30.12.14

আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.)

আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.)

নাম আবুল ফজল আব্বাস। পিতা আবদুল মুত্তালিব, মাতা নাতিলা, মতান্তরে নাসিলা বিনত খাব্বাব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা। তবে দুজন ছিলেন প্রায় সমবয়সী। ঐতিহাসিকদের ধারণা, সম্ভবতঃ তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দুই বা তিন বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ছোট বেলায় একবার তিনি হারিয়ে যান। মা মান্নত মানেন, আব্বাস ফিরে এলে কাবায় রেশমী গিলাফ চড়াবেন। কিছুদিন পর তিনি সহি-সালামতে ফিরে এলে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে আবদুল মুত্তালিব তাঁর মান্নত পুরা করেন।

জাহিলী যুগে তিনি ছিলেন কুরাইশদের একজন প্রতাপশালী রঈস। পুরুষানুক্রমে খানায়ে কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব লাভ করেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নবুওয়্যাত লাভ করলেন। মক্কায় প্রকাশ্যে তিনি তাওহীদের দাওয়াত দিতে লাগলেন। হযরত আব্বাস যদিও দীর্ঘদিন যাবত প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেননি, তবে তিনি এ দাওয়াতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ কারণে মদীনার বাহাত্তর জন্য আনসার হজ্জের মওসুমে মক্কায় গিয়ে মিনার এক গোপন শিবিরে যে দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মদীনায় হিজরাতের আহ্বান জানান এবং তাঁর হাতে বাই’আত গ্রহণ করেন, সেই গোপন বৈঠকেও হযরত আব্বাস উপস্থিত ছিলেন। তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। ইতিহাসে এ বাই’আতকে আকাবার দ্বিতীয় শপথ বলা হয়। এ উপলক্ষে তিনি উপস্থিত মদীনাবাসীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেনঃ খাযরাজ কাওমের লোকেরা! আপনাদের জানা আছে, মুহাম্মাদ (সাঃ) স্বীয় গোত্রের মধ্যে সম্মান ও মর্যাদার সাথেই আছেন। শত্রুর মুকাবিলায় সর্বক্ষণ আমরা তাঁকে হিফাজত করেছি। এখন তিনি আপনাদের নিকট যেতে চান। যদি আপনারা জীবন পণ করে তাঁকে সহায়তা করতে পারেন তাহলে খুবই ভালো কথা। অন্যথায় এখনই সাফ সাফ বলে দিন।জবাবে মদীনাবাসীগণ পরিপূর্ণ সহায়তার আশ্বাস দান করেন। এর অল্পকাল পরেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরাত করেন।

মক্কার কুরাইশদের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে তিনি কুরাইশ বাহিনীর সংগে বদর যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবহিত ছিলেন, এ কারণে তিনি সাহাবীদের নির্দেশ দিয়েছিলেনঃযুদ্ধের সময় আব্বাস বা বনু হাশিমের কেউ সামনে পড়ে গেলে তাদের হত্যা করবে না। কারণ, জোরপূর্বক তাদের রণক্ষেত্রে আনা হয়েছে।

বদর যুদ্ধে অন্যান্য কুরাইশ মুশরিকদের সাথে আব্বাস, আকীল ও নাওফিল ইবন হারিস মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। ঘটনাক্রমে, আব্বাসকে এত শক্তভাবে বাঁধা হয় যে, ব্যথায় তিনি কোঁকাতে থাকেন। তাঁর সে কোঁকানি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর রাতের আরামে বিঘ্ন ঘটায়। একথা সাহাবায়ে কিরাম অবগত হলে তাঁরা আব্বাসের বাঁধন ঢিলা করে দেন। আব্বাস কোঁকানি বন্ধ করে দিলেন। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘কোঁকানি শোনা যায় না কেন?’ বলা হলোঃ ‘বাঁধন ঢিলা করে দেওয়া হয়েছে। তখুনি রাসূল (সাঃ) নির্দেশ দিলেন সকল বন্দীর বাঁধন ঢিলা করে দাও।

বদরের যুদ্ধবন্দীদের কাছে অতিরিক্ত কাপড় ছিল না। রাসূল (সাঃ) সকলকে পরিধেয় বস্ত্র দিলেন। হযরত আব্বাস ছিলেন দীর্ঘদেহী। কোন ব্যক্তির জামা তাঁর গায়ে লাগছিল না। আব্বাসের মত দীর্ঘদেহী ছিল মুনাফিক আবদুল্লাহ বিন উবাই। সে একটি জামা আব্বাসকে দান করে। এ কারণে মুনাফিক হওয়া সত্ত্বেও আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের মৃত্যুর পর পুত্রের অনুরোধে রাসূল (সাঃ) নিজের একটি জামা তার লাশের গায়ে পরানের জন্য দান করেন। এভাবে তিনি চাচার প্রতি কৃত ইহসান পরিশোধ করেন।

বদর যুদ্ধের কয়েদীদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আব্বাসের জননী ছিলেন মদীনার আনসার-গোত্র খাযরাজের কন্যা। এ কারণে এ গোত্রের লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট নিবেদন করলো, আব্বাস আমাদের ভাগ্নে। আমরা তাঁর মুক্তিপণ মাফ করে দিচ্ছি। কিন্তু সাম্যের পরিপন্থী হওয়ায় এ প্রস্তাব আল্লাহর রাসূলের নিকট গ্রহণযোগ্য হলো না। পক্ষান্তরে আব্বাস সম্পদশালী ব্যক্তি হওয়ার কারণে রাসূল (সাঃ) তাঁর নিকট মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবী করেন। আব্বাস এত বেশী অর্থ আদায়ে অক্ষমতা প্রকাশ করে বলেনঃ ‘অন্তর থেকে আমি আগেই মুসলমান হয়েছিলাম। মুশরিকরা এ যুদ্ধে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করেছে।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ ‘অন্তরের অবস্থা আল্লাহ জানেন। আপনার দাবী সত্য হলে আল্লাহ তার বিনিময় দেবেন। তবে বাহ্যিক অবস্থার বিচারে আপনাকে কোন প্রকার সুবিধা দেওয়া যাবে না। আর মুক্তিপণ আদায়ে আপনার অক্ষমতাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আমি জানি, মক্কায় উম্মুল ফজলের নিকট আপনি মোট অংকের অর্থ রেখে এসেছেন।’ বিস্ময়ের সাথে আব্বাস বলে উঠলেনঃ ‘আল্লাহর কসম, আমি ও উম্মুল ফজল ছাড়া আর কেউ এ অর্থের কথা জানে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আপনি আল্লাহর রাসূল।’ অতঃপর তিনি নিজের, ভ্রাতুষ্পুত্র আকীল ও নাওফিল ইবন হারিসের পক্ষ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে মুক্তি লাভ করেন।

আব্বাসের একটা দীর্ঘ সময় মক্কায় অবস্থান এবং প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা না দেওয়ার পশ্চাতে এক বিশেষ কারণ ছিল। তিনি সবসময় মক্কা থেকে কাফিরদের গতিবিধি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অবহিত করতেন। তাছাড়া মক্কায় যেসব দুর্বল ঈমানের মুসলিম তখনো অবস্থান করছিল, তিনি ছিলেন তাদের ভরসাস্থল। এ কারণে একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট হিজরাতের অনুমতি চাইলে তাঁকে এই বলে বিরত রাখেন যে, ‘আপনার মক্কায় অবস্থান করা শ্রেয়। যেভাবে আল্লাহ আমার উপর নবুওয়্যাত সমাপ্ত করেছেন, তেমনি আপনার উপর হিজরাত সমাপ্ত করবেন।

মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে হযরত আব্বাস হিজরাতের অনুমতি লাভ করেন। সপরিবারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর খিদমতে হাজির হয়ে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং স্থায়ীভাবে মদীনায় বসবাস শুরু করেন। তিনি মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হুনাইন অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে একই বাহনে আরোহী ছিলেন। তিনি বলেনঃ “এ যুদ্ধে কাফিরদের জয় হলো এবং মুসলিম মুজাহিদরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো। রাসূল (সাঃ) বললেনঃআব্বাস, তীরন্দাজদের আওয়ায দাও।স্বভাবগতভাবেই আমি ছিলাম উচ্চকণ্ঠ। আহ্বান জানালামঃ ‘আইনা আসহাবুল সুমরা- তীরন্দাজরা কোথায়?’ আমার এই আওয়াযে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।” তায়েফ অবরোধ, তাবুক অভিযান এবং বিদায় হজ্জেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।

বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর রাসূল (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিন দিন অসুস্থতা বাড়তে থাকে। হযরত আলী, হযরত আব্বাস ও বনী হাশিমের অন্য লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সেবার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ওফাতের দিন হযরত আলী বাড়ীর বাইরে এলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অবস্থা কেমন?’ যেহেতু সে দিন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, এ কারণে তিনি বললেনঃ আল্লাহর অনুগ্রহে একটু ভালো।কিন্তু হযরত আব্বাস ছিলেন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি আলীর একটি হাত ধরে বললেনঃ তুমি কী মনে করেছো?’ আল্লাহর কসম, তিন দিন পরেই তোমরা গোলামী করতে শুরু করবে। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি এ রোগেই অল্প দিনের মধ্যেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইনতিকাল করবেন। আমি আবদুল মুত্তালিব খান্দানের লোকদের চেহারা দেখেই তাদের মৃত্যু আন্দাজ করতে পারি।

ঐ দিন রাসূল (সাঃ) ইনতিকাল করেন। হযরত আলী ও বনী হাশিমের অন্যান্যদের সহযোগিতায় হযরত আব্বাস কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সম্মানিত চাচা এবং বনী হাশিমের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, এ কারণে বহিরাগত লোকেরা তাঁর নিকট এসে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করতে থাকে।

হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) চাচা আব্বাসকে খুব সম্মান করতেনতাঁর সামান্য কষ্টতেও তিনি দারুণ দুঃখ পেতেন। একবার কুরাইশদের একটি আচরণ সম্পর্কে হযরত আব্বাস অভিযোগ করলে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললেনঃ সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন! যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের জন্য আপনাদের ভালবাসেনা তার অন্তরে ঈমানের নূর থাকবে না।

একবার রাসূল (সাঃ) এক বৈঠকে আবু বকর ও উমারের (রা.) সাথে কথা বলছিলেন। এমন সময় আব্বাস উপস্থিত হলেন। রাসূল (সাঃ) তাঁকে নিজের ও আবু বকরের মাঝখানে বসালেন এবং কণ্ঠস্বর একটু নীচু করে কথা বলতে লাগলেন। আব্বাস চলে যাওয়ার পর আবু বকর (রা.) এমনটি করার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ মর্যাদাবান ব্যক্তিই পারে মর্যাদাবান ব্যক্তির মর্যাদা দিতে।তিনি আরো বলেনঃ জিবরাঈল আমাকে বলেছেন, আব্বাস উপস্থিত হলে আমি যেন আমার স্বর নিচু করি, যেমন আমার সামনে তোমাদের স্বর নিচু করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন।

হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) এর পর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীন হযরত আব্বাসের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। হযরত উমার ও হযরত উসমান (রা.) ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে তাঁর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁর সম্মানার্থে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন এবং বলতেনঃ ইনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা।হযরত আবু বকর (রা.) একমাত্র আব্বাসকেই নিজে আসন থেকে সরে গিয়ে স্থান করে দিতেন।

হযরত আব্বাস ৩২ হিজরীর রজব/মুহাররম মাসের ১২ তারিখ ৮৮ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা.) জানাযার নামায পড়ান এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) কবরে নেমে তাঁকে সমাহিত করেন। মদীনার বাকী গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ৩২ বছর এবং জাহিলী যুগে ৫৬ বছর জীবন লাভ করেন।

জাহিলী যুগে হযরত আব্বাস (রা.) অত্যন্ত সম্পদশালী ছিলেন। এ কারণে বদর যুদ্ধের সময় রাসূল (সাঃ) তাঁর নিকট থেকে মুক্তিপণ স্বরূপ বিশ উকিয়া স্বর্ণ গ্রহণ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাঁর জীবিকার উৎস। সুদের কারবারও করতেন। মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এ কারবার চালু ছিল। দশম হিজরীর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ আজ থেকে আরবের সকল প্রকার সুদী কারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং সর্বপ্রথম আমি আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিবের সুদী কারবার রহিত ঘোষণা করছি।

সুদের কারবার বন্ধ হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) গণীমতের এক পঞ্চমাংশ ও ফিদাক বাগিচার আমদানী থেকে তাঁকে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাতের পর তিনি ও হযরত ফাতিমা প্রথম খলীফার নিকট রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উত্তরাধিকার দাবী করেন। নবীরা কোন উত্তরাধিকার রেখে যান না- এ সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহর (সাঃ) একটি বাণী হযরত আবু বকরের (রা.) মুখ থেকে শোনার পর তাঁরা নীরব হয়ে যান।

হযরত আব্বাস ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। অতিথি পরায়ণ ও দয়ালু। হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াককাস (রা.) বলেনঃ আব্বাস হলেন আল্লাহর রাসূলের চাচা, কুরাইশদের মধ্যে সর্বাধিক দরাজ হস্ত এবং আত্মীয় স্বজনের প্রতি অধিক মনোযোগীতিনি ছিলেন কোমল অন্তর বিশিষ্ট। দুর জন্য হাত উঠালেই চোখ থেকে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেত। এ কারণে তাঁর দুআয় এক বিশেষ আছর পরিলক্ষিত হতো।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্বাস (রা.) ও তাঁর সন্তানদের জন্য দু’আ করেছেন। তিনি তাঁদের সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অপরাধের মাগফিরাত কামনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে বহু সাহাবী ও তাবেয়ী হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হযরত আব্বাসের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। হুনাইন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তিনি একটি কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। তার কয়েকটি পংক্তি আল-ইসতিয়াবও ইবন ইসহাকের সীরাত গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।

হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.)

হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.)

