখা যায় তা প্রকৃত চিত্র নয়। এক্ষেত্রে আমাদের তাই করতে হবে যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) করেছিলেন। সুতরাং আমরা সমাজে প্রভাবশালী এমনসব লোকদের সাথে যোগাযোগ করব যাদের মাধ্যমে তাদের অনুগামী অন্য লোকদের কাছে পৌঁছানো সহজতর হয়, যাতে করে জনপ্রিয়তার ভিত্তিমূল অর্জিত হয়। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার লক্ষ্যে ক্ষমতাশালী লোকদের কাছে নুসরাহ অনুসন্ধান করব, যেমনঃ সামরিক বাহিনীর অফিসার। তাছাড়া যখন দলের সদস্যদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় তখন তাদের বন্ধু ও আত্নীয়স্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা দোষণীয় নয় এই শর্তে যে এর ফলে দাওয়াকারীর ঈমান কোনরূপ চাপ বা আপোষের সম্মুখীন হবে না। এভাবে বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে অনুসরণ করতে হবে।       

আর এটাই হল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পদ্ধতি এবং আমরা তাকে অনুসরণ করতে এই পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য। অর্থাৎ আমরা নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করবঃ

. (দলের) শাবাবদের এমনভাবে প্রস্তত করা যাতে তাদের হাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠিক যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের হাতে মুহাজেরীনদের গড়ে তুলেছিলেন যারা মক্কায় দাওয়াতের কাজ করেছিলেন এবং নবী (সাঃ) এর সাথে ইসলামিক রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং তারপরে উম্মাহকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
. সাধারণ সচেতনতার ভিত্তিতে চিন্তার পক্ষে জনমত তৈরী করা অর্থাৎ এমন জনপ্রিয় ভিত্তি যা শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কিছুকে গ্রহণ করতে চায় না ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ামাত্র একে বরণ করে নেবার ইতিবাচক প্রবণতা দেখায়। আর এ অবস্থা পুরোপুরি মদীনার জনগনের মতই যখন তারা ইসলাম দাবী করেছিল এবং এটাকে সুরক্ষা দেবার জন্য এগিয়ে এসেছিল
. ক্ষমতাধর লোকদের কাছ থেকে নুসরাহ অনুসন্ধান, যার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করা যায়।

যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো সুসম্পাদিত হবে তখন আমরাও সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারব যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) করেছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি শরীয়াহ আকড়ে ধরবার কারণে বিশ্বাসীদের বিজয় দান করবেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ

মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব। (সূরা রূমঃ ৪৭)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরও বলেনঃ

আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, শক্তিধর। (সূরা হজ্জ্বঃ ৪০)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরও বলেনঃ

তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। (সূরা আন-নূরঃ ৫৫)

ত্বরীকাহ (পদ্ধতি) এবং উসলূব (ধরন)

এখন যে প্রশ্নটি উত্থিত হয়, তা হল, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় যা বলেছিলেন এবং করেছিলেন তা কি ওহী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিনা এবং একারণে এটা মানতে আমরা বাধ্য অথবা এমন কোন কাজ বা কর্ম করেছেন কিনা যা ওহী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এবং যেগুলো একজন অনুসরণ করতে বাধ্য নয়?

এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পদ্ধতি, উপকরণ ও ধরনের প্রশ্ন আসে।

আরেকটি প্রশ্ন উত্থিত হয়, তা হল, পদ্ধতি (যা হল কিছু শর’ঈ হুকুমের সমষ্টি কিন্তু উপকরণ নয়) নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো যাবে কিনা এবং যদি পরীক্ষার পর এটা কোন ফল দেয় তাহলে এটা সঠিক, অন্যথায় নয়?

প্রথম বিষয়টির ক্ষেত্রে

আমরা নিম্নোক্তভাবে বলতে পারি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসলিমদের রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে অনুসরণ করতে বলেছেন অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন এবং করেছেন। তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কুরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা আন নাজমঃ ৩-)

এবং তিনি বলেনঃ

রাসূল তোমাদেরকে যা (‘মা’) দেন তা গ্রহণ কর এবং যা (‘মা’) তিনি নিষেধ করেন তা বর্জন কর (সূরা আল হাশরঃ )

এখানে মাশব্দটি সাধারণ অর্থে (সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ রাসূল (সাঃ) আমাদের জন্য কোন কিছু নিয়ে এসেছেন কিন্তু তা আমাদের পালন করা লাগবে না এমন কিছুই নেই; যতক্ষণ না শরীয়াহ কোন ব্যতিক্রম নির্দেশ করে।

নির্দিষ্ট রকমের কিছু কথা এবং কাজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে যেসব ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) কে অনুসরণ না করলেও চলে বলে প্রমাণ রয়েছে। যেমনঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিম্নের হাদীসঃ

দুনিয়াবী বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখ।

সুতরাং দুনিয়াবী বিষয়, যেমনঃ কৃষি, উৎপাদন, আবিষ্কার, চিকিৎসাশাস্ত্র ও প্রকৌশল ইত্যাদি বিষয়ক জ্ঞান ওহীর অর্ন্তভুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মাধ্যমে আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, এসব ক্ষেত্রে তিনি যে কোন সাধারণ মানুষের মতই। খেজুর গাছের পরাগায়ন সম্পর্কিত তাঁর (সাঃ) ঘটনাটির মধ্য দিয়েই বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো একান্তভাবেই তাঁর (সাঃ) জন্য এবং অন্য কেউ এ ব্যাপারে অংশীদার নয়। যেমনঃ তাহাজ্জুদ পড়া তাঁর (সাঃ) উপর ফরয ছিল, রাতের বেলাতেও রোযা অব্যাহত রাখা এবং চারের অধিক বিয়ে করবার অনুমতি ছিল। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে অনুসরণ করা অনুমোদিত নয়।

যেসব কাজ মানুষ হিসেবে তাঁর (সাঃ) স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল, যেমনঃ দাড়ানো, বসা, হাটা, খাওয়া, পান করা ইত্যাদি। এটা নিঃসন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, এসবই উম্মাহর জন্য মুবাহ (অনুমোদিত) হিসেবে পরিগণিত।

বিভিন্ন শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের জন্য রাসূল (সাঃ) উপযুক্ত ধরন (উসলূব) এবং উপকরণ (ওয়াসিলা) ব্যবহার করতেন। শরঈ হুকুম হচ্ছে আল্লাহর হুকুম অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু এই শরঈ হুকুম কিভাবে অর্থাৎ কোন ধরন এবং উপকরণের সাহায্যে বাস্তবায়ন করতে হবে তা একজন মানুষ হিসেবে রাসূল (সাঃ) এর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়; যাতে সে ধরন ও উপকরণ বাস্তবসম্মত হয় এবংকোন হারামের দিকে পরিচালিত না করে।

উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) যখন বলেনঃ

অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না। (সূরা হিজরঃ ৯৪)

একটি শরঈ হুকুম যাকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু কিভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে সে বিষয়টিকে শরীয়াহ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) হুকুমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাসূল (সাঃ) প্রকাশ্যে ঘোষণার কাজটি সম্পাদন করেছিলেন, কারণ এই হুকুমের বিরুদ্ধে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। কিন্তু যে উপায়ে তিনি (সাঃ) প্রকাশ্যে ঘোষণার কাজটি সম্পাদন করেছিলেন সেটা তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক ছিলনা। অতএব, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাসূলকে (সাঃ) অনুসরণকারী দলের জন্যও এই কাজটি বাধ্যতামূলক নয়। রাসূল (সাঃ) সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে লোকদের আহ্বান করেছিলেন, লোকজনকে খাবারের দাওয়াত দিয়েছিলেন, মুসলিমদেরকে সাথে নিয়ে দুটো সারিতে করে কাবা প্রদক্ষিণ করেছিলেন, এগুলো ছিল মূলত শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত কিছু ধরন অর্থাৎ এগুলো ছিল প্রকৃত (আসল) হুকুম প্রকাশ্যে ঘোষণা দানএর সাথে সম্পর্কিত কিছু সহায়ক কাজ। নীতিগতভাবে এ জাতীয় ধরনসমূহ অনুমোদিত। বিষয়টিকে শরীয়া স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত না করে দলের হাতে ছেড়ে দিয়েছে যাতে তারা সবচেয়ে উপযুক্ত ধরনসমূহকে বেছে নিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) যখন বলেনঃ

আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যর মধ্য থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে যাতে আল্লাহ এবং তোমাদের শত্রুদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পার। (সূরা আল আনফালঃ ৬০)

তখন প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তাঁর এই নির্দেশ হচ্ছে একটি শরঈ হুকুম যার আনুগত্য করতে হবে অর্থাৎ বিষয়টি ফরয এবং এর বিরুদ্ধে যাওয়া হারাম। এই আয়াতে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার ইল্লাহ (শরঈ কারণ) হচ্ছে  শত্রুদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা। কিন্তু উপকরণের (ঘোড়া) বিষয়টি এখানে বাধ্যতামূলক নয়। যেকোন উপকরণ যা এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে সেটাই এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। জিহাদের জন্য উপযুক্ত উপকরণ যুগের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে আসছে। এজন্য শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপকরণ বেছে নিতে হবে। জিহাদের জন্য বা আল্লাহর শত্রু এবং মুনাফিকদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্য বর্তমান সময়ে প্রয়োজন হচ্ছে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের (শরীয়া নির্ধারিত সীমার মধ্যে)অতএব শরঈ হুকুম হচ্ছে আল্লাহর হুকুম অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়টিতে আল্লাহর সরাসরি মন্তব্য রয়েছে বলে এটিই হচেছ প্রকৃত (আসল) হুকুম। আর ধরন (উসলূব) হচ্ছে প্রকৃত (আসল) হুকুমকে বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত আংশিক হুকুম। এ বিষয়টি হচ্ছে মুবাহ এবং উপযুক্ত ধরনকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

উপকরণ হচ্ছে সেই বস্তু যার সাহায্যে শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন করা হয়। নীতিগতভাবে বিষয়টি মুবাহ (অনুমোদিত) এবং উপযুক্ত উপকরণ বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

অতএব উপরোক্ত ব্যতিক্রমসমূহ এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় ছাড়া মতাদর্শ বা শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অন্য যেকোন বিষয় যা রাসূল (সাঃ) এর সাথে সম্পর্কিত সেটা মক্কায় নাযিল হোক অথবা মদীনায়, সেটা আক্বীদার সাথে সম্পর্কিত হোক অথবা ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত সবকিছুকেই ওহী হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং এগুলোকে তাসী (অনুসরণীয়) বিষয় হিসেবে মেনে নিতে হবে।

যদি কেউ রাসূল (সাঃ) এর মক্কী জীবনের দাওয়াতকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে দেখতে পাবে তিনি শরঈ হুকুম হিসেবে বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করেছিলেন যেগুলোকে বর্তমানে বাদ দেওয়ার কোন সুযোগ নেই বরং এগুলোকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। অনুরূপভাবে তিনি (সাঃ) এমন অনেক কাজ করেছেন যেগুলোকে উসলুব বা ধরনের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা যায়। পাশাপাশি তিনি (সাঃ) শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উপযুক্ত উপকরণও ব্যবহার করেছেন। অতএব কোন বিষয়গুলো পদ্ধতি (ত্বরীকাহ) এবং কোন বিষয়গুলো ধরন (উসলূব) বা উপকরণ (ওয়াসিলা), এ দুধরণের বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝা প্রয়োজন, যাতে দল বুঝতে পারে কোন বিষয়টি তাকে আবশ্যই পালন করতে হবে এবং কোন বিষয়টি তার সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

পুরো পদ্ধতিকে (ত্বরীকাহ) ধরন হিসেবে গণ্য করার কোন সুযোগ নেই যার ফলে মনে হবে পরিস্থিতির আলোকে দল যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির ফলে পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত শরঈ হুকুমকে তাচ্ছিল্য করা হবে এবং শরঈ হুকুমকে মনগড়া কার্যক্রম দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হবে। বিষয়টিকে আরো ভালভাবে পরিষ্কার করার জন্য নিচে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলোঃ

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ

অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় (সূরা আল হিজরঃ ৯৪)

প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া- আল্লাহর তরফ থেকে রাসূল (সাঃ) এর প্রতি একটি নির্দেশ। এই নির্দেশটি দুটো শরঈ হুকুমকে উপস্থাপন করছে। প্রথমটি হচ্ছে এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশ্য দাওয়াতের অনুপস্থিতি এবং দ্বিতীয়টি হচেছ এই আয়াত নাযিল হওয়ার সাথে সাথে প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনা। প্রকাশ্যে দাওয়াতের ঘোষণা দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টিকে রাসূল (সাঃ) এর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বরং প্রকাশ্যে দাওয়াতের ঘোষণা দেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম মান্য করা ছিল রাসূল (সাঃ) এর জন্য বাধ্যতামূলক। এটিই হচ্ছে শরঈ হুকুম, যা শরীয়াহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। এই কাজটি করার সিদ্ধান্ত রাসূল (সাঃ) তাঁর নিজস্ব ইচ্ছার কারণে গ্রহণ করেননি, অতএব এই কাজের অনুসরণ করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) এই কথা যা আপনাকে আদেশ করা হয়এর মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে বিষয়টি আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে।

