29.11.14

উমার ইবন খাত্তাব (রা.)

উমার ইবন খাত্তাব (রা.)

নাম উমার, লকব ফারুক এবং কুনিয়াত আবু হাফস। পিতা খাত্তাব ও মাতা হানতামা। কুরাইশ বংশের আ’দী গোত্রের লোক। উমারের অষ্টম উর্ধ্ব পুরুষ কা’ব নামক ব্যক্তির মাধ্যমে রাসূলুল্লা (সাঃ) এর নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। পিতা খাত্তাব কুরাইশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। মাতা হানতামা কুরাইশ বংশের বিখ্যাত সেনাপতি হিশা ইবনে মুগীরার কন্যা। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ এই মুগীরার পৌত্র। মক্কার জাবালে আকিব এর পাদদেশে ছিল জাহিলী যুগে বনী আ’দী ইবনে কা’বের বসতি। এখানেই ছিল হযরত উমারের বাসস্থান। ইসলামী যুগে উমারের নাম অনুসারে পাহাড়টির নাম হয় জাবালে উমার- উমারের পাহাড়। (তাবাকাতে ইবনে সা’দঃ ৩/৬৬) উমারের চাচাত ভাই, যায়িদ বিন নুফাইল। রাসূলুল্লা (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বে নিজের বিচার-বুদ্ধি সাহায্যে মুর্তিপূজা ত্যাগ করে জাহিলী আরবে যাঁরা তাওহীদবাদী হয়েছিলেন, যায়িদ তাঁদেরই একজন।

রাসূলুল্লা (সাঃ) এর ন্মের তেরো বছর পর তাঁর জন্ম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূলুল্লা (সাঃ) এর বয়সের সমান অর্থাৎ ৬৩ বছর। তবে তাঁর জন্ম ও ইসলাম গ্রহণের সন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

গায়ে রং উজ্জল গৌরবর্ণ, টাক মাথা, গন্ডদেশ মাংসহীন, ঘন দাড়ি, মোঁচের দু’পাশ লম্বা ও পুরু এবং শরীর দীর্ঘাকৃতির। হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকেই সবার থেকে লম্বা দেখা যেত।

তাঁর জন্ম ও বাল্যকাল সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবনে আসাকির তাঁর তারিখে আমরবন আস (রা.) হতে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে জানা যায়, একদিন আমর ইবন আ’স বন্ধু-বান্ধবসহ বসে আছেন, এমন সময় হৈ-চৈ শুনতে পেলেন। সংবাদ নিয়ে জানতে পেলেন, খাত্তাবের একটি ছেলে হয়েছে। এ বর্ণনার ভিত্তিতে মনে হয়, হযরত উমারের জন্মের সময় বেশ আনন্দোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

তাঁর যৌবনের অবস্থাও প্রায় অনেকটা অজ্ঞাত। কে জানত যে এই সাধারন একরোখা ধরনের যুবকটি একদিন ‘ফারুকে আযমে’ পরিণত হবেন। কৈশোরে উমারের পিতা তাঁকে উটের রাখালী কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক স্থানে উট চড়াতেন। তিনি তাঁর খিলাফতকালে একবার এ মাঠ অতিক্রমকালে সঙ্গীদের কাছে বাল্যের স্মৃতিচারন করেছিলেন এভাবেঃ এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখর রোদ্রে খাত্তাবের উট চড়াতাম। খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নিরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে প্রহৃত হতাম। কিন্ত আজ আমার এমন দিন এসেছে যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমার উপর কর্তৃত্ব করার আর কেউ নেই।’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৬-৬৭)

যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি তৎকালীন অভিজাত আরবদের অবশ্য শিক্ষণীয় বিষযগুলি, যথাঃ যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা, ও বংশ তালিকা শিক্ষা প্রভৃতি আয়ত্ব করেন। বংশ তালিকা বা নসবনামা বিদ্যা তিনি লাভ করেন উত্তরাধিকার সুত্রে। তাঁর পিতা ও পিতামহ ছিলেন এ বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি ছিলেন তার যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর। আরবের ‘উকায’ মেলায় তিনি কুস্তি লড়তেন। আল্লামা যুবইয়ানী বলেছেনঃ উমার (রা.) ছিলেন এক মস্তবড় পালোয়ান।’ তিনি ছিলেন জাহেলী আরবের একজন বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার। আল্লামা জাহিয বলেছেনঃ উমার (রা.) ঘোড়ায় চড়লে মনে হত ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে।’ (আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন) তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তৎকালীন খ্যাতনামা কবিদের প্রায় সব কবিতাই তাঁর মুখস্থ ছিল। আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞানভিত্তিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে তিনিই। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত তাঁর মতামতগুলো পাঠ করলে এ বিষয়ে তাঁর যে কতখানি দখল ছিল তা উপলদ্ধি করা যায়। বাগ্মিতা ছিল তাঁর সহজাত গুন। যৌবনে তিনি কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। বালাজুরী লিখেছেনঃ রাসুলে কারীম (সাঃ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র সতেরজন লেখাপড়া জানতেন। তাঁদের মধ্যে উমার (রা.) একজন।’

