শরী’য়াহ প্রদত্ত দায়িত্ব হিসেবে দলটি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ
কাজে নিষেধ করবে। আমরা এখানে এমন কোন দলের দায়িত্ব নিয়ে আলোকপাত করব না যা
আংশিকভাবে শরী’য়াহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে, যেমনঃ দরিদ্র মুসলিমদের সাহায্য করবার জন্য গড়ে উঠা দাতব্য প্রতিষ্ঠান,
নির্দেশনা ও উপদেশ দেবার জন্য গড়ে তোলা সংগঠন, মসজিদ নিমার্ণের জন্য প্রতিষ্ঠান, কুরআন
শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। বরং আমরা এমন একটি দল নিয়ে কথা বলব যারা পুরো
দ্বীন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাধে তুলে নেবে। আর এটা করা হবে খিলাফত প্রতিষ্ঠার
মাধ্যমে যা মুসলিমদের জীবনে ইসলামকে বাস্তবায়ন করবে। এর দায়িত্ব হবে শরী’য়াহ প্রদত্ত সব মারুফাত বাস্তবায়ন করা ও সব মুনকারাতকে দূরীভূত করা। এই
রাষ্ট্র তার ভেতরে ইসলামকে বাস্তবায়ন ও এর বাইরে পুরো বিশ্বে ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়ার
মাধ্যমে ইসলামকে জীবনে বাস্তবায়ন করবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের রয়েছে শরী’য়াহ প্রদত্ত বিশাল দায়িত্ব যা ইসলামিক
রাষ্ট্রের উপস্থিতি বাস্তবায়িত থাকলে হয় ও অনুপস্থিতি থাকলে বন্ধ হয়ে যায় এবং
পরিত্যক্ত হয়। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত দল গঠনের গুরুত্ব তার এই
লক্ষ্যের কারণেই। ইসলামিক রাষ্ট্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে যদি
কোন দল রত না হয় তাহলে মুসলিমগন আল্লাহ প্রদত্ত সব ইসলামী গুরুদায়িত্বকে অবহেলা
করল এবং এর চেয়ে বড় কোন গুনাহের কাজ আর কিছু হতে পারে না।
যখন কোন মুসলিম ইসলামী জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য কাজ
করে না তখন কোন যিনাকারী যখন যিনা করে, চোর চুরি করে, শাসক অত্যাচার করে, নারীরা অর্ধনগ্ন অবস্থায়
রাস্তায় বের হয়, দূর্নীতি ব্যাপকতর হয়, জিহাদ বন্ধ হয়ে যায়, কাফেররা মুসলিমদের
অত্যাচার করে, মুনকার বিস্তৃতি লাভ করে এবং মারুফ সংকীর্ণ হয়ে যায় তখন তার গোনাহ ঐ মুসলিম
ব্যক্তিকেই বহন করতে হবে। এর কারণ হল মুসলিমরা আল্লাহ নির্দেশিত খোলাফায়ে রাশেদীন
প্রতিষ্ঠার কাজকে অবহেলা করবার কারণে এই মুনাকারাতসমূহ ব্যাপকতা পেয়েছে। ইসলামী
রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রত্যেকটি জিনিসকে তার নির্ধারিত জায়গায় স্থাপন করবে, মুসলিমদের
জীবনে শরী’য়াহকে বাস্তবায়ন করবে, ঈমানকে মুমিনদের হৃদয়ে প্রোথিত করবে এবং তাকওয়া ও ইহসানের ফলকে আবাদ
করবে। সুতরাং এই সামষ্টিক কাজটি একটি বাধ্যবাধকতা, যার মাধ্যমে শোচনীয় অবস্থার
পরিবর্তন ও এর সংশোধন নির্ভরশীল। এই বাধ্যবাধকতা উম্মাহকে তার পতনের অতল গহ্বর
থেকে টেনে তুলবে এবং পথের দিশাপ্রাপ্ত ও অন্য জাতির জন্য আলোর দিশারীরূপে হারানো
গৌরব ও ক্ষমতা পুণরুদ্ধার করবে।
আজকের এ করুণ পরিণতি থেকে উদ্ধার করবে যে বাধ্যবাধকতা, তার চেয়ে বড়
পুরষ্কার মুসলিমদের জন্য আর কী হতে পারে? এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বলেনঃ ‘আল্লাহ যখন তোমাদের দ্বারা কোন ব্যক্তিকে
হেদায়াত দান করে তখন তা লাল উটের চেয়েও উত্তম।’ (আল
বুখারী)
মুসলিমদের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করা ও তাদের ধ্বংসের
হাত থেকে রক্ষা করা,
আর এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রশান্তিদায়ক দ্বীনে প্রবেশের জন্য
লোকদের জন্য সব দরজা উন্মুক্ত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর কী হতে পারে। যখন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক ব্যক্তিকে জিহাদের সমতুল্য কোন কাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন,
তখন তিনি বললেনঃ
‘‘না, আমি এর সমতুল্য কোন কিছুকেই মনে করি না।’ তখন
তিনি (সাঃ) ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘যখন একজন মুজাহিদ
জিহাদের জন্য বেরিয়ে পড়ে তখন কি তুমি মসজিদে প্রবেশ করে ক্বিয়াম করতে থাক, কিন্তু ক্লান্ত হও না? রোজা রাখ কিন্তু ইফতার
কর না?’ লোকটি তখন বললঃ ‘এগুলো
না করে কে থাকতে পারে?’’ (বুখারী)
রাসূল (সাঃ) কী বলেননিঃ
‘সর্বোত্তম
জিহাদ হল অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলা।’
রাসূল (সাঃ) কী একথা বলেননিঃ
‘শহীদদের সর্দার
হামযা এবং সেই ব্যক্তি যে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের
নিষেধের জন্য দাড়াল এবং তাকে হত্যা করা হল।’ (আল হাকীম)
মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা সর্ম্পকে জ্ঞাত হয়ে নীরব থেকে
তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে দেয়া কোন মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি নীরব থাকে তাহলে সে
তো হাদীসের বর্ণণার মত হতে পারবে না, যেখানে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
‘....তারা একটি
দেহের মত, যখন এর একটি অংশ ব্যাথা পায় তখন পুরো দেহ তাতে
সাড়া দেয় ও জ্বর অনুভব করে ও নির্ঘূম রাত কাটায়।’ (মুসলিম)
‘....এমন একটি
প্রাসাদ যেখানে একজন আরেকজনকে শক্তিশালী করে।’
সুতরাং মুসলিমদের সামনে রয়েছে মহাপুরস্কার অথবা বিশাল পাপ-
উভয় সুযোগ। আর এটাই ইসলামে (কোন কিছু) ফরয হবার শর্ত। এটি অন্যান্য ফরযের মতই। যখন
মুসলিমগন এটা পালন করবে তখন পুরষ্কারপ্রাপ্ত হবে এবং যখন পরিত্যাগ করবে তখন
শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা কোন
আংশিক সামষ্টিক ইবাদতের কথা বলছি না যা ইসলামের একটি বা দু’টি হুকুম বাস্তবায়ন করবে। বরং আমরা এমন একটি দাওয়াতের কথা বলছি যা
ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে বাস্তবায়ন করবে।
দলটির বৈশিষ্ট্য
খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজের মাধ্যমে যারা পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে
বাস্তবায়ন করবে এরকম একটি দল থাকা শরী’য়াহগতভাবে বাধ্যতামূলক। নীচের প্রসিদ্ধ
আয়াতের মাধ্যমে এটা অনুধাবন করা যায়ঃ
‘আর তোমাদের
মধ্যে এমন একটা দল থাকবে যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আল ইমরানঃ ১০৪)
উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলমানদের
এটা সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা করে দিয়েছেন যে, তাদের মধ্যে
কমপক্ষে একটি ইসলামী দল থাকতে হবে যারা মানবজাতিকে কল্যাণের দিকে ডাকবে ও সৎ কাজের
আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করবে।
আদেশ সূচক নির্দেশটি হলঃ ‘এমন একটা দল থাকবে’ - যা একটি বাধ্যবাধকতা, কারণ এটা কল্যাণের দিকে আহ্বান, সৎ কাজের আদেশ
প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধের জন্য।
‘তোমাদের মধ্যে’ (মিনকুম) এখানে অংশগ্রহনকারী
আদেশ (তাবিদ), শরঈ নির্দেশনা (ক্কারিনা) থাকবার কারণে –যা বুঝায় যে, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ
কাজের নিষেধ একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। তবে এটা সবার জন্য প্রয়োগ হবে না। কেননা
এর জন্য এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক, যা সবার মধ্যে বিদ্যমান নেই। তাই ‘উম্মাহ’ শব্দটি মুসলিমদের মধ্য হতে একটি দলের
কথা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, পুরো উম্মাহর কথা বলা হয়নি। নির্দেশটি হল মুসলিমদের
মধ্য হতে অবশ্যই একটি ইসলামী দল থাকতে হবে। উম্মাহ শব্দটিকে পবিত্র কুরআনে ‘এক দল লোক’ অর্থে বুঝানো হয়েছে। যখন আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসা (আ) সর্ম্পকে বলেনঃ
‘যখন তিনি
মাদইয়ানের কুপের ধারে পৌঁছলেন, তখন কুপের কাছে একদল লোককে
(উম্মাতান) পেলেন তারা জন্তুদেরকে পানি পান করানোর কাজে রত।’ (সূরা আল
কাসাসঃ ২৩)
এখানে যে কোন দলের কথা বলা হয়নি বরং মুসলিমদের মধ্য হতে
একটি দলের কথা বলা হয়েছে, যাদের এই আয়াতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে খায়ের তথা ইসলামের
দিকে আহ্বান জানাবার এবং সৎ কাজের (মা’রুফ) আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের (মুনকার)
নিষেধের জন্য। এই বর্ণণার মধ্যে শাসকগনও রয়েছে। কারণ তারা সব মা’রুফ বা সব মুনকার
কাজের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তারা হয় লোকদের ইসলাম বা শরী’য়াহ দিয়ে শাসন করে
অথবা এগুলোকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করে এবং তখন তাদের জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসতে
হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলটি রাজনৈতিক হবে। কারণ এর কাজ শাসকদের [জবাবদিহীতার]
সাথে সংশ্লিষ্ট হবে। এই শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে শরী’য়াহ প্রদত্ত
পদ্ধতি অনুসারে যদি তা বিদ্যমান না থাকে এবং অতঃপর তাদের অবহেলা ও পথভ্রষ্টতার
জন্য জবাবদিহী করতে হবে এবং সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অনেক হাদীসে এই ফরয ও শাসকদের মধ্যকার সর্ম্পক নিরূপন করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়ঃ
“ঐ সত্ত্বার
শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অতি সত্বর আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং
অসৎ কাজে নিষেধ) কর। অন্যথায় অচিরেই তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আরোপিত হবে। অতঃপর
তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা।” (আহমাদ ও
তিরমিযী)
তিনি (সাঃ) আরও বলেনঃ
‘অত্যাচারী শাসকের
বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’ (ইবনে মাজাহ ও
নাসায়ী)
তিনি (সাঃ) আরও বলেনঃ
“শহীদদের সর্দার
হামযা এবং ঐ ব্যক্তিও, সে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে
উপদেশ দেওয়ার পর (ঐ শাসক) তাকে হত্যা করে ফেলে।” (হাকিম)
এছাড়াও রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
‘তোমরা আমর বিল
মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার
(সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) কর। অন্যথায় তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের
ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা।’
এবং তিনি বললেনঃ
‘‘দ্বীন হল
নসীহা বা উপদেশ প্রদান’। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ ‘কার
প্রতি, ইয়া রাসূলুল্লাহ!’ তিনি
বললেনঃ ‘আল্লাহর প্রতি, তাঁর
রাসূল, মুসলিম শাসকগন ও তার অধীনস্ত জনগনের প্রতি।’ (মুসলিম)
একারণে দলটির কাজ হল কল্যাণের দিকে ডাকার পাশাপাশি সৎ
কাজের আদেশ প্রদান করা ও অসৎ কাজে নিষেধ করা। এর একটি অংশ হল শাসকদের জবাবদিহীতার
মুখোমুখি করা এবং শরী’য়াহ অনুসারে শাসন করতে বাধ্য করা। শাসকের সাথে কাজটি সম্পৃক্ত হওয়ায়
এটি একটি রাজনৈতিক কর্মকান্ড। সেকারণে এই আয়াতটি ইসলামের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল বা
সংগঠনের উপস্থিতির কথা বলে।
বাস্তবতা হল শরী’য়াহ-র নিয়মকানুনসমূহের অস্তিত্বের জন্য
একজন খলিফার অপরিহার্যতা একটি শরী’য়াহ নির্ধারিত
বাধ্যবাধকতা। একারণে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটিও শরী’য়াহ
নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা। আর এই কাজের জন্য একটি দল বা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও একটি শরী’য়াহ নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা। কারণ শরী’য়াহর
মূলনীতি হলঃ ‘ওয়াজিব পালনের জন্য যা করতে হয় তাও
ওয়াজিব।’ (মা লা ইয়াতিম্মুল ওয়াজিব ইল্লা বিহী ফাহু’ওয়া ওয়াজিব)
মূলতঃ উপরোক্ত মাদানী আয়াতে ইসলামের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া
একটি রাজনৈতিক দল থাকবার অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছে। এই আয়াত কাজের প্রকৃতিকেও
সংজ্ঞায়িত করেছেঃ যা হল দাওয়াত, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। সে
কারণে সুনির্দিষ্টকারী প্রত্যয় ‘আল’ শব্দ উল্লেখিত হয়েছে। ‘আল খায়ের’, ‘আল মারুফ’ এবং ‘আল
মুনকার’ হল সুনির্দিষ্টকারী প্রত্যয়, যার সার্বজনীনতা
উপলদ্ধি করতে হবে। আর, প্রকাশভঙ্গি অনুসারে এই নির্দেশ
প্রত্যেক ব্যক্তিকে বুঝিয়েছে এবং বাস্তবায়ন অল্প বা অনেক লোকের মাধ্যমে হতে পারে।
সুতরাং এর মধ্যে ব্যক্তি, দল ও শাসকগন তথা সংশ্লিষ্ট সবাই
অর্ন্তভুক্ত । অল্প না অনেক, এটি নির্ধারিত হবে শরী’য়াহ
এবং দল যা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য কাজ করছে তা অনুসারে। ব্যক্তিগত ইচ্ছার অধীনে
অস্পষ্টভাবে এটি হওয়া সম্ভব নয়। বরং এটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, যদি এটি পরিত্যক্ত হয় তাহলে কাজ হওয়া উচিত সংশোধনমূলক, দলকে উপদেশ দিতে হবে যাতে তারা ভ্রান্তিকে স্পষ্ট দেখতে পায় ও পরিত্যাগ
করে। সুতরাং এই বিষয়টিও অন্যান্য বিষয়ের মতই শরী’য়াহ
দ্বারা নিরূপিত। প্রবৃত্তি, স্বেচ্ছাচারীতা, পরিস্থিতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর এটি ছেড়ে দেয়া হয়নি।
ইসলামের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির
অপরিহার্যতা
উপরোক্ত আয়াতে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের অপরিহার্যতা ছাড়া
অন্য কোন কিছুর কথা বলা হয়নি। এটি দলের সাধারণ প্রকৃতি ও এর কাজ সর্ম্পকেও ধারণা
দিয়েছে। কোন মা’রুফাত প্রতিষ্ঠা এবং মুনকারাতের মূলোৎপাটিত করার জন্য কাজ করতে হবে
তা স্থির করার বেলায় দলটি যে বাস্তবতায় কাজ করবে তার সাথে সম্পর্কযুক্ত যাকে বুঝে
নিয়ে দলটি সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় শর’ঈ হুকুম গ্রহণ করবে যাতে করে এই বাস্তবতাকে পরিবর্তন
করা যায়। সুতরাং এই আয়াতের সাথে মিল রেখে যে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শাসককে
জবাবদিহী করবার জন্য কাজ করছে তার কাজ ও এর দৃষ্টিভঈী কাজের বাস্তবতার সাথে
সর্ম্পকযুক্ত হবে। তারা শাসকের কাজ পর্যবেক্ষণ করবে ও অবহেলার জন্য সত্যের প্রতি
নিষ্ঠাবান ও সত্য দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবার নিমিত্তে তাকে জবাবদিহী করবে, জনগনের মধ্যে গনসচেতনতা সৃষ্টি করবে এবং শাসকের সাথে ইসলামের দাওয়াত
প্রসারের জন্য কাজ করবে। আয়াতের ভিত্তিতে গড়ে উঠা দলটি, যখন
কোন খলিফা বা খিলাফত নেই, তখন তার কাজের জন্য প্রয়োজনীয়
সংশ্লিষ্ট সকল শরী’য়াহ নির্দেশনা গ্রহণ করবে। শরী’য়াহ-র চাহিদা অনুসারে দলটি তার লক্ষ্য নির্ধারণ করবে এবং অতঃপর যে
পদ্ধতিতে এটি কাজ করবে ও যে চিন্তাকে ধারণ করবে তাকে সুনির্দিষ্ট করবে।
সুতরাং রাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুন একটি রাজনৈতিক দলের
অস্তিত্ব অপরিহার্য। দলটির লক্ষ্য, এর কাজ, চিন্তা
বিকাশের প্রক্রিয়া ইত্যাদি বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত।
যেহেতু এখন আমরা এমন এক সময়ে বাস করি যেখানে আল্লাহর আইন
দিয়ে মুসলিমদের শাসন করবার জন্য কোন খলিফা নেই এবং যেসব ভূমিতে মুসলিমগন বসবাস
করেন সেগুলো দারুল কুফর,
যেসব ব্যবস্থা ও সর্ম্পক দিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে
সেগুলো ইসলামকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেনি, সমাজ
অনৈসলামিক; সেহেতু এমন একটি দলকে থাকতে হবে যাদের কাজ হবে
ভূমিসমূহকে দারুল ইসলামে পরিণত করবে, সমাজকে ইসলামী করবে,
এমন একটি অবস্থার প্রত্যাবর্তন ঘটাবে যেখানে আল্লাহর নাযিলকৃত
বিধিবিধান অনুসারে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে অর্থাৎ ইসলামী জীবনব্যবস্থার পূণঃপ্রবর্তন
হবে এবং বিশ্বের কাছে দাওয়াত পৌছে দেবে। আর এ লক্ষ্যকে উপলদ্ধি করেই দলটি তার
প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
কীভাবে একটি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন তৈরী করতে হয়
একটি সংগঠন বা দল তার শরী’য়াহ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শরী’য়াহর কোন পদ্ধতিকে অনুসরণ করবে?
এই লক্ষ্যকে উপলদ্ধিতে আনবার জন্য দলটি কী ধরনের শরী’য়াহ নীতিমালা
মেনে চলবে?
দাওয়াহ এর সংশ্লিষ্ট বিপুলসংখ্যক শরী’য়াহ নিয়মের
বেলায় দলটির উপলব্ধির ক্ষেত্রে মানদন্ড ও নীতিমালা কি হবে?
শরী’য়াহ নিয়মনীতিকে দলটি কীভাবে দেখে? এর উৎসসমূহ কী? দলটি কী মনে করে একটি
সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার একাধিক
হুকুম আছে? শরী’য়াহ এর যেসব
বিষয়ে ইক্বতিলাফ বা অনৈক্য রয়েছে সেসব ব্যাপারে দলটির অবস্থান কী?
চিন্তাকে দলটি কীভাবে দেখে এবং আক্বীদাহ ও শর’ই হুকুমসমূহ
গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে চিন্তার ভূমিকা কী?
বাস্তবতার ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী কী? দলটি কী একে
চিন্তার উৎস বা চিন্তার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে?
লাভের (মাসলাহা) প্রশ্নে দলের অবস্থান কী এবং এটি কী শরী’য়াহ না মনের
ভিত্তিতে গৃহীত হয়?