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ

তুমি কি সেসব লোককে দেখনি, যাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ (যুদ্ধ করা থেকে) এবং সালাত কায়েম কর (সূরা আন নিসাঃ ৭৭)

আবার কাফিরদের দুর্ব্যবহারের জবাবে অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের মোকাবেলা করার অনুমতি প্রার্থনা করলে আবদুর রহমান বন (রাঃ) কে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

প্রকৃতপক্ষে আমি ক্ষমার জন্য আদিষ্ট, অতএব তোমরা লোকজনের সাথে যুদ্ধ করোনা। (ইবনে আবি হাতিম, আন-নাসাঈ এবং আল-হাকিম থেকে বর্ণিত)

পরবর্তীতে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সময় আল্লাহর তরফ থেকে ওহী নাজিল হয়ঃ

যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফিররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে (মুমিনদেরকে) সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। (সূরা হজ্জঃ ৩৯)

উপরোক্ত দলিলগুলো থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, প্রথমে যুদ্ধের অনুমতি ছিলনা, কিন্তু পরবর্তীতে তা দেওয়া হয়; যেহেতু এই অনুমতি আল্লাহর তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু এটি একটি শরঈ হুকুম যার আনুগত্য করা আবশ্যক। স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন করা থেকে বিরত ছিলেন, বিষয়টি এরকম কিছু ছিলনা বরং বিষয়টি ছিল ওহীর মাধ্যমে নির্ধারিত যার আনুগত্য করা ছিল আবশ্যকীয় কর্তব্য। রাসূল (সাঃ) যেভাবে একাজ করা থেকে বিরত ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে তাঁর অনুসরণে নিজেদেরকে বিরত রাখাটা আমাদের জন্যও বাধ্যতামূলক।

অনুরূপভাবে রাসূল (সাঃ) যখন বিভিন্ন গোত্রের নিকট নুসরাহ (খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত সাহায্য) খুঁজতে যেতেন তখন তিনি (সাঃ) বলতেনঃ

হে অমুক এবং অমুক গোত্র, প্রকৃতপক্ষে আমি আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত একজন রাসূল। তিনি তোমাদেরকে আদেশ করছেন যাতে তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না কর, তোমরা তাঁকে ব্যতীত অন্য যেসব মূর্তির পূজা কর সেগুলোকে পরিত্যাগ কর, আমার উপর তোমরা ঈমান আন এবং আমাকে তোমরা সুরক্ষা প্রদান কর (অন্য এক বর্ণনায় সমর্থন কর’) যাতে আল্লাহ আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তা আমি পৌঁছে দিতে পারি। (সীরাতে ইবনে হিশাম)

এই হাদীসের মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) পরিষ্কার করে দিচেছন যে, বিষয়টি ছিল আল্লাহর তরফ থেকে একটি হুকুম; অর্থাৎ এক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) ওহীর অনুসরণ করছিলেন মাত্র। গোত্রগুলোর কাছ থেকে অসংখ্যবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও এবং অত্যন্ত রূঢ় ও কর্কশ ব্যবহার পাওয়া সত্ত্বেও নুসরাহ খোঁজার ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) এর অটল থাকাটাই প্রমাণ করে যে, এ বিষয়টি ছিল আল্লাহর তরফ থেকে একটি হুকুম।

এগুলো হচ্ছে পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত শরঈ হুকুমের কিছু উদাহরণ। যেসব উপকরণ এবং ধরনের সাহায্যে শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন করা হয় সেগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে অনুসরণ করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বরং এক্ষেত্রে শরঈ হুকুম বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত ধরন এবং উপকরণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীন।
সুতরাং দাওয়াতী কাজের উপযুক্ত লোক করে গড়ে তোলার জন্য রাসূল (সাঃ) মুমিনদেরকে নিয়ে দারুল আরকামে অথবা তাঁদের কারো বাসায় অথবা উপত্যকায় গিয়ে বসতেন এবং তাঁদেরকে ইসলামের শিক্ষায় দীক্ষিত করতেন। একটি শরঈ হুকুম হিসেবে আমাদেরকেও অবশ্যই এই দায়িত্বটি পালন করতে হবে এবং এ কাজের জন্য উপযুক্ত ধরন প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য উপযুক্ত ধরন হিসেবে একদল লোক অথবা কোন পরিবারকে বেছে নিতে হবে যাতে তাদেরকে ইসলামের সুষ্ঠু শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়। তাদের জন্য সাপ্তাহিক একটি সময় নির্ধারিত করতে হবে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ে পরিবার অথবা দলটির নির্দিষ্ট লোকজনকে একত্রে জড়ো হতে হবে। দাওয়াতী কাজে নিযুক্ত তরুণদের মনে যাতে ইসলামের শিক্ষা সুষ্ঠুভাবে গেঁথে দেওয়া যায় সেজন্য উপযুক্ত ধরন বেছে নিতে হবে। এ সমস্ত বিষয়গুলো নির্ধারণের দায়িত্ব আমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দাওয়াতী কাজের উপযুক্ত লোক করে গড়ে তোলার শরঈ হুকুমের বাস্তবতার আলোকে আমরা এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করব যাতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাসূল (সাঃ) নিজেকে এবং তাঁর দাওয়াতকে মক্কার বাজারে প্রকাশ্যে উপস্থাপন করতেন। এ কাজটি করার সময় আমাদেরকে উপযুক্ত ধরন বেছে নিতে হবে; যেমন যথার্থ বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে অথবা বিভিন্ন সামাজিক সমাবেশ, উৎসব বা আনন্দ-বেদনার সময় জনগণের কাছে নিজেদের ধ্যান-ধারণাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট, ক্যাসেট অথবা সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে এই লক্ষ্যঅর্জন করা যায়, এসমস্ত ধরন বা উপকরণের প্রত্যেকটিই জায়েয।

