***মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা***
"এক জাতি, এক ভূমি"- এই চেতনা ও আদর্শে উজ্জীবিত
হয়ে একদা যে মুসলিম উম্মাহ পরিণত হয়েছিল বিশ্বের প্রভাবশালী সভ্যতায় সেই একই জাতি
সিংহাসন হারানোর পর আজ হতবিহ্বল ও দিশেহারা। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতা হলো
বিভক্তি, কোন্দল, অত্যাচার আর পশ্চাৎপদতা।
বিশ্বনেতৃত্বের আসন হারানোর পর এই বহুধাবিভক্ত মুসলিম উম্মাহর আর্থ সামাজিক ও
রাজনৈতিক এজেন্ডা বর্তমানে নির্ধারিত হয় পুঁজিবাদী পশ্চিমা কুফর সভ্যতার দ্বারা।
খিলাফতের পতন পরিবর্তীতে যতই জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা মুসলিম দেশগুলোর ভেতর
প্রসারিত হচ্ছিল, ততই
বিদেশী শক্তির দ্বারা পতিত এই সভ্যতা শোষিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল যা এখনো
পর্যন্ত বর্তমান আছে। আমরা আরো দেখতে পেয়েছি সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার
তাগিদে পশ্চিমা সভ্যতা নতুন এক ব্যবস্থা চাপিয়ে ছিল বিভক্ত এই মুসলিম দেশগুলোর উপর
যার নাম "জাতি রাষ্ট্র', যা মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক বিভক্তিকরণ এখন পর্যন্ত
নিশ্চিত করে আসছে। তারই ফলশ্রুতিতে আজ আমরা দেখতে পাই মুসলিমরা নিজেদের চিহ্নিত
করে বাঙালী, পাকিস্তানী, আরব রূপে। এরই ধারাবাহিকতায়
মুসলিম দেশগুলোতে আমরা আরও দেখতে পেয়েছি পশ্চিমা মদদপুষ্ট ''নব্য এলিট" (New Elite) জাতীয়তাবাদী
শ্রেনীর যারা ছিল "জাতীয়তাবাদী" "পশ্চিমা চিন্তা চেতনা সম্পন্ন" "ধর্ম নিরপেক্ষ" অথবা "ইসলামী" হলেও ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) দ্বারা
প্রভাবিত। যুগ যুগে এই জাতীয়তাবাদী Elite শ্রেণীই মুসলিম উম্মাহর
পুনর্জাগরণে বড় বাঁধা হয়ে আসছে। জাতীয়তাবাদের এই বিষ বাষ্পই হলো বর্তমান উম্মাতে
মুহাম্মদীর জন্য বিশালাকার এক চ্যালেঞ্জ। কারণ এই জাতীয়তাবাদই হলো মুসলিম
বিশ্বগুলোতে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাচারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই "জাতি রাষ্ট্র" ও তার বিবিধ প্রতিষ্ঠান আজও
মুসলিম ভূমিগুলোতে উপনিবেশিক শাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এবং
ইসলামের শক্তিকে আজও বিভক্ত রাখতে সক্ষম হচেছ। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র
হলো আদতে "জাতি-রাষ্ট্রের" মানচিত্র যেখানে "জাতীয়তাবাদ" ও "জাতীয় স্বার্থ" ইসলামের ওপর প্রাধান্য পায়, এই নিবন্ধ ইসলামী
প্রেক্ষাপটের আওতায় জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি আলোকপাত করবে ও
তা অনুধাবনে সহায়ক হবে।
জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও স্বরুপ
জাতীয়তাবাদের বর্তমান যে রুপ আমরা দেখতে পাই তা হলো মূলত সাম্রাজ্যবাদের ফসল, যদিওবা এর উৎপত্তি হয়েছিল
ইউরোপে, বিশেষতঃ
পশ্চিম ইউরোপে, রোমান
ক্যাথলিক চার্চ এর অত্যাচার মোকাবেলায় আত্মরক্ষার পদ্ধতি হিসেবে। শুরুর দিকে এই
সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল খ্রিষ্টান ধর্মের প্রটেস্টান্ট (Protestant) মতাবলম্বীদের
দ্বারা, এটি
নিজের শক্তি সঞ্চার করতো আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া থেকে যা সর্বদাই বহিঃশক্তির প্রভাব
ও নিষ্পেষণের বিপরীতে ক্রিয়াশীল থাকত। বহিঃশত্রুর আক্রমণ সর্বদাই জনসাধারণদের
প্রতিবাদী করে তোলে যা এক পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রুপ লাভ করে। অতএব
জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের এই ধারণা গোড়ার দিকে ছিল বিদেশী আধিপত্য ও প্রভাব বলয়
থেকে মুক্তির তাড়না যা পরবর্তীতে অন্য রুপ লাভ করে।
জাতীয়তাবাদের ধারণা সম্পূর্ণরুপে বোঝার আগে এটা বোঝা আবশ্যক যে, মানুষ সমাজে কোন চিন্তার
ভিত্তিতে নিজেকে চিহ্নিত করে এবং দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। চিন্তা ও কল্পনার এই
ভিত্তিসমূহ হলো –
১. দেশপ্রেম
২. গোত্রবাদ বা জাতীয়তাবাদ
৩. ধর্ম
৪. স্বার্থ
৫. জীবন আদর্শ (Ideology)
উপরোক্ত বন্ধনসমূহের মধ্যে জাতীয়তাবাদের মূল চরিত্রই হলো এটা নির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় মানুষকে আলাদা সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক
পরিচিত দান করে। এই জাতীয়তাবাদী ভিত্তি বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বের সবচেয়ে
শক্তিশালী বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। একটি জাতির স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির জন্য
জাতীয়তাবাদকে অত্যাবশ্যকীয় মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয়তাবাদী হতে হলে
একটা জাতির নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ অবশ্যই থাকতে হবেঃ
§ একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চল
§ স্বাতন্ত্র্য আঞ্চলিক
বৈশিষ্ট্য, যেমনঃ ভাষা
ও গোষ্ঠী
§ জনস্বার্থ (উদাহরনস্বরূপঃ ট্রানজিট)
§ সাধারন ইচ্ছা ও অনুভূতি (উদাহরণস্বরুপঃ পহেলা
বৈশাখ, একুশে
ফেব্রুয়ারী)
§ সর্বোপরি অঞ্চলের
সর্বসাধারণের জন্য একটি সরকার
এছাড়াও একটি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকতে হবে, সংক্ষেপে এটা বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদের তিনটি
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছেঃ
§ প্রথমত, এটি এমন একটি রাজনৈতিক
চিন্তা যা জাতি-রাষ্ট্রে বসবাসরত
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের সর্বোচ্চ আনুগত্য দাবি করে।
§ দ্বিতীয়ত, এই চিন্তার দ্বারা একটি
সার্বভৌম জাতি হিসেবে মানুষের ঐক্যবদ্ধ থাকার আকাঙ্খা প্রকাশিত হয়।
§ তৃতীয়ত, এটি সর্বসাধারণের ইচ্ছাশক্তি
ও আবেগরুপে বিদ্যমান থাকে।
ঐতিহাসিকভাবে, রোমান
সাম্রাজের অধিবাসীদের সমাজবদ্ধতার চূড়ান্ত ভিত্তিই ছিল গির্জা (Church)। ক্যথলিক
মতবাদই ছিল রাষ্ট্রীয় ধর্ম এবং যে ক্যাথলিক ছিল না পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা তাকে দেয়া
হতো না। পোপ এর হাতেই ছিল সম্রাটদের বৈধতা দানের পূর্ণ ক্ষমতা। সেন্ট আগাষ্টিন এর
সময় থেকেই চলে আসছিল এ জাতীয় রাজনৈতিক গঠন। কারো ফরাসী, ইটালিয়ান বা জার্মান
পরিচিতির চেয়েও বড় বিষয় ছিল তার খ্রিষ্টান হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি। যখন থেকে
খ্রিষ্টান রোমান সাম্রাজ্য দূর্বল হতে শুরু করল, তখন থেকেই বিভিন্ন জাতির
মানুষ এই খ্রিষ্টান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলনে লিপ্ত হলো। তারা
নিজেদের পুনরায় নতুন পরিচিতি দিল নাগরিকত্বের এক নতুন মাপকাঠি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
নাগরিকত্ব প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় কোন বিষয় হিসেবে আর থাকল না, এক নতুন সাংস্কৃতিক পরিচিতি
উদ্ভাবনের তাগিদ অনুভব করল আন্দোলনকারী বুদ্ধিজীবীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের
উত্তর দিতে-
"ফরাসী, জার্মান তথা স্প্যানিশ বলতে
কি বোঝায়- ধর্ম