নাম তাঁর হামযা, আবু ইয়ালা ও আবু আম্মারা কুনিয়াত এবং আসাদুল্লাহ উপাধি। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আপন চাচা। হযরত হামযার জননী হালা বিনত উহাইব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জননী হযরত আমিনার চাচাতো বোন। তাছাড়া হামযা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দুধ ভাই। আবু লাহাবের দাসী সুওয়াইবাতাঁদের দুজনকে দুধ পান করিয়েছিল। বয়সে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অপেক্ষা দুবছর মতান্তরে চার বছর বড়। ছোট বেলা থেকেই তরবারি চালনা, তীরন্দাযী ও কুস্তির প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ভ্রমণ ও শিকারে ছিল তাঁর সীমাহীন আকর্ষণ। জীবনের বিরাট এক অংশ তিনি এ কাজে ব্যয় করেন।

বেশ কিছুকাল যাবত মক্কার অলি গলিতে তাওহীদের দাওয়াত উচ্চারিত হচ্ছিলো। তবে হামযার মত সিপাহী-স্বভাব মানুষের এ দাওয়াতের প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না।

একদিন তিনি শিকার থেকে ফিরছিলেন। সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি এলে আবদুল্লাহ ইবন জুদ’আনের এক দাসী তাঁকে ডেকে খবরটি দিল। বললোঃ আবু আম্মারা, ইস্‌, কিছুক্ষণ আগে এসে আপনার ভাতিজার অবস্থা যদি একটু দেখতেন! তিনি কাবার পাশে মানুষকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু জাহল তাঁকে শক্ত গালি দিয়েছে, ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ কোন প্রত্যুত্তর না করে নিতান্ত অসহায়ভাবে ফিরে গেছে।একথা শুনে তাঁর সৈনিকসুলভ রক্ত টগবগ করে উঠলো। দ্রুত তিনি কাবার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল, শিকার থেকে ফেরার পথে কারো সংগে সাক্ষাৎ হলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সংগে দু-চারটি কথা বলা। কিন্তু আজ তিনি প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মাদ হয়ে পড়লেন। রাস্তায় কারো দিকে কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা কাবার কাছে গিয়ে আবু জাহলের মাথায় ধনুক দিয়ে সজোরে এক আঘাত বসিয়ে দিরেন। আবু জাহলের মাথা কেটে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে বনু মাখযুমের কিছু লোক আবু জাহলের সাহায্যে ছুটে এলো। তারা বললোঃ হামযা, সম্ভবতঃ তুমি ধর্মত্যাগী হয়েছো।জবাবে বললেনঃ যখন তার সত্যতা আমার নিকট প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখন তা থেকে আমাকে বিরত রাখবে কে? হ্যাঁ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। যা কিছু তিনি বলেন সবই সত্যি। আল্লাহর কসম আমি তা থেকে আর ফিরে আসতে পারিনে। যদি তোমরা সত্যবাদী হও, আমাকে একটু বাধা দিয়েই দেখ।আবু জাহল তার সাহায্যে এগিয়ে আসা লোকদের বললোঃ তোমরা আবু আম্মারকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম, কিছুক্ষণ আগেই আমি তাঁর ভাতিজাকে মারাত্মক গাল দিয়েছি।

পরবর্তীকালে হযরত হামযা বলেছেন, আমি ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলি তো বলে ফেললাম; কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ ও গোত্রের ধর্মত্যাগের জন্য আমি অনুশোচনায় দগ্ধিভূত হতে লাগলাম। একটা সন্দেহ ও সংশয়ের আবর্তে পড়ে সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। কাবায় এসে অত্যন্ত বিনীতভাবে আল্লাহর কাছে দু’আ করলাম, যেন আমার অন্তর-দুয়ার সত্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়, অন্তর থেকে সংশয় বিদূরিত হয়। দু’আর পর আমার অন্তর দৃঢ় প্রত্যয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে আমার অবস্থা বর্ণনা করলাম। তিনি আমার অন্তরের স্থিতির জন্য দু’আ করলেন।

এটা মুসলমানদের সেই দুঃসময়ের কথা যখন রাসূল (সাঃ) আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে আশ্রয় নিয়ে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। মুসলমান বলতে তখন ছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু নিরাশ্রয় মানুষ। এ অবস্থায় আকস্মিকভাবে হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণে অবস্থা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মু’মিনদের সাথে কাফিরদের অহেতুক বাড়াবাড়ি ও বেপরোয়াভাব অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তাঁর দুঃসাহস ও বীরত্বের কথা মক্কার প্রতিটি লোকই জানতো।

হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের পর একদিন হযরত উমার (রাঃ) তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দানের জন্য গেলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট। তিনি তখন হযরত আরকামের গৃহে কতিপয় সাহাবীর সাথে অবস্থান করছেন। হযরত হামযাও তখন সেখানে। হযরত উমার ছিলেন সশস্ত্র। তাঁকে দেখেই উপস্থিত সকলে প্রমাদ গুণলো। কিন্তু হযরত হামযা বলে উঠলেনঃ তাকে আসতে দাও। যদি সে ভালো উদ্দেশ্যে এসে থাকে, আমরাও তার সাথে ভালো ব্যবহার করবো। অন্যথায় তারই তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করা হবে।হযরত উমার ভেতরে ঢুকেই কালেমা তাওহীদ পাঠ করতে শুরু করেন। তখন উপস্থিত মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। এই দুই মনীষীর ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। মক্কার মুশরিকরা উপলব্ধি করে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর গায়ে আঁচড় কাটা আর সহজ হবে না।

মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর প্রিয় খাদেম যায়িদ ইবন হারিসার সাথে হামযার ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। যায়িদের প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা এত প্রগাঢ় হয় যে, যখন তিনি বাইরে কোথাও যেতেন তাঁকেই সব ব্যাপারে অসীয়াত করে যেতেন।

নবুওয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরে আরো অনেকের সংগে হযরত হামযাও মদীনায় হিজরাত করলেন। এখানে তাঁর খোদা প্রদত্ত শক্তি ও সাহসিকতা প্রকাশ করার বাস্তব সুযোগ এসে যায়।

হিজরাতের সপ্তম মাসে রাসূল (সাঃ) ঈসঅঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দিকে তিরিশ সদস্যের মুহাজিরদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠান। উদ্দেশ্য, কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। এ বাহিনীতে আনসারদের কেউ ছিল না। এখানে তাঁরা সমুদ্র উপকূলে আবু জাহলের নেতৃত্বে মক্কার তিনশো অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হন। তারা সিরিয়া থেকে ফিরছিল। কিন্তু মাজদী ইবন আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় এ যাত্রা সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়। মাজদীর সাথে দুপক্ষের সন্ধিচুক্তি ছিল। মদীনা থেকে যাত্রার প্রাক্কালে রাসূল (সাঃ) হযরত হামযার হাতে ইসলামী ঝাণ্ডা তুলে দেন। ইবন আবদিল বারসহ কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, এটাই ছিল রাসূল (সাঃ) কর্তৃক কোন মুসলমানের হাতে তুলে দেওয়া প্রথম ঝাণ্ডা। (সীরাত ইবন হিশাম)

দ্বিতীয় হিজরীর সফর মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে ষাট জন সশস্ত্র সাহাবী নিয়ে কুরাইশদের বাণিজ্য চলাচল পথে আবওয়াঅভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা ছিলেন পতাকাবাহী এবং গোটা বাহিনীর কমাণ্ডও ছিল তাঁর হাতে। মুসলিম বাহিনী পৌঁছার আগেই কুরাইশ কাফিলা অতিক্রম করায় এ যাত্রাও কোন সংঘর্ষ ঘটেনি। এমনিভাবে হিজরী দ্বিতীয় সনের উশায়রাঅভিযানেও হযরত হামযা মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর গৌরব লাভ করেন।