অনুরূপভাবে রাসূল (সাঃ) যখন নুসরাহ খোঁজার জন্য তায়েফে গিয়েছিলেন তখন তিনি পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, নাকি ঘোড়ার পিঠে চড়েছিলেন নাকি অন্য কোন উপায় অবলম্বন করেছিলেন সেগুলোর অনুসরণ করাটা আমাদের জন্য আবশ্যক কিছু না। এ জাতীয় উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শরীয়া কোন স্পষ্ট নির্দেশনা না দিয়ে বরং আমাদের সিদ্ধান্তের উপর তা ছেড়ে দিয়েছে।

আমাদের জানা আবশ্যক যে রাসূল (সাঃ) এর ত্বরীকাহ ছিল মূলত ওহী দ্বারা নির্ধারিত অনেকগুলো শরঈ হুকমের সমষ্টি যা থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। শরঈ হুকুমের প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলো পরিবর্তিত হয় সেগুলো হল ধরন বা উপকরণ। এ বিষয়গুলোকে নির্ধারণ করা যেমন রাসূল (সাঃ) এর সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, বর্তমানে ঠিক তেমনিভাবে এ বিষয়গুলোকে নির্ধারণ করাটা আমাদের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে দারুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা একটি শরঈ হুকুম। এমন অনেক লোক আছে যারা ভাবে যে দারুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার ত্বরীকাহ ব্যাপারটি ধরনের অর্ন্তভুক্ত এবং এজন্য তারা যেকোন ধরনের কাজ করার ব্যাপারে স্বাধীন। উদাহরণস্বরূপ, দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে তারা গরীবদেরকে সাহায্য করে, মানুষের আখলাক ঠিক করার কথা বলে, হাসপাতাল বা স্কুল তৈরি করে, ভাল কাজ করার কথা বলে, কেউ শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেয় আবার কেউ বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের দাবী তোলে। এ সমস্ত কাজের প্রত্যেকটাই হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহর সরাসরি নির্দেশনার মাধ্যমে পরিচালিত রাসূল (সাঃ) এর কর্মকান্ডের অনুসরণ থেকে সুস্পষ্ট বিচ্যুতি। আল্লাহর হুকুমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাসূল (সাঃ) যেভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণাদানের কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণাদানের কাজ করাটা আমাদের জন্যও ফরয; যদি তা না করি তাহলে আমরা পথভ্রষ্টদের অর্ন্তভূক্ত হব। রাসূল(সাঃ) যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত ছিলেন এবং মুসলিমদেরকে অস্ত্র বহনের অনুমতি দেননি ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরকেও তা মেনে চলতে হবে। পরিস্থিতি যদি ভিন্নও হয় তবু আমাদেরকে ঠিক তেমনিভাবে নুসরাহ খুঁজতে হবে যেমনভাবে রাসূল (সাঃ) তা খুঁজেছিলেন। সাধারণভাবে বলা যায় পদ্ধতির ধাপসমূহ যেভাবে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তাঁর রাসূলকে নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন সেগুলো আমাদের জন্যও অপরিবর্তিত থাকবে। সেগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক কাজ করা অথবা সেগুলোর অনুসরণ না করা হবে শরঈ হুকুমের লঙ্ঘন।

ত্বরীকার ব্যাপারে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন সুযোগ আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। উদ্দেশ্য কি হবে এবং সেই উদ্দেশ্যে পৌঁছার জন্য ত্বরীকাহ কি হবে, দুটো বিষয়ই শরীয়া নির্ধারিত করে দিয়েছে; অতএব এসব বিষয়ে আনুগত্য করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন বিকল্প নেই।

পদ্ধতির ধাপসমূহ নির্ধারণ করার এখতিয়ার কেবলমাত্র শরঈ দলীলসমূহেরই (কুরআন ও সুন্নাহ) রয়েছে। এ ধাপসমূহ নির্ধারণ করার জন্য আমরা নিজেদের মন, পরিস্থিতি অথবা জনস্বার্থকে বিবেচনা করার অধিকার রাখি না।

মানুষের খেয়াল-খুশী বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে নয়, বরং শরঈ দলীলসমূহের অর্থ বুঝতে হয় তার ভাষাগত নির্দেশনা থেকে। আমাদের ইচ্ছাগুলোকে শরঈ হুকুমের অনুসরণে সাজাতে হবে; কারণ বাধ্যতামূলকভাবে সেগুলো অনুসরণের মধ্য দিয়েই কেবল আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব।

রাসূল (সাঃ) এর ত্বরীকাকে বুঝা, এ ত্বরীকাহ নিয়ে তিনি (সাঃ) যেভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন তার পুরো আনুগত্য করা এবং তাঁর কাজের ধাপসমূহকে এবং প্রত্যেকটি ধাপে কৃত কাজগুলোকে সঠিকভাবে আদায় করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

সুতরাং দল গঠনের পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) বিভিন্ন কাজ সম্পাদন (ব্যক্তিগতভাবে লোকজনের সাথে দেখা করা, তাঁর উপর যারা ঈমান আনতেন তাঁদেরকে গোপনে একত্রে জড়ো করে তাঁদের চিন্তা-চেতনা গঠনের দিকে মনোযোগ দেয়া) করেছিলেন। এ সমস্ত কাজের ভিত্তিকে (আসল) অনুসরণ করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। কারণ শরঈ হুকুম হিসেবে তা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। পাশাপাশি এ সমস্ত কাজ বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত ধরন এবং উপকরণ আমাদেরকে বেছে নিতে হবে।

একইভাবে জনমত গঠনের পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) বিভিন্ন কাজ সম্পাদন (প্রকাশ্যে দাওয়াতের ঘোষণাদান, কুফরী চিন্তা এবং প্রথার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শতশত আয়াত নাযিল হওয়া, নাম সহকারে অথবা পরোক্ষ বর্ণনার মাধ্যমে কুরাইশ নেতাদেরকে আক্রমণ (মৌখিকভাবে) করা এবং বিভিন্ন গোত্রের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করা) করেছিলেন। এক্ষেত্রেও শরঈ হুকুম হিসেবে এসব কাজের ভিত্তিকে (আসল) অনুসরণ করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদেরকে প্রথম পর্যায় অর্থাৎ দল গঠনের পর্যায়ের কর্মকান্ডের সাথে আরো নতুন কিছু কর্মকান্ড যোগ করতে হবে, যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা করা, ইসলামের ভিত্তিতে উম্মাহর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণ, ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদী কাফির শক্তিসমূহ এবং তাদের আস্থাভাজন দালাল শাসকদের ষড়যন্ত্রগুলোকে উম্মাহর সামনে তুলে ধরা প্রভৃতি। কারণ রাসূল (সাঃ) ঠিক এরূপই করেছিলেন। এ সমস্ত কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য তখন আমরা প্রয়োজনীয় ধরন ও উপকরণ বেছে নিব।

