দাওয়াত হচ্ছে আসক্তি ও উৎসাহ তৈরি করবার বিষয়। একজনকে ইসলামের দিকে আহ্বান
করবার অর্থ হল আপনি যে বিষয়ে একজনকে আহ্বান করছেন সে বিষয়ে ঝোঁক ও প্রবল ইচ্ছা
তৈরি করা। সুতরাং
ইসলামের দিকে দাওয়াতের অর্থ কেবলমাত্র কথা বলাই নয়, বরং ঝোঁক ও প্রবল ইচ্ছা তৈরি
করবার জন্য কথা বলা ও কর্মকান্ড পরিচালনাকেও বুঝায়। অর্থাৎ দাওয়াত কথা বলা ও
কর্মকান্ড উভয়কেই বুঝায়। একজন মুসলিম অবশ্যই নিজ জীবনে ইসলামকে ধারণ করবে এবং
বাস্তব উদাহরণ দিয়ে লোকদের ইসলামের দিকে আহ্বান করবে এবং সত্য উপলদ্ধি থেকে
ইসলামের ব্যাপারে সঠিক চিত্র তুলে ধরবে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম?’ (সূরা হা-মীম-সিজদাহঃ ৩৩)
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও
বলেনঃ
‘সুতরাং আপনি এর প্রতিই দাওয়াত দিন এবং হুকুম
অনুযায়ী অবিচল থাকুন।’ (সূরা আশ শূরাঃ ১৫)
সুতরাং আল্লাহর দাওয়াত বহন করা ফরয এবং এটি এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে দাওয়াত
বহনকারী আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। এর মর্যাদা অনেক উচুঁতে এবং এর মাধ্যমেই আল্লাহ
তাকে দুনিয়াতে সম্মান দেবেন ও আখিরাতে মুক্তি দেবেন। দাওয়াত ছিল রাসূলদের মিশন এবং
এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ
করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক।’ (সূরা আন নাহলঃ ৩৬)
‘হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে
প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহ্বায়করূপে এবং উজ্জ্বল
প্রদীপরূপে।’ (সূরা আল আহযাবঃ ৪৫-৪৬)
সুতরাং আমাদের রাসূল (সাঃ) দাওয়াত
বহনকারী ও উম্মাহর জন্য একজন সতর্ককারী ছিলেন। তিনি দুনিয়াতে লোকদের যে দিকে
আহ্বান করেছেন সে ব্যাপারে একজন সাক্ষী ছিলেন। সেকারণে তিনি লোকদের এবং আল্লাহকে
সাক্ষী হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে সে কারণে তিনি (সাঃ) বলেনঃ
‘.....আমি কি পৌঁছে দেইনি? হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন।’ (বুখারী)
সুতরাং দাওয়াত হল এ উম্মতের জন্য রাসূল (সাঃ) প্রদত্ত উপহার এবং আমাদেরকে ইসলামের ভেতরে
থাকতে হলে এ উপহারকে সংরক্ষণ করতে হবে।
এর কারণ হল ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য দাওয়াত দেয়া ব্যতিরেকে এর কার্যকর
উপস্থিতি দর্শন করা যাবে না এবং এই দাওয়াত ছাড়া মানুষের মনের ভেতরের বিদ্যমান
অন্ধকার ও বিচ্যুত চিন্তাকে দূরীভূত করতে পারবে না। আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাওয়াত
দেয়া ছাড়া ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। ইসলামকে দাওয়াতের মাধ্যমে ছড়িয়ে না
দেয়া গেলে তা শক্তিশালীভাবে বিস্তারও লাভ করবে না।
ইসলামী দাওয়াত না থাকলে দ্বীন এত শক্তিশালী হত না, বিস্তার লাভ করত না, সুরক্ষিত হত না এবং আল্লাহর
হুজ্জাত বা প্রমাণ তার সৃষ্টির সামনে প্রতিষ্ঠিত হত না।
সুতরাং কেবলমাত্র দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলাম তার হৃত গৌরব ও শক্তিশালী অবস্থান
ফিরে পেতে পারে এবং এর প্রয়োজনীয়তা আজকের দিনে ভীষণ ভাবে দরকার।
দাওয়াতের মাধ্যমে সব মানুষের কাছে ইসলাম পৌঁছে দেয়া এবং জীবনব্যবস্থাকে
আল্লাহর জন্য পরিণত করা সম্ভব। পৃথিবীর জন্য আজকে দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা
অনস্বীকার্য।
ইসলামী দাওয়াতের মাধ্যমে মুসলিমদের দলিলের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় এবং
কাফেরদের দলিলের ত্রুটি প্রকাশিত হয় এবং ইসলাম পরিত্যাগের জন্য অবিশ্বাসীরা যেন
কোন অজুহাত দাঁড় করবার সুযোগ পায় না। এ সর্ম্পকে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ্ প্রবল
পরাক্রমশীল, প্রাজ্ঞ।’ (সূরা আন নিসাঃ ১৬৫)
সে কারণে মুসলিমদের কাছে দাওয়াত দেয়ার বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এ