নাকি অন্য কিছু?" এভাবেই
আঠারশো শতকে ইউরোপে জাতীয়তাবাদ নামক এক নতুন চিন্তা ও বন্ধনের আবির্ভাব হলো যা
সাম্রাজ্যবাদ থেকে জাতি রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক রুপান্তর নিশ্চিত করল। আমরা এও দেখতে
পাই যে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা মানুষের ভেতর জাগিয়ে তোলে এক প্রচন্ড আধিপত্যবাদী মনোভাব।
তাই এই জাতীয়তাবাদ কখনোই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না কারণ এর ভিত্তিই হলো
নেতৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের ক্ষুধা যা এক প্রকার ক্ষমতার সংঘাত সৃষ্টি করে
সামাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে। একই ভাষাভাষী ও তথাকথিত বাঙ্গালী সংষ্কৃতির
ছায়াতলে থেকেও আওয়ামী ও বিএনপির ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব আমাদের স্মরণ করিয়ে
দেয় জাতীয়তাবাদের ব্যর্থতার চিত্র।
জাতীয়তাবাদ তার এই দ্বন্দ্ব ও আধিপত্যের মৌলিক চরিত্র নিয়ে কালক্রমে
সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও অত্যাচারের সহায়ক শক্তিতে রুপান্তরিত হয়। বিদেশী শক্তির
বিরুদ্ধে সংগ্রামের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে খুব সুচারুরূপে নিয়ন্ত্রন করতে
সাম্রাজ্যবাদীরা সমর্থ হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ একই জাতির ভেতর ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে
চলমান এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে সর্বদাই জীবিত রাখে এবং এই প্রকারের দ্বন্দ্বে লিপ্ত
দল/গোত্রসমূহের দ্বারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে
তাদের প্রভাব বলয় অটুট রাখে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের (উগান্ডা, রুয়ান্ডা, কঙ্গো ইত্যাদি) গৃহযুদ্ধে মার্কিনীরা উভয়
পক্ষকেই অস্ত্র যোগান দিয়ে থাকে এবং বিনিময়ে অগণিত প্রাকৃতিক সম্পদ লুট নিশ্চিত
করে। ইরাকেও আমরা দেখতে পাই মার্কিনীরা পুরো দেশটাকে শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের দ্বারা
তিনটি ভাগে বিভক্ত করে তাদের ভেতর দ্বন্দ্ব অব্যাহত রেখেছে এবং এই দ্বন্দ্ব নির্মূল
করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ইরাকের সেনাদের প্রশিক্ষনের নাম করে মার্কিনীরা
শক্ত ঘাটি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এরই মাধ্যমে আমেরিকায় তেল সরবরাহ নিশ্চিত করে
চলেছে। অতএব এ থেকেই বোঝা যায় কিভাবে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির কথা
বলে সাম্রাজ্যবাদেরই সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই প্রকারের জাতি রাষ্ট্রের
ধারণা একারণেই করা হয়েছে যাতে জাতিসমূহ নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত থাকবে এবং এরই
মাধ্যমে পুজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ তাদের সমর শিল্পের বিকাশ সাধন করবে।
মুসলিম ভূমি সমূহে জাতীয়তাবাদের বিকাশ
পতনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর
এই উম্মাহ সর্বব্যাপী ভয়াবহতম আক্রমণের শিকার হয়, তবে আক্রমণে সবচেয়ে
ক্ষতিগ্রস্থ হয় চিন্তার জগৎ। ১০৯৯ খৃষ্টাব্দে ক্রুসেডারদের দ্বারা সংঘটিত বর্বরতা
এই উম্মাহ পাড়ি দিয়েছে
৮ লক্ষ মুসলিমের জীবনের বিনিময়ে, অতিক্রম করেছে ১২৫৮ খৃষ্টাব্দের মোঙ্গলদের
বাগদাদ আক্রমণ যার পরিণতিতে আব্বাসীয় খেলাফতেরও পতন ঘটে। তা সত্ত্বেও এই উম্মাহ
