30.10.13

অধ্যায় ২- দাওয়াত বহন করবার ক্ষেত্রে ঈমানের গুরুত্ব এবং ফরয কাজসমূহের মধ্যে অগ্রাধিকার প্রদান

মারূফাতের সমন্বয়ে ইসলাম গঠিত এবং আল্লাহ একে প্রতিষ্ঠিত করবার ও মুনকারাত থেকে বিরত থাকবার ও অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

র্বোচ্চ এবং সর্বপ্রধান মারুফ হচ্ছে আল্লাহ (সুবঃ) তায়ালার পর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, ইসলামিক আকীদার অন্যান্য ভিত্তিসমূহ।

মুনকারাতের চূড়ান্ত পর্যায় হল যে কোন ধরনের কুফরের নগ্ন বহিপ্রকাশ। আল্লাহ একে পরিত্যাগ করার, বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন ও এর ফাঁদে পা না দেবার ব্যাপারে সাবধান করেছেন।

মারুফের শ্রেণীবিভাগে ঈমানের পরে তাকওয়া আসে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ও রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্যের মাধ্যমে এটা অনুধাবন করা যায়। এটা হল ঈমানের ফলাফল, এটা তা সম্পূর্ণ করে এবং এর প্রয়োজনের খাতিরে তা আসে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে ভয় করবার অর্থ হল তার ক্রোধকে এড়িয়ে চলা। আল্লাহর আইনকে গ্রহণ করা ছাড়া এটি সম্ভব নয়। আর এই গ্রহণ করবার বিষয়টি ঈমানের সাথে সর্ম্পকযুক্ত। যখন একজন মুসলমানের ঈমান শক্তিশালী হয়, তখন আনুগত্যের বিষয়টিও শক্তিশালী হয়। যখন ঈমান দূর্বল হয়ে যায় তখন গ্রহণের বিষয়টিও দুর্বল হয়ে যায়। সেকারণে মুসলমানদের ঈমান থাকা এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ও রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয় এবং সবধরনের কুফর ও আনুগত্যহীনতার পরিচায়ক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবার নির্দেশ দেয়া হয়।

একজন মুসলমানের ঈমান ও তাকওয়া থাকা এবং কুফর ও পাপ থেকে বিরত থাকা ও এ বিষয়গুলোকে ছড়িয়ে দেয়া কোনক্রমেই সম্ভবপর হবে না যদি না সে লোকদের দাওয়াত দেয় ও ইসলামকে বহন করে; সেই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যা মুসলিম এবং তাদের আক্বীদা ও তাকওয়াকে  রক্ষা করে এবং তাদেরকে কুফর ও আনুগত্যহীনতার ফাঁদ থেকে সুরক্ষা দেয়। এটাই বাস্তবতা ও রাসূল (সাঃ) এর কাজ থেকে এ সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার সাহাবীদের কেবলমাত্র ঈমান ও তাকওয়ার নির্দেশ দেননি। বরং তিনি তাদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঈমান ও তাকওয়ার পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন, যে রাষ্ট্র প্রতিটি মুসলিমকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য ঈমান ও তাকওয়ামুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। মদীনা আল মনোয়ারায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটাই অর্জন করেছিলেন।

সুতরাং, মারূফাতের ফরয দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের অবশ্যই লোকদের কাছে দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। সাথে সাথে আমরা সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যও লোকদের দাওয়াত দিব যা এগুলোকে রক্ষা করবে। যে সকল মুনকারাত থেকে দুরে থাকতে হবে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, তা থেকে পৃথক থাকতে হবে এবং তাকে বিনাশ করতে হবে এবং যে ব্যক্তি মুনকার সম্পন্ন করবে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং যে ব্যবস্থা এই ধরনের মুনকারাতকে প্রতিষ্ঠিত করে ও সংরক্ষণ করে সেই ব্যবস্থা অপসারণ করতে হবে।

সুতরাং আমর বিল মারূফ এবং নাহি আনিল মুনকার মুসলমানদের উপর ফরয। তবে আমর বিল মারূফের উপদেশ দেবার আগে ঐ ব্যক্তিকে আগে নিজেকে তা মানতে হবে এবং নাহি আনিল মুনকারের আদেশ দেবার আগে নিজেকে সে কাজ থেকে বিরত হতে হবে।

প্রথম দিকঃ আমর বিল মারূফ এবং নাহি আনিল মুনকার

মুসলমানদের আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সব ইসলামিক আক্বীদার (আল্লাহ, তার ফেরেশতা, কিতাব, রাসূল, ক্বিয়ামত দিবস এবং ক্বাদা ওয়াল ক্বদর অর্থাৎ ভাল মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং কুরআন ও হাদীসে সুনিশ্চিত দলিলে যা এসেছে) উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সুতরাং, ঈমান হল প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন (ব্যক্তিগতভাবে ফরয)। তাকে অবশ্যই এই বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং এগুলোই ভিত্তি। সুতরাং, তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এমনভাবে যে, তিনি সব কিছুর স্রষ্টা এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই। নিখুত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ও সব সীমাবদ্ধতামুক্ত সত্তা আমাদের স্রষ্টা। এ মহাবিশ্বে যা আছে, যার উপর জীবন নির্ভরশীল ও মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় তা সবই আল্লাহ আল কাদির এর পক্ষ থেকে। আকাশ ও পৃথিবীর কোন কিছুই তার দৃষ্টির বাইরে নয় এবং কোন কিছুই তার ইচ্ছা ও জ্ঞানের বাইরে যেতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই একমাত্র সত্তা যাকে উপাসনা করা যায়। কেবলমাত্র তার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করা যায়, আত্মসমর্পণ করা যায় এবং তার সন্তুষ্টির মধ্যেই প্রশান্তি নিহিত রয়েছে। মুসলমানদের ভেতরে যখন এ বিষয়ে ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন আল্লাহর প্রতি ঈমান পরিপূর্ণ হবে। তাকে আরও বিশ্বাস করতে হবে যে, মুহম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য দ্বীন ইসলাম নিয়ে এসেছেন। এই দ্বীন আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ, মুহম্মদ (সাঃ) এর বুদ্ধিমত্তা, প্রতিভা থেকে উদ্ভুত কিছু নয়। আর তিনি যে দ্বীন বহন করেছেন তা ছিল অভ্রান্ত। তাকে অবশ্যই আল্লাহর অন্যান্য রাসূলদের, অবতীর্ণ কিতাবের উপর সাধারণভাবে এবং ফেরেশতা, ক্বিয়ামত দিবসক্বাদা ওয়াল ক্বদর এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এগুলো হল ঈমানের ভিত্তি। যে ব্যক্তি এগুলোর ব্যাপারে স্বীকৃতি দেয় সেই মুসলিম, যদিও সে ব্যক্তির এসবের বিস্তারিত বিষয়ের জ্ঞানে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে তা ততদিন পর্যন্ত যতদিন তিনি এমন কোন কাজ বা অন্য কোন বিষয়ে বিশ্বাস করতে শুরু না করেন যা তার ঈমানকে লঙ্ঘন করে। তবে এই ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, এজন্য সবসময় প্রচেষ্টা ও ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। যখন বিশ্বাসীরা স্রষ্টার চিরন্তন নিদর্শন ও কোরআন এর আয়াতসমূহ জানতে পারে তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার উপর তাদের বিশ্বাস দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়। মুসলমান যত আল্লাহর সৃষ্টি, সৃষ্টির গঠন, স্রষ্টার ক্ষমতা, তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সর্ম্পকে ভাবে, ততই তার ঈমান বৃদ্ধি পায় ও ঈমানের উৎকর্ষ বিধান হয়। মানুষ যতই তার জন্য প্রদত্ত আল্লাহর নিয়ামত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে, ততই সে বিষয়ে উপলদ্ধি শাণিত হবে, যে বিষয়ে আগে সে অবগত ছিল না। এভাবে স্রষ্টার প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের মাধ্যমে ইলাহর নৈকট্য অর্জন করা সম্ভব। স্রষ্টা ব্যতিরেকে সবকিছুর সীমাবদ্ধতা নিয়ে মুসলিমরা যত ভাববে, যত বেশী তার প্রয়োজন ও দূর্বলতা নিয়ে চিন্তা করবে ততই সে ইবাদত, আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে পারবে।

একইভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি বিশ্বাসও বাড়ে ও কমে। সুতরাং যতই একজন মুসলিমের কুরআন সর্ম্পকে জ্ঞান বাড়েততই সে উপলদ্ধি করতে পারে যে, এ গ্রন্থটি আল্লাহ ব্যতিত আর কারও কাছ থেকে আসেনি এবং এভাবে মুহম্মদ (সাঃ) যে আল্লাহ প্রেরিত রাসূল সে ব্যাপারে বিশ্বাস দৃঢ়তর হবে। এভাবেই রাসূল (সাঃ) এর সীরাত, তার জীবন, আল্লাহর পথে তার ত্যাগ তিতিক্ষা সর্ম্পকে যত জানবে ততই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি মহব্বত বাড়বে ও এই বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি আগ্রহ তত বাড়বে। ফলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি পাবে ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে উৎসাহী হবে।

একই কথা বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যখন মুসলিমগন সেই বিচার দিবস সর্ম্পকে ভাববে যে বিচার দিবসের দিন দুশ্চিন্তা শিশুদেরও ভাবিয়ে তুলবে, প্রত্যেক স্নেহশীল মা সন্তানের যত্ন নেয়া ভুলে যাবে, প্রত্যেক গর্ভবতী নারী তার বোঝা ত্যাগ করবে, লোকদের মাতাল মনে হবে। বিচার দিবসের ভয়াবহতা সর্ম্পকে আল্লাহ প্রদত্ত বর্ণণা তাকে ভীত করে তোলে এবং সেদিনের এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তির জন্য পথ খুঁজতে থাকে। মুসলিম ব্যক্তি জান্নাতের বর্ণণা আছে এরূপ আয়াত ও হাদীস যত বেশী পড়বে, জান্নাতে বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত চূড়ান্ত আরাম আয়েস ও চিরস্থায়ী সুখের কথা যত জানবে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আরাম আয়েস তার কাছে ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে এবং মহিমান্বিত জান্নাতের প্রতি তার আকর্ষণ তীব্রতর হতে থাকবে। এছাড়াও বিশ্বাসীরা দোযখের শাস্তি সর্ম্পকিত কোরআনের আয়াত ও হাদীসগুলো যতই জানবে, জাহান্নামের যন্ত্রনা ও চিরস্থায়ী অগ্নিকুন্ডের ব্যাপারে তার ভীতি তত বেশী হবে। তখন দুনিয়ার জীবনের শাস্তি ও ভয় তার থেকে উবে যায় এবং যদি এ জন্য তাকে অত্যাচারী শাসকের কারাগারে যেতে হয় বা পিঠে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হতে হয় তারপরেও সে তখন দোযখের আগুনে যাওয়ার জন্য দায়ী কারণুলো এড়িয়ে চলে। সুতরাং যখন মুসলিমের হৃদয় ঈমানের সাথে গ্রন্থিত হয়, তখন তার শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আনুগত্য ও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। আখিরাতের বিষয়টি যত বেশী প্রাধান্য লাভ করবে ততই মুমিনের কাছে দুনিয়া তুচ্ছ হতে থাকবে। যখন ঈমান শক্তিশালী হয়, ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হতে থাকে এবং বাধাবিপত্তির  মুখে কথায় ও কাজে দৃঢ় থাকে।

আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে সাথে অন্য সব ইলাহ বা কুফরকে পরিত্যাগ করতে হবে হোক সেটা কোন প্রতিমূর্তি বা চিন্তা। কুরআন মুর্তিপূজারীদের এবং এ ধরনের চিন্তাধারণা পোষণকারীদের ব্যপারে বলেছেঃ

সে বললঃ তোমরা স্বহস্ত নির্মিত পাথরের পূজা কর কেন? অথচ আল্লাহ্ তোমাদেরকে এবং তোমরা যা নির্মাণ করছ সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আস সফফাতঃ ৯৫-৯৬)

তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওযযা সম্পর্কে? এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে? পুত্র-সন্তান কি তোমাদের জন্যে এবং কন্যা-সন্তান আল্লাহ জন্য? এমতাবস্থায় এটা তো হবে খুবই অসংগত বন্টন। (সূরা আন নাজমঃ ১৯-২২)

তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরও বলেনঃ

তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তো শেষ; আমরা মরি ও বাঁচি, মহাকালই আমাদেরকে ধ্বংস করে। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে। তাদের কাছে যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন একথা বলা ছাড়া তাদের কোন যুক্তিই থাকে না যে, তোমরা সত্যবাদী হলে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে নিয়ে আস। আপনি বলুন, আল্লাহ্ই তোমাদেরকে জীবন দান করেন, অতঃপর মৃত্যু দেন, অতঃপর তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্রিত করবেন, যাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না। (সূরা জাসিয়াহঃ ২৪-২৬)

সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর প্রতি ঈমান আনা অনর্থক ও মিথ্যা। এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ঈমানের জন্য প্রয়োজন চিন্তা ও গভীর উপলদ্ধি। একইভাবে কুফর বর্জনের জন্যও প্রয়োজন চিন্তা ও গভীর উপলদ্ধি। পূর্বোক্ত আয়াতটি মানুষকে চিন্তা করতে উদ্ধুদ্ধ করে এবং কুফরের চিন্তার বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে আহ্বান জানায়-যাতে করে তারা ভুল বুঝতে পারে ও তাগুতকে বর্জন করতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ

দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়েত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী তাগুত দেরকে মানবে না এবং আল্লাহে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাঙবার নয়। আর আল্লাহ্ সবই শুনেন এবং জানেন। (সূরা আল বাক্কারাহঃ ২৫৬)

চিন্তা ও গভীর উপলদ্ধি হল আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনের উপায় ও একইভাবে তাগুত পরিত্যাগের মাধ্যম। শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবার ও সঠিক নির্দেশ পাবার জন্য একজন মুসলিমের উভয়টিই প্রয়োজন।

প্রত্যেক মুসলিমের ঈমান এর প্রতি তাকে প্রতিশ্রুত করে তোলে। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করল ও মিথ্যাকে পরিত্যাগ করল সে তার মহান প্রভু, সৃষ্টিকর্তা আল কাদির এর নৈকট্য পাবে। সুতরাং সে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসবে, ভয় করবে, করুণা ভিক্ষা করবে, তাকে উপাসনা করবে এবং নির্দেশ পালন করবে। এটা মুসলমানের মধ্যে আল্লাহ যা ভালবাসেন তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে ও আল্লাহ যা ঘৃণা করেন তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে। মুসলিম ব্যক্তি তখন আল্লাহর নিয়ামত ও করুণার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। সে এটা করবে না কেন? কারণ সে অনুধাবন করতে পারে যে,সে দূর্বল ও অক্ষম এবং তাকে এমন একজনের কাছে আত্নসমর্পন করতে হবে যে তার দায়িত্ব নিতে যথেষ্ট পারঙ্গম। যদি এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য না হত তাহলে সে পথনির্দেশ পেত না, সঠিক পথের উপরে অবস্থান করত না এবং তার সমস্যাসমূহের ভাল সমাধান হত না। সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্দেশ মানার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ভাল জীবনযাপন করে এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত হয়ে সে দূর্দশাগ্রস্ত ও অভিশপ্ত জীবন পায়। এভাবে সে দুনিয়া ও আখিরাত হারায়। সুতরাং ঈমান অবিসংবাদিতভাবে আনুগত্য ও তাকওয়ার দিকে ধাবিত করে। এটা প্রত্যেক মুসলিমকে স্রষ্টার উপাসনা ও আনুগত্যের পথে নিয়ে যায় এবং স্রষ্টার উষ্মার উদ্রেক করে এরকম কাজ থেকে বিরত রাখে এবং স্রষ্টাকে খুশি করবার ব্যাকুলতা সৃষ্টি করে। কী আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে আর কী তাঁর ক্রোধের উদ্রেক করে? আল্লাহর প্রতি আনুগত্য তাকে সন্তুষ্ট করে যার মধ্যে মুসলিমদের জন্য হুকুমদাতার নির্ধারিত অসংখ্য মারুফাত রয়েছে। আর আনুগত্যহীনতা স্রষ্টার ক্রোধের উদ্রেক করে যার মধ্যেও স্রষ্টা নির্ধারিত অনেক মুনকারাত রয়েছে এবং এগুলো থেকে বিরত থাকবার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ফরযে আইন (ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা) ও ফরযে কিফায়া (সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা) 

যে ব্যক্তি শরী’য়াহগত বাধ্যবাধকতা নিয়ে নিরীক্ষা করবে সে দেখতে পাবে যে, এদের কিছু ব্যক্তিগত ও কিছু সামষ্টিক। ফরযে আইন (ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা) হল এমন বাধ্যবাধকতা যা প্রত্যেক মুকাল্লীফকে (আইনগতভাবে দায়িত্বশীল ব্যক্তি) অবশ্যই পালন করতে হবে। যদি কোন মুসলিম এই বাধ্যবাধকতাকে ত্যাগ করে তাহলে সে পাপমুক্ত হবে না যদিও সে ব্যতিত সব মুসলিম এই দায়িত্ব পালন করে। আর যদি কোন মানুষ এই হুকুম না মানে, কিন্তু একমাত্র ঐ ব্যক্তি তা মানে তাহলে সে আল্লাহর দোষারোপ ও পাপমুক্ত হবে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরযে আইন জানা ও মানা অত্যাবশ্যকীয়। এতে করে সে অভিযোগ এবং বাধ্যকতার স্রষ্টার সামনে বিবেকের পীড়ন থেকে মুক্তি পাবে। ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতার মত ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর অর্থ হল মুসলমানদের সালাত আদায় করতে হবে, রমযানে রোজা রাখতে হবে, সামর্থবানদের হজ্জ পালন ও যাকাত আদায় করতে হবে এবং বাবা মার দেখশোনা করাহালাল খাদ্য খাওয়া, মন্দ ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা, জিনা থেকে দূরে থাকা, মিথ্যা বলা ও গীবত করা এবং এজাতীয় সবকিছু থেকে বিরত থাকা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সে সব মারুফাত সম্পন্ন করবে এবং মুনকারাত বর্জন করবে।

ফরযে কিফায়া (সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা) হল সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা যা মুসলমানদের মধ্য হতে যে কেউ সম্পন্ন করলেই হবে। প্রত্যেকের সম্পন্ন করা প্রয়োজনীয় নয়। এ অপরিহার্যতাটি থাকবে কিছু সংখ্যক বা অনেকের উপর। যদি তারা তা না করেন তবে সকল মুসলিম ততক্ষন পর্যন্ত গুনাহগার হবেন যতক্ষন না কাজটি সম্পন্ন হয়। তবে যারা এটি বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেছে ও পরিশ্রম বিনিয়োগ করেছে তারা এ গোনাহ থেকে মুক্ত হবে। এ কথা কারো মনে করার সুযোগ নেই যে অপর মুসলমানের সাথে গুনাহ্ ভাগাভাগি করার ফলে গুনাহ্ হাল্কা হয়ে যাবে তাই সে সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। এটা সত্য নয়, বরং ক্বিয়ামতের দিন তাকে একাই আল্লাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হতে হবে। সেকাণে তার অপরাধ তাকেই বহন করতে হবে। এ কারণে আল্লাহ বলেনঃ

কিয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে। (সূরা মারইয়ামঃ ৯৫)

বাস্তবতা হচ্ছে, যখন উম্মাহ তার সাথে গোনাহে পতিত হয় তখন এটা ভেবে হয়ত তিনি দুনিয়াতে সন্তুষ্ট ভোগ করবেন, তবে তার আখেরাতের শাস্তি এতে সামান্য পরিমাণেও হালকা হবে না। সুতরাং, আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান এবং চক্ষু ও মন নিশ্চুপ হবার পূর্বে যারা কোন অসম্পাদিত বা অপ্রতিষ্ঠিত ফরযে কিফায়ার ব্যাপারে উদাসীন তাদের অনতিবিলম্বে তা সম্পাদন ও প্রতিষ্ঠা করতে আত্ননিয়োগ করতে হবে। সুতরাং যেসব মুসলিম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলায় বিশ্বাস করে এবং তার সতর্কতায় ভয় করে, সে অবশ্যই তাকে (আল্লাহ) সন্তুষ্ট করতে, জান্নাত লাভ করতে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাচার চেষ্টা করবে। এ ধরনের মুসলমান সামষ্টিক বাধ্যবাধকতাকে তার দায়িত্ব মনে করবে ও তা সম্পাদন করবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালনে ঐ ব্যক্তি ব্রতী হবে ততক্ষণ সে গোনাহগার হতে থাকবে। তবে কিছু লোক যদি কাজটি সম্পন্ন করে ফেলে তাহলে তিনি সে দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন। সেকারণে মুসলিমদের আল্লাহর প্রদত্ত দায়বদ্ধতা পালনের জন্য ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। যেমনঃ আল্লাহ প্রদত্ত আইন দ্বারা শাসন করা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা, ইজতিহাদ করা, সৎ কাজের আদেশ প্রদান করা ও অসৎ কাজে নিষেধ করা। এসবই হল সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা যা মুসলিমগন সম্পাদন করবার জন্য চেষ্টা করবে এবং অন্যথায় তারা গোনাহগার হবে। যদি উম্মাহের ভেতরে কেউই ইজতিহাদ না করে, তাহলে যে ব্যক্তি ইজতিহাদ ফিরিয়ে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছে সে ব্যতিত বাকী সবাই গুনাহগার হবে। ইজতিহাদ ফিরিয়ে নিয়ে আসবার জন্য কর্মরত লোকদের কাজ অন্যদের পাপমুক্ত করবে নাততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ ইজতিহাদ বাস্তবায়িত না হয়। যখন ইজতিহাদ শুরু হবে তখন সবাই এ ব্যাপারে পাপমুক্ত হয়ে যাবেএকই কথা ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রযোজ্য। খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজের সাথে যুক্ত নয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে গোনাহগার হবে। এসময় প্রতিষ্ঠার কাজে রত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টার কারণে অন্যরা পাপমুক্ত হবে না যতক্ষণ না খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। আল ফিকরুল ইসলামী’ (ইসলামী চিন্তা) নামক বইয়ের ফরযে কিফায়া সব মুসলিমের উপর ফরয শীর্ষক অধ্যায়ে এ বিষয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ

যতক্ষণ না যে কাজের জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে সে কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি একে অবহেলা করল সে পরিত্যাগের কারণে শাস্তি ভোগ করবে। যখন সে দায়িত্ব পালন করবে তখন দায়মুক্ত হবে। এক্ষেত্রে ফরযে আইন ও ফরযে ক্বিফায়ার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। সব মুসলিমের উপর এটি তখন ফরয হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে......... (সূরা আত তাওবাহঃ ৪১)

এটি একটি ফরযে ক্বিফায়া এবং এই আমলটি সিদ্ধান্তগ্রহণকারী (তালবান যাজিমান)। সুতরাং ফরযে আইন ও ফরযে ক্বিফায়ার মধ্যে পার্থক্য করা একটি অপরাধ এবং আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার নামান্তর ও আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টি থেকে উদ্ভুত প্রবঞ্চণা। ব্যক্তির উপর দায়িত্বের অব্যাহতির দৃষ্টিতে বলতে গেলে, ফরযে ক্বিফায়া ও ফরযে আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কাজটি যতক্ষণ না সম্পন্ন হবে ততক্ষণ কোন ব্যক্তি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে না হোক তা ব্যক্তি পর্যায়ের যেমনঃ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা অথবা সব মুসলিমের উপর যেমনঃ খলিফার প্রতি বায়াত প্রদান করা। এদের কোনটি থেকে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না যতক্ষণ না এগুলো প্রতিপালিত হয়, অর্থাৎ নামাজ প্রতিষ্ঠিত হয় ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একজন খলিফাকে বায়াত প্রদান করা হয়। সুতরাং ফরযে ক্বিফায়ার দায়বদ্ধতা থেকে প্রত্যেক মুসলিম ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহতি পাবে না যতক্ষণ কিছু লোক চেষ্টা করতে থাকে এবং পরবর্তীতে সেটি সম্পন্ন হয়ে যায়। কাজটি যতক্ষণ না সম্পন্ন হবে ততক্ষণ প্রত্যেক মুসলিম গোনাহগার হতে থাকবে। সুতরাং ফরযে ক্বিফায়া হল সে ইবাদত যা কেউ আদায় করলে অন্যরা গোনাহমুক্ত হয়ে যাবে এ কথা বলা সম্পূর্ণরূপে ভুল। বরং ফরযে ক্বিফায়া হল সে ইবাদত যা কেউ সম্পন্ন করবার পর বাকী সবাই গোনাহমুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ফরযে ক্বিফায়া হল ফরযে আইনের মতই। সুতরাং খিলাফত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সব মুসলিমের অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলিমের উপর এটা ফরয। খিলাফত বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব থেকে কোন মুসলিম অব্যাহতি পেতে পারে না। এ ব্যাপারে দায়িত্ব প্রত্যেক ব্যক্তি মুসলমানের উপর ও গোনাহগারও প্রত্যেক ব্যক্তি মুসলিম হবে। যে কাজের মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে সে কাজে অংশগ্রহণের আগ পর্যন্ত একজন মুসলিম গোনাহমুক্ত হবে না এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তাকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং যে কোন ফরযে ক্বিফায়া ততক্ষণ পর্যন্ত ফরযে আইন থাকে যতক্ষণ না উক্ত কাজটি সুসম্পন্ন হয়।

ফরযে আইন ও ফরযে ক্বিফায়ার বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হওয়ার পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সামনে দোষমুক্ত অবস্থায় দন্ডায়মান হবার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি মুসলিম ফরযে আইন যেমনি বাস্তবায়ন করবে তেমনি ফরযে কিফায়া বাস্তবায়নের জন্যও নিজেকে শরীক করবে।

বাধ্যবাধকতার মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা

ফরযসমূহ পালনের ব্যাপারে রয়েছে শরী’য়াহহ নির্ধারিত অগ্রাধিকার। যখন মুসলিমগন সব ধরনের ফরযে আইন ও ফরযে ক্বিফায়া সঠিকভাবে সুসম্পন্ন করতে পারছে তখন কোন সমস্যা নেই। তবে যখন দ্বন্দ শুরু হয় তখন ফরযে আইন ফরযে ক্বিফায়ার উপরে প্রাধান্য লাভ করে। আবার যদি ফরযে আইন আমলসমূহের মধ্যে দ্বন্দ তৈরি হয় তখন শরী’য়াহর ভিত্তিতে প্রাধান্য নির্ধারণ করতে হবে, মনের ভিত্তিতে নয়। যেমন পরিবারের নাফাকা (ভরণপোষণ) ঋণ পরিশোধের উপর এবং ঋণ পরিশোধ হজ্জের জন্য টাকা জমা দেয়ার উপর প্রাধান্য লাভ করে। রমযানের রোজা নদরের (প্রতিশ্রুত) রোজার উপর প্রাধান্য লাভ করে। জুম্মার নামায কারও প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষার উপর প্রাধান্য লাভ করে ইত্যাদি.... ইত্যাদি। ফরযে ক্বিফায়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও যদি কোন দ্বন্দ হয় তখনও শরী’য়াহর ভিত্তিতে প্রাধান্য নির্ধারণ করতে হবে, মনের ভিত্তিতে নয়। এই ক্ষেত্রটি বিস্তৃত ও জটিল। এর কারণ হল অনেক ফরযে ক্বিফায়া রয়েছে যা সম্পন্ন করা খরচ সাপেক্ষ ও জটিল। আবার কিছু রয়েছে শ্রম ও সময়সাপেক্ষ। সংখ্যায় অনেক হওয়ার কারণে মুসলিমদের পক্ষে সবগুলো পালন করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। সে কারণে তাকে কিছুর উপর অন্য কিছু ফরযে ক্বিফায়াকে প্রাধান্য দিতে হবেকোনগুলো সে প্রতিপালন করবে এবং কোনগুলো সে পরিত্যাগ করবে তা খেয়ালখুশী, আকলী মূল্যায়ন বা ব্যক্তিগত পছন্দ অনুসারে নির্ধারণ করা যাবে না। বরং এটা আইনগতভাবে হতে হবে যেখানে শরী’য়াহহ অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে। যার গুরুত্ব ক্বারাঈন (শরীয় দৃষ্টান্ত) থেকে স্পষ্ট হতে হবে।

সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরযে ক্বিফায়া

যেমন ধরা যাকঃ যখন আমরা ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটিকে ফরযে ক্বিফায়ার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি,তখন কুরআন ও সুন্নাহের ভিত্তিতেই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।

যেসব লোক আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। (সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৪)

যেসব লোক আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম। (সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৫)

যারা আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই ফাসেক (মিথ্যাবাদী) (সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৭)

অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মনে না করে... (সূরা আন নিসাঃ ৬৫)

আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না... (সূরা আল মায়িদাহঃ ৪৯)

তারা কি জাহেলি যুগের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ্ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?’ (সূরা মায়িদাহঃ ৫০)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ ও কোরআনের এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আয়াত ও হাদীসসমূহ প্রমাণ করে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা যা আল্লাহর নাজিলকৃত বাণী দিয়ে শাসন করবে।

যেসব আয়াতের মাধ্যমে হুদুদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে তাদের সংখ্যা অনেক।

যে পূরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের হাত কেটে দাও...। (সূরা আল মায়িদাহঃ ৩৮)

ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ' করে বেত্রাঘাত কর। (সূরা আন-নূরঃ ২)

যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতঃপর স্বপক্ষে সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে... (সূরা আন-নূরঃ ৪)

সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ্ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি... (সূরা বনী ইসরাইলঃ ৩৩)

যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচেছ এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। (সূরা আল মায়িদাহঃ ৩৩)

যারা মদ্য পান করে তাদের চাবুক দ্বারা আঘাত করা, বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা, দাঁতের বদলা দাঁতআঘাতের জন্য ক্বিসাস (অনুরূপ শাস্তি), ক্বিসাসের বদলে অর্থের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ (আরস) এবং শরী’য়াহ-তে যেসব অপরাধের ব্যাপারে নির্ধারিত শাস্তির বিধান নেই সেক্ষেত্রে তাজীর বাস্তবায়ন করার ব্যাপারেও অসংখ্য হাদীস রয়েছে। এইসব আইন ও হুদুদ -যাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা রয়েছে সেসব নির্ভর করছে আল্লাহর আইন দ্বারা পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর।

জিহাদ সম্বলিত কোরআনের আয়াতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যেমনঃ

তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জেহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে... (সূরা আত তাওবাহঃ ৪১)

তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ্ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে। (সূরা আত তাওবাহঃ ২৯)

আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচেছ সমবেতভাবে (সূরা আত তাওবাহঃ ৩৬)

আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায় এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিন্ঠিত হয়ে যায়। (সূরা আল আনফালঃ ৩৯)

আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না... (সূরা আত তাওবাহঃ ৬০)

উপরোক্ত আয়াত ও জিহাদের সাথে সংশিষ্ট অসংখ্য হাদীস অনুসারে জিহাদ করতে হলে আল্লাহর বিধান দ্বারা পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরিহার্য। এরকম অনেক হাদীস রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে জিহাদ ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং ন্যায়নিষ্ঠ লোকের ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়হীন লোকের অন্যায় এটাকে বন্ধ করতে পারবে না। অন্য কথায় মুসলমানদেরকে তখনই জিহাদে ঝাপিয়ে পড়তে হবে যখন এ ব্যাপারে আহ্বান করা হবে তখন ইসলামী রাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক এবং জিহাদে আহ্বানকারী আমীর পাপিষ্ঠ বা ত্বাকওয়াসম্পন্ন যাই হোক। তবে এখনকার শাসকগন জিহাদে রত নেই এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবার জন্য তারা কোন নির্দেশও প্রদান করে নাবরং তারা মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করবার জন্য নির্দেশ দেয়। তারা ততক্ষণ পর্যন্ত এটা করতে থাকবে যতক্ষণ না আল্লাহ ও বিচার দিবসে বিশ্বাসীরা জেগে উঠতে পারবে ও কুফরী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎপাটন করে আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে।

বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া ও মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছেঃ

তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্ম, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে... (সূরা আল ইমরানঃ ১১০)

শক্তি ও সম্মান তো আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরই কিন্তু ... (সূরা আল মুনাফিকুনঃ ৮)

‘... কিছুতেই আল্লাহ্ কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর বিজয় দান করবেন না... (সূরা আন নিসাঃ ১৪১)

এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও... (সূরা আল বাক্বারাহঃ ১৪৩)

কীভাবে বিশ্বাসীরা সম্মানিত হবে এবং কাফেররা কোন পথ পাবে না, যখন মুসলিমদের কোন রাষ্ট্র নেই? কীভাবে তারা অন্যজাতিকে সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে যখন তারা নিজের ঘরে তা করতে অক্ষম। এসব কাজ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়।

মুসলমানদের একজন ইমাম থাকার ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে যাকে তারা আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহের উপর বায়াত দেবেঃ

যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যে, তার কাঁধে (কোন খলীফার) বাইআত নেই, সে যেন জাহেলী মরণ মরল। (মুসলিম)

ইমাম হচ্ছে ঢালস্বরূপ, যার পেছনে থেকে মুসলিমগন জিহাদ করে ও আত্নরক্ষা করে। (মুসলিম)