ব্যবসা বাণিজ্য ছিল জাহেলী যুগে আরবদের সম্মানজনক পেশা। উমারও ব্যবসা শুরু করেন এবং তাতে যথেষ্ট উন্নতিও করেন। ব্যবসা উপলক্ষে অনেক দুরদেশে গমণ ও বহু জ্ঞানী-গুনী সমাজের সাথে মেলা-মেশার সুযোগ লাভ করেন। মাসউদী বলেনঃ উমার (রা.) জাহেলী যুগে সিরিয়া ও ইরাকে ব্যবসা উপলক্ষে ভ্রমনে যেতেন। ফলে আরব ও আযমের অনেক রাজা-বাদশাহ’র সাথে মেলা-মেশার সুযোগ লাভ করেন।’ শিবলী নুমানী বলেনঃ জাহেলী যুগেই উমারের সুনাম সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে কুরাইশরা সর্বদা তাঁকেই দৌত্যগিরিতে নিয়োগ করতো। অন্যান্যা গোত্রের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি হলে নিষ্পত্তির জন্য তাঁকেই দূত হিসেবে পাঠানো হতো। (আল-ফারুকঃ ১৪)

উমারের ইসলাম গ্রহণ এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা। তাঁর চাচাতো ভাই যায়িদের কল্যানে তাঁর বংশে তৌহিদের বাণী একেবারে নতুন ছিল না। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়িদের পুত্র সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেন। সাঈদ আবার উমারের বোন ফাতিমাকে বিয়ে করেন। স্বামীর সাথে ফাতিমাও ইসলাম গ্রহণ করেন। উমারের বংশের আরো এক বিশিষ্ট ব্যক্তি নাঈম ইবন আবদুল্লাহও ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্ত তখনও পর্যন্ত উমার (রা.) ইসলাম সম্পর্কে কোন খবরই রাখতেন না। সর্বপ্রথম যখন ইসলামের কথা শুনলেন, ক্রোধে জ্বলতে থাকলেন। তাঁর বংশে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের তিনি পরম শত্রু হয়ে দাড়ালেন। এর মধ্যে জানতে পারলে, ‘লাবীনা নামক তাঁর এক দাসী ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যাদের উপর তাঁর ক্ষমতা চলতো, নির্মম অত্যাচার চালালেন। এক পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ইসলামের মুল প্রচারক মুহাম্মদ (সাঃ)-কেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যে কথা সেই কাজ।

আনাস ইবন মালিক হতে বর্ণিতঃ তরবারী কাঁধে ঝুলিয়ে উমার চলেছেন পথে বনী যুহরার এক ব্যক্তির (মতান্তরে নাঈম ইবন আবদুল্লাহ’র) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন দিকে উমার? বললেনঃ মুহাম্মদের একটা দফারফা করতে।’ লোকটি বললেনঃ মুহাম্মদ (সাঃ) এর দফারফা করে বনী হাশিম ও বনী যুহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে? এ কথা শুনে উমার বলে উঠলেনঃ মনে হচ্ছে তুমিও পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছো।’ লোকটি বললেনঃ উমার একটি বিস্ময়কর খবর শোন, তোমার বোন ও ভগ্নীপতি বিধর্মী হয়ে গেছে। তাঁরা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে।’” (আসলে লোকটির লক্ষ্য ছিল উমার (রা.)-কে তার লক্ষ থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া।) এ কথা শুনে উমার রাগে উন্মত্ত হয়ে ছুটলেন তাঁর বোন-ভগ্নীপতির বাড়ীর উদ্দেশ্যে। বাড়ীর দরজায় উমারের করাঘাত পলো। তারা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত এর কাছে কুআন শিখছিলেন। উমারের আভাষ পেয়ে খাব্বাব তখন বাড়ীর আরেকটি কক্ষে আত্মগোপন করলেন। উমার বোন-ভগ্নীপতিকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের এখানে গুগুন আওয়াজ শুনছিলাম, তা কিসের? তারা তখন কুআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন। তাঁরা উত্তর দিলেনঃ আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম।’ উমার বললেনঃ সম্ভবত তোমরা দু’জন ধর্মত্যাগী হয়েছো।’ ভগ্নীপতি বললেনঃ তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে উমার? উমার তাঁর ভগ্নীপতির উপর ঝাপিয়ে পলেন এবং দু’পায়ে ভীষভাবে তাঁকে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাচাতে এগিয়ে এলে উমার তাকে ধরে এমন মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। বোন রাগে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ সত্য যদি তোমার দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে থাকে, তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল।’