প্রকৃতপক্ষে, খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে রাসূল (সাঃ) এর মক্কী জীবনের (শরঈ ত্বরীকার) অনুসরণ করতে হবে। রাসূল (সাঃ) যখন তাঁর এই ত্বরীকার সূচনা করেছিলেন এবং এই ত্বরীকার আলোকে কর্মকান্ড শুরু করেছিলেন তখন তিনি অনেক অপমান, দুর্বলতা, সন্ত্রাস এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবুও তিনি দৃঢ় সংকল্পের সাথে অবিরাম কাজ করে গিয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ) এর নিকট আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তাআলা) এর হুকুম আসত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি কঠোর সংগ্রাম করতেন। কোন ব্যক্তি নবীর (সাঃ) সঠিক পথের অনুসরণ থেকে অনেক দূরে সরে যায় যখন আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) এর এই আয়াত সে শুনেঃ অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় (সূরা আল হিজরঃ ৯৪); যেখানে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তাঁর রাসূলকে (সাঃ) নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তিনি  শুধুমাত্র আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) এর আদেশ অনুযায়ী প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন এবং সেই ব্যক্তি দেখে যে রাসূল (সাঃ) তাঁর নিজের ইচ্ছানুসারে নয় বরং আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) এর আদেশ অনুযায়ী প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন; তারপরও সে বলেঃ এই ত্বরীকার অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক কিছুনা।যদি এই ত্বরীকার অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক কিছু না-ই হতো তবে রাসূল(সাঃ) কেন সে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন যেখানে তিনি (সাঃ) কাফিরদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং তাদের উপাস্য দেব-দেবীদের, তাদের নেতৃবৃন্দের, তাদের প্রথার এবং তাদের চিন্তাসমূহের বিরোধিতা প্রকাশ্যে করেছিলেন যার প্রতিটা বিষয়ই কুরআনের নির্দেশনার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে। অথচ তিনি চাইলে তোষামোদের মাধ্যমে শাসকদের সন্তুষ্ট করতে পারতেন অথবা বিদ্যমান প্রথায় নিজেকে সমর্পণ করতে পারতেন যার ফলে তাদের কাছ থেকে তিনি মর্যাদা লাভ করতে পারতেন। যদি তিনি (সাঃ) তা করতেন তাহলে প্রকৃতপক্ষে তিনি(সাঃ) তাঁর রবের হুকুমের অবাধ্য হতেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কুরআন নাযিল হত এবং রাসূল (সাঃ) নিজেকে তার মধ্যে সমর্পণ করতেন। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ

উঠুন এবং সতর্ক করুন!” (সূরা আল মুদ্দাসসিরঃ ২)

তিনি (সাঃ) নেতৃবৃন্দকে আক্রমণ (মৌখিকভাবে) করলেন যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে!” (সূরা লাহাবঃ ১)

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে রাসূলের (সাঃ) পক্ষাবলম্বন করলেনঃ

আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে আপনি পাগল নন। (সূরা আল ক্বলমঃ ২)

কুরআনে কাফিরদের মানসিক অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছেঃ

তারা চায় যদি আপনি নমনীয় হন তবে তারাও নমনীয় হবে। (সূরা আল কলমঃ ৯)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন এবং উম্মুল-কুরা অর্থাৎ মক্কা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকজনকে সতর্ক করেন। পাশাপাশি তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তাঁর রাসূলকে (সাঃ) এবং যাঁরা তাঁর (সাঃ) সাথে ছিলেন তাঁদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দাওয়াতের কাজে অস্ত্র বহন না করতে। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে তখন কুরআন নাযিল হচ্ছিল এবং রাসূল (সাঃ) সে অনুযায়ী আমল করছিলেন মাত্র। যে বলে এই ত্বরীকার অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক কিছু না তার জন্য কি এর চেয়ে বেশি প্রমাণের প্রয়োজন আছে?

কেউ যদি বলে এই ত্বরীকার অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক কিছু না বরং ঐচ্ছিক তাহলে তার মানে দাঁড়াবে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) নাযিলকৃত আয়াতের মাধ্যমে যা কিছু হুকুম করছিলেন রাসূল (সাঃ) সম্পূর্ণরূপে অথবা আংশিকভাবে সেসব আয়াতের অবাধ্য হয়েছিলেন। কারণ সেক্ষেত্রে যা কিছু নাযিল হচ্ছিল তিনি তাঁর অনুগত ছিলেন না। অতএব তখন বিষয়টি আমাদের জন্যও ঐচ্ছিক বলে বিবেচিত হবে যে, আমরা কি রাসূল (সাঃ) এর ত্বরীকাহ অনুসরণ করব নাকি অন্য কোন ত্বরীকাহ? প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যা রাসূল (সাঃ) এর কর্মকান্ড এবং তাঁর সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতির সঠিক উপলদ্ধি থেকে অনেক দূরে।

আজকাল কিছু মুসলিম ত্বরীকার সাথে ধরনকে (উসলুব) গুলিয়ে ফেলে

এ ধরনের সন্দেহ কিছু মুসলিমের মধ্যে সৃষ্টি হবার কারণ হল তারা মনে করে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় থেকে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্নতর। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় সমাজের বিভক্তি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের, অর্থাৎ বংশ এবং গোত্র। আজকে এ বিভক্তি আরও জটিল ও পারস্পরিকভাবে সর্ম্পকযুক্ত। একটি রাষ্ট্রের সাথে আগের গোত্র সমূহের তুলনা করা চলে, যার জনসংখ্যা ছিল হাজার হাজার। এখন এ সংখ্যা মিলিয়ন মিলিয়ন। তখন দাওয়াত ছিল লোকদের কুফর থেকে ইসলাম গ্রহণের জন্য। আর আজকে দাওয়াত করা হয় মুসলিমদের ইসলামী জীবনধারা পুণঃপ্রবর্তনের জন্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় সুপার পাওয়ার পারস্য ও রোমানরা মক্কায় তার দাওয়াতে হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু আজকের দিনে শাসকেরা পশ্চিমাদের আজ্ঞাবহ ও পুতুল মাত্র। এখন সুপার পাওয়ারগুলোই ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে....ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিভ্রান্ত লোকেরা আরও বলে, ‘আমরা কীভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে মানবো যখন অনেক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে গেছে? যদি পরিবর্তিত না হই তাহলে সেটা হবে কঠোরতা ও অনমনীয়তা। আমরা এভাবে কিছু গ্রহণ করতে বাধ্য নই। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল দাওয়াতের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লক্ষ্য রাখা, অর্থাৎ ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং আল্লাহর দাসত্ব বা উবুদিয়্যাহ উপলদ্ধি করা।