যদি কোন ব্যক্তি তার আমীরের মধ্যে এমন কিছু দেখে যা ঘৃণ্য, তাহলে সে যাতে এ ব্যাপারে ধৈর্য্য ধারণ করে। এটা একারণে যে, যদি কোন ব্যক্তি জামায়াত বা দল থেকে নিজেকে এক হাত পরিমাণও সরিয়ে নিল এবং এ অবস্থায় মারা গেল, সে যেন জাহেলিয়াতের সময়কার মৃত্যুবরণ করল। (মুসলিম)

সাহাবী (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর একজন উত্তরসুরী খলিফা নির্বাচনের ফরযিয়াতের ব্যাপারে ইজমা বা ঐকমত্যে পৌছেছিলেন। তারা আবু বকর, উমর, উসমান ও আলীকে পর্যায়ক্রমে পূর্ববর্তী খলিফার মৃত্যুর পর তার (রাঃ) স্থলাভিষিক্ত করবার ব্যাপারে একমত ছিলেন। প্রত্যেক সাহাবা তার পুরো জীবন ধরে একজন খলিফা নিয়োগের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে সুনিশ্চিত ছিলেন। কে খলিফা হবেন এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনৈক্য থাকলেও একজন খলিফা নিয়োগের ব্যাপারে একমত ছিলেন।

একইভাবে মুসলিমদের জীবনের জন্য ইসলামিক সমাজে অত্যাবশ্যকীয়, যেমনঃ শিল্পকারখানা, ঔষধ, হাসপাতাল, গবেষণাগার, জ্বালানী উৎপাদন এবং অন্যান্য সামষ্টিক অপরিহার্যতা অর্জনের ক্ষেত্রেও সব মুসলিম সমান দায়িত্ব পালন করবে। যা হোক এ সমস্ত বিষয়সমূহ একটি পূর্ণাঙ্গ উপায়ে নিশ্চিত রা, যা সমৃদ্ধ ইসলামী জীবনের জন্য অপরিহার্য, যার একদিক নির্ভর করে আল্লাহ্ (সুবঃ) তা’আলার দাসত্ব, অন্যদিক নির্ভর করে মুসলিমদের শক্তি সামর্থ ও দাওয়া প্রচারের উপর,তা রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছাড়া পালন সম্ভবপর নয়, যে কাঠামো এ সমস্থ বিষয়াদি ইসলাম এবং তার উদ্দ্যেশ্যের সাথে মিল রেখে কার্যকরভাবে তত্ত্বাবধান করবে।

একইভাবে জনগন যাতে শরী’য়াহগত বাধ্যবাধকতা পালনে সচেষ্ট থাকে এ ব্যাপারে ইসলাম শাসকদের দায়িত্ব প্রদান করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া শাসকের সাথে বিজড়িত হুকুমসমূহ অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবার জনগন যখন এইসব হুকুমসমূহ পালন করতে যাবে তখন তাদের বাধ্য করবার জন্য রাষ্ট্র ছাড়া তারা কোন শাসক পাবে না। তখন জনগনের দায়িত্বের সাথে সম্পৃক্ত সব হুকুম অকার্যকর হয়ে পড়ে। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মানবজীবনের উপর ইসলামের বাস্তব প্রয়োগের জন্য অন্যতম একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যখন এ ভিত্তি থাকে না তখন অনেক হুকুমসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ইসলামের অনেক বাণী বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। মুসলিমরা তখন তাদের সম্মান হারিয়ে ফেলে, ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেতাদের ভূমি বেদখল হয় ও শত্রুগন আধিপত্য বিস্তার করে ও মুনকারাত বিস্তৃতি লাভ করে যা আজকে হচ্ছে।

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়

ভাবতে খুব আশ্চর্যজনক লাগে যখন লোকজন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে কেউ কেউ ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটিকে সাধারণ শরীয়াহ্‌দায়িত্ব মনে করে এবং এটিকে অন্য হুকুমের উপর অগ্রাধিকার প্রদান করে না।

এমনকি আরও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা যায় যে, অনেক মুসলিমগন শরীয়া বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ না করে বর্তমান শাসনব্যবস্থার মধ্যে শরীয়া হুকুম বাস্তবায়ন করতে চায়।

সুতরাং আমরা অবশেষে বলতে পারি যে, সামষ্টিক দায়িত্বসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য বাধ্যবাধকতা হল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আজকে মুসলিমদের একটি অংশ এ দায়িত্ব পালন করছে। তবে তারা অপরিহার্যতা পূরণে সক্ষম নয়। কেননা ইসলামী রাষ্ট্র এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একারণে পুর্বের আলোচনার মত এ সামষ্টিক বাধ্যবাধকতাটি ব্যক্তিপর্যায়ের বাধ্যবাধকতা হিসেবে পরিগণিত হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলিমকে তার সামর্থ অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সঠিক ও সুনির্ধারিত পদ্ধতি হল যে, মুসলিমগন আল্লাহ নির্দেশিত ফরযে আইনসমূহ সর্ম্পকে শিক্ষা নিবে। সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কর্তৃক নির্দেশিত নিষেধসমূহ সর্ম্পকেও জ্ঞান অর্জন করবে। তারপর তাকে সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা বা ফরযে ক্বিফায়ার দিকে যেতে হবে এবং তার সামর্থ অনুযায়ী সেগুলো সম্পাদনের অংশগ্রহণ করতে হবে। জ্ঞানার্জনের পর আমাদেরকে সবচেয়ে বড় সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা ইসলামের অধিকাংশ সামষ্টিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের হুকুম বাস্তবায়নের পদ্ধতি।

এইভাবে একজন মুসলিম নিজেকে বিচার দিবসের জন্য প্রস্তুত করে যেখানে সে তার কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সামনে জিজ্ঞাসিত হবে। কারণ সে ব্যক্তি পর্যায়ের সকল বাধ্যবাধকতা পালন করেছে ও নিষিদ্ধ কর্মকান্ড থেকে বিরত থেকেছে। তিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা পালন করেছেন যা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনেক বাধ্যবাধকতা পালন না করার গোনাহ থেকে মুক্ত হয়েছেন। এ উপায়ে মুসলিমগন সব দিক দিয়ে সত্যকে ধারণ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ সে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যাতে করে তার ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতিনি এমন ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন যাতে সমাজের মধ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি অন্যকিছু যা এখন পর্যন্ত গ্রহন করা হয়নি তা হয়ত হবে সামষ্টিক বাধ্যবাধকতার খুবই সামান্য অংশ। এই ধরনের বাধ্যবাধকতার প্রকৃতি সামষ্টিক নয় (যেমন, হাঁচি দিলে কারও জন্য দোয়া করা বা কারও জানাযার নামাজ আদায় করা) বরং ব্যক্তিপর্যায়ের।

মারুফ ও মুনকারের জ্ঞান

মারুফের আদেশ ও মুনকারের নিষেধের জন্য এর জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যকীয়। জ্ঞান সবসময় বিধিনিষেধের আগে আসে। জ্ঞান ব্যতিরেকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সম্ভবপর নয়। সুতরাং একজন মুসলিমের জন্য শরী’য়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য?

এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, কাজের আগে কাজের ব্যাপারে জ্ঞান অগ্রগন্য। আবার কাজটিও শরী’য়া জ্ঞান অনুসারে হতে হবে। আর না হয় কাজ আল্লাহর ইবাদত হবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একজন মুসলিমকে মারুফাত পালনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং একারণে এ সর্ম্পকিত জ্ঞান থাকা বাঞ্ছণীয়। একইভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একজন মুসলিমকে মুনকারাত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং একারণে এ সর্ম্পকিত জ্ঞান থাকা বাঞ্ছণীয়।

সুতরাং উপাসনা, আনুগত্য ও পালনের জন্য জ্ঞানের অপরিহার্যতা অপরিসীম। নিছক জ্ঞানার্জনের জন্য জ্ঞানার্জন নয়, বরং আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য জ্ঞানার্জন জরুরী। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

বস্তূতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। (সূরা আন-নিসাঃ ৬৪)

আবদুল্লাহ বিন আল মুবারক (রঃ) এর মতে, ‘আমরা সাধারণত জ্ঞানার্জনের জন্যই জ্ঞান অন্বেষন করি। কিন্তু স্বয়ং জ্ঞানই আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নিমিত্তে হতে নারাজ। উপাসনা ও আনুগত্য কেবলমাত্র এ জন্যই। এ দুবিষয়ের জ্ঞান এর সর্বনিম্ন সীমার মাধ্যমে অর্জন করা যায়, যেমনঃ তাকলীদ এবং এর সর্বোচ্চ সীমা হল ইজতিহাদ। উভয়ই ভাল যখন তা পালিত হয় ও আনুগত্যের জন্য উপলদ্ধি করা যায়। যে ব্যক্তি সালাত আদায় করে, সে সালাতের রুকন ও শর্তসমূহ পালন করে এবং এ ইবাদতকে প্রতিষ্ঠিত করে সেভাবে যেভাবে করতে বলা হয়েছে। যাহোক বাস্তবতা হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজস্ব ইজতিহাদ এবং জ্ঞান অর্জনের পন্থায় ইবাদত করেনি সে জ্ঞানের উৎকর্ষতা থেকে সীমাবদ্ধ করবে - এই উৎকর্ষই হচ্ছে জ্ঞান যার মাধ্যমে আল্লাহ্ মুসলিমদের বিভিন্ন মাত্রায় উত্থান ঘটান। মুকাল্লীদ হিসেবে ইবাদত সম্পন্ন করার অর্থ হল সম্পন্নকারী ব্যক্তি মুত্তাকী ও শরী’য়াহর জ্ঞানসম্পন্ন যাকে মনে করবে তার কাছ থেকে হুকুম গ্রহণ করবে। অর্থাৎ তার ঐ ইসলামী চিন্তাবিদের প্রতি সন্দেহমুক্ত ধারণা থাকবে যে, তিনি সঠিক ও আল্লাহর আনুগত্যের অধিকতর নিকটবর্তী। একইভাবে একজন মুতাব্বী হিসেবে যিনি ইবাদত করেন তিনি দলিলসহ আরেকজনকে অনুসরণ করেন এবং একারণে তিনিও একজন মুকাল্লিদ। তবে তিনি একজন আম্মী অর্থাৎ দলিল ব্যতিরেকে তাকলীদকারীর চেয়ে উচুস্তরের মুকাল্লীদ। উভয়েই অন্যের কাছ থেকে হুকুমটি গ্রহণ করেছেন এবং আনুগত্য ও ইবাদতকে উপলদ্ধি করেছেন। মুজতাহিদের স্থান সর্বোচ্চ ও পদমর্যাদায় অগ্রগামী। তিনি নিজেই আল্লাহ প্রদত্ত বাণী ও শর’ঈ দলিল থেকে হুকুম বের করে নিয়ে আসেন।