আমরা যখন দলটির লক্ষ্য, এর কাজ, কাজের
পদ্ধতি, চিন্তার প্রক্রিয়া সংজ্ঞায়িত করতে পারব, তারপর খুব সহজেই এর কার্যক্রম ও প্রতিষ্ঠার ভিত্তি জানতে পারব। এরপর
আমরা জানতে পারব যদি দলটি পথভ্রষ্ট বা লক্ষ্যচ্যূত হয় তখন কী সংশোধনমূলক পদক্ষেপ
বা উপদেশ প্রদান করতে হবে।
কাজ করবার শরী’য়াহ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার পূর্বে আমরা
নিজেদের এমন একটি মূলনীতি মনে করিয়ে দেব যে বিষয়ে কারোই অজ্ঞ থাকা সঙ্গত নয়। তা
হলো এই যে, মানুষের সম্পর্কে - দুনিয়ার কোন ব্যাপার হোক
বা আখেরাতের কোন ব্যাপার হোক অথবা তাদের ভাল মন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে, তা যত
বড় বা ছোট বিষয়ই হোক - কোন ব্যাপারেই শরী’য়াহ কোন হুকুম
বাদ রাখেনি। সুতরাং মানুষের কাপড় পরিধান বা খোলা, মসজিদ
বা বাড়ীতে প্রবেশ করা বা সেখান থেকে প্রস্থান করা, অন্যের
সাথে আচরণ, বিয়ে করা, সালাত আদায়,
সাওম পালন, কথা বলা বা কাজ করা, সব
বিষয়ে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে হুকুম প্রদান করেছেন এবং কাজটি সম্পন্ন করবার পদ্ধতিও
বাতলে দিয়েছেন। কাজটি কী বাধ্যতামূলক নাকি বর্জনীয় অথবা মুস্তাহাব বা উৎসাহব্যঞ্জক
অথবা অপছন্দনীয়, যা থেকে সে বিরত থাকবে নাকি এটি মুবাহ, যে ব্যাপারে ব্যক্তির
নিজস্ব পছন্দ রয়েছে। এটা মানুষের সব কাজের সাথে সম্পৃক্ত। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন
বস্তু সম্পর্কেও ধারণা দেয়া হয়েছে যদিও এ ব্যাপারে রয়েছে ভিন্নরকমের দৃষ্টিভঙ্গী।
আর তা হল সব বস্তুই হালাল সেগুলো ব্যতিত যাদের ব্যাপারে শরী’য়াহ-র সুনির্দিষ্ট আপত্তি রয়েছে। সুতরাং এমন কোন কাজ বা বস্তু নেই
যেগুলোর বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কোন হুকুম
নেই। এটা নিম্নোক্ত দুটি শরী’য়াহ মূলনীতি অনুসারেঃ ‘কাজের ভিত্তি হল শরী’য়াহ নীতিমালা’ এবং ‘বস্তু ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল যতক্ষণ
পর্যন্ত এ ব্যাপারে শরী’য়াহর কোন আপত্তির ব্যাপারে দলীল
না পাওয়া যায়।’
ইসলামে রয়েছে ফিকরাহ (চিন্তা) এবং তরীকা (পদ্ধতি)
যখন আমরা আল্লাহর হুকুমকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য পদ্ধতির
কথা চিন্তা করব তখন এ ব্যাপারে আল্লাহ প্রদত্ত শরী’য়াহ নিয়মকানুন অনুসন্ধান করব
যাতে মুসলিমগন পরম করুণাময়ের কাছ থেকে পূর্ণ সচেতনতা, নির্দেশনা
ও হেদায়েতের মাধ্যমে অগ্রসর হতে পারবে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘বলে দিনঃ এই
আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝে সুঝে দাওয়াত দেই - আমি এবং আমার অনুসারীরা।’ (সূরা ইউসুফঃ ১০৮)
এটা অবশ্যই বলা উচিত হবে না যে, ‘শরী’য়াহ-র প্রকৃতিই এমন যে, এটি যে কোন বিষয়ে একটি
হুকুমকে আমাদের সম্মুখে পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপন করে এবং তারপর তা কিভাবে বাস্তবায়ন
করতে হবে তা লোকদের মন, পরিস্থিতি কিংবা স্বার্থরক্ষার
জন্য যে পদ্ধতি সুবিধাজনক হয় তার উপর ছেড়ে দেয়।’ এ থেকে
বুঝা যেতে পারে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করাকে আমাদের জন্য ফরয করে দিয়েছেন।
সুতরাং উম্মাহর প্রচেষ্টা ফরয বাস্তবায়নের দিকে থাকা উচিত। কিন্তু, তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি মুসলমানদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে; এমন দাবী করা কোন অবস্থাতেই ঠিক নয়। কারণ, শরী’য়াহ কোন কিছুই মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়নি এবং তার পছন্দের বশবর্তী
করেনি। যদি করত তবে তা হত শরী’য়াহ এর মূলনীতির সাথে
সাংঘর্ষিক। এমন কোন শরী’য়াহ নীতি নেই যেখানে একটি সমস্যার
সমাধান উপস্থাপন করা হয়েছে কিন্তু, তা বাস্তবায়নের
প্রয়োগযোগ্য পদ্ধতি পরিষ্কার ও পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং এইসব সমাধানসমূহ
এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে তা বাস্তবায়ন করা যায় ও জীবনের বাস্তবতায় প্রয়োগ
করা যায়। সেকারণে ইসলামের হুকুমসমূহের যদি বাস্তব পদ্ধতি না থাকে তাহলে সেগুলো হবে
কেবলমাত্র পুস্তকনির্ভর আদর্শ, লোকদের চিন্তা ও কল্পনার
বিষয়বস্তু, যেখানে লোকজন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করবে
এবং এটা ফলদায়ক হবে না।
সেকারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার শরী’য়াহ-র মধ্যে লোকদের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। তিনি মানবজীবনের সাথে
সম্পৃক্ত সব ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবস্থা প্রদান করেছেন। আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামী আক্বীদা এবং তা থেকে উদ্ভুত
ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের সব প্রবৃত্তি ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করেছেন। সুতরাং ইসলাম
স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এতেই
থেমে থাকেননি, বরং তিনি শর’ঈ হুকুমগুলোকে বাস্তবভাবে
প্রয়োগ করবার জন্য এবং ইসলামকে অবাস্তব দর্শন বা মামুলী কিছু বিধিনিষেধ হিসেবে মনে
না করবার জন্য অন্যান্য নীতিমালা নাজিল করেছেন। সেকারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এমন
একজন ব্যক্তি ছিলেন না যিনি কেবলমাত্র স্রষ্টার বার্তাবাহক, বরং তিনি একজন শাসক ও আল্লাহর হুকুমসমূহের বাস্তব প্রয়োগকারীও ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কেবলমাত্র এ বিষয়টি পরিষ্কার করেননি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে শুধুমাত্র
উপাসনা করতে হবে, বরং তিনি সেটা বাস্তবে প্রয়োগ করে
দেখিয়েছেন। তিনি লোকদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং সাহাবীদের দলটিকে নিয়ে
মক্কায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য কাজ করেছেন। অবশেষে তিনি ঈমানের ভিত্তিতে
সে রাষ্ট্রটি বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যা ইসলামকে বাস্তবায়ন করেছিল এবং ইসলামিক
আক্বীদাহ ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা গিয়েছিল তাদের শাস্তি দিয়েছিল। তিনি (সাঃ)
দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। একারণে আমাদের কাছে ইসলামী
রাষ্ট্রের জন্য নিয়মকানুন রয়েছে, কিভাবে তা প্রতিষ্ঠা
করতে হবে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা রয়েছে, রয়েছে উকুবাত
(শাস্তি) এর হুকুম, জিহাদের হুকুম, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রদানের জন্য নিয়মকানুন
রয়েছে। এসবই বাস্তব পদ্ধতিগত শরী’য়াহ হুকুম, যা শরী’য়াহ দিয়েছে আক্বীদাহ ও ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার জন্য, পরিচালনার জন্য, প্রসারের নিমিত্তে কাজ করবার
জন্য এবং এগুলোকে শাশ্বত রূপ দিতে আহ্বান জানাবার জন্য।
যদি এসব শরী’য়াহ নীতিমালার মাধ্যমে আক্বীদাহ ও
ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, সংরক্ষণ ও প্রসারের ব্যবস্থা না থাকত
তাহলে ইসলাম হত অবরুদ্ধ এবং এটি আমাদের কাছে পৌছাত না এবং প্রসারও লাভ করত না। এটা
খ্রীস্টান ধর্মের মত নিছক নীতিকথা সর্বস্ব হত। যেমনঃ “তোমরা ব্যভিচার করো না এবং
প্রতিবেশীর স্ত্রীর প্রতি লোভ করো না।” ইসলাম তখন
অন্যান্য ব্যবহারিক চিন্তা দ্বারা ধ্বংস হয়ে যেত বা সমূলে উৎপাটিত হত এবং এটা দিয়ে
এমন কিছু করা যেত না যা এর আওতাধীন নয়। অন্যান্য চমকপ্রদ চিন্তার মত এটাও ইতিহাসের
পাতায় পুস্তকের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, যেমনি আছে
প্লেটোর ‘The
Republic’.
উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু যিনা ইসলামে হারাম, সেহেতু এর সাথে যুক্ত আরেকটি শরী’য়াহ হুকুম এ অবৈধ
সর্ম্পককে বাস্তবে প্রতিরোধ করে এবং তা হলো যিনাকারীকে শাস্তি প্রদানের হুকুম,
আর এটি বাস্তবায়ন করবে ইসলামী রাষ্ট্র। সুতরাং শরী’য়াহ যিনা সর্ম্পকে হুকুম প্রদান করেছে, যেমন
আল্লাহ বলেনঃ
‘আর ব্যভিচারের
কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সূরা বনী
ইসরাইলঃ ৩২)
তাছাড়া তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যিনাকারীর
শাস্তি সর্ম্পকেও সুস্পষ্ট হুকুম প্রদান করেন, যখন তিনি বলেনঃ
‘ব্যভিচারিণী
নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে
বেত্রাঘাত কর।’
(সূরা আল নূরঃ ২)
তাছাড়া শরী’য়াহ এই হুকুম (শাস্তি) বাস্তবায়নের জন্য
দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যেমন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
‘মুসলিমদের উপর
হুদুদ বাস্তবায়ন যতটা সম্ভব কম করবার চেষ্টা করো। যদি তুমি তাকে কোনভাবে বাচিয়ে দিতে
পার তবে তাই কর। একজন ইমামের পক্ষে শাস্তি প্রদানে ভুল করবার চেয়ে ক্ষমায় ভুল করা
অনেক শ্রেয়।’
(তিরমিযী এবং আল হাকীম)
সুতরাং শরী’য়াহ ইমামকে এ দায়িত্ব প্রদান করেছে।
একই কথা সালাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শরী’য়াহ এটা
পরিষ্কার করেছে যে, সালাত ফরজ এবং কেউ তা পরিত্যাগ করলে
কী শাস্তি হবে। এক্ষেত্রেও এই শাস্তি বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রকে দায়িত্ব
দিয়েছে। এভাবে ইসলামের যে কোন হুকুমের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিও অন্য একটি
হুকুমের মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমামকেই এ ব্যাপারে
কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, ইসলামের রয়েছে
একটি মৌলিক বিশ্বাস, যা হতে অন্যান্য শাখা বিশ্বাস ও চিন্তাসমূহ উৎসারিত হয়।
তাছাড়া এমন চিন্তাসমূহ রয়েছে যা ভাল (খায়ের) ও মন্দকে (শর), হাসান (সুন্দর ও প্রশংসনীয়) এবং কুবহ-কে (অসুন্দর ও নিন্দনীয়), মারুফ ও মুনকারকে, হালাল (অনুমোদিত) ও হারামকে
(নিষিদ্ধ) সুস্পষ্ট করে। এর ইবাদত (উপাসনা), মু’আমালাত (লেনদেন), মাতু’মাত (খাদ্যদ্রব্য),
মালবুসাত (পরিচ্ছদ), আখলাক (নৈতিকতা) এর
ব্যাপারে শরী’য়াহ নীতিমালা রয়েছে। এগুলো সবই একটি ইসলামিক
ও মানবিক সমাজে বসবাসের জন্য অপরিহার্য। ইসলাম যে সমাজের দিকে মানুষকে আহ্বান করে
তা সর্ম্পকে এগুলো স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করে। এইসব বিশ্বাস, চিন্তুা ও নিয়মকানুনকে আল ফিকরাহ আল ইসলামীয়া (ইসলামিক চিন্তা) বলা হয়।
শরী’য়াহ নিয়মকানুন যা ইসলামী ফিকরাহকে পূর্ণতা দান করে ও
তা প্রতিষ্ঠিত করে, রক্ষা করে ও প্রসার ঘটায় এগুলো হলঃ
শাস্তির বিধান, জিহাদের বিধান, খিলাফতের
বিধান, শরী’য়াহর যে বিধানের
কারণে ইসলামিক রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয় এবং মা’রুফ সম্পাদন ও মুনকার নিষিদ্ধ করবার
বিধান। এসব সহায়ক শরী’য়াহ বিধিবিধানকে আত-তারিকা আল ইসলামীয়া
(ইসলামিক পদ্ধতি) বলা হয়।
যারা ত্বরিকাকে (পদ্ধতি) উপেক্ষা করে
যে জন্য আমরা ইসলামকে ফিকরা (চিন্তা) এবং ত্বরিকা (পদ্ধতি)
এ দু’য়ের সমষ্টি হিসেবে দেখাতে বাধ্য হচ্ছি তা হলো এই যে, এভাবে না
দেখার কারণে মুসলিমরা অনেক শরী’য়াহ বিধান বর্জন করছে এই
বলে যে, আমরা এগুলো অনুসরনে বাধ্য নই। তারা এই অজুহাতও দেখায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অমুক কাজটি অমুক অবস্থা ও পরিস্থিতির কারণে সেসময়
করেছিলেন। তাই, যদি সেগুলো আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির
সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে আমরা সেগুলো এখন গ্রহণ করব, অন্যথায় পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য কোন আইন গ্রহণ করব। এ
দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেকে ইসলামের পেনাল কোড পরিবর্তনের জন্য আহ্বান করে কেননা তারা
মনে করে এগুলো বর্তমান সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা চাবুক মারা, পাথর মারা অথবা হাত কাটা এখন আর গ্রহণযোগ্য মনে করে না যেহেতু তাদের
মতে এগুলো অনেক নিষ্ঠুর নিয়মকানুন ও পশ্চিমারা এসবকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা মনে করে
কেননা এসব তাদের মনে করিয়ে দেয় তাদের ধর্মের কথা যেখানে মধ্যযুগে কঠিন ও নিষ্ঠুর
সব নিয়মকানুনের মাধ্যমে মানুষের উপর জুলুম করা হত, সুতরাং
এইসব আইন কানুনের কথা বললে মানুষ ইসলাম থেকেও দূরে সরে যাবে। তাই, এইসব আইন কানুনকে জেল ও জরিমানা দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে কোন অসুবিধা
নেই। একইভাবে আমরা দেখতে পাই কেউ কেউ জিহাদের অবলুপ্তির কথা বলে। ইসলাম প্রসারের
জন্য যে জিহাদ এসেছিল তা বর্তমানে বিজ্ঞাপন ও প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে
প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। বর্তমান সময় হল সংস্কৃতি বিনিময়ের। যেহেতু ইসলামে রয়েছে
প্রামাণ্য দলীলাদি ও পরিষ্কার সত্য, সেহেতু কলম, টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে শক্তিপ্রয়োগের চেয়ে বেশী সুফল
পাওয়া যাবে। আর শক্তি প্রয়োগ করা হলে হৃদয়সমূহ রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং ঘৃণা ও অসৎ প্রবৃত্তি
জাগ্রত হবে। কেউ কেউ জিযিয়াকে বিড়ম্বনাকর ও দ্রোহাত্নক বলে একে পরিত্যাগ করবার
পক্ষে মতামত প্রদান করে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ইসলামিক
আইনে খিলাফত ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক নয়। তারা এমন ফতওয়া প্রদান করেছে যা ইসলামী