এ ঘটনার কিছুদিন আগ থেকে উমারের মধ্যে একটা ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল। কুরাইশরা মক্কায় মুসলিমদের ওপর নির্মম অত্যাচার-উৎপীড়ন চালিয়ে একজনকেও ফেরাতে পারেনি। মুসলিমরা নীরবে সবকিছু মাথা পেতে নিয়েছে। প্রয়োজনে বাড়ী-ঘর ছেড়েছে, ইসলাম ত্যাগ করেনি। এতে উমারের মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল। তিনি একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবর্তে দোল খাচ্ছিলেন। আজ তার প্রিয় সহোদরার চোখ-মুখের রক্ত, তার সত্যের সাক্ষ্য তাঁকে এমন একটি ধাক্কা দিল যে, তাঁর সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কর্পূরের মত উড়ে গেল। মুহূর্তে হৃদয় তাঁর সত্যে জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি পাক-সাফ হয়ে বোনের হাত থেকে সূরা ত্বাহার অংশটুকু নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বললেনঃ আমাকে তোমরা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে নিয়ে চল।’ উমারের একথা শুনে এতক্ষণে খাব্বাব ঘরের গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেনঃ সুসংবাদ উমার! বৃহঃস্পতিবার রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তোমার জন্য দু’আ করেছিলেন। আমি আশা করি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ আল্লাহ, উমার ইবনুল খাত্তাব বা আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী কর।’ খাব্বার আরো বললেনঃ রাসুল (সাঃ) এখন সাফার পাদদেশে ‘দারুল আরকামে

উমার (রা.) চললেন দারুল আরকামের দিকে। হামজা এবং তালহার সাথে আরো কিছু সাহাবী তখন আরকামের বাড়ীর দরজায় পাহারারত। উমারকে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে পরলেন। তবে হামজা সান্তনা দিয়ে বললেনঃআল্লাহ উমারের কল্যান চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসুল (সাঃ) এর অনুসারী হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য খুবই সহজ হবে।’ রাসুল (সাঃ) তখন বাড়ীর ভিতরে তাঁর উপর তখন ওহী নাজিল হচ্ছিল। একটু পরে তিনি বেরিয়ে উমারের কাছে এলেন। উমারের কাপড় ও তরবারীর হাতল তিনি মুঠো করে ধরে বললেনঃ উমার তুমি কি বিরত হবে না?………তারপর তিনি দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ, উমার আমার সামনে, হে আল্লাহ উমারের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী কর।’ উমার (রা.) বলে উঠলেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসুল। ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি আহবান জানালেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ুন। (তাবাকাতুল কুবরা/ ইবন সা’দঃ ৩/২৬৭-৬৯) এটা নবুওয়্যাতের ষষ্ঠ বছরের ঘটনা।

ইমাম যুহরী বর্ণনা করেনঃ রাসুলাল্লাহ (সাঃ) দারুল আরকামে প্রবেশের পর উমার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পুর্বে নারী-পুরুষ সর্বমোট চল্লিশ বা চল্লিশের কিছু বেশী লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উমারের ইসলাম গ্রহণের পর জিবরাঈল (আ.) এসে বললেনঃ মুহাম্মদ, উমারের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছে।’” (তাবাকাতঃ ৩/২৬৯)

উমারের ইসলাম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। যদিও তখন পর্যন্ত ৪০/৫০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে হযরত হামজাও ছিলেন, তথাপি মুসলিমদের পক্ষে কা’বায় গিয়ে নামাজ পড়াতো দূরে কথা নিজেদেরকে মুসলিম বলে প্রকাশ করাও নিরাপদ ছিল না। হযরত উমারের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে এ অবস্থার পরিবর্তন হলো। তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষনা দিলেন এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে কা’বা ঘরে নামাজ আদায় করা শুরু করলেন।