আমলের সাথে জড়িত জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরযে আইন

মুকাল্লাফ (আইনগতভাবে দায়িত্বশীল ব্যক্তি) এর ক্ষেত্রে শরীয়া বিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের উপর তার জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করা ফরয। কারণ তাকে অবশ্যই আল্লাহ প্রদত্ত বিধিনিষেধ অনুযায়ী সব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু এটা কখনই তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত শরী’য়া জ্ঞান অর্জন ব্যতিরেকে সম্ভবপর নয়। সুতরাং মুসলমানের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শরীয়া জ্ঞান অর্জন করা ফরযে আইন এবং এটা কখনও সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা নয়। আর এর চেয়ে বেশী কিছুই হল মুস্তাহাব। যখন সে সালাত আদায় করবে তখন তাকে অবশ্যই সালাত আদায়ের পদ্ধতি জানতে হবে। যদি তার সম্পদ নিসাব অতিক্রম করে থাকে ও একবছর পূর্ণ হয় তাকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে। তাকে অবশ্যই জানতে হবে সম্পদের কত অংশ যাকাত হিসেবে দিতে হবে। সম্পদ স্বর্ণ বা রৌপ্য হলে তাকে অবশ্যই যাকাত দেয়ার পদ্ধতি ও গ্রহীতাদের সর্ম্পকে জানতে হবে। কিন্তু সে যদি ফল বা ফসলের যাকাতের ব্যাপারে কিছু না জানে তাহলে কোন সমস্যা নেই। তবে যদি সে এসব সর্ম্পকে জানে তাহলে সে নেক কাজ করল এবং এর জন্য পুরষ্কৃত হবে। সে যদি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ করে তাহলে তাকে শিখতে হবে এটা প্রতিষ্ঠার জন্য কী করতে হবে। সুতরাং সব বাধ্যবাধকতা পালনকারীর দায়িত্ববোধ ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত।

এভাবে একজন মুসলিম তার ঈমানের বিশুদ্ধতা এবং ইসলাম পালনের বাধ্যবাধকতা সর্ম্পকে নিশ্চিত হতে পারে।

যদি এ বাসনা কেবলমাত্র তার প্রভুর জন্য হয় ও সে সঠিক পথে নির্দেশিত হয় তাহলে সে অবশ্যই এমন একজন করুণাময় প্রভূকে পাবে যিনি আমলসমূহকে কবুল করবেন এবং ক্বিয়ামত দিবসে তাকে রক্ষা করবেন।

দ্বিতীয় দিকঃ সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ

আমরা ইতোমধ্যে বলেছি যে, ইসলাম সব মারুফ ও মুনকারকে আমাদের সামনে পরিষ্কার করেছে এবং একজন মুসলিমকে অবশ্যই সব মারুফ মেনে চলতে হবে এবং মুনকার থেকে বিরত থাকতে হবে। এখানে যে প্রশ্নটি খুব বেশী শোনা যায়,সেটি হল একজন মুসলিমকে সে যেসব মারুফ মেনে চলে তার আদেশ করবে, নাকি এর অধিকাংশ কিংবা কম? একই প্রশ্ন মুনকার থেকে নিষেধ করার ক্ষেত্রেও উত্থিত হয়।

এ ব্যাপারে কথা বলবার আগে আমাদের অবশ্যই এ বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, শরীয়া এগুলোকে কীভাবে অনুধাবন করতে বলে। শরী’য়াহ মনে করে এমন একটি ইসলামী সমাজ কায়েম হবে যেখানে এমন একটি ধারণাও গ্রহণ করা হবে না যা শরী’য়াহর ধারণার বিরুদ্ধে যাবে, একটি কর্মকান্ডও গৃহীত হবে না যা শরী’য়াহর সাথে সাংঘর্ষিক হবে। প্রত্যেক মুনকারকে প্রতিরোধ ও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে। এক কথায় হুকুম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত সব নির্দেশ বাস্তবায়িত হবে। যত মুনকার সংঘটিত হয়েছে এবং হতে পারে সবই প্রতিহত করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসলিমদের এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এ কাজটিকে অত্যন্ত মহিমান্বিত করেছেন ও এর জন্য বড় পুরষ্কার বরাদ্দ করেছেন। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তার বই ইয়াহইয়াউল উলুম উদ দ্বীন এ বলেনঃ আম্মা বা, অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজে নিষেধ করা হল দ্বীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ। এই মিশন দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রত্যেক নবী রাসূলকে প্রেরণ করেছেন। এ কাজ যখন বন্ধ হয়ে যায় বা অবহেলিত হয় তখন নবুয়্যত পরিত্যক্ত হয়, দ্বীন বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, দ্বীনহীনতার কার্যকাল বলবৎ হয়, পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা ব্যাপকতর হয়, দূর্নীতি বিস্তার লাভ করে, জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়।

যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিবেদিত

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবার পূর্বে আমরা জানার চেষ্টা করব শরী’য়াহর হুকুম সমূহ বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাদের উপর বর্তায়। উম্মাহর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি, দল ও শাসকবৃন্দ। প্রত্যেক অংশের উপরে রয়েছে শরী’য়াহ প্রদত্ত সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব। তারা যে বিষয়ে নিবেদিত সে বিষয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে তাদেরকে উপদেশ, জবাবদিহিতা এবং সংশোধনের আওতায় আনতে হবে। যদি এ বিষয়টি বুঝবার বাস্তবতা আমাদের কাছে পরিষ্কার না হয় তাহলে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ফরয দায়িত্ব পালনে জটিলতার সৃষ্টি হবে। একারণে আমরা নীচের কথাগুলো বলতে পারি।

শরী’য়াহর কিছু কিছু দায়িত্ব কেবলমাত্র খলিফার উপরে বর্তায় - এছাড়া অন্য কারও উপর নয়। আরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে যা ব্যক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট এবং ব্যক্তি পালনে অপারগ হলে খলিফা সেগুলো পালন করবে। আবার খলিফার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব রয়েছে যা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি সেগুলো পালন করতে পারে। দলের জন্য রয়েছে কিছু নিয়মনীতি।

ব্যক্তির উপর অর্পিত দায়িত্ব সমূহের মধ্যে রয়েছেঃ নামাজ পড়া, সাওম পালন করা, হজ্জ পালন করা, যাকাত প্রদান করা এবং নিষিদ্ধ জিনিষ থেকে বিরত থাকা, যেমনঃ মদ্যপান করা, জুয়া খেলা, সুদ, চুরি, হত্যা, ব্যভিচার, ধর্মত্যাগ, মিথ্যাপ্রতারণা, গীবত করা ইত্যাদি। মুসলিমগন দারুল কুফর ও দারুল ইসলাম বা ইসলামী এবং কাফের রাষ্ট্র যেখানেই বসবাস করুক না কেন তাদের এগুলো মানতেই হবে। এক্ষেত্রে একজন মুসলিম কেবলমাত্র মক্কা বা কেবলমাত্র মদীনাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তার সাহাবীগন কী কাজ করেছে সে ব্যাপারে চিন্তা করবে না। ইবাদত (উপাসনা), মুয়ামালাত (লেনদেন), মাতুমাত (খাদ্যদ্রব্য), মালবুসাত (পোষাকপরিচ্ছদ), আখলাক (চরিত্র) এবং অন্যান্য ইসলামী বিশ্বাসসমূহ -এ সব সর্ম্পকিত শরী’য়াহ নীতিমালা ব্যক্তিপর্যায়ের। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পরিবার সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করা হবে -যেখানে তিনি একজন ওয়ালী (অভিভাবক)। দারুল কুফরের শাসক যদি কোন মুসলিমকে তার ব্যক্তি পর্যায়ের শরী’য়াহ হুকুম পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তাহলে রায় হচ্ছে তাকে অবশ্যই অন্য কোন দারুল কুফর বা দারুল ইসলামে হিজরত করতে হবে। এ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

যারা নিজের অনিষ্ট করে, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান। কিন্তু পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা অসহায়, তারা কোন উপায় করতে পারে না এবং পথও জানে না। (সূরা আন-নিসাঃ ৯৭-৯৮)

একজন ব্যক্তির জন্য দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে হিজরত করা মুস্তাহাব হবে যদিও বা সে শরী’য়াহ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় অন্যথায় সে দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে পরিণত করবার জন্য সেখানে থাকবে। এটা সর্বজনবিদিত যেদারুল ইসলাম হল সে রাষ্ট্র যা ইসলাম দিয়ে শাসিত হয় ও এর নিরাপত্তা মুসলিমদের দ্বারা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

ব্যক্তির উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে খলিফা সে দায়িত্ব পালন করবে এমন দায়িত্বের উদাহরণ হলঃ একজনের ভরণপোষণ ও দেখভালের দায়িত্ব যখন অপর আরেকজন ব্যক্তির উপর অর্পিত হয় এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি অপারগ হন তখন খলিফা সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিংবা অধিবাসীরা অপারগ হলে গ্রামে মসজিদ নির্মাণ করা বা শহরে বসতি গড়ে দেয়া....ইত্যাদি।

কিছু দায়িত্ব রয়েছে যা কেবলমাত্র আমীর বা খলিফার উপর বর্তায় এবং এর জন্য ব্যক্তি কোনভাবেই দায়িত্বশীল নয়। এগুলো হল হুদুদ বাস্তবায়ন করা, জিহাদ ঘোষণা করা, চুক্তি সম্পাদন করা বা আইন গ্রহণ করা এবং অন্যান্য বাধ্যতামূলক কাজসমূহ সম্পাদন করা। উল্লেখিত শরী’য়াহ কর্তব্যসমূহ ও আর কিছু বিষয়ে শাসকগন দায়িত্বশীল।

খলিফার উপর অর্পিত কিছু দায়িত্ব ব্যক্তিও পালন করতে পারেন; তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমনঃ জিহাদ। যদি কাফেরদের দ্বারা মুসলিমগন অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়, তখন খলিফার অনুমতির অপেক্ষা না করে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া মুসলিমদের জন্য ফরয। এমনও হতে পারে সেসময় তাদের কোন খলিফা নেই। শাসক যদি ফাযীরও হন এবং লোকবল সংখ্যায় কম থাকে তারপরেও জিহাদে অংশগ্রহণ করতে হবে। যা হোক মূলকথা হল, মুসলিমরা সর্বশেষ এ বিষয়টি মেনে নেবার সুযোগ নেই, অর্থাৎ খিলাফত থাকবে না এবং তারা ফাযীর নেতার অধীনে  থাকবে

দলের উপর অর্পিত শরী’য়াহ দায়িত্ব হল খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, শাসকদের জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসা,তাদের সত্যবিমুখতা থেকে ফিরিয়ে হক্বের পথে নিয়ে আসা ইত্যাদি। কোন ইসলামী দল, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর কর্তব্য এর আওতায় পড়ে।

কাকে কী ধরনের শরী’য়াহ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তা পরিষ্কার করা জরুরী। কেননা এ জ্ঞান সর্ম্পকে অজ্ঞতা ও অবহেলা ব্যক্তি বা একটি আন্দোলনকে শরী’য়াহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে প্ররোচিত করতে পারে। এভাবে মুসলিমগন সঠিক দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও এর কার্যকর প্রয়োগের ব্যাপারে বিভ্রান্ত হতে পারে। ফলস্বরুপ, মুসলিমরা দায়িত্বের বাধ্যবাধকতাকে অবহেলা করবে এবং মানদুবাত (অনুমোদনযোগ্য কর্মগুলো) নিজের মত করে করবে। কর্তব্যের বিভিন্ন ভাগসমূহ সর্ম্পকে না জানবার কারণে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ও দলের সদস্য হিসেবে অর্পিত শরী’য়াহ দায়িত্বের বদলে দলটি ব্যক্তিপর্যায়ের দায়িত্ব নিয়ে অধিকতর সচেতন হবে। ইসলামী পন্ডিতগন তখন লোকদের সাথে ব্যক্তিপর্যায়ের শরী’য়াহ দায়িত্ব নিয়েই বেশী আলোচনা করবে, যেমনঃ সালাত, যাকাত, রোজা অথবা গীবত থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে তারা আলোচনা করবে না, যেমনঃ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তিনি একজন ধার্মিক বা ভৎসনাকারী ব্যক্তি হতে পারেন। তবে তিনি এমন কোন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ইসলামী পন্ডিত হবে না যিনি উম্মাহের সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন এবং এ ব্যাপারে সমাধানে উপনীত হয়েছেন ও এর জন্য কাজে নেমে পড়েছেন।

