7.2.14

অধ্যায় ৬ ~ আহকাম (হুকুম) বুঝার জন্য ইসলামের পদ্ধতি

দ্বীন প্রতিষ্ঠার সাথে সর্ম্পকিত সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সংক্রান্ত দায়িত্ব বহন শরীয়াহ সর্ম্পকিত প্রয়োজনীয় জ্ঞানভিত্তিক হতে হবে এটি একারণে যে, আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি জ্ঞান ছাড়া কোন কাজের মূল্য নেই এবং জ্ঞান ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি আন্তরিক সদিচ্ছা ছাড়া কোন ইবাদতের মূল্য নেই

সুতরাং দলের জন্য প্রয়োজনীয় শরঈ জ্ঞানের সীমা কতটুকু? কোন বিকাশ প্রক্রিয়ার (culturing process) মাধ্যমে দলটি গঠিত হবে এবং কিসের ভিত্তিতে এর শাবাবগন ও উম্মাহ তৈরি হবে?

উপযুক্ত শরঈ জ্ঞানের ভিত্তিতে সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ সংঘটিত হয়, যা দলটিকে গ্রহণ করতে হবে যদি দলটি এমন কিছু গ্রহণ করে যা শরীয়াহ-র সাথে সাংঘর্ষিক, তাহলে সে ব্যাপারে সদুপদেশ দিতে হবে যদি বিচ্যুত হয় তাহলে সংশোধন করতে হবে যে শরঈ বাধ্যবাধকতা দলটির জন্য বাধ্যতামূলক, তা অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য মূল বিষয় হল গ্রহণ ও অনুসরণ, বিচ্যুতির কোন সুযোগ নেই উপদেশ প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রত্যেকের জন্য আসা উচিত

এ পর্যায়ে এটা বলে রাখতে হবে যে, যে কোন শরঈ হুকুম বের করবার জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, এটা হতে পারে দাওয়াত, ইবাদত (উপাসনা), মুআমালাত (লেনদেন), উকুবাত (শাস্তি), মাতউমাত (খাদ্যদ্রব্য), মালবুসাত (পরিচ্ছদ) অথবা আখলাক (নৈতিকতা).....

মুসলিমদের প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য নয়, বরং ইসলাম এবং এর প্রকৃতির দ্বারা এই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিটি নির্দেশিত হয়েছে এটা এ কারণে যে, ইসলামী আক্বীদাহ-র নির্দেশ হচ্ছে, একজন মুসলিম শরঈর বাইরে থেকে একটিমাত্র হুকুমও গ্রহণ করবে না কিতাবের (Shariah texts) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে সীমারেখা টানা আছে তাকে অবশ্যই সে সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করতে হবে সুতরাং ইসলামের এমন পদ্ধতি থাকা দরকার যা এই নির্দেশনাকে সুরক্ষা দিবে, উপলদ্ধিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রন করবে যাতে যা নাজিল হয়েছে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যাতে এর আক্বীদাহ-র দৃষ্টিভঙ্গি ফিকহের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং এর শর্তসমূহ হচ্ছে সমন্বিত

ইজতিহাদের এই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা দলের বিকাশের (culturing process) সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা উচিত এই পদ্ধতি আইন অবরোহনের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান করে যদি অবরোহণের পদ্ধতি সঠিক হয়, তাহলে এমন শরঈ হুকুম পাওয়া যাবে যেখানে সবচেয়ে কম সন্দেহ থাকবে এবং একজন এর জন্য পুরষ্কৃত হবে অন্যথায় সঠিক শরঈ পদ্ধতির ভিত্তিতে গড়ে না উঠা মতামত শরঈ মতামত বিবেচিত হতে পারে না, যদিও বা কেউ ভুলভাবে একে শরঈ মতামত বলে আখ্যা দিতে পারে এর কারণ হলো, বিবেচ্য বিষয় নাম নয়, বরং বাস্তবতা সুতরাং এটা বাধ্যতামূলক

অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে আজকে এ পদ্ধতির অনুসরণ করা বড়ই প্রয়োজন এটা মুসলিমদের পশ্চিমা চিন্তাধারা ও এর পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া থেকে বিরত রাখবে এটা এ সময়ের একটি ব্যধি যা দ্বারা অনেকে আক্রান্ত হয়েছে আর এদের একটি অংশ হল উলেমাগণ এ কারণে তাদের ইজতিহাদ ও ফতওয়া মূল নিয়ন্ত্রক  [dawaabit (regulators)] থেকে অনেক দূরে, যেখানে তারা ঐশী নির্দেশনার দাসত্ব না করে পশ্চিমা খেয়ালখুশীর দাসত্ব করে

সুতরাং শরঈর দৃষ্টিতে ইজতিহাদের একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে এবং এর উপর মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যদিও তাদের ইজতিহাদ ভিন্ন হতে পারে এখানে আমরা বিষয়টি সার্বজনীনভাবে উপস্থাপন করব এটা সালাফ বা পূর্ববর্তীদের পদ্ধতি ছিল, একই ধারায় ক্বিয়ামতের আগ পর্যন্ত খালাফ বা পরবর্তীদেরও এবং তার পরবর্তীদেরও পদ্ধতি হিসেবে থাকবে

মানাত (বাস্তবতা) উপলদ্ধি

আহকাম বুঝবার জন্য ইসলামিক পদ্ধতির ভিত্তি হলঃ সমস্যাকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করা, এর মর্মোদ্ধার করা, সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় শরঈ দলীল এবং সবশেষে এই শরঈ দলীল থেকে হুকুম বের করে নিয়ে আসা

সুতরাং পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করা একটি দলের উপস্থিতি এটি যে বাস্তবতায় আছে তার সাথে সর্ম্পকযুক্ত কেননা এ বাস্তবতার নিরীখেই দলটিকে ঐ বাস্তবতা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় শরঈ হুকুম বের করতে হবে