কারণে ইসলামের প্রথম যুগে সাহাবীগন রাসূল (সাঃ) এর সাথে সাথে দাওয়াতের কাজে আত্ননিয়োগ করেন এবং দ্বীনের মতই এটিকে গুরুত্ব
প্রদান করেন। যদি ইসলামে দাওয়াত না থাকত, তাহলে ইসলাম আমাদের কাছে পৌছত না এবং কয়েকশ
মিলিয়ন লোক এটা গ্রহণের সুযোগ পেত না। সে অবস্থায় ইসলাম কেবলমাত্র রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। সে
কারণে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর
উপর সর্বপ্রথম নাযিলকৃত কথাটি ছিলঃ
‘পড়’ (সূরা আল-আলাকঃ ১)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাকে
পড়তে বলেছেন এবং লোকদের পড়ে শোনাতে বলেছেন।
প্রথমদিকে নাযিলকৃত আয়াতসমূহের মধ্যে একটি ছিলঃ
‘উঠুন, সতর্ক করুন’ (সূরা আল মুদ্দাসিরঃ ২)
সুতরাং, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দাওয়াতের সব উপকরণের দ্বারাই
এ কাজটি করেছেন এবং সর্বপ্রথম মুসলমান হিসেবে যাদের পেয়েছেন তারা তাঁর
পর দাওয়াত বহনকারী হিসেবে সবচেয়ে উত্তম ছিলেন। ঐ সকল মুসলিমদের দাওয়াতই পরবর্তীদের
নিকট পৌঁছে। এভাবে পূর্বের মত আজকেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাওয়াত বহন করবার কাজটি
করে যেতে হবে।
পানির সাথে প্রবাহের যে সর্ম্পক দাওয়াতের সাথে ইসলামের সে সর্ম্পক। যেমনঃ
পানি দিয়ে সেচকার্য করা হয়, পিপাসা
নিবারণ করা হয় এবং মানুষের আরও অনেক কল্যাণ সাধন করা হয়। কিন্তু এই পানির দায়িত্ব
কাউকে নিতে হয়। একইভাবে ইসলাম যা একটি সত্য দ্বীন ও সঠিক জীবনব্যবস্থা -এটাকে এবং এর হককে কাউকে না
কাউকে বহন করতে হয়। এতে করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ, সেচকার্য পরিচালনা ও সুপথের
নিদর্শন পাওয়া যায়।
সুতরাং ইসলাম ও দাওয়াতের মধ্যকার গভীর সর্ম্পক সুস্পষ্ট।
একারণে দাওয়াত ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও মৌলিক ভিত্তিসমূহের একটি।
ইসলামের বিস্তার ও ইসলাম দ্বারা কাউকে প্রভাবিত করবার জন্য দাওয়াত খুব দরকার। যখন
তা শুরু হয়
তখন থেকেই দাওয়াতের যুগই
ইসলামের
যুগ, যতক্ষন না আল্লাহ দুনিয়া এবং এর অধিবাসীদের অধিগ্রহণ করে নেন। সে কারণে
মুসলমানদের জীবনে দাওয়াতকে অত্যন্ত বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত। মুসলমানদের দাও’য়াতী কাজে আত্ননিয়োগ করতে হবে। এর জন্য সময় ও শক্তি বিনিয়োগ
করতে হবে।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ দাওয়াতের একটি অংশ
এ ব্যাপারে ইমাম আন নববী (রঃ) তার শরহে সহিহ মুসলিম-এ ’সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ শিরোনামে অধ্যায়ে বলেনঃ “এ বিষয়ে অর্থাৎ সৎ কাজের
আদেশ অসৎ কাজের নির্দেশ সম্পর্কে- যা বহুপূর্বে দেখা যেত, কিন্তু বর্তমানে তা পরিত্যাজ্য তবে সামান্যতম কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।”
এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন মন্দ কাজ পরিব্যপ্তি লাভ করে, তখন ভাল ও মন্দ সব ধরনের লোক
শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। আর এমতাবস্থায় যদি কেউ অত্যাচারী শাসককে মন্দ কাজ থেকে বিরত
থাকবার জন্য উপদেশ না দেয় তাহলে আল্লাহ সবার উপর শাস্তি নাযিল করেনঃ
‘অতএব যারা রাসূলের আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে স্পর্শ করবে
অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।’ (সূরা আন-নূরঃ ৬৩)
যতদিন মানুষ বাঁচে ততদিন ’সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ তার নিজের নিরাপত্তা ও
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকবার জন্য অপরিহার্য। রাসূল (সাঃ) এ বিষয়টি হাদীসের মাধ্যমে একটি উদাহরণ দিয়ে খুব
সুন্দরভাবে ব্যাখা করেছেনঃ
“যারা আল্লাহ্’র হুকুম মেনে চলে আর যারা সেগুলোকে নিজেদের প্রবৃত্তির
খেয়ালে লঙ্ঘন করে,