উমার (রা.) বলেনঃ আমি ইসলাম গ্রহনের পর সে রাতেই চিন্তা করলাম, মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসুলাল্লাহ (সাঃ) এর সবচেয়ে বড় কট্টর দুশমণ কে আছে। আমি নিজে গিয়ে তাকে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানাব। আমি মনে করলাম, আবু জাহেলই সবচেয়ে বড় দুশমন। সকাল হতেই আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম। আবু জাহেল বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলঃ কি মনে করে? আমি বললামঃ আপনাকে এ কথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ)র প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান ও বাণীকে মেনে নিয়েছি।’ এ কথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল এবং বললঃ আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলংকিত করুক।’ (সীরাতে ইবন হিশাম)

এভাবে এই প্রথমবারের মত মক্কার পৌত্তলিক শক্তি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো। সাদ ইবন মুসায়্যিব বলেনঃ তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম মক্কায় প্রকাশ্য রুপ নেয়।’ আবদুল্লাহ ইব মাসউদ (রা.) বলেনঃ উমার (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেই কুরাইশদের সাথে বিবাদ আরম্ভ করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কা’বায় নামাজ পড়ে ছাড়লেন। আমরাও সকলে তাঁর সাথে নামাজ পড়েছিলাম।’ সুহায়িব ইন সিনান বলেনঃ তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর আমরা কা’বার পাশে জটলা করে বসতাম, কা’বা ঘর তাওয়াফ করতাম, আমাদের সাথে কেউ রুঢ় ব্যবহার করলে তার প্রতিশোধ নিতাম এবং আমাদের উপর যে কোন আক্রমণ আসলে তা প্রতিহত করতাম।’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৯) তাই রাসুল (সাঃ) তাঁকে ‘আল-ফারুক উপাধীতে ভূষিত করেছিলেন। কারণ তারই কারনে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ উমারের জিহ্বা ও অন্তঃকরনে আল্লাহ তাআলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক’, আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যের পার্থক্য করে দিয়েছেন।’ (তাবাকাতঃ ৩/২৭০)

মক্কায় যারা মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন, রাসুল (সাঃ) তাদেরকে মদীনায় হিজরত করতে নির্দেশ দিলেন। আবু সালামা, আবদুল্লাহ বিন আশহাল, বিলাল ও আম্মার বিন ইয়াসিরের মদীনায় হিজরাতের পর বিশজন আত্মীয়-বন্ধুসহ উমার (রা.) মদীনার পথে পা বাড়ালেন। এ বিশজনের মধ্যে তাঁর ভাই যায়িদ, ভাইয়ের ছেল সাঈদ, জামাই খুনাইসও ছিলেন। মদীনার উপকন্ঠে কুবা পল্লীতে তিনি রিফায়া ইবন আবদিল মুনজিরের বাড়িতে তিনি আশ্রয় নেন।

উমারের হিজরাত অন্যান্যদের হিজরাতের মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য ছিল। অন্যদের হিজরাত ছিল চুপে চুপে। সকলের অগোচরে। আর উমারের হিজরাত ছিল প্রকাশ্যে। তার মধ্যে ছিল কুরাইশদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহের সুর। মক্কা থেকে মদীনায় যাত্রার পূর্বে তিনি প্রথমে কা’বা তাওয়াফ করলেন। তারপর কুরাইশদের আড্ডায় গিয়ে তিনি ঘোষনা করলেন, আমি মদীনা চলছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়। এমন একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তিনি মদীনার পথ ধরলেন। কিন্ত কেউ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দুঃসাহস করল না। (তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাহঃ খিদরী বেক, ১/১৯৮)

বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, রাসুল (সাঃ) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সাথে উমারের দ্বীনি ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। আবু বকর সিদ্দিক, উয়াইস ইবন সায়িদা, ইতবান ইবন মালিক ও মুয়াজ ইবন আফরা (রা.) ছিলেন উমারের দ্বীনি ভাই। তবে এটা নিশ্চিত যে, মদীনায় হিজরাতের পর বনী সালেমের সর্দার ইতবান ইবন মালিকের সাথে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। (তাবাকাতঃ ৩/২৭২)