দ্বীনের সঠিক আলো তার ভেতর জ্বালিয়ে রেখেছিল এবং ইসলামকে আরো সম্প্রসারিত করার
জন্য ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইজতিহাদের দরজা বন্ধ, আরবী ভাষার প্রতি অবহেলা এবং
মিশনারী আক্রমণের মতো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে আল্লাহর প্রিয় এই উম্মাহ তিলে
তিলে ইসলামের চিন্তা হারিয়ে ফেলতে লাগল। চিন্তার এই পতন এমন এক পর্যায়ে পৌছাল যে
মুসলিম চিন্তাবিদরা আলোচনা শুরু করল সভ্যতার উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে। ইউরোপীয়ানদের
ভেতর এটা খুবই প্রচলিত ছিল কার ভাষা সবচেয়ে বিশুদ্ধ, কার সাহিত্য খুবই উন্নতমানের
অথবা কোন জাতি সত্যিকার অর্থে সভ্য। উদাহরণস্বরূপ, রুশো (Rousseau) বিশ্বাস
করত সবচেয়ে বড় ভক্তি হলো দেশের প্রতি ভালবাসা। মানুষকে অবশ্যই দেশপ্রেমের গুণ
দ্বারা দীক্ষিত করতে হবে। মুসলিম দেশগুলোতে এই প্রকারের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমের
আলোচনা এমন এক সময়ে শুরু করা হয় যখন দেশগুলো স্বাধীনতা চাইতে শুরু করল। রেনেসা
পরবর্তী "আলোকিত যুগের" (Age of enlightenment) চিন্তা
চারিদিকে ছড়াতে লাগল এবং ১৮১৬ শতকের শুরুতে রুশো, ভলটেয়ার ও মনটেসকু প্রমুখের
লেখনীতে মুসলিমদের লাইব্রেরীসমূহ ভরে গেল। সামরিক আগ্রাসনের সমান্তরালে পরিচালিত
সাংস্কৃতিক ও মিশনারী আগ্রাসন (যা "শিক্ষা ও মানবতার" ছদ্মাবরনে ছিল) মূলত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের
পথকে সুগম করে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোকে রাজনৈতিকভাবে দখল করে নিতে। মিশনারী
স্কুলগুলো খুবই সফলতার সাথে আগামী প্রজন্মসমূহের চিন্তাধারাকে দূষিত করতে পেরেছিল।
যারাই এই স্কুলগুলোতে পড়েছিলো তারাই পশ্চিমা সিলেবাস ও পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে
ইতিহাস ও গবেষণাধর্মী লেখনী শুরু করে। এভাবে অনেক মুসলিমই পশ্চিমা মূল্যবোধে
দীক্ষিত হয় এবং পশ্চিমা জীবনব্যবস্থায় আলোকিত হতে থাকে। পশ্চিমা সভ্যতা দ্বারা
তারা এতই মুগ্ধ হয় যে এক পর্যায়ে তারা মনে করা শুরু করে ইসলামী সংস্কৃতিই মুসলিম
উম্মাহর পতন ও পশ্চাৎপদতার মূল কারণ। এরই পাশাপাশি চলতে থাকে ইউরোপীয়দের দ্বারা
গোপনে পরিচালিত বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন, উদাহরণস্বরূপ, তুর্কি আল ফাতাত (অটোমান বিকেন্দ্রীকরণ
সোসাইটি) Young Turks, Union
& Progress, ও আল আহদ (আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন)। জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত এই
বীজ বপনই ছিল ইউরোপীয়দের নতুন এক পরিকল্পনা। খিলাফত রাষ্ট্রের পক্ষে সবচেয়ে বড়
ভুলটি ছিল এই মিশনারী সংগঠনগুলোকে মুক্তভাবে মুসলিম ভূখন্ডসমূহে কাজ করার অনুমতি
দেওয়া। এই মিশনারীসমূহ,
যারা ছিল মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী ও আমেরিকান এজেন্ট, তাদের প্রধান দু’টি উদ্দেশ্য ছিল-
১. মুসলমানদের ইসলামের সঠিক
ধারণা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা। ইসলামী আকীদার ব্যাপারে সন্দেহ তৈরী করে।
২. তুর্কি, পারস্য ও আরবদের মাঝে
জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রেক্ষিতে সংঘাত তৈরী করা।
তাদের প্রথম উদ্দেশ্যটি পুরোপুরি সফল হয়নি। আক্বীদাহ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টিতে ব্যর্থ
হলেও ইসলামের সঠিক ধারণা তারা বিনষ্ট করেছিল। বৃটেনের ইহুদী প্রধানমন্ত্রী
বেঞ্জামিন ডিজরাইলির উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যখন সে কুর'আন হাতে হাউস অব কমন্সে বলেছিল