প্রত্যেক ভাগের জন্য নির্ধারিত শরী’য়াহ দায়িত্ব অবশ্যই পালিত হতে হবে। দায়িত্বে অবহেলা দেখা দিলে অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ দিতে হবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে। যে দায়িত্ব কাউকে দেয়া হয়নি তার জন্য সে জবাবদিহীতার সম্মুখীনও হবে না। সে কারণে শরী’য়াহর বাস্তবায়নও কেবলমাত্র একটি অংশের উপর বর্তায় না। পুরো উম্মাহকে পূর্ণাঙ্গ শরী’য়াহ বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি ব্যক্তিপর্যায়ের, দল সামষ্টিক ও খলিফা তার উপর অর্পিত শরী’য়াহ দায়িত্ব যখন সুসম্পন্ন করবে তখন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে।

এখানে আমরা একটি বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই যে, প্রত্যেকটি মুসলিমকে পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীনভাবে ইসলামের উপর আস্থা স্থাপন করতে হবে। তবে সে তার প্রয়োজন অনুসারে প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিতভাবে গ্রহণ করবে। ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুসারে এবং দলের সদস্যগন তার কাজের জন্য সামষ্টিকভাবে। এ দায়িত্বসমূহের কোনটির ব্যাপারে তার অবহেলার জন্য সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে জবাবদিহি করবে। তাকে ব্যক্তিগতভাবে শরী’য়াহ দায়িত্ব পালন করতে হবে। একই কথা খলিফার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ তিনি নিজে সালাত আদায় করেন, সাওম ও হজ্জ পালন করেন, পিতামাতার দেখভাল করেন এবং সুদ ও যিনা থেকে নিবৃত থাকেন। শরী’য়াহ খলিফা হিসেবে তার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তাও তিনি পালন করেন। অর্থাৎ তিনি আইন পাশ করবেন, জিহাদের ঘোষণা দেবেন, মুসলিমদের ভূমি রক্ষা করবেন, আল্লাহর কালাম দিয়ে শাসন করবেন ও হুদুদ বাস্তবায়ন করবেন। এ ব্যাপারে যে কোন অবহেলার জন্য তিনি আখেরাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে জবাবদিহীতার সম্মুখীন হবেন এবং দুনিয়াতে উম্মাহ তাকে জবাবদিহি করবে।

এই বাস্তবতা মুসলিমদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে কখন মুহাসাবা (জবাবদিহিতা) করতে হয়। এতে করে ব্যক্তি, দল ও খলিফা এমন কোন কিছুর জন্য জবাবদিহিতা সম্মুখীন হবে না যা তার জন্য নয়।

শরী’য়াহ প্রত্যেক মুসলিমকে তার সক্ষমতা ও জ্ঞান অনুসারে সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধের ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেছে। মুসলিমকে ব্যক্তি, দল ও শাসক হিসেবে এসব শরী’য়াহ বাধ্যবাধকতা যে কোন পরিস্থিতিতে সম্পন্ন করবার জন্য শরী’য়াহ নির্দেশ প্রদান করেছে। তখন ইসলামী রাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক, শাসক ইসলাম দিয়ে অথবা কুফর দিয়ে শাসন করুন না কেন কিংবা শাসকগন ইসলামিক আইনের সঠিক প্রয়োগ করুক বা অপপ্রয়োগ করুক না কেন। সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ রাসূলুল্লাহ (সাঃ), সাহাবীগন, তাবেয়ীন ও তাদের অনুসারীদের সময়ে বলবৎ ছিল। ক্বিয়ামতের আগ পর্যন্ত এটা বলবৎ থাকবে।

নিম্নোক্ত ব্যাখ্যানুযায়ী যদি রাষ্ট্রে, ব্যক্তি, দলে এমন কিছু ঘটে যেখানে সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নির্দেশ দেবার বাধ্যবাধকতা দেখা দেয় তবে রাষ্ট্রকে, ব্যক্তিকে এবং দলকে অবশ্যই তা সম্পন্ন করতে হবে।

ব্যক্তি পর্যায়ে, মুসলিমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সব হুকুমগুলোর আদেশ করার এবং নিষেধাজ্ঞাসমূহ নিষেধ করার - যদি তাদের সামনে এমন কিছু ঘটে যা এ প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে - বিষয়টি নিজেদের জ্ঞানানুযায়ী করবে। ফলে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রদান ফরযে আইন হয়ে যায় এবং না পালন করলে সে গোনাহগার হবে এবং এর জন্য কোন অজুহাত দাঁড় করাতে পারবে না। সেকারণে একজন মুসলিমকে তার প্রতিদিনকার জীবনে নিজের স্ত্রী, সন্তান,ত্নীয়স্বজন, প্রতিবেশী, খরিদ্দার, পরিচিত ব্যক্তি কিংবা যার সাথেই সাক্ষাৎ হোক না কেন প্রত্যেককেই নসীহা বা সদুপদেশ দিতে হবে যদি সে কোন শরী’য়াহগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় বা যথার্থভাবে আনুগত্যশীল না হয়। এরূপ না হলে কী উপায় আছে, যেহেতু এমন হতে পারে যে কোন একটি পাপকার্য সংঘটিত হবার বিষয়ে হয়তো সে-ই কেবল জানে। যেমনঃ এই রকম পরিস্থিতি হতে পারে যখন অপরাধ সংঘটনের সময় সে ও অপরাধী ব্যক্তি ব্যতীত ঐ স্থানে আর কেউ ছিলনা। যদি সে মুসলিম দর্শক ঐ অপরাধীকে সে সময় সদুপদেশ প্রদান না করে, তাহলে সে অপরাধী হবে। কিন্তু এর জন্য অন্য কেউ পাপী হবে না, কারণ সে সময় তারা অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না ও এ ব্যাপারে তারা জ্ঞাতও ছিলেন না। ঐ দর্শকের পরিমন্ডলে যত অপরাধ বা মুনকার সংঘটিত হবে, এর কোনটির জন্য তিনি ব্যতিরেকে আরও কেউ গোনাহগার হবেন না।

যখন একজন মুসলিম তার নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট আল্লাহ নির্দেশিত হুকুমসমূহ মেনে চলবে অর্থাৎ তার সাথে সম্পৃক্ত সৎ কাজ বা মারুফ সম্পন্ন করবে ও মুনকার বা অসৎ কাজ বর্জন করবে, তখন সে অন্যদেরকে সে হুকুমসমূহ সর্ম্পকে জানাতে পারবে। যদি তিনি এসব হুকুম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে গ্রহণ করেন তাহলে তিনি সেভাবে অন্যদের কাছে বহন করতে পারবেন। তিনি যদি একজন মুতাব্বী (যিনি দলিলসহ মতামত প্রদান করেন) হিসেবে এসব গ্রহণ করেন, তখন তিনি সেরকম উচ্চমানসহকারে তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিবেন। আবার তিনি যদি ত্বাকলীদ বা অনুকরণ করে আম্মি (সাধারন ব্যক্তি) হিসেবে হুকুম গ্রহণ করেন তাহলে আম্মি (সাধারন ব্যক্তি) এর মতই তা বহন করবেন। যদি কোন ব্যক্তি অন্যদের বুঝানোর ব্যাপারে অপারগ ভাবেন তাহলে তাকে এমন কোন ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হবে যার বুঝানোর সক্ষমতা রয়েছে যেমনঃ কোন ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফতী বা এমন কোন দাওয়াত বহনকারী যার এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও উপলদ্ধি রয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার আদেশ দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে। (সূরা আত তাওবাহঃ ৭১)

এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরও বলেনঃ

সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। (সূরা আল মায়িদাহঃ ৫)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ পৌছে দাও যদিও বা তা একটি আয়াত হয়। (আল বুখারী)

তিনি (সাঃ) আরও বলেনঃ আল্লাহ তার সে বান্দার মুখকে উজ্জল করুন, যিনি আমার কথা শুনেছেন, উপলদ্ধি করেছেন এবং এমনভাবে পৌছে দিয়েছেন যে রকম আমি বলেছি। হয়ত যিনি বহন করছেন তিনি একজন ফকীহ নাও হতে পারেন, কিন্তু যার কাছে বহন করা হচ্ছে তিনি বহনকারীর চেয়ে বুঝার ক্ষেত্রে শ্রেয়তর হতে পারেন। (আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ)

এভাবে একজন ব্যক্তি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন অর্থাৎ নিজে মারুফ সম্পন্ন করবেন ও মুনকার থেকে বিরত থাকবেন ও অন্যকে এ বিষয়ে উপদেশ প্রদান করবেন।

জ্ঞানের অপরিহার্যতা

এখানে এটা সবার কাছে স্পষ্ট যে, জ্ঞান এবং সমসাময়িক মারুফ ও মুনকার সর্ম্পকে ওলামাদের পরিষ্কার ধারণা প্রদানলোকদের মারুফ সম্পাদন ও মুনকার বর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

আলেমগন হল সে ব্যক্তিবর্গ যারা অন্যদের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করেতাদের ব্যক্তিগত ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানার্জন করা তাদের জন্য ফরয। এর অতিরিক্ত হিসেবে উম্মাহর উপর অর্পিত বাধ্যবাধকতা সর্ম্পকেও তারা জ্ঞান লাভ করে। সুতরাং জ্ঞানার্জন একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা এবং উলামাগন উম্মাহর পক্ষ থেকে তা সম্পাদন করেন ও এর জন্য তারা যথার্থ পুরষ্কার অর্জন করবেন। এই জ্ঞানার্জন করবার পরও তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে মাহরুম হতে পারবেন না। অন্যদের মত তাদেরও ব্যক্তি পর্যায়ের ইবাদতসমূহ সম্পাদন করতে হবে। এ দায়িত্বের একটি হল খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। যদি কেউ উত্তরাধিকার আইনের উপরে একজন বিশেষজ্ঞ হন বা একজন তাফসীরকারক হন অথবা তালাক বা বিয়ের উপর শরঈ নীতিমালার উপরে একজন বিচারক হওয়া সত্ত্বেও তার উপর অর্পিত শরঈ ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও পুরো উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট সামষ্টিক দায়িত্ব থেকে পরিত্রাণ পাবেন না। কারণ আলেমগন এ উম্মাহর অংশ এবং তাদের কাছে কোন কিছু পৌছার অর্থ হল তা পুরো উম্মাহর কাছে পৌছে যাওয়া। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে আজকে আমরা লক্ষ্য করছি যে, আলেমগন শরঈ এ দায়িত্ব (খিলাফত প্রতিষ্ঠা) পালনে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এর জন্য তারা অবশ্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এবং উম্মাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবেন।