হিজরী দ্বিতীয় সনে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। রণক্ষেত্রে উভয়পক্ষ কাতারবন্দী হওয়ার পর কুরাইশ পক্ষের উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ সারি থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম বাহিনীর কাউকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। দ্বীনের সিপাহীদের মধ্য থেকে তিনজন আনসার জওয়ান তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু উতবা চিৎকার করে বলে উঠেঃ মুহাম্মাদ, আমাদের সমকক্ষ লোকদের পাঠাও। এসব অনুপযুক্ত লোকদের সাথে আমরা লড়তে চাই না।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আদেশ দিলেনঃ ‘হামযা, আলী ও উবাইদা ওঠো, সামনে এগিয়ে যাও।তাঁরা শুধু আদেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। এ তিন বাহাদুর আপন আপন নিযা ও বর্শা নিয়ে তাঁদের প্রতিপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রথম আক্রমণেই হযরত হামযা জাহান্নামে পাঠালেন উতবাকে। হযরত আলীও বিজয়ী হলেন তাঁর প্রতিপক্ষের ওপর। কিন্তু আবু উবাইদা ও ওয়ালিদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধস্তাধস্তি চলতে লাগলো। অতঃপর আলীর সহযোগিতায় আবু উবাইদা তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। শত্রুপক্ষের এ বেগতিক অবস্থা দেখে তুয়াইমা ইবন আদী তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। হামযার সহযোগিতায় আলী (রাঃ) তরবারির এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। এরপর মুশরিক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। মুসলিম মুজাহিদরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন। তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধে হযরত হামযা পাগড়ীর ওপর উটপাখির পালক গুঁজে রেখেছিলেন। এ কারণে যে দিকে তিনি যাচ্ছিলেন সুস্পষ্টভাবে তাকে দেখা যাচ্ছিল। দুহাতে বজ্রমুষ্টিতে তরবারি ধরে বীরত্বের সাথে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ করে দিচ্ছিলেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) দুশমনরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। ‍উমাইয়্যা ইবন খালাফ হযরত আবদুর রহমান ইবন আউফকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ ‘উটপাখির পালক লাগানো এ লোকটি কে?’ তিনি যখন বললেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা হামযা’, তখন সে বলেছিলঃ এ ব্যক্তিই আজ আমাদের সবচেয়ে বেশী সর্বনাশ করেছে।

মদীনার উপকণ্ঠেই ছিল ইয়াহুদী গোত্র বনু কাইনুকার বসতি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আসার পর তাদের সাথে একটি মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভে তাদের হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ চুক্তি ভংগের কারণে রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালন করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা পতাকাবাহীর দায়িত্ব পালন করেন।

বদরের শোচনীয় পরাজয়ে কুরাইশদের আত্নাভিমান দারুণভাবে আহত হয়। প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত বিশাল কুরাইশ বাহিনী হিজরী তৃতীয় সনে মদীনার দিকে ধাবিত হলো। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সংগীদের নিয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের গতিরোধ করেন। শাওয়াল মাসে যুদ্ধ শুরু হয়। কাফিরদের পক্ষ থেকে সিবানামক এক বাহাদুর সিপাহী এগিয়ে এসে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্‌বান জানায়। হযরত হামযা কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে ময়দানে এসে হুংকার ছেড়ে বললেনঃ ‘ওরে উম্মে আনমারের অপবিত্র পানির সন্তান, তুই এসেছিস আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়তে?’ এ কথা বলে তিনি এমন প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন যে, এক আঘাতেই সিবার কাজ শেষ। তারপর সর্বাত্মক ‍যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হযরত হামযার ক্ষিপ্র আক্রমণে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ হয়ে গেল। এ যুদ্ধে তিনি একাই তিরিশ জন কাফির সৈন্যকে হত্যা করেন।

যেহেতু হযরত হামযা বদর যুদ্ধে কুরাইশদের বাছা বাছা নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছিলেন, এ কারণে কুরাইশদের সকলেই তাঁরই খুনের পিয়াসী ছিল সবচেয়ে বেশী। হযরত হামযার হত্যাকারী ওয়াহশী উহুদ ময়দানে হামযার হত্যা ঘটনাটি পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন। ইবন হিশাম তাঁর সীরাতগ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন। ওয়াহশী বলেনঃ আমি ছিলাম জুবাইর ইবন মুত’ঈমের এক হাবশী ক্রীতদাস। বদর যুদ্ধে জুবাইরের চাচা তুয়াইম ইবন আদী হামযার হাতে নিহত হয়। মক্কায় ফিরে জুবাইর আমাকে বললোঃ ‘যদি তুমি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করে আমার চাচার হত্যার বদলা নিতে পার, আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। আমাকে সে বিশেষভাবে ট্রেনিং দিল। আমি শুধু হামযাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই উহুদের দিকে রওয়ানা হলাম। যুদ্ধ শুরু হলো। একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে হামযার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমার কাছাকাছি উপস্থিত হলে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করলাম। তারপর আমার স্বপক্ষ সৈন্যদের নিকট ফিরে এসে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলাম। যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করলাম না। কারণ, আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি মক্কায় ফিরে এলে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এ মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি। হযরত হামযার বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি।

হযরত হামযার শাহাদাত লাভের পর কুরাইশ রমণীরা আনন্দ সংগীত গেয়েছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনত উতবা হামযার নাক-কান কেটে অলংকার বানিয়েছিল, বুক, পেট চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। একথা শুনে রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ ‘সে কি তার কিছু অংশ খেয়েও ফেলেছে?’ লোকেরা বলেছিলঃ ‘না।’ তিনি বলেছিলেনঃ ‘হামযার দেহের কোন একটি অংশও আল্লাহ জাহান্নামে যেতে দেবেন না।’

যুদ্ধ শেষে শহীদের দাফন-কাফনের পালা শুরু হলো। রাসুল (সাঃ) সম্মানিত চাচার লাশের কাছে এলেন। যেহেতু হিন্দা তাঁর নাক-কান কে বিকৃত করে ফেলেছিল, তাই এ দৃশ্য দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেনঃ ‘কিয়ামাতের দিন হামযা হবে সাইয়্যেদুশ শুহাদাবা সকল শহীদের নেতা। তিনি আরো বললেনঃ ‘তোমার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার জানামতে তুমি ছিলে আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে অধিক সচেতন, অতিশয় সৎকর্মশীল। যদি সাফিয়্যার শোক ও দুঃখের কথা আমার মনে না থাকতো তাহলে এভাবেই তোমাকে ফেলে রেখে যেতাম, যাতে পশু-পাখী তোমাকে খেয়ে ফেলতো এবং কিয়ামাতের দিন তাদের পেট থেকে আল্লাহ তোমাকে জীবিত করতেন। আল্লাহর কসম, তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমার ওপর ওয়াজিব। আমি তাদের সত্তর জনকে তোমার মত নাক-কান কেটে বিকৃত করবো।রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এ কসমের পর জীবরাঈল (আ.) সূরা নাহলের নিম্নোক্ত আয়াত দুটি নিয়ে অবতীর্ণ হলেনঃ

যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঠিক ততখানি করবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্যধারণ করলে, ধৈর্যশীলদের জন্য তাই-ই তো উত্তম। ধৈর্যধারণ কর। তোমার ধৈর্য তো হবে আল্লাহরই সাহায্যে। তাদের জন্য দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ন হয়োনা। (সূরা আন-নাহলঃ ১২৬-২৭)

এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সাঃ) কসমের কাফ্‌ফারা আদায় করেন। (তাবাকাত ইবন সাদ)

হযরত সাফিয়্যা ছিলেন হযরত হামযার সহোদরা। ভাইয়ের শাহাদাতের খবর শুনে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য দৌড়ে আসেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাঁকে দেখতে না দিয়ে কিছু সান্ত্বনা দিয়ে ফিরিয়ে দেন। ভাইয়ের কাফনের জন্য হযরত সাফিয়্যা দুখানি চাদর পাঠান। কিন্তু হযরত হামযারই পাশে আরেকটি লাশও কাফনহীন অবস্থায় পড়ে ছিল। তাই চাদর দুখানি দুজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। হযরত খাব্বাব ইবনূল আরাত (রাঃ) বলেনঃ ‘একটি চাদর ছাড়া হামযাকে কাফন দেওয়ার জন্য আর কোন কাপড় আমরা পেলাম না। তা দিয়ে পা ঢাকলে মাথা এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা চাদর দিয়ে মাথা এবং ইজখিরঘাস দিয়ে পা ঢেকে দিলাম।’ (হায়াতুস সাহাবা- /১৩৬) সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত হামযাকে উহুদের ময়দানে দাফন করা হয়। ইমাম বুখারী হযরত জাবির থেকে বর্ণনা করেছেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উহুদ যুদ্ধের শহীদদের দুজন করে একটি কবরে দাফন করেছিলেন। হামযা ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশকে এক কবরে দাফন করা হয়।’

ইবন হাজার আল-ইসাবাগ্রন্থে ফাওয়ায়েদে আবিত তাহিরেরসূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত জাবির (রাঃ) বলেনঃ ‘মুয়াবিয়া যে দিন উহুদে কূপ খনন করেছিলেন সেদিন আমরা উহুদের শহীদদের জন্য কান্নাকাটি করেছিলাম। শহীদদের আমরা সম্পূর্ণ তাজা অবস্থায় পেয়েছিলাম। এক  ব্যক্তি হযরত হামযার পায়ে আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে পড়ে।’

হযরত হামযার হত্যাকারী হযরত ওয়াহশী (রাঃ) মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর খেদমতে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তুমি কি ওয়াহশী?’ জবাব দিলেনঃ ‘হাঁ।’ তুমিই কি হামযাকে হত্যা করেছো?’ জবাব দিলেনঃ আল্লাহর রাসূল যা শুনেছেন, তা সত্য।রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তুমি কি তোমার চেহারা আমার নিকট একটু গোপন করতে পার?’ তক্ষুনি তিনি বাইরে বেরিয়ে যান এবং জীবনে আর কখনো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মুখোমুখি হননি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রাঃ) খিলাফত কালে ভণ্ড নবী মুসাইলামার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয। তিনিও সে অভিযানে অংশ নিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, মুসাইলামাকে হত্যা করে হযরত হামযার হত্যার কাফফারা আদায় করবেন। তিনি সফল হলেন। এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দিয়ে ইসলামের যতটুকু ক্ষতি করেন তার চেয়ে বেশী উপকার সাধন করেন।

হযরত হামযার মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। ইসলাম গ্রহণ করার পর তখনকার অনুভূতি তিনি কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। সীরাত ইবন হিশামে ‘‘হামযার ইসলাম গ্রহণ’’ অধ্যায়ের টীকায় তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হয়েছে।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিঃ হে দেশবাসী! খুনি এই শাসকদের অপসারণ করুন; ৪ বছর বয়সী শিশু জিহাদের মৃত্যুর জন্য নিঃসন্দেহে এই হাসিনা সরকার দায়ী

প্রেস বিজ্ঞপ্তি
হে দেশবাসী! খুনি এই শাসকদের অপসারণ করুন; ৪ বছর বয়সী শিশু জিহাদের মৃত্যুর জন্য নিঃসন্দেহে এই হাসিনা সরকার দায়ী

গত শুক্রবার (০৫.১২.২০১৪) বিকাল আনুমানিক সাড়ে তিনটার সময় ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনী মাঠে ৪ বছর বয়সী শিশু জিহাদ তার বন্ধুদের সাথে খেলার সময় গভীর নলকূপের (পানির পাইপ) ভেতর পড়ে যায়। এলাকাবাসী দেশীয় উদ্ধার পদ্ধতি ব্যবহার করে ২৪ ঘন্টা পর জিহাদের মরদেহ নলকূপ থেকে বের করে আনে। এই ২৪ ঘন্টা যাবৎ সমগ্র দেশের জনগণ এই সরকারের ব্যর্থতাগুলো প্রত্যক্ষ করেছে এবং জেনেছে –

১. সরকার কলোনীতে বসবাসরত জনগণ এবং তাদের সন্তানদের কোনো তোয়াক্কা না করে গভীর নলকূপটির মুখ খোলা রেখেছিল এবং এটাই দেশের একমাত্র ঢাকনাবিহীন গভীর নলকূপ, ড্রেন এবং মেইনহোল নয়; বরং সমগ্র ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এরকম শত শত বিদ্যমান।
২. ঘটনার মাত্র দুইদিন আগে ঠিক একইরকম ঘটনার সুত্রপাত হওয়ার পর জনগণের দাবি সত্ত্বেও সরকার কূপটির মুখ বন্ধ করেনি, যেখানে ঐ একই নলকূপে আরেকটি শিশু পড়েছিল এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অশেষ রহমতে সে বেঁচে গিয়েছিল।
৩. সরকার এমন একজন চরম অজ্ঞ ব্যক্তি, আসাদুজ্জামান খান কামালকে রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছে, যে শত শত মানুষের মুখের কথাকে সম্পুর্ণ উড়িয়ে দিয়ে, গভীর নলকূপে জিহাদের পড়ে যাওয়ার ঘটনাকে গুজব আখ্যা দিয়েছে। এমনকি তার আওতাধীন পুলিশ সদস্যরা জিহাদের বাবাকে জিহাদ হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আটক করে রাখে! আমরা এতে একেবারেই আশ্চর্য নই; কারণ এই মন্ত্রী শিশু জিহাদের টানে কিংবা জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হয়নি, বরং শুধুমাত্র তার উপস্থিতিকালীন সময়ে যদি জিহাদ উদ্ধার হয় তখন সে যাতে তার প্রধানমন্ত্রীর এবং তার সরকারের “সাফল্যের গল্পের” গুণ-কীর্তন গাইতে পারে।
৪. এই শাসকগোষ্ঠী এতো বছরেও এমন একটি জরুরী সেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি যার রয়েছে দক্ষ এবং কার্যকরীভাবে একটি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করার মতো যথাযথ উপকরণ এবং ট্রেনিং। কাজের মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা এবং যারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন তাদের সবার কাছে তা সুস্পষ্ট দৃশ্যমান ছিল।

হে দেশবাসী!