খিলাফত ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটিয়ে আধুনিক শাসনপ্রথা গ্রহণের যৌক্তিকতাকে দৃঢ় করেছে।
তাদের মতে ইসলামিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা জরুরী, কিন্তু
যে কাঠামো তা বাস্তবায়ন করে তা নয়, কেননা এই কাঠামো অনেক
ধরনের হতে পারে।
এভাবে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির ব্যাপারে অনেক
প্রস্তাবনা এসেছে, যেমনঃ ইসলামী বই লেখা, মসজিদ নির্মাণ করা,
দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, মিশনারী
স্কুলের আদলে ইসলামী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, লোকদের
নৈতিকতার দিকে আহ্বান করা, সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা
বা গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ক্ষমতা ভাগাভাগি
করা ইত্যাদি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতি বরাবরই উপেক্ষিত
থেকেছে।
এভাবে মুসলিমগন আজকে ফিকরাহ এর সাথে সম্পৃক্ত শর’ঈ
নীতিমালা অস্পষ্ট ও দ্বান্দিক উপায়ে গ্রহণ করছে। সেকারণে তারা ত্বরীকার সাথে যুক্ত
শরী’য়াহ নিয়মকানুনকে অবজ্ঞা করছে। এসবই ঘটেছে একারণে যে, তারা পশ্চিমা ধ্যানধারণার শিকার হয়ে ইসলামকে পরিষ্কার ও আইনগতভাবে
অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে ইসলামের প্রয়োগকে বুঝতে অসমর্থ হয়েছে।
একারণে ফিকরাহ (চিন্তা) ও ত্বরীকা (পদ্ধতি) এর আলোচনা উঠে
আসে, যাতে করে মুসলিমগন গুরুত্বপূর্ণ শরী’য়াহ নীতিমালাকে অবহেলা না করে, যেগুলো
পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও আমাদের বাস্তব জীবনে বাস্তবায়নের জন্য এসেছে। এইসব
হুকুমকে অবজ্ঞা করার অর্থ হল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশকে পরিত্যাগ করা, যা
একটি অপরাধ এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে এর
জন্য আমাদের জবাবদিহী করতে হবে।
সেকারণে আমরা এই শ্রেনীবিন্যাসের মধ্যে এসেছি যে, ‘ইসলাম হল ফিকরাহ
(চিন্তা) ও ত্বরীকা (পদ্ধতি) এর সমন্বিত রূপ।’ এর মাধ্যমে
ইসলাম আরও স্পষ্ট হয়, বুঝতে সহজ ও প্রয়োগ সরলতর হয়।
পূর্বে মুসলিমগন এ ধরনের শ্রেণীবিন্যাস করেছিল, যেমনঃ
ইসলাম হল আক্বীদাহ ও ব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মাতু’মাত (খাদ্যদ্রব্য) এর
নিয়ম, মালবুসাত (পরিচ্ছদ), আখলাক
(নৈতিকতা) ও ইবাদত (উপাসনা)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় এগুলো একসাথে সুবিন্যস্ত
ছিল না। তারপর ফকীহগন এগুলো সংগ্রহ ও সুবিন্যস্ত করেছেন এবং বইয়ের অধ্যায়ে স্থান
দিয়েছেন, যাতে করে মুসলিমরা খুব সহজে এগুলো অনুধাবন ও প্রয়োগ করতে পারে।
এই আলোচনার অবতারণা একারণে করা হচ্ছে যাতে মুসলিমগন
সুনির্দিষ্ট শরী’য়াহ নিয়ম এমনভাবে গ্রহণ না করে যে প্রয়োজনে সেগুলো পরিবর্তিত ও বিকৃত
করে ফেলে এবং সবশেষে অবহেলা ও পরিত্যাগ করে।
শরী’য়াহ শাস্তিকে আধুনিক শাস্তি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা
অনুমোদিত নয়, একইভাবে খিলাফতকে রিপাবলিকান পদ্ধতি দ্বারা
প্রতিস্থাপন করা যাবে না। পশ্চিমা সিভিল আইন ইসলামিক আইনের বদলে গ্রহণ করা যাবে না
অথবা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতির বদলে নিজস্ব আকল বা নিয়মকানুন
মানা যাবে না, যদিও এ ব্যাপারে অনেক ফতওয়া দেয়া হয়েছে।
সুতরাং, যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা একটি শরী’য়াহ হুকুম, সেহেতু এটি প্রতিষ্ঠা করবার
পদ্ধতিও একইভাবে শরী’য়াহ হুকুম। এর অর্থ হল পদ্ধতির সাথে
সংশ্লিষ্ট শরী’য়াহ-র অন্যান্য নিয়মকানুনের মত এ ব্যাপারে
বিস্তারিত দলিলাদি রয়েছে এবং নির্দেশ
দেয়া হয়েছে গ্রহণ করবার জন্য এবং তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার জন্য।
কেউ যদি ফিকাহশাস্ত্রের বইগুলোর দিকে তাকায় তাহলে দেখতে
পাবে যে, মুসলিম ফকীহগন সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে উকুবাত (শাস্তি),
জিহাদ, ইমারাত বা রাষ্ট্র এবং অন্যান্য
পদ্ধতিগত হুকুম আলোচনা করেছেন। প্রয়োজন হয়নি বিধায় কেবলমাত্র ইসলামিক রাষ্ট্র
বাস্তবায়নের পদ্ধতি সেখানে আলোচিত হয়নি। এর কারণ হল কালপরিক্রমায় মুসলিমগন এমন কোন
পরিস্থিতিতে উপনীত হয়নি যখন একদিনের জন্যও ইসলামিক রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু আজকে
মুসলিমদের এটি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি বের করা ও তা গ্রহণ করবার জন্য সব প্রচেষ্টা
বিনিয়োগ করা উচিত। পরিস্থিতি বিবেচনা করে খেয়ালখুশী বা প্রবৃত্তির ভিত্তিতে নয় বরং
এটা হওয়া উচিত শর’ঈ দলিলাদির ভিত্তিতে।
শরী’য়াহ অনুসারে যখন পদ্ধতি আইনসম্মত হয়ে যাবে তখন
আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শ সেখানে প্রতিফলিত হবে। যখন
গ্রহণযোগ্যতা থাকবে তখন জবাবদিহীতা ও পরামর্শ প্রদানের সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ আমীরসহ
দলের যে কোন সদস্যকে তখন জবাবদিহী ও উপদেশ প্রদান করা যাবে। বিষয়সমূহ মানুষের মন,
ব্যক্তিগত সম্পর্ক অথবা জীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ করা যাবে না।
কর্মপদ্ধতি কখনই পরীক্ষামূলক বিষয় হওয়া উচিত নয়, বরং এ
ব্যাপারে শুধুমাত্র শরী’য়াহ-র দ্বারস্থ হওয়া উচিত।
যে ব্যক্তি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে সে
স্বভাবতই এটা করবার শরী’য়াহ পদ্ধতি ও বিস্তারিত দলিল সর্ম্পকে জানতে চাইবে। সে এ ব্যাপারে
আলোচনা করবে ও লোকদের সেদিকে আহ্বান করবে। এখন জানা দরকার কী সেই শরী’য়াহ কর্মপদ্ধতি যা একজনকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রহণ করতে
হবে?
