23.1.15

উসুলি কা'ইদাহ "সকল বস্তুর 'আসল' হল ইবাহা" প্রয়োগ করে কি করে গনতন্ত্রকে জায়েয এবং খিলাফতকে ধ্বংস করা হয়েছিল

উসুলি কা'ইদাহ "সকল বস্তুর 'আসল' হল ইবাহা" প্রয়োগ করে কি করে গনতন্ত্রকে জায়েয এবং খিলাফতকে ধ্বংস করা হয়েছিল

যারাই বলে থাকেন ইসলামে ইবাদতের 'তউকিফি' (অর্থাৎ ওহী দ্বারা সুনির্দিষ্ট) ইস্যুগুলো ছাড়া বাকি সব *একশন (কাজ)* বাই ডিফল্ট মুবাহ বা হালাল, তারা ইসলামী আইনবিজ্ঞানের (উসুল আল ফিকহ) বিষয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে খুব ভয়ংকরভাবেই উম্মাহকে ভুল পথে চালিত করছেন। পর্যাপ্ত ধারণা না থাকায় আমাদের অনেকের মনে এটা গেঁথে গেছে (কিছু ভ্রান্ত প্রচারনার দ্বারা) কোন বিষয় যদি ইসলামের সাথে কনফ্লিক্ট না করে এবং ঐ ব্যাপারে কোন শারী’আহ-র নুসুস (দলীল) যদি না থাকে, তাহলেই তা মুবাহ বা হালাল। এই ভয়ংকর চিন্তার কারনেই মুসলিম উম্মাহকে ইসলামিক গণতন্ত্র”, “ইসলামিক সমাজতন্ত্র”, “সোশ্যাল জাস্টিসইত্যাদি কুফরি চিন্তা গলধঃকরণ করানো হয়েছিল। খিলাফত ধ্বংসের বিস্তারিত ইতিহাস নিয়ে যারা অবহিত নন, তারা এই বিষয়টিও হয়তো জানেন না যে, কাফেররা মুসলিম ভূমিগুলোকে বাইরে থেকে আক্রমণ পরে করেছিল। প্রথমে ভেতর থেকে ধ্বংস করা হয়েছিল কিছু ভ্রান্ত উসুলি কাইদাহ (নীতি) প্রয়োগ করে যার ভেতর ছিল এইটিও – “সকল কিছুই বাই ডিফল্ট মুবাহএই নীতির দ্বারা ঐ পশ্চিমা চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত মুসলিম পণ্ডিতরা বলা শুরু করেছিল যে রাজনীতি তউকিফি” (আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত) না এবং সব কাজই বাই ডিফল্ট হালাল এবং তা বলেই ফ্রেঞ্চ পেনাল কোড ও রোমান আইন এবং গণতন্ত্র মুসলিম খিলাফতে ঢোকানো হয়েছিল বিখ্যাত পণ্ডিতদের দ্বারা।

এক্ষেত্রে দেখা যায় যেসব ফকিহ বা উসুলিয়্যুন এই চিন্তার প্রচার-প্রসার ঘটান, তারা নীচের কাইদাহ (নীতি) টি সর্বদাই উল্লেখ করে থাকেনঃ

সব বস্তুর আসলবা অরিজিন হল ইবাহা (বা হালাল)” [আল আসলু ফিল-আশইয়া আল ইবাহা]

এখানে উল্লেখ্য ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা শুধু বস্তু/জিনিস (আশইয়া) এর ক্ষেত্রে এই কাইদাটি ব্যবহার করতেন (আফ'আল বা কাজের ক্ষেত্রে না)।  আল্লাহ (সুব.) কুর’আনে বলেছেনঃ

وَخَلَقَ لَكُمْ مَا في الأَرْضِ جَمِيعاً

এবং তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর বুকে যা আছে সবই সৃষ্টি করেছেন

আয়াতটিতে আল্লাহ বস্তুকে আম’ ভাবে উল্লেখ করেছেন তাই সকল বস্তু বাই ডিফল্ট হালাল এবং যেগুলো হারাম সেগুলো উল্লখে করা আছে।

কিন্তু সমস্যা হয় যখন বস্তুর (আশইয়া) সাথে একশন বা কাজ (আফআল)-কে মিশিয়ে ফেলে এই কাইদাহটি দ্বারা জাস্টিফাই করানো হয়। এটি একটি কমনসেন্স যে বস্তু আর একশন কখনই এক বিষয় হয় না। আমরা বলতে পারি না 'ছুরি' (বস্তু) আর ছুরি মারা’ (একশন) এক বিষয়। তাই অতীতে স্কলাররা প্রয়োজন বোধই করেননি এই নীতির ক্ষেত্রে বস্তুকে একশন থেকে আলাদা করে বোঝানোর। 