আপনাদের বিষয়াদির তত্ত্বাবধানে সরকারের ব্যর্থতার তালিকা সম্পর্কে আপনারা ভালোভাবেই অবগত আছেন। ইহা এমন একটি তালিকা নয় যা এক/দুই পৃষ্ঠায় শেষ করা যাবে কিংবা তার প্রয়োজন আছে। বরং আমরা আপনাদেরকে সমাধানের বিষয়ে পুনরাবৃত্তি করতে চাই; এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে এমন একটি শাসনব্যবস্থা এবং শাসকগণ, যারা নিষ্ঠা, যত্ন এবং সচেতনতা সহকারে আপনাদের বিষয়াদির তত্ত্বাবধান করবে এবং তা হচ্ছে ইসলামী খিলাফত, যেখানে উমর বিন খাত্তাব-এর মতো শাসকগণ যারা রাষ্ট্রের সীমানা এবং সীমানার বাইরে কোনো মানুষতো দূরের কথা একটি পশুও যদি রাস্তায় এবং চলার পথে হোঁচট খেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেন: “ইরাকের রাস্তায় যদি একটি ছাগল হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়, আমার ভয় হয় যে আল্লাহ্ আমাকে প্রশ্ন করবেন, হে উমর তুমি কেন তার জন্য রাস্তাটি মসৃন করোনি।” যদি এবং যতক্ষন না আপনারা বর্তমান খুনি শাসকদের অপসারণ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন, ততক্ষন পর্যন্ত মৃত্যু এবং কষ্ট-যন্ত্রনার এই চক্রের পরিসমাপ্তি ঘটবে না যা আপনাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

হিযবুত তাহরীর কর্তৃক আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ



হিযবুত তাহরীর, শাহজাহানপুর-এর সদস্যগণ সরকার কর্তৃক জিহাদের হত্যার প্রতিবাদে আজ বাদ আসর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনীর শাপলা জামে মসজিদ-এ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন। তার পূর্বে হিযবুত তাহরীর-এর একটি প্রতিনিধিদল সমবেদনা জানাতে জিহাদের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।



হিযবুত তাহরীর-এর মিডিয়া কার্যালয়
উলাই’য়াহ বাংলাদেশ

2.12.14

সাঈদ ইবন যায়িদ (রা.)

সাঈদ ইবন যায়িদ (রা.)

নাম সাঈদ, কুনিয়াত আবুল আ’ওয়ার। পিতা যায়িদ, মাতা ফাতিমা বিনত বা’জা। উর্ধ্বপুরুষ কা’ব ইবন লুই-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।

সাঈদের পিতা যায়িদ ছিলেন জাহিলী যুগের মক্কার মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের একজন যাঁরা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই শিরক ও পৌত্তলিকতা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখেন, সব রকম পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকেন। এমন কি মুশরিকদের হাতে যবেহ করা জন্তুর গোশতও পরিহার করতেন। একবার নবুওয়্যাত প্রকাশের পূর্বে ‘বালদাহ’ উপত্যকায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে খাবার আনা হলে তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানান। যায়িদকে খাওয়ার অনুরোধ করা হলে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদেরকে বলেনঃ ‘তোমাদের দেব-দেবীর নামে যবেহকৃত পশুর গোশত আমি খাইনে।’

হযরত আসমা (রা.) বলেনঃ একবার আমি যায়িদকে দেখলাম, তিনি কা’বার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বলছেন, ওহে কুরাইশ বংশের লোকেরা আল্লাহর কসম, আমি ছাড়া দ্বীনে হানীফের ওপর তোমাদের মধ্যে আর কেউ নেই।

জাহিলী যুগে সাধারণত কন্যা সন্তান জীবন্ত দাফন করা হতো। কোথাও কোন কন্যা সন্তান হত্যা বা দাফন করা হচ্ছে শুনতে পেলে যায়িদ তার অভিভাবকের কাছে চলে যেতেন এবং সন্তানটিকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নিতেন। তারপর সে বড় হলে তার পিতার কাছে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ইচ্ছে করলে এখন তুমি নিজ দায়িত্বে নিতে পার অথবা আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিতে পার।

কুরাইশরা তাদের কোন একটি উৎসব পালন করছে। মানুষের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে যায়িদ ইবন আমর ইবন নুফায়িল তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি দেখছে পুরুষেরা তাদের মাথায় বেঁধেছে দামী রেশমী পাগড়ী, গায়ে জড়িয়েছে মূল্যবান ইয়ামনী চাদর। আর নারী ও শিশুরা পরেছে মূল্যবান সাজে সুসজ্জিত করে হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে তাদের দেব-দেবীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য।

তিনি কা’বার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বললেনঃ

‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! এই ছাগলগুলি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তা’আলা। তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের পান করান, যমীনে ঘাস সৃষ্টি করে তাদের আহার দান করেন। আর তোমরা অন্যের নামে সেগুলি যবেহ কর? আমি তোমাদেরকে একটি মূর্খ সম্প্রদায়রূপে দেখতে পাচ্ছি।’

এ কথা শুনে তাঁর চাচা ও উমার ইবনুল খাত্তাবের পিতা আল খাত্তাব উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললোঃ

তোর সর্বনাশ হোক! সব সময় আমরা তোর মুখ থেকে এ ধরণের বাজে কথা শুনে সহ্য করে আসছি। এখন আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারপর তার গোত্রের বোকা লোকদের উত্তেজিত করে তুললো তাঁকে কষ্ট দিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলতে। অবশেষে তিনি বাধ্য হলেন মক্কা ছেড়ে হিরা পর্বতে আশ্রয় নিতে। তাতেও সে ক্ষান্ত হল না। গোপনেও যাতে তিনি মক্কায় প্রবেশ করতে না পারেন, সেদিকে সর্বক্ষণ দৃষ্টি রাখার জন্য একদল কুরাইশ যুবককে সে নিয়োগ করে রাখে।

অতঃপর যায়িদ ইবন আমর কুরাইশদের অগোচরে ওয়ারাকা ইবন নাওফিল, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, উসমান ইবনুল হারিস এবং মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহর ফুফু উমাইমা বিনতু আবদিল মুত্তালিবের সাথে গোপনে মিলিত হলেন। আরববাসী যে চরম গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত সে ব্যাপারে তিনি তাদের সাথে মত বিনিময় করলেন যায়িদ তাঁদেরকে বললেনঃ

‘আল্লাহর কসম আপনার নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন, আপনাদের এ জাতি কোন ভিত্তির ওপর নেই। তারা দ্বীনে ইবরাহীমকে বিকৃত করে ফেলেছে, তার বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে। আপনারা যদি মুক্তি চান, নিজেদের জন্য একটি দ্বীন অনুসন্ধান করুন।’

অতঃপর এ চার ব্যক্তি ইয়াহুদী, নাসারা ও অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুদের নিকট গেলেন দ্বীনে ইবরাহীম তথা দ্বীনে হানীফ সম্পর্কে জানার জন্য। ওয়ারাকা ইবন নাওফিল খৃষ্টধর্ম অবলম্বন করলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, উসমান ইবনুল হারিস কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলেন না। আর যায়িদ ইবন আমর ইবন নুফায়িলের জীবনে ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা। আমরা সে ঘটনা তাঁর জবানেই পেশ করছি।