(উভয়ে) যেন তাদের মতো যারা একই
জাহাজে আরোহণ করে। তাদের একাংশ জাহাজের উপরের তলায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে এবং
অন্যরা এর নিচের তলায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। যখন নিচের লোকদের পিপাসা মেটানোর
প্রয়োজন হয় তখন তাদেরকে জাহাজের উপরের অংশের লোকদের অতিক্রম করে যেতে হয়। (তাই) তারা (নিচতলার লোকেরা) নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে
নিল,
‘আমরা
যদি জাহাজের নিচের দিকে একটা ফুটো করে নিই তাহলে জাহাজের উপরের তলার লোকদের কোন
সমস্যা করবো না।’ এখন যদি উপরের তলার লোকেরা নিচতলার লোকদেরকে এ কাজ করতে দেয় তবে নিশ্চিতভাবেই
তারা সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর তারা যদি তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখে, (তবে) তারা (উপরতলা) রক্ষা পাবে এবং এভাবে (জাহাজের) সবাই রক্ষা পাবে।” (বুখারী)
এ হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবনের জন্য ’সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের
নিষেধ’ কতটা
গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজের গুরুত্ব বুঝার ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের আত্নপ্রসাদ সেই জাহাজের নিমজ্জিত
লোকদের মত অবস্থা হবে। সে অবস্থায় সবাই সমুদ্রের অতলে নিক্ষিপ্ত হবে এবং
ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
পবিত্র কোরআনও বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে দাওয়াতের গুরুত্ব ও মানুষের জন্য এর
প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। কুরআন কেবলমাত্র দাওয়াতের বিষয়বস্তু তুলে ধরেনি, বরং রাসূল (সাঃ) -এর বিভিন্ন হাদীসের পাশাপাশি, এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক
কিছু যা দাওয়াতকে ঘিরে পরিগ্রহ করে তাও উপস্থাপন করেছে। সামগ্রিকভাবে না হলেও এদের
কিছু আমরা এখানে উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি।
পবিত্র কুরআন দাওয়াতকে ’আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার’ বলে সম্বোধন করেছে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই
তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা
দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (সূরা আল ইমরানঃ ১১০)
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও
বলেনঃ
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা
আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং
বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আল ইমরানঃ ১০৪)
এ সর্ম্পকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
“ঐ সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অতি সত্বর আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে
নিষেধ) কর। অন্যথায় অচিরেই তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আরোপিত হবে। অতঃপর
তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা।” (তিরমিযী)
এবং তিনি (সাঃ) আরও
বলেনঃ
“তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি অন্যায় কাজ হতে
দেখলে সে যেন তার হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্য না থাকলে সে যেন তার
মুখ দ্বারা তা প্রতিহত করে। তার এই সামর্থ্যও না থাকলে সে যেন তার অন্তর দ্বারা তা
প্রতিহত করে (ঘৃণার মাধ্যমে), আর এটা হলো দূর্বলতম ঈমান।” (মুসলিম, তিরমিযী)
তাবলীগ দাওয়াতের আরেকটি অংশ
একইভাবে পবিত্র কুর’আন দাওয়াতকে লোকদের সম্মুখে ’সাক্ষ্য দান করা’ বলে উল্লেখ করেছে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায়
করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রাসূল
সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।’ (সূরা আল বাক্বারাহঃ ১৪৩)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
‘.....বিশ্বাসীরা হল পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষীদাতা।’ (ইবনে মাজাহ)
তিনি (সাঃ) আরও
বলেনঃ
‘যারা এখানে উপস্থিত আছ (সাক্ষীদাতারূপে), তারা যারা অনুপস্থিত তাদের
কাছে পৌছে দাও।’
কুর’আন দাওয়াতের কাজকে তাবলীগ (বহন করা) অর্থে উল্লেখ করেছে। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘হে রাসূল, পৌঁছে দিন আপনার
প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই
পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন।’ (সূরা আল মায়িদাহঃ
৬৭)
তিনি (সাঃ) বলেনঃ
‘পৌঁছে দাও আমার পক্ষ থেকে যদি একটি আয়াতও হয়।’ (বুখারী)
একে অপরকে সত্যের ব্যাপারে সতর্ক করা (তাওয়াসী) দাওয়াতের অংশ
কুর’আন ও সুন্নাহ দাওয়াতের
ধারণাকে একে অপরকে সত্যের ব্যাপারে সতর্ক করা (তাওয়াসী) সাথে সর্ম্পকযুক্ত করেছে, সুসংবাদ প্রদান করা (তাবসীর), লোকদের সতর্ক করা (নসীহা) এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া, আহলে কিতাবদের সাথে
সর্বোত্তম পন্থায় বিতর্ক করা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা এবং দ্বীন
প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এছাড়াও আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘কসম যুগের, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্ত তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও
সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ দেয় সত্যের এবং তাকীদ দেয় সবরের।’ (সূরা আল আসরঃ ১-৩)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও
সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্ত অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা আস সাবাঃ ২৮)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও
বলেনঃ
‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ
করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে।’ (সূরা ইবরাহীমঃ ৪)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও
বলেনঃ
‘এটা (কুর’আন) তো কেবল বিশ্বাবাসীদের জন্যে
উপদেশ’ (সূরা আত তাকভীরঃ ২৭)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘এটা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে উল্লেখিত
থাকবে এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন।’ (সূরা আয যুখরুফঃ ৪৪)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘............এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায়।’ (সুরা আন নাহলঃ ১২৫)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনা
শেষ হয়ে যায় এবং দ্বীন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।’ (সূরা আল আনফালঃ ৩৯)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেনঃ
‘তিনি তাঁর রাসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্যধর্ম নিয়ে
প্রেরণ করেছেন, যাতে একে সবধর্মের উপর প্রবল করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা আস সফঃ ৯)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
‘অবশ্যই দ্বীন হল নসীহা (উপদেশ) । তাঁকে
জিজ্ঞেস করা হলঃ ‘কার প্রতি ইয়া রাসূলুল্লাহ’। তিনি বললেনঃ আল্লাহ, তার কিতাব, রাসুলের
জন্য, মুসলিমদের নেতা এবং
জনসাধারনের প্রতি। (মুত্তাফিকুন আলাইহি)
সুলায়মান বিন বুরাইদাহ তার বাবার বরাত দিয়ে বর্ণণা করেন যেঃ
‘যখন
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কাউকে কোন অভিযান বা সেনাবাহিনীর আমীর হিসেবে নিয়োগ দিতেন তখন
তাকে আল্লাহভীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন এবং তার সাথের মুসলমানদের প্রতি সদয় হতে
উপদেশ দিতেন। তিনি (সাঃ) বলতেনঃ আল্লাহর জন্য তার নামে জিহাদ কর। আল্লাহর প্রতি
অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। যখন তুমি মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে তাদের তিন
পর্যায়ের কাজের প্রস্তাব দেবে। তারা যদি তিনটির কোন একটিকে গ্রহণ করে তাহলে সেটি
মেনে নাও এবং তাদের কোন ক্ষতি করা থেকে বিরত থাক। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য
আমন্ত্রন জানাও; যদি তারা
প্রস্তাব গ্রহণ করে তাহলে মেনে নাও এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত
থাক.....।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরও
বলেনঃ
‘আল্লাহ যাতে তার মুখ উজ্জ্বল করে দেয় -যে আমার কথা শুনে, সেইরূপ স্মরণে রাখে, বুঝে এবং তা পৌঁছে দেয়।
সেক্ষেত্রে কেউ ফকীহ না হয়েও ফিকহ (জ্ঞান) বহন করবে। আবার কেউ কেউ এমন
কারও কাছে জ্ঞান বা ফিকহ বহন করে নিয়ে যাবে যে তার চেয়েও বড় ফকীহ।’ (তিরমিযী)
এইভাবে সংশ্লিষ্ট সব আয়াত ও হাদীস যুক্ত করে পুরো বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে -যেগুলোর উপজীব্য বিষয় হল
দাওয়াত। প্রত্যেক মুসলিম সাধ্য অনুসারে দাওয়াত বহনের কাজ করতে হবে।
আমরা যদি দাওয়াত সংশ্লিষ্ট অন্য আয়াতসমূহের কথা চিন্তা না করে কেবলমাত্র ’আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার’ এর আয়াতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, ইসলামের এ শক্তিশালী ভিত্তির
সাথে প্রত্যেকটি মুসলিম বিজড়িত। আমাদের অণুকরণীয় আদর্শ রাসূল (সাঃ) এর সাথে সম্পৃক্ত। একটি
আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা
বলেনঃ
‘......... তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষনা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ.........’ (সূরা আল-আ’রাফঃ ১৫৭)
এটা নব্যুয়তের সমাপ্তির কথা বলে। রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের
ব্যাপারে নির্দেশ দেন, সব
ভাল (তাইয়্যিব) জিনিসের অনুমোদন ও অবৈধ (খাবিত) জিনিষের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা
দেন।
উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই
তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা
দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (সূরা আল ইমরানঃ ১১০)
এখানে উম্মাহ বলতে সব মুসলিম, ব্যক্তিগতভাবে, সামষ্টিক বা দলগতভাবে এবং কর্তৃত্বশীল লোক সবাইকে বুঝানো
হয়েছে এবং সবাইকেই’ আমর
বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার’ এর ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ব্যক্তিপর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত একটি আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের
সহায়ক। তারা ভাল কাজের শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আত তাওবাঃ ৭১)
ইমাম কুরতুবী বলেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমল বিন মারুফ ও নাহিয়ান মুনকার এর মাধ্যমে
ঈমানদার ও মুনাফেকের মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন। অর্থাৎ ঈমানদারদের প্রধান
বৈশিষ্ট্য হল ’আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার’ এবং এর প্রধান দিক হল
ইসলামের দাওয়াত।’ (তাফসীর আল কুরতুবী ৪/১৪৭)
দলগত দাওয়াতের কাজের আয়াতসমূহে দলের কাজ সুস্পষ্ট করা হয়, যেমনঃ
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা
আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং
বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আল ইমরানঃ ১০৪)
কর্তৃত্বশীল লোকদের সর্ম্পকে
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ
‘তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ
ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত।’ (সূরা আল হাজ্জঃ ৪১)