এই ইস্যুটিকে কীভাবে দেখতে হবে তা ব্যাখ্যা করতে হবে এভাবে- শরীয় হুকুম নাজিল হয়েছিল বিভিন্ন বাস্তবতায় পরিপ্রেক্ষিতে। যখন বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে গেছে তখন এর সাথে বিজড়িত হুকুম পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যদি বাস্তবতা পরিবর্তিত না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে শর’ঈ হুকুম অপরিবর্তিত থাকবে। বাস্তবতার ক্ষেত্রে এর বাহ্যিক দিকে খেয়াল না রেখে এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সমাজ হল কিছু লোকের সমষ্টি যাদের রয়েছে সাধারণ ধারণা, এ সাধারণ ধারণা হতে কিছু আবেগ ও এর সাথে একমত সবকিছুকে সমর্থন করার বিষয় উৎসারিত হয় এবং এ সাধারণ ধারণা হতে কিছু ক্ষোভের বিষয় উৎসারিত হয় যখন কোন কিছু এর বিরুদ্ধে যায়। অতঃপর একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় যা এই চিন্তা বা ধারণাকে বাস্তবায়ন করে এবং এর কোনরকম ব্যত্যায়কে প্রতিহত করে। সুতরাং লোকেরা এমনভাবে জীবনযাপন করে যে তারা পুরো বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে এবং এ ব্যাপারে তারা সন্তুষ্ট।

সমাজের বাস্তবতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এটা হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ের বা জটিল। কিন্তু প্রত্যেক জনসমষ্টিই একটি সাধারণ চিন্তা ও আবেগের ভিত্তিতে একত্রিত হয় এবং শাসিত হয় এমন একটি ব্যবস্থা দ্বারা যা ঐ চিন্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। হতে পারে এ জনসমষ্টি একটি রাষ্ট্র বা গোত্র এবং সংখ্যায় হাজার হাজার বা মিলিয়ন মিলিয়ন। রাষ্ট্র বা গোত্র নির্বিশেষে এটি একটি সমাজ। কারণ, উভয়ক্ষেত্রেই সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি রয়েছে এবং এটি পরিবর্তিত হয়নি।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইসলামিক চিন্তা, আবেগ ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন। ইসলামিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি শর’ঈ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। তার সমস্ত কর্মকান্ড সেদিকেই লক্ষ্য করে ঠিক করা হয়েছিল। মদীনাতে তিনি প্রত্যেকটি বিশ্বাসী ব্যক্তিকে গড়ে তুলেছিলেন। তাদের মনের ভেতরে তিনি ইসলাম সর্ম্পকে মৌলিক চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যা একটি সুষম আবেগের সৃষ্টি করেছিল। তিনি সেখানে হিজরত করলেন ও ইসলামিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলেন এবং এভাবে ইসলামিক সমাজ কায়েম হল। শুরুতে এটি সহজ অবয়বে ছিল এবং তারপর একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়, যা পরিচালনার জন্য একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে

এখন ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুপার পাওয়ারগুলো যেভাবে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে আগে সেভাবে হস্তক্ষেপ করেনি - এর জবাবে আমরা বলতে চাই, একারণে পদ্ধতির কোন পরিবর্তন হতে পারে না। তবে এটা পদ্ধতির অনুসরণকে আরও কঠিনতর করে ফেলেছে। এর জন্য প্রয়োজন বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় এনে অতিরিক্ত বিকাশ প্রক্রিয়া ও নিবিড় দাওয়াত চালু রাখা। একারণে দলটি এখন আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং তাদেরকে মোকাবেলা করবার জন্য সুপার পাওয়ারগুলোর পরিকল্পনা ও পুতুল শাসকগুলোর মাধ্যমে যে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চায় তা বুঝতে হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কাতে কেবলমাত্র ঈমান ও সামান্য কিছু শর’ঈ আহকাম ব্যাপারে আহ্বান করেছিলেন- এ দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই, সামান্য কিছু হলেও তিনি শর’ঈ আহকাম এর ব্যাপারে আহ্বান করেছিলেন। এছাড়াও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মক্কায় দাওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম গ্রহণের জন্য লোকদের আহ্বান। কিন্তু আজকে মুসলিমদের দাওয়াত দেয়া হচ্ছে যাদের রয়েছে ইসলামিক আক্বীদা এবং নাজিলকৃত সব শর’ঈ হুকুম। সেকারণে মুসলিমগন আজ আল্লাহর কাছে কেবলমাত্র ঈমান নয়, পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং মক্কার একজন মুসলিম তার মৃত্যুর আগে সে পর্যন্ত নাজিল হওয়া হুকুমের জন্য দায়িত্বশীল। আজকে যে মুসলিম মারা যাচ্ছে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে পুরো ইসলামের ব্যাপারে জবাবদিহীতার সম্মুখীন হবে। সে কারণে আজকের আহ্বান হতে হবে পূর্ণাঙ্গ এবং ইসলামিক জীবনধারা পূণরায় শুরু করবার জন্য, কেবলমাত্র ঈমানের দাওয়াত নয়। কারণ এটা কোন নতুন দ্বীনের আহ্বান নয়।

এছাড়া মুসলিম উম্মাহর দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, আক্বীদা থেকে বিচ্যুত হওয়া এখন মুসলিম উম্মাহর সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হল এই আক্বীদার সাথে জীবনের চিন্তা ও আইনী ব্যবস্থার সম্পর্ক উপলদ্ধি করতে না পারা। এভাবে আক্বিদা তার প্রাণশক্তি হারিয়ে বসেছে। এসবই সম্ভব হয়েছে মুসলিমদের উপর পশ্চিমা চিন্তার প্রভাব বিস্তার করবার কারণে। পশ্চিমা কাফের রাষ্ট্রগুলো নতজানু শাসকদের ক্ষমতায় বসানো, শিক্ষা ব্যবস্থা ও মিডিয়ায় প্রচারণার মাধ্যমে এসব চিন্তার বিস্তার ঘটায়, সংরক্ষণ করে এবং এগুলো বলবৎ ও এর প্রতি আকর্ষণ বজায় রাখবার জন্য কাজ করে।