আর কোন বিষয়ের বাস্তবতা বুঝতে হলে একজনকে ঐ বিষয়টি গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে

শরীয়াহ বুঝতে হলে প্রথমেই এর উৎস সুনির্দিষ্ট করতে হবে এবং উসুল ও মূলনীতি গ্রহণ করতে হবে যার ভিত্তিতে হুকুসমূহ বের করে আনতে হবে হুকুম আহরণের এই প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য একজন মুজতাহিদ প্রয়োজন, যিনি যে কোন হুকুমকে তার বাস্তবতা অনুসারে প্রয়োগ করতে পারবেন এবং ইল্লাত বা ঐশী কারণ অনুসারে কার্যকর করতে পারবেন

সুতরাং একটি দল বা হিজবের উত্থান বাস্তবতার সাথে সর্ম্পকযুক্ত দলটি বাস্তবতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে সে কারণে এর চিন্তা ও পরিবর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে সে কারণে দলকে বাস্তবতা গভীরভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে উপলদ্ধি করতে হবে এবং যে সমস্যা সমাধান করা হবে তা খুঁজে বের করতে হবে অগণিত সমস্যা রয়েছে সেকারণে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবন করতে পারতে হবে একজনকে যেমনি মূল সমস্যা বুঝতে হবে, তেমনি মূল সমস্যা থেকে উদ্ভুত শাখা সমস্যাগুলোও বুঝবার মত সক্ষমতা থাকতে হবে এর মাধ্যমে একটি সমস্যা ও এর আপাত উপস্থিতির মধ্যকার পার্থক্য প্রতীয়মান হবে অর্থাৎ অসুস্থতার মূল কারণ ও সেকারণে সৃষ্ট উপসর্গের মধ্যকার পার্থক্য বুঝা যাবে মূল কারণ সনাক্ত হবার পর একজন এর প্রতিকারের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে

এখানে আমরা একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ ডাক্তারের সাথে তুলনা করতে পারি, যিনি রোগের মূল কারণ উপলদ্ধি না করে উদ্ভুত উপসর্গ দ্বারা প্রতারিত হন না যেমনঃ কোন লোকের পেটের অসুখ আছে এবং একারণে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তার চামড়ায় ফুসকুড়িসহ জ্বর হল যদি সে ডাক্তার কেবলমাত্র চামড়ায় ফুসকুড়িসহ জ্বরের চিকিৎসার জন্য ঔষধ প্রদান করেন কিন্তু পেটের অসুখের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তাহলে এ চিকিৎসা নিশ্চিতভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে সে কারণে চিকিৎসককে প্রথমে মূল সমস্যার প্রতিবিধান করতে হবে, অর্থাৎ পেটের ব্যাধি যদি তা করা হয় তাহলেই কেবলমাত্র উপসর্গসহ মূল অসুখের প্রতিকার করা হবে মূল চিকিৎসার পরে ডাক্তার উদ্ভুত উপসর্গগুলোর জন্য প্রয়োজনে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেবে তবে স্বাভাবিকভাবে উদ্ভুত উপসর্গগুলো মূল সমস্যার সাথে সাথে উপশম হয়ে যাবার কথা আর না হলে পরবর্তীতে এগুলো চিকিৎসা করা যাবে যদি সেটার প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা হবে একটি আংশিক কাজ

একই কথা আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য আমরা জানি, বাস্তবে কিছু মৌলিক সমস্যা রয়েছে এবং এসব সমস্যা থেকে কিছু উদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে একটি বড় মৌলিক সমস্যা যা আজকে উম্মাহকে ক্লিষ্ট করে তুলেছে, তা হল মুসলিমদের জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অনুপস্থিতি এটি থেকে অনেক উদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যেমনঃ অবিচার থেকে উদ্ভুত দারিদ্রতা, অজ্ঞানতা, অনৈতিক কাজের বিস্তৃতি এবং অবৈধ সর্ম্পকের প্রাধান্য এর মূল কারণ সর্ম্পকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেনঃ

‘যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে (সূরা ত্বাহাঃ ১২৪)

এই আংশিক সমস্যাসমূহ মূল একটি সমস্যা বা বাস্তবতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে যদি এই বাস্তবতার পরিবর্তন না হয় তাহলে এক্ষেত্রে টেকসই ও মৌলিক পরিবর্তন সংঘটিত হবে না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বর্ণিত কুপ্রভাব থেকে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত বের হতে পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ নিষেধের ভিত্তিতে ইসলামিক আক্বীদাহকে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করে জীবনধারা পূণঃপ্রবর্তন হবে

সুতরাং শিক্ষা, নৈতিকতা বা অর্থনৈতিক সংকট মৌলিক সমস্যা নয় মুসলিমদের অধিকার পুরুদ্ধার বা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থাকে শক্তিশালী করাও মৌলিক সমস্যা নয় বরং আক্বীদা ও বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মৌলিক সমস্যা হল আল হাকিমিয়্যাহ বা সার্বভৌমত্ব এই সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য সে কারণে আমাদেরকে ইসলামের সমাধানের উপর মুসলিমদের ভেতরে আত্নবিশ্বাস তৈরি করতে হবে আমরা অবশ্যই তাদের হৃদয়ে হৃত আক্বীদাহ, আক্বীদাহ থেকে উদ্ভুত ব্যবস্থা জীবনে ফিরিয়ে আনবার জন্য সদিচ্ছা ফিরিয়ে আনবার জন্য প্রচেষ্টা চালাব, যাতে করে তারা জান্নাত লাভ, জাহান্নামকে ভয় করে ও এর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করে, ইসলামিক আক্বীদাহ-র ভিত্তিতে মুসলিমদের বর্তমান করুণ অবস্থা তথা পুরো মানবতা সর্ম্পকে সচেতন হয়