মুসলিমদের কখনোই হারানো সম্ভব না যতক্ষণ পর্যন্ত এই কুরআন তাদের অন্তর থেকে সরিয়ে
ফেলা না যায়।
ইতিহাস স্বাক্ষী মুসলিমদের কখনোই সামরিকভাবে পরাজিত করা যেত না কারণ তাদের
লড়াই ও চিন্তা সর্বদাই ছিল আক্বীদার উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা সঠিকভাবেই বুঝত "আযল" (মৃত্যুর কারণ) ও "রিযক" এর ধারণাসমূহ। তাইতো খালিদ
বিন ওয়ালিদ একদা এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুকে বলেছিলোঃ "এই মানুষ যারা আমার সাথে আছে
তারা মৃত্যুকে সেরকম ভালবাসে যেরকম তোমরা জীবনকে ভালবাসো"। চিন্তার জগতের ইউরোপীয়
আগ্রাসন মুসলিম উম্মাহর এই সাহস ও পৌরুষদীপ্ত চেতনা সবই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিল।
মূল ইতিহাসে আবার ফেরা যাক- ১৯০৮ সালের Young Turks বিপ্লব এবং খলীফা আবদুল
হামিদের ১৯০৯ সালের নির্বাসন পরবর্তী সময়ে ক্রমশই বুদ্ধিজীবী এবং
সামরিক অফিসাররা আরব স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হতে শুরু করে। এই অফিসাররা ছিল
মূলত পশ্চিমা ট্রেনিং ও শিক্ষায় শিক্ষিত যাদের প্রধানতম রাজনৈতিক চিন্তাই ছিল
জাতীয়তাবাদ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটেন মূলত আরব জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রবলতার
সাথে উস্কে দেয়। তারা মক্কার শরিফ হোসেনকে সে সময়কার মাসিক ২ লক্ষ পাউন্ড এর
বিনিময়ে অটোমান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লেলিয়ে দেয়, যা সে শুরু করে ১৯১৬ সালে এই
অযুহাতে যে, অটোমান
রাষ্ট্র আরবদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে। এই আন্দোলন প্রচুর সামরিক অফিসারদের
আকর্ষণ করে যারা ছিল অটোমান সামরিক বাহিনী থেকে বহিস্কৃত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
পরবর্তী আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ।
পশ্চিমা জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার সন্তান জাতীয়তাবাদ
মুসলিম উম্মাহকে ছিন্ন-বিছিন্ন করার পরিকল্পনায় বিষাক্ত হাতিয়ার ছিল বিভিন্ন
পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষামূলক সংগঠন যাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল লুকায়িত। যেসময়
পশ্চিমারা রেনেসাঁ পরবর্তীতে পুজিবাদকে তাদের জীবনের জন্য একমাত্র আদর্শ হিসেবে
বেছে নিয়ে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, সেসময় মুসলিমরা ইসলামী জীবনাদর্শকে ধীরে ধীরে
ত্যাগের মাধ্যমে পশ্চিমাদের দাসে পরিণত হচ্ছিল। আর এই দাসত্বের শৃঙ্খলকে টেকসই
করার তাগিদে মূলত ১ম শতকের মাঝামাঝিতে পশ্চিমারা নতুন এক পরিকল্পনা নেয় যা
ইতিপূর্বে নেয়া হয়নি। মিশনারীরা তাদের বিদ্যালয়, হাসপাতাল এর মাধ্যমে যখন মুসলিমদের
বেশী আকৃষ্ট করতে পারছিল না, তখনই তারা বিভিন্ন "বৈজ্ঞানিক সংগঠনের" পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় যা
সফলতার মুখ দেখে। ১৮৪২ সালে আমেরিকান মিশনের ছত্রছায়ায় একটি কমিটি গঠিত হয় যার
উদ্দেশ্যই ছিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংগঠন তৈরীতে সহায়তা করা। পাঁচ বছরের কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার
পর তৈরী হয় "Association of Arts & Science" যার
সদস্য ছিল বুট্রোস আল বুসতানি। এই বুসতানিই সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিল বিখ্যাত