সুতরাং আমাদের দাওয়াতে ইসলামকে সঠিকভাবে, পূর্ণাঙ্গরূপে ও সমন্বিতভাবে উপস্থাপন করতে হবে যার আক্বীদা ও ঈমান মৌলিক চিন্তা হিসেব আবির্ভূত হবে, যা হতে হুকুম উৎসারিত হয় ও যার উপর ভিত্তি করে জীবন সর্ম্পকে দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারিত হয়। তারপর আক্বীদার মাধ্যমে জীবনের চিন্তাসমূহকে ব্যাখ্যা করতে হবে। এটা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা আহ্বান করব আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলাই একমাত্র স্রষ্টা ও আল মুদাব্বির (সব বিষয়ের পালনকর্তা), বিচার দিবসের মালিক এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সব বিষয়ের জন্য তার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এভাবে যখন ঈমান ও হুকুম সমুহ মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য তা ব্যাখ্যা করা হয় তখন সত্যের ক্ষমতা ও এর প্রাণশক্তি তাদের কাছে পরিস্ফুট হয়ে উঠে এবং ইসলাম বুঝা ও এর আহ্বান করার কাজে দাওয়াতকারী দলের শক্তিমত্তা এবং দলের পরিবর্তনের সক্ষমতা সবার কাছে পরিস্ফুট হয়ে উঠে।

সেকারণে আজকে দাওয়াত হল ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলিমদের ইসলামিক জীবনধারায় ফিরে আসার জন্য আহ্বান করা। এ দাওয়াতের ভিত্তি হবে ইসলামিক আক্বীদা এবং এর রাজনৈতিক চিন্তার উপস্থাপন করতে হবে যাতে মুসলিমরা আল্লাহর নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী এটিকে জীবনের সব কাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে গ্রহণ করে।

সুতরাং যা পরিবর্তিত হয়েছে তা হল বাহ্যিক রূপ। মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সুতরাং ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়নের হুকুম এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজের পদ্ধতির হুকুম মোটেও পরিবর্তিত হয়নি।

শরঈ হুকুমসমূহ কী নিরীক্ষামূলক?

দ্বিতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রেঃ

কিছু লোক আছে যারা ইসলামিক রাষ্ট্র বাস্তবায়নের কাজকে নিরীক্ষামূলক হিসেবে নিয়েছে এবং এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিরীক্ষামূলক পরিকল্পনা থেকে উদ্ভুত দাওয়াতের মাধ্যমে এগুবে বলে মনে করে। কিন্তু প্রশ্ন হল এ বিষয়ে এভাবে চূড়ান্ত কিছু বলা কী সমীচীন?

পদ্ধতিকে নিরীক্ষামূলক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা অপাংক্তেয়। এর অর্থ শরঈ পদ্ধতিএর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ইসলামে যে কোন কাজের পদ্ধতি শরঈ হুকুম দ্বারা স্বীকৃত যা এর দলিলের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করে। দলটি শরীয়া গ্রহণে যেমনি বাধ্য, তেমনি এইসব দলিল গ্রহণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বাধ্যবাধকতা এবং প্রমাণিত কোন শরঈ হুকুম থেকে চ্যুত হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ তাদের নেই। সুতরাং এটা লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নিরীক্ষামূলক (যদি পরীক্ষামূলকভাবে কার্যসম্পাদনের পর সাফল্য পাওয়া যায় তবে সেটাই পদ্ধতি এবং অন্যথায় অন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে) কোন বিষয় নয়।

শরঈ যে কোন হুকুমের ধারক হল শরঈ পদ্ধতি, যা ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হল লক্ষ্য অর্জন করা। আর তা হল ইসলামিক জীবনধারা পূণঃপ্রবর্তন। এই হুকুম দলিলের শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করে। এগুলো গ্রহণ ও আস্থাভাজন থাকবার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার উপাসনা করে থাকে। ঐ ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত এটাকে পরিবর্তন করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য শক্তিশালী দলিল আছে বলে সুনিশ্চিত হওয়া যায়।

একজনকে অবশ্যই শরীয়াগত পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে অনুসরণ করতে হবে। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা অনুযায়ী কাজ করা এবং শরঈ পদ্ধতিতে কাজ করা কখনোই এক বিষয় নয়। ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা থেকে নেয়া সমাধানে লোকজন যে কোন কাজকে সাফল্য বা ব্যর্থতা অথবা লক্ষ্য অর্জন হওয়া বা না হওয়ার ভিত্তিতে উপলদ্ধি করে থাকে।

গ্রহণের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা এমন যে, কোনটিই তাদের জন্য চূড়ান্ত সমাধান নয়। এর জন্য প্রয়োজন অবিরত পরিবর্তন ও বিবর্তন। যে কোন পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করুক না কেন সেটা নিরীক্ষামূলক। অবশ্য পশ্চিমা সব আইনই নিরীক্ষামূলক। তাদের জন্য একটি পদক্ষেপ সঠিক বা ভুল তা যাচাইয়ের একমাত্র পদ্ধতি হল তা বাস্তবায়নের পর লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য বা বিফলতার উপর। এ বাস্তবতা ইসলামের সাথে এ প্রকৃতির কারণেই সম্পূর্ণরূপে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। ইসলামের পদ্ধতি আল্লাহ প্রদত্ত- যিনি আল আলীম (সবজান্তা) এবং আল খাবীর(সর্বসচেতন)যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়া দলিলের উপর নির্ভর করে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি নির্ভূল ও পূর্ণাঙ্গ। এর নির্ভূলতা উৎসারিত হয় শরঈ দলিলের নির্ভূলতা এবং ইসতিদলাল (সংশ্লেষণ) থেকে। কোনক্রমেই ফলাফলের উপর এটি নির্ভরশীল নয়। অতএব, দলিলের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে ভিত্তি, যে ভিত্তি থেকে কাজের মূল্যায়ন হয়। কাজের পদ্ধতির ক্ষেত্রে ফলাফল বলতে বুঝায় ক্ষমতা গ্রহণ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা। আর এ বিষয়টি সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। (সূরা আন-নূরঃ ৫৫)

হে বিশ্বাসীগণ। যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন। (সূরা মুহম্মদঃ ৭)