এ উপলদ্ধি থেকে দলটি মৌলিক সমস্যাকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে জানবে যে, যখন এ রোগের চিকিৎসা হবে তখন সব উদ্ভুত উপসর্গ দূরীভূত হবে সুতরাং বাস্তবতা সর্ম্পকে সচেতনতার গুরুত্ব এখন সুস্পষ্ট

একে উসুলী চিন্তাবিদগন মানাত বলে থাকেন শর’ঈ প্রমাণাদি নিয়ে আসবার আগে মানাত বা বাস্তবতাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করা বাধ্যতামূলক

বাস্তবতা সর্ম্পকে সচেতন হওয়া এবং তা বুঝা এর সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমের চেয়ে কঠিন এর জন্য দরকার যথার্থতা কারণ যদি আমরা বাস্তবতা বুঝতে ভুল করি এবং এই ভ্রান্তি মনের উপর কোন ছাপ ফেলে তাহলে স্বভাবতই আমরা এমন দলীল উপস্থাপন করব যা হৃদয়নিবেশিত ভাবরাশিতে থাকা চ্যুত বাস্তবতাকে উপস্থাপন করবে কখনই আসল বাস্তবতাকে নয় অর্থাৎ আমরা এমন দলীল উপস্থাপন করব যা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়

বাস্তবতা বুঝার জন্য চিন্তার ব্যবহার অপরিহার্য বাস্তবতাকে চিন্তার উৎস হিসেবে নির্ধারণ করা অনুমোদিত নয় এমন কোন সমাধান গ্রহণ করা অনুমোদিত নয় যা বাস্তবতা থেকে উদ্ভুত সেকারণে, বাস্তবতাকে এর মত করেই বুঝতে হবে

শরী’য়াহ উপলদ্ধি করা

চিন্তাকে ব্যবহার করে বাস্তবতাকে প্রকৃতভাবে বুঝবার পর শরঈ দলীল থেকে উৎসারিত শরঈ হুকুম বাস্তবতায় প্রয়োগের জন্য উদ্ভুত হয় সমাধান বের করবার জন্য চিন্তাকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করা অনুমোদিত নয় এখানে চিন্তার কাজ হল শরঈ দলিলে থাকা শরঈ সমাধান উপলদ্ধি করা

শরঈ বুঝতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে দলটি কোন উৎস থেকে শরঈ এবং ঊসুলী মূলনীতি গ্রহণ করে এবং কিসের দ্বারা দলটি মন্দ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চায় এভাবে, জনগনের সামনে নিয়ে যাবার জন্য বাস্তবতা সর্ম্পকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করবে এবং ইজতিহাদী প্রক্রিয়ার যথার্থ জ্ঞান অর্থাৎ অবরোহণের প্রক্রিয়া সর্ম্পকিত জ্ঞান রাখবে

শরী’য়াহর উৎস

যেহেতু প্রতিটি হুকুমকে একটি সঠিক উৎস থেকে আসতে হবে, সেহেতু উৎস অধ্যয়ন করবার পর সে সর্ম্পকে যথার্থ উপলদ্ধি তৈরির পরই তা গ্রহণ করতে হবে এটা সর্বজনবিদিত যে, ইসলামিক আইনের প্রধান উৎস হল কুরআন ও সুন্নাহ- যেগুলোর ব্যাপারে কোনরূপ মতানৈক্য নেই লদ্ধ উৎসসমূহ হল- ইজমা, ক্বিয়াস, ইসতিহসান (আইনগত প্রাধান্য), মাজহাব আস সাহাবা (সাহাবীদের মতামত), শারা মান কাবলানা (পূর্ববর্তীদের শরঈ)-এ সবগুলোর ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে উৎস সর্ম্পকে অর্ন্তনিহিত দৃষ্টিভঙ্গি দলের শরঈ গ্রহণ সর্ম্পকে একটি ধারণা দেয়

এটা সর্বজনবিদিত যে, লদ্ধ উৎসসমূহ নির্ভর করে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদির উপর সুতরাং, যদি কোন কিছু চূড়ান্তভাবে শরঈর উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়, তাহলে এটাকে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আসতে হবে অন্য কথায়, দুটি প্রধান উৎস অন্য একটি বিশেষ উৎসকে গ্রহণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দলীল হিসেবে বিবেচিত হবে শরঈ উৎস তাক্বলীদের মাধ্যমে গ্রহণ করা যথেষ্ট নয় শরঈ উৎস মৌলিক বিষয় এবং একারণে এগুলোকে চূড়ান্ত হতে হবে এবং আমরা জানি তাক্বলীদ নিশ্চয়তার দিকে পরিচালিত করে না

উৎস সুনির্ধারিত হবার পর আমরা বুঝতে পারব জলের কোন ধারা থেকে তারা পান করতে পারবে এবং পারবে না উৎসকে সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা উৎস নির্ধারণে একটি ভুল হলে পুরো হুকুমের মধ্যে গলদ চলে আসবে শরঈ উৎস সংজ্ঞায়িত হবার পর দলটি তার কাজের সাথে বিজড়িত শরঈ হুকুম অবরোহণ করবে শরঈ উৎস নির্ধারণ না করে দাওয়াতের কাজ করা যে কোন দলের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়

ভাল মনে করে সব লদ্ধ শরঈ উৎস গ্রহণ করাও গ্রহণযোগ্য নয় যদি দলটি এরকম কিছু করে তাহলে তারা ভাল ও মন্দ দুটোই গ্রহণ করবে এতে করে শরীয়াহ বাস্তবতা, মানুষের মন, প্রবৃত্তি, আবেগ ও স্বার্থের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যায় এমতাবস্থায় দলীলসমূহ কেবলমাত্র এইসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই ব্যবহার করা হয় এবং শরীয়াহ-র দাবীর বিপরীতে অবস্থান নেয়