শরী’য়াহ কর্মপদ্ধতি সর্ম্পকে ধারণা পাবার আগে একজন
মুসলিমকে অবশ্যই আজকে মুসলিমগন কী ধরনের বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করছে তা
সুনির্দিষ্ট ও গভীরতার সাথে উপলদ্ধি করতে হবে যাতে করে মৌলিক কার্যকারণ বুঝা যায়।
এতে করে মৌলিক কার্যকারণের সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় সমাধান করা যাবে। সেকারণে এই
সমাধান হবে মৌলিক। যখন বাস্তবতা অনুধাবনে আসবে ও মৌলিক কার্যকারণ বুঝা যাবে তখন শরী’য়াহ-র লক্ষ্য নির্ধারণ করা সহজতর হবে। এর পরই দলটি তার শরী’য়াহ কর্মপদ্ধতি সর্ম্পকে অবহিত হবে, যা তাকে মেনে চলতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাহকে অনুসরণ করতে হলে তাঁর (সাঃ) জীবনকালের কোন সময়
বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বা নিকটবর্তী তা বিবেচনায় আনতে হবে।
বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনই কর্মপদ্ধতি বিষয়ক হুকুমগুলোকে ঢেকে
দিয়েছে
বাস্তবতার নিরীখে আমরা দেখতে পাই যে, মুসলিমগন
ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং পশ্চিমা কাফেররা এক্ষেত্রে যথেষ্ট
সফলতার পরিচয় দিয়ে মুসলিমদের ইসলামের সঠিক উপলদ্ধি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। একারণে
মুসলিমরা ইসলামকে পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে
ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে - যা হল দ্বীনকে জীবন থেকে আলাদা করা। যা পশ্চিমাদের জন্য
পরবর্তী ধাপ নিয়ে কাজ করবার পথকে সুগম করেছে, অর্থাৎ তারা
ইসলামী খিলাফতকে ধ্বংস করে মুসলিমদের জীবন থেকে ইসলামকে আলাদা করে ফেলল এবং ৫০
টিরও বেশী ক্ষুদ্র অকার্যকর স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করে ফেলল। তারপর পশ্চিমারা
প্রতিটি রাষ্ট্রে একজন করে তাদের প্রতি আজ্ঞাবহ শাসক বসাল, যারা সেসব দেশের
সম্পদকে পশ্চিমের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে পাহারা দিতে শুরু করল ও এমন ব্যবস্থা করল
যাতে জনগন তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে। তারা এ জনগনকে পরিচালনা করবার জন্য নানা
ব্যবস্থা প্রদান করল, প্রচারযন্ত্রকে তাদের চিন্তা
প্রসারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করল, ভবিষ্যত প্রজন্মের
কাছে পশ্চিমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করবার জন্য পাঠ্যসূচী
প্রণয়ন করে দিল। এসব কিছু মুসলিমদের উপরে পশ্চিমাদের আধিপত্যকে সুনিশ্চিত করল এবং
বাস্তব জীবন থেকে ইসলামকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে সমর্থ হল।
এর ফলশ্রুতিতে মুসলিমগন আল হাক্ব বা সত্যের সাথে আল বাতিল
বা মিথ্যাকে পার্থক্য করবার ক্ষেত্রে সন্দিহান হয়ে পড়লো। তাদের চিন্তা পশ্চিমা
চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হল এবং তাদের জীবনব্যবস্থা পশ্চিমা মডেল অনুযায়ী গড়ে উঠল, যেখানে
বৈষয়িক স্বার্থ জীবনের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে উঠল। তাদের আবেগ জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও
আধ্যাত্মিক আবেগের মিশেলে তৈরি হল। একারণে মুসলিমদের পারস্পরিক বন্ধন ছিন্ন হল।
মুসলিমগন নিজেদের কুফর ব্যবস্থার কাছে অর্পন করল এবং ইসলামিক রাষ্ট্র না থাকার
বিষয়টি মেনে নিল। ফলে ইসলাম কিছু ব্যক্তিসর্বস্ব শরী’য়াহ
নিয়মনীতিতে পরিণত হল। অন্যকথায় তখন মুসলিমদের জীবনযাত্রা পশ্চিমাদের আদলে গড়ে উঠল
যেখানে জীবন হতে দ্বীন বিচ্ছিন্ন। একারণে দুনিয়ার প্রতি মোহ বৃদ্ধি পেল এবং
জান্নাত লাভের আকাঙ্খা তিরোহিত হল।
ফলস্বরূপ আল্লাহর বিধান (গজব) মুসলিমদের উপরে পতিত হল।
দারিদ্রতা, জুলুম, বঞ্চণা, দ্বীন
ও দুনিয়া সর্ম্পকে অজ্ঞতা, হানিকর নৈতিক চরিত্র ও অসুস্থ
সর্ম্পক এসবই মুসলিমদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলল।
এই বাস্তবতায় সঠিক দলটিকে অসুস্থতার মূল কারণ ও এর
উপসর্গসমূহের মধ্যে পার্থক্য করতে জানতে হবে। যারা এই পার্থক্য করতে পারবে না তারা
মনে করে যে, দারিদ্রতাই অসুখের মূল কারণ অথবা অসৎ নৈতিক চরিত্র, অজ্ঞতা ইত্যাদিও হতে পারে। তাই তারা সমস্যা সমাধানের জন্য যখন এগিয়ে
আসবে তখন সেই সমাধান হবে আংশিক এবং তিনি রোগের মূল চিকিৎসা বাদ দিয়ে কেবল রোগের
উপসর্গের চিকিৎসা করবেন। যদি কোন ব্যক্তি গভীরভাবে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা
উপলদ্ধি করবার চেষ্টা করেন, তাহলে দেখবেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণেই মুসলিদের জীবনে পূর্ণাঙ্গ
ইসলামের অনুপস্থিতি ঘটেছে। এই রাষ্ট্র না থাকায় তারা আজ অধঃপতিত, কাফেররা মুসলিমদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং অজ্ঞতা, দারিদ্র ও জুলুমের মত উপসর্গসমূহ ব্যাপকতা লাভ করেছে। ইসলামের
পূণর্জাগরণ ঘটাতে হলে দলটিকে অনুধাবন করতে হবে যে, মুসলিমরা
যে দারুল কুফরে এখন বসবাস করে সেটিকে দারুল ইসলামে পরিণত করতে হবে, যেখানে
মুসলিমগন কেবলমাত্র ইসলামিক আইন কানুন দ্বারা শাসিত হবে। এছাড়াও বর্তমান অনৈসলামিক
সমাজকে ইসলামিক সমাজে পরিণত করতে হবে যেখানের মানুষগুলো ইসলামিক চিন্তায় বিশ্বাস
করে এবং এই আবেগের উপর ভিত্তি করে একীভূত থাকে। ইসলাম দিয়ে তারা শাসন করে ও
বিচারের জন্য ইসলামিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। আর তখনই ইসলাম পূর্ণাঙ্গরূপে
বাস্তবায়িত হয়।
এভাবে লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়, যা হল ইসলামিক আক্বীদার উপর
ভিত্তি করে দারুল ইসলাম তথা ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা, যেখানে মুসলিমগন ইসলামিক
জীবনব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং যার ভিত্তি হলো আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত হুকুম
পালন ও নিষেধাজ্ঞা বর্জন।