যদি ফলাফল না পাওয়া যায়, তাহলে একজন কোনক্রমেই এ পদ্ধতিকে অবজ্ঞা করতে পারবে না বা এটিকে অন্য কোন কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না বা এটাকে ব্যর্থ ঘোষণা করতে পারবে না। বরং পদ্ধতির হুকুমটি আরও অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। কোন শরঈ হুকুমকে পরিত্যাগ করা যাবে না যদি না দলটি বুঝতে পারে তারা হুকুমটি বুঝতে ভুল করেছিল। যদি দলটি ভুল না পায় তাহলে ঐ বিশেষ হুকুমের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব মতামতের উপর দৃঢ় থাকতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সবর করতে হবে যতক্ষণ না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বিজয় দান করেন। অথবা বিষয়টি এমন হতে পারে যা বিজয়ের বিলম্বসুত্রের কারনে প্রলম্বিত হচ্ছে, যা থেকে নবীরা পর্যন্ত রেহাই পাননি। এ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান বুঝি মিথ্যায় পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌছে। (সূরা ইউসুফঃ ১১০)

অবশ্যই এ কাজটি ব্যাপক কদ্বান্তিকর ও কষ্টকর ও ব্যাপক প্রচেষ্টা সাপেক্ষ। দলটি যে শাসকদের মুখোমুখি হচ্ছে তার চেয়ে দলটির ক্ষমতা অনেক কম। কাজের সাফল্য কখনোই সময়সাপেক্ষ নয় যে, একটি নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর সাফল্য না আসলে আমরা ধরে নেই যে এটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বরং এটি চিন্তার পরিশুদ্ধতা, চিন্তাধারণকারীদের দৃঢ়তা এবং জনগনের গ্রহণের সার্বজনীনতার সাথে সর্ম্পকযুক্ত। যখন এই পূর্বশর্তগুলো পূরণ হবে তখন একজন ধরে নিতে পারে যে দলটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মত নুসরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিজয়ী হবে। এ ব্যাপারে মূল্যায়ন হল যে, বিজয় কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে আসে। দলটি মূল্যায়ন করবে হুকুম ও দলিলের শক্তিমত্তার সম্ভাব্যতার ব্যাপারে।

যদি বিজয়ের শর্তসমূহ পূরণ করা যায়, তাহলে এটা আসবে। অন্যথায় এটা প্রলম্বিত হবে। বিজয় আসবার ক্ষেত্রে বিলম্ব বিফলতার নামান্তর নয়। হতে পারে যে, প্রস্তুতি ও তৎপরতার মাত্রা সন্তোষজনক নয় এবং তা বাড়াতে হবে। দল বা দলের শাবাবদের জন্য এ প্রলম্বন একটি পরীক্ষা হতে পারে যে, কেউ কি এ কারণে ভগ্নমনোরথ হয়ে পরিত্যাগ করে প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে এসেছে নাকি দৃঢ় থেকেছে? যে কোন পরিস্থিতিতে পূর্ণমূল্যায়ন করতে হবে। যদি পদ্ধতি পরিবর্তন করবার মত কোন যুক্তিসংগত কারণ দলটি খুজে না পায়, তাহলে কেবলমাত্র বিলম্বজনিত কারণে পদ্ধতি পরিবর্তন করা যাবে না। দলটিকে এর ধরন ও উপকরণকে বারংবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আর অনুমোদিত এবং সর্বাপেক্ষা কার্যকরী ধরন ও উপকরণকে গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং বিজয়ের বিলম্ব মানে বিফলতা নয়। তাছাড়া এমন কোন শরঈ বিধান নেই যে, একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে।

অবশ্যই পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট হুকুম ও চিন্তার সঠিকতার বিষয়টিতে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। এ চিন্তা দিয়েই শাবাবগন ও উম্মাহ প্রস্তত হবে। যদি দলটি এই চিন্তা ও হুকুমসমূহকে বিশুদ্ধ মনে করে সঠিক ধরন ও উপকরণকে গ্রহণ করে ধৈর্য্যের উপর দৃঢ় থাকে, তাহলে বিলম্বের জন্য চিন্তা ও হুকুম পরিবর্তন অনুমোদিত নয়।

পরিবর্তনের বিষয়টি ব্যক্তি নয় উম্মাহর সাথে সর্ম্পকযুক্ত। একজন ব্যক্তিকে পরিবর্তনের চেয়ে সমাজ পরিবর্তনের কৌশল অনেক জটিল। সুতরাং এর গতি শ্লথ এবং সহজে অনুধাবন করা যায় না। তবে সে অনুধাবন করতে পারে যার রয়েছে দূরদৃষ্টিমূলক চিন্তা এবং সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। এর অর্থ এই নয় যে, যখন কোন ব্যক্তি লক্ষ্যটাকে মাথায় নিয়ে কাজ করবে তখন তার মনোবৃত্তি এই হবে যে, সে সাফল্য অর্জন করতে পারবে না অথবা সাফল্য অর্জিত হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে। বরং তাদেরকে এই মনোবৃত্তি পোষণ করতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তার সাহাবী (রাঃ) এর মত তাদের হাতেই ইনশাআল্লাহ খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারা এর সাক্ষী হবে। একজন ব্যক্তির জীবন সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ হতে পারে। সুতরাং বিজয়ের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির জন্য নয় বরং পুরো দলের জন্য। তারা সেই বিশ্বাসীদের দল যাদের পৃথিবীতে ইসতিখলাফ বা সাফল্যের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ কাজের সময় একজন ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যু হতে পারে, দলের আমীর মারা যেতে পারেন, কেউ কেউ এ পথ থেকে ছিটকে যেতে পারেন; কিন্তু প্রতিশ্রুতি ততক্ষণ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত দলটি আল্লাহর নির্দেশ পালনে তৎপর থাকবে। বিজয় বিলম্বিত হোক বা না হোক, এ দলের কাছে বিজয়ের বিষয় আসবে। এ বিষয়ের জ্ঞানের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ছাড়া আর কেউ দায়িত্বশীল নয়। কিন্তু দলটি কেবলমাত্র সঠিক পদ্ধতি গ্রহণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল।

সুতরাং কারোর বলা ঠিক হবে না শরঈ হুকুম এমন একটি নিরীক্ষামূলক বিষয় যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অনুভূত না হলে আমরা একে ব্যর্থতা বলে গন্য করব এবং অন্য একটি নিরীক্ষামূলক পদ্ধতি দ্বারা এটিকে প্রতিস্থাপন করব। যতক্ষণ পর্যন্ত শরঈ দলিল দ্বারা পদ্ধতিটি সুপ্রমাণিত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ এ ধরনের কথা বলবার এখতিয়ার রাখেন না। তবে ধরন ও উপকরণের ক্ষেত্রে নিরীক্ষা চালানো সঠিক।

No comments:

Post a Comment