জ্ঞান হল আনুগত্য ও উপাসনার জন্য। জ্ঞান হল এমন জিনিস যা মানুষকে ত্বাকওয়া বা আল্লাহভীতির দিকে পরিচালিত করে।

আল্লাহ বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। (সূরা ফাতিরঃ ২৮)

ইতিহাসে উলামাদের আমরা সবকিছুর আগে খুঁজে পাই - হোক সেটা সালাত, জিহাদ, দাওয়াত পরিবহন, শাসকদের জবাবদিহী করা, কুফর ও স্রষ্টাবিহীন চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে। লোকদের সঠিক চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ করা ও সে অনুযায়ী কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে আমরা তাদের অগ্রদূত হিসেবে দেখতে পাই।

এটা কারও ভাবা ঠিক হবে না যে, ইসলামে উলামাদের আনুষ্ঠানিক কোন অবস্থান আছে - যা ধর্মীয় পদবি বা অন্য কোন স্বতন্ত্র পদবি। অথবা তাদের জ্ঞানের কারণে লোকদের নির্দেশ দেয় এবং তারা তা মেনে নেয়বরং তারা অন্য সাধারণ মুসলিমদের মতই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বর্ণণায় তারা এমনভাবে এসেছেন যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগন অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলেন।

শরী’য়াহ উলামা ও জ্ঞানের বাধ্যবাধকতা সত্য উপলদ্ধি ও পালনের নিমিত্তে সুনিশ্চিত করেছে। শরী’য়াহর জন্য তারা হলেন মাধ্যম। তাদের মাধ্যমে মুসলিম তার উপর প্রভূর অধিকার সম্বন্ধে অবগত হয়। তাদের উপস্থিতি হল একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। যদি তাদের উপস্থিতি না থাকে তাহলে পুরো উম্মাহ গুনাহগার হবে। কারণ এ অবস্থায় পুরো উম্মাহ জাহেলিয়াতের মধ্যে পতিত হবে। ফলে ইজতিহাদ হল একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। সুতরাং এরকম একটি সময় কোনক্রমেই থাকা উচিত নয় যখন কোন মুজতাহিদ নেই। আর না হয় পুরো উম্মাহ গোনাহগার হবে।

আগ্রহের দিক থেকে উম্মাহর স্বাভাবিক প্রবণতা হল উলামাদের মতামতকে গ্রহণ করা বা গুরুত্ব প্রদান করা। একারণে উলামাদের কোন ধরনের প্রলোভনে সাড়া দেয়া ঠিক হবে না - পদ বা অবস্থান চাওয়া, সঠিক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কোন বিষয়ে ফতওয়া প্রদান করা, নফসের বশবর্তী হয়ে বা শাসককে সন্তুষ্ট করবার জন্য শরী’য়াহকে অসত্যভাবে উপস্থাপন করা সমীচীন নয়। যেহেতু শরী’য়াহর জ্ঞান হল মারুফ, সেহেতু এক্ষেত্রে মুনকার হল রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা), নেতৃত্বের মনোবাঞ্ছা এবং সস্তা সুবিধা খোজা। সেকারণে আজকের দিনে শাসকের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য উলামাদের ক্রীড়ানক হিসেবে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি পূরণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। একারণে এদের জন্য টাকা ছিটানো হয়, সম্মানিত ইসলামিক পন্ডিত হিসেবে পদবী দেয়া হয়। তখন তারা লোকদের জন্য নজীর বা বিশিষ্ট মুফতী হয়ে যান - যাদের কাছে লোকেরা বিভিন্ন বিষয়ের সমাধানের জন্য আসেন। সেকারণে তারা এমন ফতওয়া প্রদান করে যাতে শাসক সন্তুষ্ট হয় এবং আল্লাহর ক্রোধের উদ্রেক করে। শরী’য়াহকে তারা শাসকের আওতাধীন ও ইচ্ছাধীন করে দেয়। সেকারণে যদি দেখা যায় শাসকগন সুদকে জায়েয ঘোষণা করে, উলামাগনও এটাকে জায়েয বলে এবং এর জন্য বাণীকে বিকৃত করবার প্রয়োজন হলে তাই করে ও যেরকম চায় সেরকমভাবে দলিলাদি উপস্থাপন করে। যদি শাসকগন কোন কারণে কাফির রাষ্ট্রের সহায়তা চায় তাহলে উলামাগন তাতেও সায় দেয়। যদি শাসকগন ইহুদীদের সাথে শান্তি চায় তারা সেটাতেও সম্মতি প্রদান করে। তারা হল আজ্ঞাবহ ইসলামী পন্ডিত -যাদের সাবধান করতে হবে। উম্মাহকে তাদের কর্মকান্ডসমূহ দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখান করতে হবে এবং শরী’য়াহকে বিকিয়ে দিয়ে তাদের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখা যাবে না। এই ধরনের লোক যারা নিকৃষ্ট শাসকদের প্রতি সহায়তার হস্ত প্রসারিত করে, তাদের সর্ম্পকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমার উম্মাহর ব্যাপারে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হল মুনাফেক আলেম ব্যক্তি। (মুসনাদে আহমাদ)

এসব লোকদের প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করতে হবে যাতে অন্যরা তাদের মিথ্যে ফতওয়ার স্বীকার না হয়। এরা তারাই যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে ক্রয় করে নিয়েছে।

যখন মুসলিম সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও পালন এবং মুনকার পরিত্যাগের আদেশ প্রদান ও বিরত থাকার মাধ্যমে এইসব কার্যাবলী সম্পাদন করে তখন তার ব্যক্তিগত জীবন ভাল হয়। তখন একজন মুসলিম নিজস্ব কলেবরে যেমনি আনুগত্যশীল হয় তেমনি অন্যদেরও এ ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করে, একইভাবে সে যখন তার ব্যবসা ও আশেপাশের লোকদের সাথে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল আচরণ করে তখন দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা আগেও বলেছি,দ্বীনের প্রধান লক্ষ্য হল আনুগত্য প্রকাশ করা, সৎ কাজ ও মুনকার বর্জন ও সমাজের কোন দিক যাতে আল্লাহর হুকুম ব্যতিরেকে না চলে -হোক সেটা ব্যক্তি বা সামষ্টিক পর্যায়ের। সমাজ কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তির সমষ্টি নয়, বরং এই ব্যক্তিবর্গ একত্রিত হয়েছে কিছু বিশ্বাসের ভিত্তিতে যা থেকে জীবনের সবক্ষেত্রের জন্য একটি ব্যবস্থা উদ্ভুত হয়। যদি ব্যক্তিগত দিকটি অর্জিত হয় তাহলে কেবলমাত্র একটি দিক অর্জিত হয়। কিন্তু তারপরেও আরও অনেক দিক রয়ে যায় যে ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শরণাপন্ন হতে হয়। এসব ব্যক্তিকে খলীফার দ্বারা শাসিত হতে হবে যিনি বাস্তবতায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। খলিফা তলোয়ারের দ্বারা এ বাস্তবতা প্রতিস্থাপন করবেন যখন মুসলিমরা এই বাস্তবতায় আল্লাহর ভয়ে স্বেচ্ছায় আওতায় আসবে না। আল্লাহ অবশ্যই শাসক দ্বারা সংযত রাখবেন যা কোরআন দ্বারা সংযত রাখা সম্ভব হয়নি।শরী’য়াহ ইসলামী বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইসলামী রাষ্ট্রকে এর পদ্ধতি হিসেবে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ বিষয়টি শরী’য়াহ স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতিও উল্লেখ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রকে এই বিশ্বাস সংরক্ষণ, প্রসার ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেমনঃ জিহাদ যা ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়ার ব্যাপারে ইসলাম রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়েছে এবং জিহাদের মাধ্যমে দাওয়াত করতে নির্দেশ দিয়েছে। কত সুন্দরই না লাগে যখন ইমাম গাজ্জালী (রঃ) বলেনঃ অবশ্যই কুর'আন এবং সুলতান জমজের মত। কুর'আন হল ভিত্তি, সুলতান হল এর রক্ষক। যার কোন ভিত্তি নেই, তা খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়; আর যার কোন রক্ষক নেই তা দ্রুত হারিয়ে যায়।

শাসকদের জবাবদিহী করা

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কর্তৃক প্রদত্ত ও ব্যাখ্যাকৃত শরী’য়াহ কেবলমাত্র কিছু চিন্তার সমষ্টি নয়, বরং আইনপ্রণেতা এসবকে বাস্তবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। সেকারণে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বাস্তব হুকুমসমূহ উপস্থাপন করেছেন যাতে এগুলো বাস্তবে অস্তিত্বশীল হয় এবং যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা যাতে বর্জিত হয় ও এসবের বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বাতলে দিয়েছেন। শরী’য়াহকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা শাসকদের জন্য আইন দিয়েছেন ও তাকে নির্দেশ এবং বিধিনিষেধ দিয়েছেন যাতে সে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে ও এর রক্ষক হয়। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) উম্মাহকে শাসকের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাকে অবহেলার ক্ষেত্রে জবাবদিহী করতে বলেছেন। ব্যক্তি ও দল উভয়ক্ষেত্রে উম্মাহর কাছ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এটা দাবী করেছেন। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ

শহীদদের সর্দার হামযা এবং ঐ ব্যক্তিও, সে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে উপদেশ দেওয়ার পর (ঐ শাসক) তাকে হত্যা করে ফেলে। (হাকিম)

তিনি (সাঃ) আরও বলেনঃ

অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ। (তিরমিযী)

তিনি (সাঃ) আরও বলেনঃ

আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজে নিষেধ প্রদান করতে হবে এবং অত্যাচারী শাসকের হস্তদ্বয় চেপে ধরতে হবে এবং সত্যের ব্যাপারে তাকে বাধ্য ও এর মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। (আবু দাউদ ও তিরমিযী)

সত্যের ব্যাপারে শাসককে বাধ্য ও সত্যের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা শক্তি ও ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ কাজ কোন ব্যক্তি করতে পারবে না এবং এর জন্য অবশ্যই একটি দল প্রয়োজন।

সাহাবা এবং ইসলামী ফকীহগন একথা নিশ্চিতভাবে জানতেন যে, এ কাজের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র হল পূর্বশর্ত। এ রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল হলে হুকুমসমূহ বাস্তবায়িত হয়, অন্যথায় সেগুলো হয় না। যখন আবুবকর (রাঃ) কে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সর্ম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কীভাবে এটি অব্যাহত থাকবে?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বললেনঃ যতক্ষণ পর্যন্ত ইমামগন সঠিক পথে থাকবে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া আল ফাদিল হতে ইয়াদ এবং আহমাদ বিন হাম্বল থেকে বরাত দিয়ে বলেনঃ যদি এমন কোন দোয়া থাকে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা গ্রহণ করবেন, তিনি তা রেখেছেন সুলতান বা শাসকদের জন্য।