কুরআন স্পষ্টভাবে বলেছে দাওয়াত ইসলামের প্রতিঃ
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা
আহবান জানাবে সৎকর্মের (ইসলামের) প্রতি.....’ (সূরা আল ইমরানঃ ১০৪)
‘যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহূত হয়েও আল্লাহ্ সম্পর্কে মিথ্যা বলে; তার চাইতে অধিক যালেম আর কে?’ (সূরা আস সফঃ ৭)
‘আপনি তো তাদেরকে সোজা পথে দাওয়াত দিচেছন’ (সূরা মু’মিনুনঃ ৭৩)
কুরআন স্পষ্টভাবে বলেছে এটি আল্লাহর প্রতি দাওয়াতঃ
‘যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়......তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?’ (সূরা হা-মীম সিজদাহঃ ৩৩)
‘বলে দিনঃ এই আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝে সুঝে দাওয়াত দেই- আমি এবং আমার অনুসারীরা।’ (সূরা ইউসুফঃ ১০৮)
কুরআন স্পষ্টভাবে বলেছে এটি আল্লাহর নাযিলকৃত শাসনব্যবস্থার প্রতি দাওয়াতঃ
‘তাদের মধ্যে শাসন করার জন্য যখন তাদেরকে আল্লাহ
ও রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সূরা আন নূরঃ ২৪)
‘মুমিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই যখন তাদের মধ্যে
শাসন করার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলেঃ আমরা শুনলাম ও
আদেশ মান্য করলাম।’ (সূরা আন নূরঃ ৫১)
‘.... আল্লাহর কিতাবের প্রতি তাদের
আহবান করা হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা যায়। অতঃপর তাদের মধ্যে একদল তা
অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সূরা আল ইমরানঃ ২৩)
‘আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার’ হল ফরযে কিফায়া। কারও কারও জন্য এটি
বাধ্যতামূলক। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তাদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার এবং যারা তা
পালন করবে না তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত এর দায়ভার বহন করবে। কেননা
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দাওয়াত বহন করাকে
মুক্তির পথ হিসেবে বাধ্যতামূলক করেছেন এবং দাওয়াত ত্যাগ করার ফলাফল যন্ত্রনাদায়ক
শাস্তি। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা
বলেনঃ
‘অতঃপর যখন তারা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বুঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি
দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর
পাকড়াও করলাম, গোনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানীর দরুন।’ (সূরা আল আ’রাফঃ ১৬৫)
ঈমান যেমনিভাবে মা’রুফ এর মুখ্য বিষয় ও ভিত্তি, তেমনিভাবে কুফর হল সবচেয়ে বড়
মুনকার ও সব মুনকারের ভিত্তি। আনুগত্যের সব কাজ হল এ মুখ্য মা’রুফ থেকে উদ্ভুত মা’রুফাত। আর অবাধ্যতা হল মুখ্য মুনকার থেকে
উদ্ভুত মুনকারাত। আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন করা হল আনুগত্যের সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর যার
মাধ্যমে ঈমান ও আনুগত্যের বিভিন্ন কাজ প্রকাশিত হয় এবং যার মাধ্যমে দাওয়াত বহন করা
হয় ও ইসলামের প্রসার ঘটে। অন্যদিকে আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা
অবাধ্যতার চূড়ান্ত পর্যায় যাতে মানুষের খেয়ালখুশী, প্রবৃত্তি ও পথভ্রষ্টতা
প্রতিফলিত হয়।
এই ফরযিয়াত বাস্তবায়নের জন্য একত্র হওয়া ফরয। দ্বীন সর্ম্পকে প্রত্যেক সচেতন
মুসলমানের জানা উচিত, সে
যখন কোন আয়াত বা হাদীস পাঠ করে তা শুধু নিজের জন্য নয় বরং সব মুসলিমের জন্য ।
এমনকি রাসূলের প্রতি জারিকৃত যে কোন নির্দেশও পুরো উম্মাহ’র জন্য প্রযোজ্য হবে যদি তাকে সুনির্দিষ্ট করা
হয়েছে এমন প্রমাণ না থাকে। যখন আল্লাহ তাকে (সাঃ) ঈমান, ইবাদত এবং নাযিলকৃত আয়াতসমূহ দিয়ে শাসনের
ব্যাপারে কোন নির্দেশ দেন তখন এগুলো সকলের জন্যও প্রযোজ্য।
No comments:
Post a Comment