নীতিগতভাবে, বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য মতামত প্রদানের আগে দলটিকে অবশ্যই উৎসসমূহ সুনির্দিষ্ট করা উচিত উৎসের ক্ষেত্রে কখনোই বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া চলবে না বরং উৎসসমূহকে প্রতিষ্ঠা অথবা ভুল প্রমাণ করবার জন্য কেবলমাত্র নাজিলকৃত ওহী ও এদের চূড়ান্ত নির্দেশনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত তাছাড়া যেসব উৎসকে দলটি প্রতিষ্ঠিত করবে সেগুলোকে তার নিজের জন্য উসুল হিসেবে গ্রহণ করবে এবং অন্যদের এ ব্যাপারে বাধ্য করবে না বরং তারা অন্যদের সাথে প্রমাণ ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে তাদের কাছে চূড়ান্ত বলে বিবেচিত মতামত নিয়ে আলোচনা করবে যদি দলটি নিজেদের উৎসকে অন্যদের জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে, তাহলে সেটি তাদের এবং অন্যদের সমস্যার কারণ হবে

শরী’য়াহ বুঝার নিয়মসমূহ

দলটি শরীয়াহ-র উৎস সুনির্দিষ্ট করবার পর কীভাবে এসব উৎস থেকে শরীয়াহ গ্রহণ ও এগুলোকে ব্যবহার করবে তা উপলদ্ধি করবে অন্য কথায়, এটি এমন নীতিমালা (কাওয়াইদ) বুঝার দিকে মনোনিবেশ করবে, যেগুলোর মাধ্যমে একজন উৎস থেকে আহকাম বের করে নিয়ে আসতে পারে এটা নিঃসন্দেহাতীত যে, যখন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ একটি শরীয়া হুকুম বের করবার জন্য মনস্থির করে, তখন তার মনে উসুলের নীতিমালাসমূহ থাকে যেগুলোর ভিত্তিতে সে একটি হুকুম প্রণয়ন করে এমন কোন জ্ঞান নেই যার কোন মূলনীতি নেই, হতে পারে সেটি লিখিত অথবা অলিখিত

শরঈ যে কোন বর্ণণা হতে পারে আম বা সার্বজনীন, খাস বা সুনির্দিষ্ট, মুজমাল বা সংক্ষিপ্ত, মুফাসসাল বা বিস্তৃ, মুতলাক বা চূড়ান্ত, মুক্বায়েদ বা সীমিত, আওয়ামীর বা নির্দেশ, নাওয়াহী বা নিষেধাজ্ঞা, মাফহুম আল মুয়াফাক্বাহ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থ, মাফহুম আল মুখালাফাহ বা বিপরীতার্থক অর্থ, মানতুক বা প্রকাশিত অর্থ, মাফহুম বা অপ্রকাশিত অর্থ, বর্ণিত বিষয়ের মাকুল বা যুক্তি, খবর আল ওয়াহিদ বা একক বর্ণণা এবং কখন তা দলীল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে আর কখন যাবে না ও এরকম অনেককিছু দলটি তার আইনগত মূলনীতিকে চূড়ান্ত করবে, গ্রহণ করবে এবং অন্যদের কাছে উপস্থাপন করবে

উল্লেখিত ঊসুলের মূলনীতিসমূহের অধিকাংশই বিতর্কিত এটা সর্বজনবিদিত যে, প্রতিটি মূলনীতির আবার অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে যেহেতু এগুলো বিতর্কিত, সেহেতু এগুলোকে বিতর্কিত অবস্থা থেকে দূরে রাখতে হবে দলটি যা সঠিক মনে করে এর ভিত্তিতেই এগুলো করতে হবে উসুলের মূলনীতি বুঝবার পর, শাখাসমূহ মূলনীতি অনুসারে উপলদ্ধি করা যায়

উসুল ও এর মূলনীতি সর্ম্পকে জানবার পর দলটি শরঈকে এর উৎস থেকে বুঝবার মত সক্ষমতা অর্জন করবে এরপর ইজতিহাদের পরিচিত পদ্ধতি ব্যতিরেকে আর কিছু গ্রহণের কোন সুযোগ দলটির নেই এটিই দলটিকে অন্যদের থেকে আলাদা করবে আর এটাকে দলটি তার শাবাবদের বিকশিত (culturing) করবার মাধ্যমে লোকদের কাছে নিয়ে যাবে আর এটিই প্রথম জিনিস যার উপর দলটি প্রতিষ্ঠিত হবে

অবশ্যই একজন মুজতাহিদের কাজ অনেকটা ডাক্তারের মত প্রথমে তাকে রোগীর হাল-তবিয়ত সর্ম্পকে জানতে হবে এবং তার অবস্থা বর্ণণা করতে হবেতঃপর তিনি রোগীর ভাষ্য অনুসারে মৌলিক অসুস্থতা নির্ণয় করবেন এবং এক্ষেত্রে অন্যান্য উপসর্গ দ্বারা বিভ্রান্ত হবেন না অতঃপর তার শিক্ষা অর্জনের সময়কার জ্ঞানের শরণাপন্ন হবেন এবং এমন বইপত্রের দ্বারস্থ হবেন, যেগুলো তাকে সমাধান বের করবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে এরপরই তিনি সমাধান তথা ঔষধ দিবেন অন্য কথায়, তিনি বর্ণিত বিষয়ের সাহায্য নিয়ে সমাধানটি বিধৃত করবেন

যদি কোন দল পরিবর্তন চায় এবং এটি ইসলামী হয়, তাহলে অবশ্যই তারা ইসলামের ভিত্তিতে পরিবর্তনের জন্য কাজ করবে পরিবর্তন অবশ্যই শরঈ দলিলের ভিত্তিতে হতে হবে এবং কোন ব্যক্তিগত খেয়ালখুশী, মতামত, যৌক্তিকভাবে প্রাপ্ত সুবিধাদি, বাস্তবতা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নয় বরং একমাত্র শরীয়াহ-ই হবে, যা দলের জন্য হুকুম শরঈকে নিয়ন্ত্রন করবে মুসলিমদের স্বার্থ শরীয়াহ দ্বারা সংজ্ঞায়িতকারণ শরঈ একে সংজ্ঞায়িত করেছে একারণে মাসলাহাহ বা স্বার্থের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে

আল মাসলাহাহ (জনস্বার্থ)

মাসলাহাহ মানে হল কোন উপযোগিতা অর্জন করা বা ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকা এটা মনের ভিত্তিতে হতে পারে, আবার শরীয়াহ দ্বারা ঠিক করা হতে পারে যদি মানুষের মনকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে মানুষের পক্ষে সত্যিকারের উপযোগিতা খুজে বের করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে যাবে কারণ আমাদের মন সীমিত মানুষের মন তার সব প্রয়োজন ও বাস্তবতাকে ধারণ করতে পারে না সেকারণে সে তার জন্য সঠিক উপযোগিতা নির্ধারণ করতে সক্ষম নয়, যেহেতু কোন একটি জিনিস উপকারী না ক্ষতিকর এ বিষয়ের বাস্তবতাকে মানুষ সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারে না স্রষ্টা ব্যতীত আর কেউ মানুষের বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখে না কোনটা কীভাবে হলে মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হবেতা মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ব্যতীত আর কেউ নির্ধারণ করতে পারে না মানুষ হয়ত কোন একটি জিনিসকে তার জন্য উপকারী বা ক্ষতিকর মনে করতে পারে কিন্তু এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত জ্ঞানলাভ করতে পারবে না সেকারণে অনুমাননির্ভরতার উপর ভিত্তি করে কোনটি উপকারী-এ ব্যাপারে মনের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হলে তা বিপজ্জনক এবং মানুষের জন্য তা ধ্বংস নিয়ে আসে কোন কিছুকে হয়ত সে ক্ষতিকারক ভাবতে পারে কিন্তু পরে এটি তার জন্য উপকারী প্রমান হতে পারে সেক্ষেত্রে সে একটি ভাল জিনিসকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখল আবার কোন কিছুকে হয়ত সে ভাল ভাবতে পারে এবং পরে এটি ক্ষতিকারক বলে আবির্ভূত হতে পারে এবং এভাবে সে নিজের জন্য ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে আজকে মন যে জিনিসটাকে ক্ষতিকারক ভাবে আগামীদিন সেটিকেই উপকারী বলে রায় দিতে পারে অনুরূপে, আজকে যে জিনিসকে ক্ষতিকারক মনে হচ্ছে গতকাল হয়ত সেটি উপকারী ভাবা হয়েছিল এ ধরনের পরষ্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত দেয়া ঠিক নয় আর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থায় এ ধরনের পরিস্থিতি একটি স্বাভাবিক বিষয় আইন প্রণেতা হিসেবে মানুষ তার নিজের জন্য ভাল কিছু করার চেষ্টা করে সে কারণে আমরা দেখি সমস্যার সমাধানকল্পে ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নয়ন সাধনের জন্য পরিবর্তন ও সংশোধন হতেই থাকে কারণ হল, বাস্তবে তারা কোন জিনিস বা কাজের ক্ষেত্রে এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না, যা চূড়ান্ত ও সঠিক সে কারণে যাদের ব্যবস্থা সুদৃঢ় ও স্থির তাদেরকে তারা এর জন্য দোষারোপ করে কাফেরদের এ প্রবণতা দ্বারা আমরা মুসলিমদের আক্রান্ত হতে দেখি নিজেদের এবং দ্বীনের ব্যাপারে তখন তারা আত্মরক্ষামূলক হয়ে উঠে এবং ইসলামের প্রকৃতির ব্যাপারে তাদের চিন্তা সঠিক উপলদ্ধি থেকে অনেক দূরবর্তী হবার কারণে তারা ইসলামের শত্রুদের চিন্তার প্রক্রিয়াকে ধারণ করে ক্রমান্বয়ে তাদের নিকটবর্তী  হতে থাকে

স্রষ্টাই একমাত্র সত্ত্বা যিনি মানুষের বিষয়সমূহ বিবেচনায় আনতে পারেন এবং জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তি থেকে উদ্ভুত সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন এবং সঙ্গতভাবে এগুলো মেটাবার ব্যবস্থাপনা প্রদান করতে পারেন যেহেতু মানুষের এসব বাস্তবতা সুনির্দিষ্ট এবং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় না, সেহেতু সমাধানও অপরিবর্তনীয় ও সুনির্দিষ্ট একজন পুরুষ মানুষকে স্বাভাবিক প্রবণতার কারণেই একজন নারীর দ্বারস্থ হতে হয় যেহেতু মানব মানবীর অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তাগুলো পরিবর্তনশীল নয়, সেহেতু তাদের মধ্যকার সর্ম্পকও অপরিবর্তনীয় এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি আমরা মানব মানবীর সর্ম্পকের ক্ষেত্রে একটি ব্যবস্থাপনা প্রদান করি এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হবার পর উন্নয়নের সাথে সাথে তাদের বাস্তবতা পরিবর্তিত না হওয়া সত্ত্বেও সে ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করি

যেমন, মদের বাস্তবতা একই রকম আছে এবং এতে কোন পরিবর্তন হয়নি তাহলে এ ব্যাপারে হুকুম পরিবর্তন করা হবে কেন?