ইসলাম সবার জন্য একটি জীবনব্যবস্থা। এর মধ্যে গোটা মানবজাতির জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর বিশ্বাসসমূহ সার্বজনীন এবং এর ব্যবস্থাপনাও। বিশ্বের দরবারে বহন করবার জন্য এর রয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা দ্বারা ইসলাম বাস্তবায়ন ও দাওয়াতী কাজ করবার একটি পদ্ধতি। এ থেকে বুঝা যায় ইসলামিক রাষ্ট্র এর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য কতটা অপরিহার্য। সুতরাং এর কাজ কী? কে রাষ্ট্রের কার্য সম্পাদন করবে যদি তা অস্তিত্বশীল না হয়? কে তাকে সঠিক পথের দিশা দেখাবে যদি তা পথভ্রষ্ট হয়?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কর্তৃক রাষ্ট্রের উপর অর্পিত দায়িত্ব হল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। সুতরাং রাষ্ট্রের কাজ হল দ্বীন বাস্তবায়ন করা হোক তা ব্যক্তিপর্যায়ের বা সামষ্টিক নিয়মনীতি অথবা ব্যক্তিপর্যায়ের বা সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য এটি দায়িত্বশীল, অর্থাৎ বাস্তবে মারুফ সম্পাদন ও মুনকার অপসারণ করা। যেমনঃ যদি কোন মুসলিম সালাত আদায় না করে তাহলে রাষ্ট্র তাকে তা করতে নির্দেশ প্রদান করবে; অন্যথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একইভাবে সে যদি যাকাত প্রদান না করে, হজ্জ পালন না করে বা সাওম পালন না করে অথবা এজাতীয় ব্যক্তিপর্যায়ের বাধ্যবাধকতা পরিত্যাগ করলে রাষ্ট্র এগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করবার দায়িত্ব নেবে এবং নিয়মভঙ্গকারীকে জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসবে। একই কথা সামষ্টিক বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি রাষ্ট্র উম্মাহর জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় অধিকার সমূহ প্রদান না করে, যেমনঃ চিকিৎসা, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং অন্যান্য-যেগুলোর জন্য ব্যবস্থাপনা, সমন্বয় ও বন্টন জরুরী সেগুলোর ব্যাপারে তিনি জবাবদিহীতার মুখোমুখি হবেন। একই কথা যেসব বাধ্যবাধকতা জনগনের মধ্যে বিস্তৃত থাকে যেমনঃ জিহাদ এবং ইজতিহাদ এবং যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা খলিফাকে দায়িত্ব ও নির্দেশ প্রদান করেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আইনপ্রণেতা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছেন। প্রকাশ্য কুফর প্রদর্শন ব্যতিরেকে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মুসলমানদের জন্য স্রষ্টা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

ইসলামিক রাষ্ট্রে মৌলিক বিষয় হচ্ছে শরী’য়াহ আইনের ব্যাপারে শাসক হলেন অভিভাবকতুল্য। শরী’য়াহ অনুসারে তিনি হলেন ব্যক্তি বা সামষ্টিক পর্যায়ের যে কোন মুনকারাত প্রতিহত করবার জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তি। একারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ ইমাম হলেন রাখাল এবং তিনি তার জনগনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। (মুত্তাফিকুন আলাইহি)

ব্যক্তি বা সামষ্টিক পর্যায়ে আল্লাহ প্রদত্ত সব নির্দেশনার ব্যাপারে লোকদের বাধ্য করবার ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ শাসকদের দায়বদ্ধ করেছেন। যদি কোন কাজ করবার জন্য বলপ্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে তাহলে খলিফার অধিকার রয়েছে তা করবার। একইভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন লোকদের হারাম করা থেকে নিবৃত্ত করবার জন্য। আর এই নিবৃত্ত করবার জন্য যদি বলপ্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে তাহলে তাকে তাই করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র মুনকারকে বলপূর্বক বা হাত দিয়ে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করে। এর কারণ হল শরী’য়াহ অনুসারে, রাষ্ট্র ইসলাম বাস্তবায়ন এবং লোকদের ইসলামী আইন কানুন মানতে বাধ্য করবার ব্যাপারে দায়িত্বশীল।

যদি শাসকগন কোন মুনকার করে, যেমনঃ অবিচার করা, অন্যের সম্পদ অসুদপায়ে জবরদখল করা, জনগনের অধিকার ভূলুন্ঠিত করা, নাগরিকদের অধিকার অবহেলা করা, কোন ফরয সম্পাদনের ব্যর্থ হওয়া, ইসলামের কোন আইনের সাথে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়া কিংবা এ জাতীয় কোন মুনকার তখন সব মুসলিমের উপর ফরয হয়ে যায় তাকে জবাবদিহী করা ও তার মুনকারগুলোকে প্রত্যাখান করা, ব্যক্তি বা দল হিসেবে তার কাজের পরিবর্তনের জন্য কাজ করা। অন্যথায় তারা নীরবতা পালন করলে এবং মুনকার পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে সবাই গোনাহগার হবে।

যখন শাসক কোন মুনকার করে তখন সেই মুনকারে বাধা প্রদান করা বা তা পরিবর্তন করার উপায় হচ্ছে কথার মাধ্যমে তাকে জবাবদিহী করা। উম্মে সালামা থেকে মুসলিম বর্ণণা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ

তোমাদের উপর যারা আমীর নিযুক্ত হবে তারা ভাল কাজ করতে পারে আবার মন্দ কাজও করতে পারে। যারা তাদের মন্দ কাজকে ঘৃণা করবে তারা দায়মুক্ত হবে, যারা সেগুলোকে প্রত্যাখান করবে তারাও নিরাপদ; কিন্তু যারা সেগুলো গ্রহণ করবে বা অনুসরণ করবে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে ইবনে মাসউদও অনুরূপ বর্ণণা করেনঃ

আল্লাহর কসম, তোমাদেরকে অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে এবং অত্যাচারী শাসকদের হাত চেপে ধরতে হবে ও সত্যের পথে ফিরে আনবার জন্য তাকে জোর করতে হবে ও সত্যের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

অন্য একটি বর্ণণায় এ ব্যাপারে বলা হয়ঃ

অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের মধ্য হতে কিছু লোক দ্বারা অন্যদের হৃদয়ে আঘাত করবেন। তারপর তিনি তোমাদের অভিসম্পাত করবেন যেমনি তিনি তাদের করেন। (আবু দাউদ)

একইভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলাকে সর্বোত্তম জিহাদ বলেছেন। যখন একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ

কোন জিহাদ সর্বোত্তম?’ প্রত্যুত্তরে তিনি (সাঃ) বললেন, ‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ। (ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী)

একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যেশাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ কর্তৃক প্রমাণিত প্রকাশ্য কুফর করছে, যে কুফরের ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অর্থাৎ তিনি যখন কুফর দিয়ে শাসন করবেন এবং আল্লাহর হুকুমকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখান করবেন। আউফ বিন মালিক আল আশযায়ী বর্ণণা করেন যেরাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

ইমামদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে তারা যাদের তোমরা ভালবাস এবং যারা তোমাদের ভালবাসেনযাদের জন্য তোমরা প্রার্থনা কর ও যারা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করে। অন্যদিকে ইমামদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট হচ্ছে তারাই যারা তোমাদের অপছন্দ করে ও তোমরা যাদের অপছন্দ কর এবং তোমরা তাদের অভিশাপ দাও ও তারাও তোমাদের অভিশাপ দেয়।’ আমরা জিজ্ঞেস করলামঃ ‘ও রাসূলুল্লাহ! আমাদের কী তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা উচিত হবে না?’ তিনি (সাঃ) বলেনঃ ‘নাততক্ষণ পর্যন্ত নয় যতক্ষণ তারা সালাত কায়েম রাখে। (মুসলিম)

সালাত কায়েম রাখার মানে হচ্ছে এখানে ইসলাম দিয়ে শাসন করা বা শরীয়াহকে বাস্তবায়ন করা; এখানে অংশবিশেষের উল্লেখের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিষয়কে (বাব তাসমিয়াত আলকুল্ল বিসমিল জুযা) বর্ণনা করা হয়েছে। উম্মে সালামাহ হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

তোমাদের উপর যারা আমীর নিযুক্ত হবে তারা ভাল কাজ করতে পারে আবার মন্দ কাজও করতে পারে। যারা তাদের মন্দ কাজকে ঘৃণা করবে তারা দায়মুক্ত হবেযারা সেগুলোকে প্রত্যাখান করবে তারাও নিরাপদকিন্তু যারা সেগুলো গ্রহণ করবে বা অনুসরণ করবে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তারা বললঃ আমরা কী তাদের সাথে যুদ্ধ করবনা?’ তিনি (সাঃ) বলেনঃ ‘নাততক্ষণ পর্যন্ত নয় যতক্ষণ তারা সালাত কায়েম রাখে। (মুসলিম)

উবাদা বিন আস সামিত বর্ণণা করেনঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বায়াত দেয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন যাতে এর মাধ্যমে তাকে আমরা সুখে দুখে,আনন্দে ও ক্লেশে তার কথা শুনি ও মান্য করি এবং নিজেদের উপরে তাকে প্রাধান্য দেই। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কর্তৃত্বশীল লোকদের সাথে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ব না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ কর্তৃক সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত প্রকাশ্য কোন কুফর তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়। সর্বাবস্থায় আমরা যাতে হক্ব কথা উচ্চারণ করি এবং আল্লাহর পথে কাজ করবার সময় কোন মিথ্যে দোষারোপকে ভয় না করি। (মুসলিম)

হাদীস অনুসারেশাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ কর্তৃক প্রমাণিত প্রকাশ্য কুফর করছেযে কুফরের ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

এসবই প্রযোজ্য যখন একজন মুসলিম শাসক অধিষ্ঠিত থাকেন এবং তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন অথবা তিনি যদি স্পষ্ট কুফর দিয়ে শাসন করেন। এমতাবস্থায় উম্মাহকে ব্যক্তি অথবা সামষ্টিক উভয় পর্যায়েই শাসকের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাড়াতে হবে এবং এমনকি প্রয়োজনে অস্ত্র দিয়ে হলেও তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। তাহলে কী অবস্থা হবে যখন কোন মুসলিম শাসক বর্তমান থাকে না বা কোন দারুল ইসলাম অনুপস্থিত থাকেএমতাবস্থায় এটা স্বাভাবিক যেআল্লাহর আইন তখন বাজেয়াপ্ত হবেদূর্নীতি ও দূর্বৃত্ততা ব্যাপকতা লাভ করবেঅনিয়ম স্বাভাবিক হবে এবং ভ্রান্ত সর্ম্পকের উদ্ভব হবে,মুনকারাত উদ্ভুত ও প্রসার লাভ করবে এবং মারুফ হ্রাস পাবে ও ক্রমেই বিলুপ্ত হবে। মুসলিমগন তখন দূর্বল হবেতাদের অবস্থান খর্ব হবে ও ক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু হবে। তারা এমন সিংহে পরিণত হবে যা দন্তহীন ও নখরবিহীন। তারা এমন এক দৃশ্যের অবতারণা করবে যার বাস্তবতা নেই, যেমনি খাবারের ছবি ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারে না এবং সিংহের ছবি ত্রাস সৃষ্টি করে না।

এমতাবস্থায় - বর্তমান বাস্তবতায় - উম্মাহর উচিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা যিনি আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসন করবে কারন তার (খলিফার) উপস্থিতি ফরয। এখন প্রশ্ন হল কে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দায়ভার কাধে তুলে নিবে এবং এটা কীভাবে করা হবেসঙ্গত কারণেই এখন ইসলামিক একটি দলের অপরিহার্যতার কথা বলতে হয় যারা সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।

No comments:

Post a Comment