তাই আফআল (একশন) এর ক্ষেত্রে আসল’ (অরিজিন) হল

হুকুম আশ-শারঈর মাঝে নিজেদের কাজকে সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে শারী’আহ-র সাথে লেগে থাকা

তাই যদি আল্লাহ কোন কাজের জন্য ইবাহা (অনুমতি) দেয় তাহলে তা হবে মুবাহ আর যদি আমরা অনুমতি না দেখতে পাই তাহলে আদিল্লাহ আশ-শারিয়্যাহ” (শারী’আহর দলীল) থেকে হুকুম বের করে আনতে হবে। এটা বলার কোন সুযোগ নেই যেহেতু শারী’আহ এক্ষেত্রে এপারেন্টলি নীরব, তাই আমরা সেই একশন সমূহ পালন করতে পারবো।

যারা এই বস্তুর সাথে একশনকে মিলিয়ে দেখেন তারা আবার মুবাহ” (যা করলে কোন সাওয়াব বা গুনাহ নেই)-কে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তারা মনে করেন যেসব বিষয়ে শারী’আহ কোন তিরস্কার (হারাজ) করে না বা শারী’আহ নিশ্চুপ, সেগুলোই হল মুবাহ। তাই তিরস্কারের অনুপস্থিতিই হল অনুমতি” (ইবাহা)। তারা রাসুলের (সাঃ) কথাটি উল্লেখ করেনঃ

وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَفْو

এবং যে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা হয়েছে সেসব বিষয়ে মাফ করে দেয়া হয়েছে

এভাবেই নিকট অতীতের স্কলাররা গনতন্ত্রকে জায়েয করেছিল এই যুক্তিতে যে গণতন্ত্রও শুরা” (পরামর্শ) ও সামাজিক ন্যায় দ্বারা পরিচালিত এবং সকল বস্তুই যেহেতু বাই ডিফল্ট হালাল, তাই গণতন্ত্রও এডোপ্ট করা যাবে এবং বর্তমানেও অতীতের সেই বিষাক্ত চিন্তা অনেক স্কলাররাই বহন করছে।

তাই এটা জেনে নেয়া ভাল উসুল আল ফিকহের ক্লাসিক্যাল বইগুলোতে কোথাও বলা নেই কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে হারাজ (তিরস্কার) এর অনুপস্থিতিই হল অনুমতি” (ইবাহা), কারন কোন কাজ করা বা না করার ক্ষেত্রে হারাজ এর অনুপস্থিতি ইঙ্গিত বহন করে না যে ঐ কাজ বা বস্তুটি মুবাহ। আবার ব্যাপারটি এমনও না যে ঐ হারাজটিকে তুলে নেয়ার অর্থই হল অনুমতি তাই, কোন বিষয় মুবাহ হওয়ার অর্থ হল উক্ত বিষয়ে হুকুমদাতা (আল্লাহ) মানুষকে কোন কাজ করা বা না করার ক্ষেত্রে বাছাই করার অপশন দিয়েছেন এবং এই বাছাইয়ের অপশনটিও শারী’আহর দলীল দ্বারা সমর্থিত হতে হবে

যারা উপরে বর্ণিত হাদিসটির (এবং যে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা হয়েছে সেসব বিষয়ে মাফ করে দেয়া হয়েছে”) এভাবে ব্যাখ্যা দেন যে শারী’আহ কিছু বিষয়ে নিশ্চুপ রয়েছে তাই ওসব বিষয় মুবাহ, তারা হাদিসটির ভুল ব্যাখ্যা দেন। বিষয়টি এমন না যে শারী’আহ কোন ব্যাপার ব্যাখ্যা করে নাই এবং এই চিন্তা করাও পাপ কারন আল্লাহ বলেছেনঃ

“আজকে আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম... [সূরা আল-মায়িদাহঃ ৩]

আরো বলেছেনঃ

আমরা এই কিতাব নাযিল করেছি সবকিছুর ব্যাখ্যা দিয়েই [সূরা আন-নাহলঃ ৮৯]

তাই ওপরের হাদিসটিতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বোঝাতে চেয়েছেন সেসব টেক্সট গ্রহন করো যা তোমাদের দেয়া হয়েছে। আর যে বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি তা নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করো না কারন হয়তো তা আবার হারামও হয়ে যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেনঃ

ذَرُونِي مَا تَرَكْتُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ . فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَاجْتَنِبُوهُ . وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرِ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ

আমাকে চাপ দিও না সেসবের বাইরে কিছু বলতে যা আমি তোমাদের ইতিমধ্যেই বলেছি। তোমাদের আগে যারা এসেছিল তারা অতিরিক্ত প্রশ্ন করা এবং তাদের নবীদের সাথে বিতর্ক করার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি যদি তোমাদের কিছু করতে নিষেধ করি তাহলে তা থেকে দূরে থাক এবং যদি কিছু করার আদেশ দেই তাহলে তোমাদের সাধ্যমতো করার চেষ্টা করো [মুসলিম]

তাই মুল কথা হল ইসলামে এমন কিছু নাই যা শারী’আহ এক্সপ্লেইন করেনি। তাই কোন কিছু মুবাহ বলতে নিলেও আমাদের আগে দলীল ঘাটতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে শারী’আহ উক্ত বিষয়টিকে মুবাহ ঘোষণা দিয়েছে।  

আবার অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকেন নিউক্লিয়ার বোমা, উড়োজাহাজ তৈরি ইত্যাদি একশনগুলোর ক্ষেত্রে তো কোন শারী’আহ বিধান নেই। তাই এই কাজগুলো যদি আমরা ইবাহা ধরে করতে পারি, তাহলে কেন সকল কাজের আসল” (অরিজিন) এর ক্ষেত্রে আমরা একই কথা বলতে পারি না?  এই বিষয়ে ফুকাহাদের মত হল কিছু চিন্তা থাকে আকিদাহ এবং আহকাম সংক্রান্ত এবং কিছু থাকে উলুম (বিজ্ঞান), মাদানিয়্যাহ (প্রযুক্তি), উদ্ভাবন/উৎপাদন, দক্ষতা ইত্যাদি সংক্রান্ত। তাই দ্বিতীয় বিষয়ের (যেগুলো আকিদাহ বা আহকাম সংক্রান্ত নয়) ক্ষেত্রে যদি শারী’আহ দ্বারা নিষেধকারী কোন দলীল না থাকে, তাহলে তা গ্রহন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একবার কিছু কৃষক এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাদের বললেনঃ 

أَنْتُمْ أَدْرَى بِأُمورِ دُنْيَاكُمْ

তোমরা দুনিয়ার বিষয়ে আমার চেয়ে অধিক সচেতন

বদরের যুদ্ধের সময় সাহাবা আল-হুব্বাব বিন আল-মুনযির (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে যুদ্ধ-কৌশল সংক্রান্ত এক প্রশ্ন করেছিল। রাসুলের পরিকল্পনাটি কি ওহী ছিল নাকি রাসুলের নিজস্ব মতামত ছিল তা ঐ সাহাবা জানতে চেয়েছিল, উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেনঃ

بَلْ هُوَ الرَّأْيُ وَالحَرْبُ وَالمَكِيدَة

অবশ্যই এটা আমার মতামত, যুদ্ধবিগ্রহ ও ধূর্ত (বিষয়ের ক্ষেত্রে)

ঐ সাহাবার পরামর্শে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করেছিলেন। কারন তা ওহী ছিল না। তাই নন-আহকাম/আকিদার বিষয়ের আসলএর ক্ষেত্রে ইবাহা (অনুমতি) আছে যদি কোন বিপরীত টেক্সট আমরা না পাই শারী’আহতে। কিন্তু গণতন্ত্র সরাসরি আকিদাহ বিরোধী।  

মোদ্দা কথাঃ সকল বস্তু বাই ডিফল্ট হালাল এবং সকল একশন এর ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের শারী’আহ দ্বারা সীমাবদ্ধ রাখতে হবেকোনভাবেই বস্তুর সাথে একশনকে এক করে দেখলে হবে না। কারন একশনের ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেনঃ

وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

“এবং আল্লাহর রাসুল যা কিছু তোমাদের জন্য এনেছেন তা গ্রহন করো এবং যেসব থেকে দূরে থাকতে বলেছেন তা পরিত্যাগ করো” [সূরা আল-হাশরঃ ৭]

তাই ওপরের আয়াতের 'তালাব' (আবেদন) টিতে যে 'মাআ' (যা কিছু) শব্দটি এসেছে তা 'আম' আকারে এসেছে এবং এই তালাব হোক সেটা "তালাব উত তারক" (কোন কাজ পরিত্যাগ করার আবেদন) বা তালাব উল ফি' (কোন কিছু করার আবেদন) হল তালাব জাযিম (সুনির্দিষ্ট আবেদন) যা মেনে চলা ফরয। তাই সকল একশনের ক্ষেত্রে খুজতে হবে শারী’আহর নুসুস (দলীল) কি বলছে। এটাই হল আফ'আল এর ক্ষেত্রে 'আসল'


***লেখকঃ ইমতিয়াজ সেলিম

No comments:

Post a Comment