দলটি তার লক্ষ্য নির্ধারণের পর এবার সে লক্ষ্য অর্জনের শরী’য়াহ পদ্ধতি
নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে যা মেনে দলটিকে অগ্রসর হতে হবে। এটা বুঝতে হলে আমাদের
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মাক্কীযুগে ফিরে যেতে হবে, যখন সেটা ছিল দারুল কুফর এবং
রাসুল (সাঃ) তাঁর দাওয়াতকে জনসমক্ষে আনার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। সেখান থেকেই
দলটি তার পথের মাইলফলক, কর্মধারা ও এর বিভিন্ন পর্যায়
সর্ম্পকে ধারণা নেবে।
আজকের পদ্ধতিও হবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পদ্ধতির অনুরূপ
সুতরাং, দলটিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সে কর্মকান্ডসমূহের দিকে
দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে যেগুলো তাকে মদীনাতে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র বাস্তবায়নের
দিকে নিয়ে গেছে। অবশ্যই পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপসমূহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে নিতে হবে
এবং দাওয়াতের নিয়মসমূহ সেসময়ের বাস্তবতা থেকে বুঝতে হবে। সুতরাং, দাওয়াত ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের সাথে এগিয়ে যাবে, শত প্রতিকূলতার মাঝে; কেউ এ প্রতিকূলতা থেকে
পরিত্রাণ পাবে না। যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর আয়াত নাজিল হচ্ছিল তখন ওয়ারাকা
বিন নওফেল বলেছিলেনঃ ‘তুমি মিথ্যুক হিসেবে সাব্যস্ত
হবে, ক্ষতির শিকার হবে, পরবাসে
যেতে বাধ্য হবে এবং যুদ্ধের মুখোমুখি হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ ‘তারা কি আমাকে তাড়িয়ে দেবে?’ ওয়ারাকা বললেনঃ
‘তোমার আগে এমন একজন নবীও আসেনি যারা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হননি।’
এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
‘আপনার
পূর্ববর্তী অনেক পয়গম্বরকে মিথ্যা বলা হয়েছে। তারা এতে সবর করেছেন। তাদের কাছে
আমার সাহায্য পৌছা পর্যন্ত তারা নির্যাতিত হয়েছেন। আল্লাহর বাণী কেউ পরিবর্তন করতে
পারে না। নিশ্চয়ই আপনার কাছে পয়গম্বরদের কাহিনী পৌছেছে।’ (সূরা আনআমঃ
৩৪)
আজকের পদ্ধতিও হবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দেখানো সেই পদ্ধতি।
তিনি (সাঃ) মক্কায় দারুল কুফরে বসবাস করতেন। তিনি স্বতপ্রণোদিত হয়ে এমন কিছু
কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন যা তাকে মদীনাতে দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে
গিয়েছিল। মক্কা থেকে মদীনাতে হিজরতের সময়টি ছিল দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে
পরিণত হবার ক্রান্তিকাল।
এখানে একটি প্রশ্ন উত্থিত হয় যে, তাহলে কী এখন
দাওয়াত দু’টি পর্যায়ে পরিচালিত হবে, অর্থাৎ মাক্কী ও মাদানী পর্যায়? উত্তর হল এই
যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময় দাওয়াত বহন করা হয়েছিল দু’টি পর্যায়েঃ
১. মাক্কী পর্যায়ে
বিশ্বাস ও সামান্য কিছু হুকুম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর নাজিল হয়েছিল। আইনগতভাবে
মুসলিমগন তখন যা নাজিল হত এর বাইরে আর কোন কিছুর জন্য দায়িত্বশীল ছিল না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল লোকদের ক্ষমা করে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপায়ে
আহ্বানের করবার জন্য। নিষেধ করা হয়েছিল যে কোনধরনের হিংসাত্নক কর্মকান্ড থেকে বিরত
থেকে প্রতিকূল পরিবেশে ধৈর্যধারণ করবার জন্য।
২. মাদানী যুগে বা
পর্যায়ে বিশ্বাস সম্পর্কিত বাকী আয়াত ও আহকাম সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা
সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ইসলামিক আইন
বাস্তবায়নের, উকুবাত (শাস্তি) সম্বলিত হুকুমসমূহ প্রতিষ্ঠা করবার, জিহাদ ঘোষণা করবার, নতুন ভূমি জয় করবার এবং
লোকদের দেখভাল করবার। এ অবস্থায় মুসলিমগন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অংশের জন্য দায়িত্বশীল
হল।
আজকে আমরা মক্কা ও মদীনার হুকুম নির্বিশেষে পূর্ণাঙ্গ
ইসলামের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। যে কোন আইনের অবহেলায় জবাবদিহীতার সম্মুখীন হতে হবে।
সুতরাং তালাক, বিয়ে, ব্যবসা, জিহাদ,
রোযা, হজ্জ্ব, শাস্তির
বিধান, ভূমি, মালিকানা ইত্যাদির
সাথে সম্পৃক্ত মদীনায় নাজিলকৃত আয়াত সমূহের ব্যাপারে মুসলিমদের জবাবদিহী করতে হবে।
এমন আইন রয়েছে যেগুলো পালনের জন্য মুসলিমদের খলিফা অত্যাবশ্যকীয় এবং কোন মুসলিম
ব্যক্তিগতভাবে তা গ্রহণের জন্য দায়িত্বশীল নয়, যেমনঃ
শাস্তির বিধিবিধান, দাওয়াত প্রসারের জন্য আক্রমণাত্নক
জিহাদ পরিচালনা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সাথে সংশ্লিষ্ট
নির্দেশনা ও খিলাফতের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমসমূহ। আবার এমন হুকুম রয়েছে যেগুলো
খলিফার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এবং পরিস্থিতি নির্বিশেষে মুসলিমদের জন্য পালন করা
বাধ্যতামূলক। এগুলো পালনে তারা ব্যর্থ হলে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে, হোক সেটা মক্কা
বা মদীনায় নাজিলকৃত; এবং ইসলাম সেসব মুসলমানদের জন্য
হিজরতকে বাধ্যতামূলক করেছে যারা অবস্থানরত ভূমিতে ব্যক্তিপর্যায়ের হুকুমসমূহ পালন
করতে পারছে না। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
‘যারা নিজের
অনিষ্ট করে, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে
আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব,
এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান। কিন্তু পুরুষ,
নারী ও শিশুদের মধ্যে
যারা অসহায়, তারা কোন উপায় করতে পারে না এবং পথও জানে না।’ (সূরা নিসাঃ
৯৭-৯৮)
No comments:
Post a Comment