‘আমি ইয়াহুদী ও খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে অবগত হলাম; কিন্তু সে ধর্মে মানসিক শান্তি পাওয়ার মত তেমন কিছু না পেয়ে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। এক পর্যায়ে আমি শামে (সিরিয়া) এসে উপস্থিত হলাম। আমি আগেই শুনেছিলাম সেখানে একজন রাহিব’ ‘সংসারত্যাগী ব্যক্তি আছেন, যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আমার কাহিনী বিবৃত করলাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেন- ’ওহে মক্কাবাসী ভাই, আমার মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনে ইবরাহীম অনুসন্ধান করছেন।’

বললাম ‘হ্যাঁ আমি তাই অনুসন্ধান করছি।’

তিনি বললেনঃ ‘আপনি যে দ্বীনের সন্ধান করছেন, আজকের দিনেতো তা পাওয়া যায়না। তবে সত্য তো আপনার শহরে। আপনার কওমের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি পাঠাবেন যিনি দ্বীনে ইবরাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাকে পান তাঁর অনুসরণ করবেন।’

যায়িদ আবার মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। প্রতিশ্রুত নবীকে খুঁজে বের করার জন্য দ্রুত পা চালালেন।

তিনি যখন মক্কা থেকে বেশ কিছু দূরে, তখনই আল্লাহ তা’লা নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠালেন। কিন্তু যায়িদ তাঁর সাক্ষাৎ পেলেন না। কারণ, মক্কায় পৌঁছার পূর্বেই একদল বেদুঈন ডাকাত তাঁর উপর চড়াও হয়ে তাঁকে হত্যা করে।

এভাবে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দর্শন লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’আ করেনঃ

আল্লাহুম্মা ইন কুনতা হারামতানি মিন হাজাল ‍খায়রি ফালা তাহরিম মিনহু ইবনী সাঈদান’- ‘হে আল্লাহ, যদিও এ কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি মাহরুম করবেন না।’

আল্লাহ তা’আলা যায়িদের এ দু’আ কুবল করেছিলেন। রাসূল (সাঃ) লোকদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। প্রথম ভাগেই যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর ওপর ঈমান আনলেন তাঁদের মধ্যে সাঈদও একজন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, সাঈদ প্রতিপালিত হয়েছিলেন এমন এক গৃহে, যে গৃহ ঘৃণাভরে প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যান করেছিল কুরাইশদের সকল কুসংস্কার ও গুমরাহীকে। তাঁর পিতা ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন সত্যের সন্ধানে। সাঈদ একাই ইসলাম গ্রহণ করেননি, সাথে তাঁর সহধর্মিনী উমার ইবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা বিনত খাত্তাবও ইসলাম গ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণের কারণে কুরাইশ বংশের এ যুবকও অন্যদের মত যুলুম অত্যাচারের শিকার হন। কুরাইশরা তাঁকে ইসলাম থেকে ফেরানো দূরে থাক, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে বরং কুরাইশদের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন ইসলামের মধ্যে। তিনি হলেন তাঁর শ্যালক হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)। তাঁদের মাধমেই আল্লাহ তা’আলা উমারকে ইসলামের মধ্যে নিয়ে আসেন।

হযরত সাঈদ তার যৌবনের সকল শক্তি ব্যয় করেন ইসলামের খিদমতে। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স বিশ বছরও অতিক্রম করেনি। একমাত্র বদর যুদ্ধ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে অন্য সব যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সিরিয়ায় থাকার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি। তবে বদর যুদ্ধের গণিমতের অংশ তিনি লাভ করেছিলেন। এ হিসাবে তিনি প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে বদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

পারস্যের কিসরা ও রোমের কাইসারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে তিনি মুসলিম সৈন্য বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুসলিমদের সাথে তাঁদের যতগুলি যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার প্রত্যেকটিতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ইয়ারমুক যুদ্ধেই তিনি তাঁর বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তিনি নিজেই বর্ণনা করেনঃ

‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমরা ছিলাম ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি। অন্যদিকে রোমান বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল এক লাখ বিশ হাজার। তারা অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে পর্বতের মত অটল ভংগিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। তাদের অগ্রভাগে বিশপ ও পাদ্রী-পুরোহিতদের বিরাট এক দল। হাতে তাদের ক্রুশ খচিত পতাকা, মুখে প্রার্থনা সংগীত। পেছন থেকে তাদের সুরে সুর মিলাচ্ছিল বিশাল সেনাবাহিনী। তাদের সেই সম্মিলিত কণ্ঠস্বর তখন মেঘের গর্জনের মত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল।

মুসলিম বাহিনী এ ভয়াবহ দৃশ্য ও তাদের বিপুল সংখ্যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ভয়ে তাদের অন্তরও কিছুটা কেঁপে উঠলো, সেনাপতি আবু উবাইদা তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং মুসলিম সৈন্যদের জিহাদে অনুপ্রাণিত করে এক ভাষণ দিলেন। তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহর বান্দারা। আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের পা’কে দৃঢ় করবেন।

আল্লাহর বান্দারা! ধৈর্য ধারণ কর। ধৈর্য হল কুফরী থেকে মুক্তির পথ, প্রভুর রিজামন্দী হাসিলের পথ এবং অপমান ও লজ্জার প্রতিরোধ। তোমরা তীর বর্শা শানিত করে ঢাল হাতে প্রস্তুত হয়ে যাও। অন্তরে আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য সব চিন্তা থেকে বিরত থাক। সময় হলে আমি তোমাদের নির্দেশ দেব ইনশাআল্লাহ।’

সাঈদ (রা.) বলেনঃ

তখন মুসলিম বাহিনীর ভেতর থেকে এক ব্যক্তি বেরিয়ে এসে আবু ’উবাইদাকে বললোঃ

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ মুহূর্তে আমি আমার জীবন কুরবানী করব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে পৌঁছে দিতে হবে এমন কোন বাণী কি আপনার কাছে?’ আবু উবাইদা বললেনঃ
‘হ্যাঁ, আছে। তাঁকে আমার ও মুসলিমদের সালাম পৌঁছে দিয়ে বলবেঃ
ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের রব আমাদের সাথে যে অংগীকার করেছেন, তা আমরা সত্যই পেয়েছি।’

সাঈদ (রা.) বলেনঃ

‘আমি তাঁর কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তার তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে অগ্রসর হলাম এবং আমার বর্শা হাতে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুপক্ষের প্রথম যে ঘোড় সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমি তাকে আঘাত করলাম। তারপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালাল এবং তাদেরকে পরাজিত করল।’