হিজরী প্রথম সাল হতে রাসুলে কারীম (সাঃ) এর ইন্তিকাল পর্যন্ত উমারের কর্মজীবন প্রকৃতপক্ষে রাসুল (সাঃ) এর কর্মময় জীবনের একটা অংশ বিশেষ। রাসুল (সাঃ)-কে যত যুদ্ধ করতে হয়েছিল, যত চুক্তি করতে হয়েছিল, কিংবা সময় সময় যত বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হয়েছিল এবং ইসলাম প্রচারের জন্য যত পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল তার এমন একটি ঘটনাও নেই, যা উমারের সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছাড়া সম্পাদিত হয়েছে। এইজন্য এই সব ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ লিখতে গেলে তা উমারের (রা.) জীবনী না হয়ে রাসুল (সাঃ) এর জীবনীতে পরিণত হয়ে যায়। তাঁর কর্মবহুল জীবন ছিল রাসুল (সাঃ) এর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

হযরত উমার (রা.) বদর, ওহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই রাসুল (সাঃ) এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া আরো বেশ কিছু সারিয়্যা (যে সব ছোট অভিযানে রাসুল (সাঃ) নিজে উপস্থিত হননি)-তে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের পরামর্শ দান ও সৈন্য চালনা হতে আরম্ভ করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রাসুল (সাঃ) এর সাথে দৃঢ়ভাবে কাজ করেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের সম্পর্কে তাঁর পরামর্শই আল্লাহ পাকের পছন্দ হয়েছিল। এ যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিম্নরুপঃ

১. এ যুদ্ধে কুরাইশ বংশের প্রত্যেক শাখা হতে লোক যোগদান করে; কিন্ত বনী আ’দী অর্থাৎ উমারের খান্দান হতে একটি লোকও যোগদান করেনি। উমারের প্রভাবেই এমনটি হয়েছিল।
২. এ যুদ্ধে ইসলামের বিপক্ষে ‘উমারের সাথে তাঁর গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ লোকদের থেকে মোট বারোজন লোক যোগদান করেছিল।
৩. এ যুদ্ধে হযরত উমার (রা.) তাঁর আপন মামা আ’সী ইবন হিশামকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এ হত্যার মাধ্যম তিনিই সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, সত্যের পথে আত্মীয় ও প্রিয়জনের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করতে পারে না।

উহুদ যুদ্ধেও হযরত উমার (রা.) ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম সৈন্যরা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন এবং রাসুল (সাঃ) আহত হয়ে মুষ্টিময় কিছু সঙ্গী-সাথী সহ পাহাড়ের এক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন, তখন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান নিকটবর্তী হয়ে উচ্চস্বরে মুহাম্মদ (সাঃ), আবু বকর (রা.), উমার (রা.) নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা বেচে আছ কি? রাসুল (সাঃ) এর ইঙ্গিতে কেউই আবু সুফিয়ানের জবাব দিল না। কোন সাড়া না পেয়ে আবু সুফিয়ান ঘোষনা করলঃ নিশ্চয় তারা সকলে নিহত হয়েছে।’ এ কথায় উমারের পৌরুষে আঘাত লাগল তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেনঃ ওরে আল্লাহর দুশমন! আমরা সবাই জীবিত।’ আবু সুফিয়ান বললোঃ উ’লু হুবল - হুবলের জয় হোক। রাসুল (সাঃ) এর ইঙ্গিতে উমার (রা.) জবাব দিলেনঃ ‘আল্লাহু আ’লা ওয়া আজাল্লু -আল্লাহ মহান ও সম্মানী

খন্দকের যুদ্ধেও উমার (রা.) সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। খন্দকের একটি বিশেষ স্থান রক্ষা করার ভার পড়েছিল উমারের উপর। আজও সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ বিদ্যমান থেকে তাঁর সেই স্মৃতির ঘোষনা করছে। এ যুদ্ধে একদিন তিনি প্রতিরক্ষায় এত ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁর আসরের নামাজ ক্বাজা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। রাসুল (সাঃ) তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেনঃ ব্যস্ততার কারণে আমিও এখন পর্যন্ত নামাজ আদায় করতে পারিনি।’ (আল-ফারুকঃ শিবলী নু’মানী-২৫)

হুদাইবিয়ার শপথের পুর্বেই হযরত উমার (রা.) যুদ্ধের প্রস্ততি আরম্ভ করে দিলেন। পুত্র আবদুল্লাহকে পাঠালেন কোন এক আনসারীর নিকট থেকে ঘোড়া আনার জন্য। তিনি এসে খবর দিলেন যে, লোকেরা রাসুল (সাঃ) এর হাতে বাই’আত করছেন। উমার (রা.) তখর রণসজ্জায় সজ্জিত। এ অবস্থায় তিনি দৌড়ে গিয়ে রাসুল (সাঃ) এর হাতে বাই’আত করেন।

হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলো বাহ্য দৃষ্টিতে মুসলিমদের জন্য অপমানজনক মনে হলো। উমার (রা.) উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রথমে আবু বকর পরে রাসুল (সাঃ) এর নিকট এ সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। রাসুল (সাঃ) বললেনঃ আমি আল্লাহর রাসুল। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কোন কাজ আমি করিনে।’ উমার (রা.) শান্ত ও অনুতপ্ত হলেন। নফল রোযা রেখে, নামাজ পড়ে, গোলাম আযাদ করে এবং দান খয়রাত করে এ গোস্তাখীর কাফফারা আদায় করলেন।

খাইবারে ইয়াহুদীদের অনেকগুলি সুরক্ষিত দূর্গ ছিল। কয়েকটি সহজেই জয় হলো। কিন্তু দু’টি কিছুতেই জয় করা গেল না। রাসুল (সাঃ) প্রথম দিন আবু বকর, দ্বিতীয় দিন উমারকে পাঠালেন দূর্গ দু’টি জয় করার জন্য। তাঁরা দু’জনেই ফেরত আসলেন অকৃতকার্য হয়ে। তৃতীয়দিন রাসুল (সাঃ) ঘোষনা করলেনঃ আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ইসলামের পতকা দিব, যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’ পরদিন সাহাবায়ে কিরাম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাসুল (সাঃ) এর দরবারে উপস্থিত হলেন। প্রত্যেকেরই অন্তরে এ গৌরব অর্জনের বাসনা। উমার (রা.) বললেনঃ আমি খাইবারের এ ঘটনা ব্যতিত কোনদিনই সেনাপতিত্ব বা সরদারীর জন্য লালায়িত হইনি। সে দিনের সেই গৌরব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শেরে-খোদা আলী (রা.)।’

খাইবারের বিজিত ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। হযরত উমার (রা.) তাঁর ভাগের অংশটুকু আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম ওয়াকফ। (আল-ফারুকঃ ৩০)

মক্কা বিজয়ের সময় হযরত উমার (রা.) ছায়ার মত রাসুল (সাঃ)-কে সঙ্গ দেন। ইসলামের মহাশত্রু আবু সুফিয়ান আত্মসমর্পন করতে এলে উমার (রা.) রাসুল (সাঃ)-কে অনুরোধ করেন, অনুমতি দিন এখনই ওর দফা করে দেই। এদিন মক্কার পুরুষরা রাসুল (সাঃ) এর হাতে এবং মহিলারা রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশে হযরত উমারের হাতে বাই’আত গ্রহণ করেছিলেন।

হুনাইন অভিযানেও হযরত উমার (রা.) অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিলেন। এ যুদ্ধে কাফেরদের তীব্র আক্রমণে বারো হাজার মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। ইবন ইসহাক বলেনঃ মুহাজির ও আনসারদের মাত্র কয়েকজন বীরই এই বিপদকালে রাসুল (সাঃ) এর সাথে দৃঢ়পদ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আবু বকর, উমার (রা.), আব্বাসের (রা.) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তাবুক অভিযানের সময় রাসুল (সাঃ) এর আবেদনে সাড়া দিয়ে হযরত উমার (রা.) তাঁর মোট সম্পদের অর্ধেক রাসুল (সাঃ) এর হাতে তুলে দেন।

রাসুল (সাঃ) এর ইন্তিকালের খবর শুনে হযরত উমার (রা.) কিছুক্ষন স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন। তারপর মসজিদে নববীর সামনে গিয়ে তরবারী কোষমুক্ত করে ঘোষনা দেন, যে বলবে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখন্ডিত করে ফেলবো।’ এ ঘটনা থেকে রাসুল (সাঃ) এর প্রতি উমারের ভক্তি ও ভালবাসার পরিমাণ সহজেই অনুমান করা যায়।

রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর ‘সাকীফা বনী সায়েদায়’ দীর্ঘ আলোচনার পর উমার (রা.) খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে হযরত আবু বকরের হাতে খিলাফতের বাই’আত গ্রহণ করেন। ফলে খলিফা নির্বাচনের মহা সংকট সহজেই কেটে যায়।