জুয়া খেলার বাস্তবতাও একই রকম ও অপরিবর্তনীয় আছে তাহলে এ ব্যাপারে হুকুম পরিবর্তন করার কারণ কি? এ ধরনের আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে

সেকারণে ক্রমউন্নয়ন’, ‘উদারতাএবং আধুনিকতা’-এগুলো হল মানবরচিত ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, যা সত্যের দিকে ধাবিত করে না তারা একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ক্রমাগত যেতে থাকে, যা একটি সঠিক ব্যবস্থার দিকে মানুষ নিজেকে পরিচালিত করবার যে ব্যর্থতা বা অক্ষমতা তাকেই প্রকাশ করে এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া একটি নিশ্চিত অক্ষমতা হওয়া সত্ত্বেও তারা একে ক্রমবিবর্তন বলে অভিহিত করে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐ মূলনীতিটি প্রত্যাখ্যান করা ঊচিত যা মানুষ শরঈ থেকে ঊদ্ভুত বলে দাবী করে, যাতে বলা হয় সময় এবং স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে হুকুমেরও পরিবর্তন ঘটবে এ মূলনীতিটি অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করা ঊচিত

সুতরাং কোন একটি বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হুকুম একটিই এবং তা একাধিক হতে পারে না যদি এর বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে বাস্তবতার পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐ হুকুমও পরিবর্তিত হয়ে যায় সেকারণে আঙ্গুর অনুমোদিত, কিন্তু যখন স্বীয় বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে তা মদে রূপান্তরিত হয়, তখন এ সম্পর্কিত হুকুম পরিবর্তিত হয়ে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় আবার যখন অ্যালকোহল ভিনেগারে রূপান্তরিত হয়, তখন তা অন্য একটি হুকুমে পরিবর্তিত হয়- অর্থাৎ অনুমোদিত হয় সুতরাং এখানে সময় বা স্থানের কোন বিবেচনা নেই এরকম কিছু নেই যা এক জায়গায় অনুমোদিত এবং অন্য জায়গায় নিষিদ্ধ অথবা উল্টো করে বললে কোন জায়গার নিষিদ্ধ কিছু, অন্য এক জায়গায় অনুমোদিত হতে পারে না শরঈ হুকুমের উপর সময় ও স্থানের কোন প্রভাব নেই

অতীতে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, বর্তমানে যে সমস্যাসমূহ দেখা দিচ্ছে বা ভবিষ্যতে যে সমস্যাগুলো হতে পারে, ইসলামী শরীয়াহ-র মধ্যে তার সবগুলোর সমাধানই রয়েছে এমন কোন ঘটনা ঘটতে পারে না বা সমস্যা হতে পারে না, যে বিষয়ে শরীয়াহ-র কোন হুকুম নেই ইসলামী শরীয়াহ মানুষের সব কাজকে পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিকভাবে বেষ্টন করে এ সর্ম্পকে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ

‘আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা (সূরা আন নাহলঃ ৮৯)

সুতরাং শরীয়াহ একটি বিষয় বা কাজের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে দলিলাদি দিয়েছে অথবা এ বিষয়ে আইনের জন্য ইল্লাহ বা ঐশী কারণ বিধৃত করেছে এ ইল্লাহ শরঈগত এবং কখনোই ইল্লাহ আকলিয়া বা প্রবৃত্তিপ্রসূত নয় এখানে আমাদের শরঈ ক্বিয়াস এবং আকলিয়াগত ক্বিয়াসের মধ্যে পার্থক্য উপস্থাপন করা প্রয়োজন

ক্বিয়াস আক্বলী (যুক্তির ভিত্তিতে ক্বিয়াস নির্ধারন)

আক্বল সাদৃশ্যতাপূর্ণ ও তুলনীয় বস্তু সর্ম্পকে একই ধরনের নিয়ম প্রদান করে সেকারণে এমন দুটি বিষয়ের মধ্যে স্বরূপতা আনা হয় যেগুলোর মধ্যে সাদৃশ্যতা রয়েছে এবং আক্বল ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম প্রদান করে

এ অবস্থা ক্বিয়াস শরীয়াহ-র সাথে সাংঘর্ষিক কারণ শরীয়াহ একই ধরনের বিষয়ে ভিন্ন ধরনের হুকুম প্রদান করেছে এবং ভিন্ন ধরনের বিষয়ে একই হুকুম প্রদান করেছে শরীয়াহ একই বিষয়কে দুভাবে দেখেছে, যেমনঃ দুটি ভিন্ন সময়কে লাইলাতুল ক্বদরকে অন্যান্য রাতের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে একই ধরনের স্থানকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছে, মক্কাকে মদীনার উপর এবং মদীনাকে অন্যান্য স্থানের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সালাতের ক্ষেত্রে চার রাকাআত এর নামাজ ও তিন রাকাআতের মধ্যে পার্থক্য করেছে - শরীয়াহ চার রাকআতকে ছোট করে দুই রাকআত করবার অনুমতি দিলেও তিন বা দুই রাকাআতকে সংক্ষিপ্ত করবার অনুমতি দেয়নি আক্বল এ ধরনের তুলনা করতে সক্ষম নয় বীর্য স্খলনের ক্ষেত্রে শরীয়াহ গোসলের বিধান দিয়েছে যদিও এটা পবিত্র অন্যদিকে মাজিহ বা বীর্য স্খলনপূর্ব তরল অপবিত্র হওয়া সত্ত্বেও এর নিঃসরণের পর ওযুর বিধান প্রদান করেছে, যদিও বীর্য ও মাজিহ একই স্থান হতে নিঃসৃত হয় তালাকপ্রাপ্ত নারীদের জন্য ইদ্দত বা অপেক্ষমান সময় তিন মাসিক চক্র করেছে, অন্যদিকে বিধবা নারীর জন্য তা চারমাস দশদিন, যদিও এক্ষেত্রে জরায়ুর অবস্থা একই থাকে পরিষ্কারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা পানি ও ধুলাকে একই মর্যাদা প্রদান করেছে, যদিও পানি ধুলা পরিষ্কার করে এটা ব্যভিচার, ধর্মত্যাগ ও হত্যার বদলে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে, যদিও তিনটি ভিন্ন ধরনের অপরাধ