দিমাশক অভিযানেও সাঈদ ইবন যায়িদ অংশগ্রহণ করেন। দিমাশক জয়ের পর আবু উবাইদা তাঁকে সেখানকার ওয়ালী নিযুক্ত করেন। এভাবে তিনি হলেন দিমাশকের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম ওয়ালী। কিন্তু জিহাদের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে এ পদ লাভ করে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি আবু উবাইদাকে লিখলেনঃ ‘আপনারা জিহাদ করবেন, আর আমি বঞ্চিত হবো, এমন আত্মত্যাগ ও কুরবানী আমি করতে পারিনে।’ চিঠি পৌঁছার সাথে সাথে কাউকে আমার স্থলে পাঠিয়ে দিন। আমি শিগগিরই আপনার নিকট পৌঁছে যাচ্ছি। আবু উবাইদা বাধ্য হয়ে হযরত ইয়াযিদ ইবন আবু সুফিয়ানকে দিমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন এবং হযরত সাঈদ জিহাদের ময়দানে ফিরে গেলেন।

উমাইয়া যুগে হযরত সাঈদ ইবন যায়িদকে কেন্দ্র করে এক আশ্চর্যময় ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে মদীনাবাসীদের মুখে ঘটনাটি শোনা যেত।

ঘটনাটি হল, আরওয়া বিনত উওয়াইস নাম্নী এক মহিলা দুর্নাম রটাতে থাকে যে সাঈদ ইবন যায়িদ তার জমির একাংশ জবদখল করে নিজ জমির সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন। যেখানে সেখানে সে একথা বলে বেড়াতে লাগল। এক পর্যায়ে সে মদীনার ওয়ালী মারওয়ান ইবনুল হিকামের নিকট বিষয়টি উত্থাপন করল। বিষয়টি যাচাই করে দেখার জন্য মারওয়ান কয়েকজন লোককে সাঈদের নিকট পাঠালেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবী হযরত সাঈদের জন্য বিষয়টি ছিল বেশ কষ্টদায়ক। তিনি বললেনঃ

‘‘তারা মনে করে আমি তার ওপর যুলুম করছি। কিভাবে আমি যুলুম করতে পারি? আমি তো রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ ‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জমি যুলুম করে নেবে, কিয়ামতের দিন সাত তবকা যমীন তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’ ইয়া আল্লাহ! সে ধারণা করেছে অমি তার ওপর যুলুম করেছি। যদি সে মিথ্যুক হয়, তার চোখ অন্ধ করে দাও, যে কূপ নিয়ে সে আমার সাথে ঝগড়া করেছে, তার মধ্যেই তাকে নিক্ষেপ কর এবং আমার পক্ষে এমন আলোক প্রকাশ করে দাও যাতে মুসলিমদের মাঝে স্পষ্ট হয়ে যায় যে আমি তার ওপর কোন যুলুম করিনি।’

এ ঘটনার পর কিছুদিন যেতে না যেতেই আকীক উপত্যকা এমনভাবে প্লাবিত হল যে অতীতে আর কখনো তেমন হয়নি। ফলে দু’যমীনের মাঝখানে বিতর্কিত অদৃশ্য চিহ্নটি এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল যে, মুসলিমরা তা দেখে বুঝতে পারল সাঈদ সত্যবাদী। তারপর একমাস না যেতেই মহিলাটি অন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একদিন সে তার যমীনে পায়চারী করতে করতে বিতর্কিত কূপটির মধ্যে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা.) বলেনঃ

‘আমরা শুনতাম লোকেরা কাউকে অভিশাপ দিতে গেলে বলতঃ আল্লাহ তোমাকে অন্ধ করুন যেমন অন্ধ করেছেন আরওয়াকে। এ ঘটনায় অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই, কারণ রাসূল (সাঃ) তো বলেছেনঃ ‘তোমরা মাযলুমের দু’আ থেকে দূরে থাক। কারণ, সেই দু’আ আর আল্লাহর মাঝে কোন প্রতিবন্ধক থাকে না।’ এই যদি হয় সব মাযলুমের অবস্থা, তাহলে ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’ জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ জনের একজন সাঈদ ইবন যায়িদের মত মাযলুমের দু’আ কবুল হওয়া তেমন আর আশ্চর্য কি?

আবু নুয়াঈম, বিরাহ ইবনুল হারিস থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মুগীরা ইবন শু’বা একটি বড় মসজিদে বসে ছিলেন। তখন তাঁর ডানে বাঁয়ে বসা ছিল কুফার কিছু লোক। এমন সময় সাঈদ ইবন যায়িদ নামক এক ব্যক্তি এলেন। মুগীরা তাকে সালাম করে খাটের ওপর পায়ের দিকে বসালেন। অতঃপর কুফাবাসী এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে মুগীরার দিকে মুখ করে গালি বর্ষণ করতে লাগল। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ মুগীরা, এ লোকটি কার প্রতি গালি বর্ষণ করছে? বললেনঃ আলী ইবন আবী তালিবের প্রতি। তিনি বললেনঃ ওহে মুগীরা! এভাবে তিনবার ডাকলেন। তারপর বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাহাবীদের আপনার সামনে গালি দেওয়া হবে, আর আপনি তার প্রতিবাদ করবেন না, এ আমি দেখতে চাইনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ আবু বকর জান্নাতী, উমার জান্নাতী, উসমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী, তালহা জান্নাতী, যুবাইর জান্নাতী, আবদুর রহমান জান্নাতী, সা’দ ইবন মালিক জান্নাতী এবং নবম এক ব্যক্তিও জান্নাতী, তোমরা চাইলে আমি তার নামটিও বলতে পারি। রাবী বলেনঃ লোকেরা সমস্বরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলঃ হে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাহাবী, নবম ব্যক্তিটি কে? বললেনঃ নবম ব্যক্তিটি আমি। তারপর তিনি কসম করে বললেনঃ যে ব্যক্তি একটি মাত্র যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে অংশগ্রহণ করেছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে তার মুখমণ্ডল ধূলি ধূসরিত হয়েছে, তার এই একটি কাজ যে কোন ব্যক্তির জীবনের সকল সৎকর্ম অপেক্ষা উত্তম- যদিও সে নূহের সমান বয়সই লাভ করুক না কেন। (হায়াতুস সাহাবা/ ২য়- ৪৭০ পৃঃ)

তিনি ছিলেন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীদের অন্যতম। সাঈদ ইবন হাবীব বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট আবু বকর, উমার, উসমান, আলী, সা’দ, সাঈদ, তালহা, যুবাইর ও আবদুর রহমান ইবনে আওফের স্থান ও ভূমিকা ছিল একই। যুদ্ধের ময়দানে তাঁরা থাকতেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আগে এবং নামাযের জামায়াতে থাকতেন তাঁর পেছনে।

সাঈদ ইবন যায়িদের নিকট থেকে সাহাবীদের মধ্যে ইবন উমার, আমর ইবন হুরাইস, আবু আত তুফাইল এবং আবু উসমান আন-নাহদী, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, কায়েস ইবন আবী হাযেম প্রমুখ প্রখ্যাত তাবেয়ীগণও হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ওয়াকিদী বলেনঃ তিনি আকীক উপত্যকায় ইনতিকাল করেন এবং মদীনায় সমাহিত হন। মৃত্যুসন হিজরী ৫০। মতান্তরে হিজরী ৫১ অথবা ৫২। সত্তর বছরের ওপর তিনি জীবন লাভ করেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস তাঁকে গোসল দিয়ে কাফন পরান এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। তবে হাইসাম ইবন আদীর মতে তিনি কুফায় ইনতিকাল করেন এবং প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুগীরা ইবন ‍শু’বা তাঁর জানাযার ইমামতি করেন।