খলিফা হযরত আবু বকর যখন বুঝতে পারলেন তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে, মৃত্যুর পুর্বেই তিনি পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যাওয়াকে তিনি কল্যাণকর মনে করলেন। তাঁর দৃষ্টিতে উমার (রা.) ছিলেন খিলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি। তা সত্বেও উচু পর্যায়ের সাহাবীদের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করা সমীচীন মনে করেন। তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফ (রা.)-কে ডেকে বললেনঃ উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ তিনি বললেনঃ তিনিতো যে কোন ব্যক্তি হতে উত্তম; কিন্ত তাঁর চরিত্রে কিছু কঠোরতা আছে।’ আবু বকর বললেনঃ তার কারণ; আমাকে তিনি কোমল দেখেছেন, খিলাফতের দায়িত্ব কাঁধে পরলে এ কঠোরতা অনেকটা কমে যাবে।’ তারপর আবু বকর অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে আলোচিত বিষয়টি কারো সাথে ফাঁস না করার জন্য। অতঃপর তিনি উসমা বিন আফফানকে ডাকলেন। বললেন, আবু আবদিল্লাহ, উমার সম্পর্কে আপনি আপনার মতামত আমাকে জানান। উসমান বললেনঃ আমার থেকে আপনিই তাঁকে বেশী জানেন।’ আবু বকর বললেনঃ তা সত্বেও আপনার মতামত আমাকে জানান।’ উসমান বললেনঃ তাঁকে আমি যতটুকু জানি তাতে তাঁর বাইরে থেকে ভিতরটা বেশী ভাল। তাঁর মত দ্বিতীয় আর কেউ আমাদের মধ্যে নেই।’ আবু বকর (রা.) তাদের দুজনের মধ্যে আলাপের বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ করে তাঁকে বিদায় দিলেন।

এভাবে বিভিন্নজনের কাছ হতে মতামত নেওয়া শেষ হলে তিনি উসমান ইবন আফফানকে ডেকে ডিকটেশন দিলেনঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটা আবু বকর ইবন আবী কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলিমদের প্রতি অঙ্গীকার। আম্মা বা’দ – এতটুকু বলার পর তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তারপর উসমান ইবন আফফান নিজেই সংযোজন করেন- ‘আমি তোমাদের জন্য উমার ইবন খাত্তাবকে খলিফা মনোনীত করলাম এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কল্যাণ চেষ্টায় কোন ত্রুটি করি নাই’ অতঃপর আবু বকর সংজ্ঞা ফিরে পান। লিখিত অংশটুকু তাঁকে পড়ে শুনানো হলো। সবটুকু শুনে তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলে উঠেন এবং বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল, আমি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মারা গেলে লোকেরা মতভেদ সৃষ্টি করবে। উসমানকে লক্ষ্য করে তিনি আরো বলেনঃ আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও মুসলিমদের পক্ষ থেকে আপনাকে কল্যাণ দান করুন।’”

তাবারী বলেনঃ অতঃপর আবু বকর উপস্থিত লোকদের দিকে তাকালেন। তাঁর স্ত্রী আসমা বিনত উমাইস তখন তাঁকে ধরে রেখেছিলেন। সমবেত লোকদের তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তিকে আমি আপনাদের জন্য মনোনীত করে যাচ্ছি তাঁর প্রতি কি আপনার সন্তুষ্ট? আল্লাহর কসম, মানুষের মতামত নিতে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমি উমার ইবনুল খাত্তাবকে আপনাদের খলিফা মনোনীত করেছি। আপনারা তাঁর কথা শুনুন, তাঁর আনুগত্য করুন। এভাবে উমারের (রা.) খিলাফত শুরু হয় হিজরী ১৩ সনের ২২শে জমাদিউস সানী মুতাবেক ১৩ই আগষ্ট, ৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দ।

হযরত উমারের রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা সম্ভব নয়। দশ বছরের স্বল্প সময়ে গোটা বাইজান্টাইন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। তাঁর যুগে বিভিন্ন অঞ্চলসহ মোট ১০৩৬টি শহর বিজিত হয়। ইসলামী হুকুমাতের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মুলতঃ তাঁর যুগেই আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মত ছড়িয়ে আছে।

হযরত উমার (রা.) প্রথম খলিফা যিনি আমিরুল মু’মিনীন উপাধি লাভ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন, তারাবীর নামাজ জামা’আতে পড়ার ব্যবস্থা করেন, জনশাসনের জন্য দুররা বা ছড়ি ব্যবহার করেন, মদ্যপানে আশিটি বেত্রাঘাত নির্ধারন করেন, বহু রাজ্য জয় করেন, নগর পত্তন করেন, সেনাবাহিনীর স্তরভেদ ও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন নির্দিষ্ট করেন, জাতীয় রেজিষ্টার বা নাগরিক তালিকা তৈরী করেন, কাজী নিয়োগ করেন এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।