এছাড়াও, শরীয়াহ এমন সব বিষয়ে হুকুম প্রদান করেছে, যে বিষয়ে আক্বলের ভিত্তিতে কিছু বলার নেই যেমনঃ এটা স্বর্ণের দ্বারা স্বর্ণ বিক্রিকে নিষিদ্ধ করেছে, যদি সমভাবে অথবা বাকীতে না হয় এটা ছেলেদের স্বর্ণ পরিধান করতে নিষেধ করেছে, কিন্তু মেয়েদের অনুমতি দিয়েছে একই কথা রেশমী কাপড়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এটা সুদকে হারাম করেছে এবং ব্যবসাকে করেছে হালাল এটা অসিয়তের সাক্ষী হিসেবে কাফেরদের অনুমোদন দিয়েছে কিন্তু আবার প্রত্যাহারকৃত তালাকের  ক্ষেত্রে এ শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে, সাক্ষী হতে হবে মুসলিম

এ কারণে আলী (রাঃ) বলেছেনঃ যদি দ্বীন কোন ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে করা হত, তাহলে মাসেহ করবার ক্ষেত্রে পায়ের উপরের চেয়ে নীচের অংশটিই বেশী পছন্দনীয় ছিল

সুতরাং যে দলটি ইসলামিক জীবনধারা ফিরিয়ে নিয়ে আসবার জন্য কাজ করছে তাদের অবশ্যই এই মূলনীতিগুলোকে বুঝতে হবে দলটি কীভাবে বাস্তবতা অনুধাবন করবে এবং তা তুলে ধরবে, এটা অবশ্যই দলটি বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে উপস্থাপন করবে, যাতে সদস্যগন বুঝতে পারে এটা অবশ্যই শরঈ উৎস ও উসুলী মূলনীতিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং গ্রহণ করবে ও শাবাবদের এর ভিত্তিতে বিকশিত করবে কারণ এসব মূলনীতির উপর ভিত্তি করে তাদের মনস্তত্বকে গঠন করতে হবে এটা বিকাশ প্রক্রিয়ারও অংশ হবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও উসুলী বিকাশ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা অপরিহার্য -যা ওহীর বিশুদ্ধতা ও চিন্তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং এমন বাহুল্যতাকে দূরীভূত করবে যা ওহীকে অস্পষ্ট করে তোলে, যেমনঃ এরকম মূলনীতি, এটা পরিত্যাজ্য নয় যে, সময় ও পাত্রভেদে হুকুম পরিবর্তন হয় এবং এর সার্বিক অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো প্রয়োজন হারামকে জায়েয করে এবং দ্বীন উদার ও বিবর্তনযোগ্য কিংবা যেখানে সুবিধা পরিলক্ষিত হয় সেটাই হলো আল্লাহর বিধান

কাজের সাথে সর্ম্পকযুক্ত শরঈ হুকুম গ্রহণ ও পালন, এগুলোকে নির্দেশনা ও আলোকিত চিন্তা হিসেবে গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই দলটি তার নিজস্ব উসুলের মধ্যে এগুলোকে গ্রহণ করবে, যা এর দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রন করবে ও শরীয়াহকে হৃদয়ঙ্গম করতে সহায়তা করবে এবং সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সুনিশ্চিত করবে

একটি ইস্যূতে একাধিক ইজতিহাদ থাকতে পারে বিতর্কিত ইস্যুগুলো থেকে দলিলের বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে দলটি তার জন্য শরঈ হুকুম গ্রহণ করবে এবং এগুলোর সাথে স্থির থাকবে এরপর দলটি তার উসুলী মূলনীতি ও ফুরু বা শাখা সম্বন্ধীয় মূলনীতি ঘোষণা করবে এর মাধ্যমে শাবাবদের বিকশিত করবে, জীবনকে এগিয়ে নিবে এবং এটা ব্যবহার করে আলোচনা করবে নিজে গ্রহণ করেছে বিধায় এটি দলীল ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অন্যদের তা গ্রহণের জন্য হৃদয় জয় করবে বিকাশ প্রক্রিয়া অনুসারে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করবে; অন্যথায় সে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে এবং পথিমধ্যে দিক হারিয়ে ফেলবে

সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় শরঈ হুকুম জানার আগে এ বিষয়ে শরঈর উৎস ও ঊসুল  অধ্যয়ন করতে হবে দলটি তার কাজ পরিচালনার সময় অনেক দূর্ভোগ ও জটিলতার সম্মুখীন হবে যদি এটা শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে নিষ্ঠার সাথে কোন উসুল গ্রহণ না করে, তাহলে এটি দোদুল্যমান হবে এবং গৃহীত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে ক্রমাগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে তারা বর্তমান দূষিত শাসনব্যবস্থার ভেতরে গিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, যা কিনা ছিল দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা ও প্রতিবন্ধক যখন তারা গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে, তখন বর্তমান ব্যবস্থার সাথে ইসলামী শুরা ব্যবস্থার সাদৃশ্যতা খুজে পায় পূর্ববর্তী নবীদের শরীয়াহ তাদের জন্যও শরীয়াহ -এ যুক্তিতে তারা পূর্ববর্তী নবীদের শরীয়াহ থেকে গ্রহণ করে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করে সঠিক শরঈ পদ্ধতি অনুসরণ না করবার কারণে, এভাবে ক্রমাগত পরিবর্তনের মত জটিলতায় উপনীত হয় অথবা দলটি এমনও দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহন করতে পারে যে, বিভিন্ন সংস্থা গঠন করে তারা বাস্তবতা পরিবর্তনের সুযোগ পাবে, ফলে পদ্ধতির বদলে উপায়ের চিন্তায় তাদের মন আচ্ছন্ন থাকে অথবা এমনকি তারা শরঈ পদ্ধতির অনুসরণ না করে অস্ত্রধারণ করতে পারে; কারণ বাস্তবতা তাদের সেদিকে ধাবিত করে

সুতরাং উসুল ও ঊৎস গ্রহণ এবং ইজতিহাদের নির্ধারিত পদ্ধতির অনুসরণের মাধ্যমে দলটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাঙ্খিত পথে অটল থাকবে এবং বাস্তবতা, পরিস্থিতি কিংবা স্বার্থ যেদিকে উদ্দীপিত করে সেদিকে ধাবিত হবে না

এভাবে দলটি আইনগত চিন্তার পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করবার পর এর কাজের পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করবে অন্যথায়, এটি বহুপথে বিচ্যুত হয়ে যাবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংস ডেকে আনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেন না

দলটি এর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণের উৎসকে সুনির্দিষ্ট করবার পর এইসব উৎস ও গৃহীত উসুলের ভিত্তিতে বিকাশের চিন্তাগুলোকে সংজ্ঞায়িত করবে

উৎস ও উসুল অধ্যয়নের ক্ষেত্রে দলটি অবশ্যই সুনিশ্চিত করবে যে, শরীয়াহ উপলদ্ধির ক্ষেত্রে দলটি অবিশুদ্ধ চিন্তা ও অন্য চিন্তার সাথে গুলিয়ে ফেলার মত ভুল থেকে মুক্ত ওহীকে অবিশুদ্ধ করে এমন সব কিছুকে দূরীভূত করবার জন্য এটা প্রচেষ্টা চালাবে এবং শরীয়াহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়াল খুশীর অনুগামী না হবার জোর প্রচেষ্টা চালাবে এবং মনকে বিধি-বিধান নিয়ন্ত্রনের কোন অনুমতি দিবে না উসুল এবং উৎস অধ্যয়ন ছাড়া দলীয় বিকাশের চিন্তাগুলোর চর্চা সম্ভব নয়

এরপর দলটিকে ফিরতে হবে ও অনুশীলন করতে হবে সেই বাস্তবতার প্রতি, যেখানে উম্মাহ বসবাস করে, যা পূর্বে উল্লেখ করেছি এইভাবে এটা বর্তমান চিন্তা, আবেগ ও ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করবে, যাতে বুঝতে পারে, এ সমস্ত চিন্তা ও ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগনের গ্রহনযোগ্যতা ও প্রতিক্রিয়া কতটুকু উম্মাহ কুফর চিন্তা দ্বারা আকর্ষিত, যেগুলোকে কাফেররা উম্মাহর স্বাস্থ্যের পূনরুদ্ধারের শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে রাজনৈতিকভাবে উম্মাহ পুতুল শাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যাদেরকে উপনিবেশবাদীরা মুসলিমদের উপর চাপিয়েছে, যাতে করে উম্মাহর সম্পদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করা যায় এবং যে কোন আন্তরিক কর্মকান্ড, যা তাদের উপনিবেশবাদীতাকে হুমকির মুখে ফেলবে তার প্রতিহত করা যায়দ্যাবধি পশ্চিমা কাফির উপনিবেশবাদীরা সচেতন যে কোন সামষ্টিক আন্দোলনের ব্যপারে যা তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখোমুখি করবে, তাই সে জনগনের মধ্যে সামষ্ঠিক বা দলীয় কর্মকান্ড সম্পর্কে দূরে রাখার চিন্তা ছড়ায় পরিবর্তে সে উৎসাহ প্রদান করে সমিতি মূলক কর্মকান্ডে যা চাক্রিক সমস্যার সমাধান দেয়, যেমনঃ দারিদ্র নিরসন ও মন্দ নৈতিকতা

পশ্চিমা কাফিররা মুসলিমদের তাদের দ্বীনই মানুষের সমস্যার একমাত্র সমাধান সেসম্পর্কে আত্নবিশ্বাসকেও সন্দিহান করে তুলেছে, যখন তারা (পশ্চিমা কাফিররা) আকীদাকে (মুসলিমদের) জীবন থেকে পৃথক করেছে, এই পৃথকীকরনই তাদের উপর বল প্রয়োগ করে চাপিয়ে দিয়েছে এবং তাদেরকে এ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার ক্ষেত্রেও বাধা দিচ্ছে

এজন্যই দলটি গভীর ও সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট উপায়ে বিরাজমান বাস্তবতা, চিন্তা, আবেগ এবং ব্যবস্থাসমূহ অধ্যয়নে বাধ্য এটা এই কারনে যে, যে ভূমির উপর সে দাড়িয়ে আছে সেই ভূমিটির প্রকৃতি, কেমন করে এর উপর সে হাটবে, বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কি কি হাতিয়ার প্রয়োজন, আর উর্বরতার জন্য কি কি জিনিস দরকার অথবা উর্বরতা ফিরিয়ে আনার জন্য কোন উপাদান প্রয়োজন, তা উপলদ্ধি করার জন্য তাই অবশ্যই প্রথমে একজনকে বাস্তবতা বুঝতে হবে এটা দলটির সংস্কৃতির (culture) গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে, কারন এটা দলটির নিকট পরিস্কার থাকতে হবে এবং এটা অবশ্যই শাবাব এবং জনগনের নিকট পরিস্কার থাকতে হবে যাতে তারা এ প্রসঙ্গে অজ্ঞ না থাকে এবং তারা এরপরে এর সমাধানের সঠিকতা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে

যে বাস্তবতায় উম্মাহ রয়েছে তার বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা অনুধাবনের পর, দলটিকে পূর্বোল্লিখিত উৎস ও উসুল অনুসরন করে চিন্তা, মতামত এবং শরঈ বিধানের দিকে অগ্রসর হতে হবে যে পদ্ধতিতে দলটি এ চিন্তা, মতামত ও শরঈ বিধানে (method) পৌছেছে তা শাবাব এবং জনগনের কাছে পরিস্কার থাকতে হবে কারণ এটাই দলটির শাবাবদের মধ্যে দৃঢ়বিশ্বাস, সচেতন মনোভাব এবং ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরী করবে গভীরভাবে, যা সাধারনভাবে উম্মাহর মাঝেও তৈরী হবে

No comments:

Post a Comment