উমার (রা.) ছিলেন রাসুলাল্লাহ (সাঃ) এর অন্যতম কাতিব। নিজ কন্যা হযরত হাফসাকে রাসুলাল্লাহ (সাঃ) এর সাথে বিয়ে দেন। তিনি রাসুলাল্লাহ (সাঃ) ও আবু বকর (রা.) এর মন্ত্রী ও উপদেষ্টার ভুমিকা পালন করেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরে ব্যবসা ছিল তাঁর জীবিকার উপায়। খিলাফতের গুরুদায়িত্ব কাধে পরার পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান। কিন্ত পরে তা অসম্ভব হয়ে দাড়ালে হযরত আলী (রা.) সহ উচু পর্যায়ের সাহাবীরা পরামর্শ করে বাইতুল মাল হতে বার্ষিক ৮০০ দিরহাম ভাতা নির্ধারন করেন। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল থেকে অন্য লোকদের ভাতা নির্ধারিত হলে বিশিষ্ট সাহাবীদের ভাতার সমান তাঁরও ভাতা ধার্য করা হয় পাঁচ হাজার দিরহাম।

বাইতুল মালের অর্থের ব্যাপারে হযরত উমারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইয়াতিমের অর্থের মত। ইয়াতিমের অর্থসম্পদ যেমন ইয়াতিমের অভিভাবক রক্ষনাবেক্ষন করে। ইয়াতিমের ও নিজের জন্য প্রয়োজনমত খরচ করতে পারে কিন্ত অপচয় করতে পারে না। প্রয়োজন না হলে ইয়াতিমের সম্পদ হতে হাত গুটিয়ে নিয়ে শুধু হিফাজত করে এবং ইয়াতিম বড় হলে তাকে তার সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। বাইতুল মালের প্রতি হযরত উমারের (রা) এ দৃষ্টিভঙ্গিই সর্বদা তার কর্ম ও আচরণে ফুটে উঠেছে।

হযরত উমার (রা.) সব সময় একটা দুররা বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন। শয়তানও তাকে দেখে পালাতো। তাই বলে তিনি অত্যাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারক। মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন, মানুষও তাঁকে ভালবাসতো। তাঁর প্রজা পালনের বহু কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়।

হযরত ফারুকে আমের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে কুআন ও হাদীসে এত বেশী ইঙ্গিত ও প্রকাশ্য বাণী রয়েছে যে, সংক্ষিপ্ত কোন প্রবন্ধে তা প্রকাশ করা সম্ভব না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) র নিকট তাঁর স্থান অতি উচ্চে। এ জন্যে বলা হয়েছে, উমারের সব মতের সমর্থনেই সর্বদা কুনের আয়াত নাযিল হয়েছে। হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেনঃ ‘খাইরুল উম্মাতি বা’দা নাবিয়্যিহা আবু বকর সুম্মা উমার’ -নবী (সাঃ) এর পর উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম আবু বকর, তারপর উমার হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেনঃ উমারের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। তাঁর হিজরাত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত।’ উমারের যাবতীয় গুনাবলী লক্ষ্য করেই হুজুর (সাঃ) বলেছিলেনঃ ‘লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লা কানা উমার (রা.)’ -আমার পরে কেউ নবী হলে উমারই হতো। কারণ তাঁর মধ্যে ছিল নবীদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে উমারের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি আরবী কবিতা –পাঠন ও সংক্ষনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। আরবী ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ; তাঁর সামনে ভাষার ব্যাপারে কেউ ভুল করলে শাসিয়ে দিতেন। বিশুদ্ধভাবে আরবী ভাষা শিক্ষা করাকে তিনি দ্বীনের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন। আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে উমার (রা.) ছিলেন অত্যন্ত কঠোর, একই হাদীস বিভিন্ন সনদের মাধ্যমে বর্ণনার প্রতি তিনি তাগিদ দিতেন।’

প্রখ্যাত সাহাবী মুগীরা ইবন শু’বার (রা.) অগ্নি উপাসক দাস আবু লুলু ফিরোজ ফজরের নামাযে দাড়ানো অবস্থায় এ মহান খলিফাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত হওয়ার তৃতীয় দিনে হিজরী ২৩ সনের ২৭ শে জিলহজ্জ, বুধবার তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে আলী, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, সা’দ, যুবাইর ও তালহা (রা.) -এ ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর উপর তাদের মধ্য থেকে কোন একজনকে খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পন করে যান। হযরত সুহায়িব (রা.) জানাজার নামাজ পড়ান। রওজায়ে নববীর মধ্যে হযরত সিদ্দিকে আকবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তাঁর খিলাফতকাল দশ বছর ৬ মাস ৪ দিন।

No comments:

Post a Comment