বিদ্যালয় "আল মাদরাসা আল ওয়াতানিয়া" (জাতীয়তাবাদী বিদ্যালয়)। এই বিদ্য্যালয়টি প্রতিষ্ঠাই করা হয়েছিল আরব
জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি করার জন্য। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যই ছিল "হুব আল ওয়াতান" (দেশের প্রতি ভালবাসা) সৃষ্টি করা শিক্ষার্থীদের
ভেতর, একইভাবে
মিশরেও আমরা দেখতে পাই "রিফা আল তাহতাওয়ি" (১৮৭৩) Wataniya ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দিকে আহ্বান জানাতে শুরু
করে। এই পশ্চিমাদীক্ষিত মুসলিম পুর্নজাগরণবাদীর (Revivalist) মতে ভাতৃত্ববোধ কখনোই
বিশ্বাস দ্বারা সৃষ্টি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট এক ভূমি, এ থেকে বোঝা যায় কিভাবে
মুসলিমরা জাতীয়তাবাদে আস্থা আনা শুরু করল। তাদের জীবনের অর্থ বংশ, ভূমি ও ভাষার দ্বারা
নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হতে লাগল।
যদিও বা নতুন নতুন অনেক বৈজ্ঞানিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, কিন্তু "সিরিয়ান সাইয়েন্টিফিক
এসোসিয়েশন" এর
প্রতিষ্ঠার আগে অন্যান্যগুলো সফলতা পায়নি। অন্যান্যগুলোতে শুধু খ্রিষ্টানরাই
যোগদান করত, আর শেষোক্তটিতে মুসলিমদের যোগদানই ছিল বেশী। এই সংস্থাটির উদ্দেশ্যই ছিল সব
গোত্র, ধর্মকে
এক করে আরব জাতীয়তাবাদকে প্রজ্বলিত করা। এর পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আরব অঞ্চলের
মুসলিমরা আরব জাতীয়তাবাদকে নিজেদের জীবনের ভিত্তি হিসেবে নিতে শুরু করল। ঐ সময়কার
এসব সংগঠনসমূহের কার্যক্রমের প্রতিফলন আমরা এখানো দেখতে পাই ইসলাম নিয়ে উম্মাহর
সংশয় এবং মুসলিম দেশসমূহে জাতীয়তাবাদের শক্ত অবস্থান দেখে। তাইতো পুরো বিশ্বের
মুসলিমরা ক্ষনিকের অশান্তির পর আবারো স্বাভাবিক বস্তুবাদী জীবনে ফিরে যেতে পারল
চোখের সামনে তাদের ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের অসহায়ত্ব দ্বারা আবৃত আহাজারী দেখার পরও। এই
জাতীয়তাবাদী মানসিকতাই হলো সাম্রাজ্যবাদীদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার (legacy)।
এভাবেই জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত বীজ মুসলিম ভূমিতে ইউরোপীয়ানরা বপন করেছিল। বিংশ
শতকের শুরুতেই জাতীয়তাবাদের জ্বর সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ১ম বিশ্ব যুদ্ধের
শুরুতে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বর্বর ও ভয়াবহ আক্রমণ সূচিত হলো খিলাফতের বিরুদ্ধে এবং
ইউরোপীয়রা এক সময়কার অদম্য ও অপরাজেয় রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নিল। কোন প্রতিরোধ ছাড়াই
দূর্বল ও মৃয়মান এই উম্মাহ তার রাসূল (সাঃ) এর আমানতকে (খিলাফত রাষ্ট্রকে) কুফফার এর হাতে তুলে দিল।
তাইতো ১৯১৭ সালে (General Allenby) জেরুজালেম দখলের পর যথার্থই
বলেছিল- "Only today the
crusades have ended"
সাম্রাজ্যবাদ পরবর্তী জাতি রাষ্ট্র তত্ত্ব
বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মুসলিম উম্মাহকে ধরাশায়ী করা, বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী
আন্দোলনকে উস্কে দেওয়া এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফতের মৃত্যু
সাটিফিকেট দেয়ার পরও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছে এই উম্মাহ
যাতে কোনদিনও তার গৌরবজ্জল অতীতকে ফিরে না পায়। তাই আরব বিপ্লবের মাধ্যমে খিলাফত
ধ্বংসের পরবর্তীতেও তারা উম্মাহর আরও বিভক্তি তৈরী করেছিল। Sykes-Picot চুক্তির
মাধ্যমে আরব ভূমিসমূহকে আবারো খন্ডিত করা ছিল এক ভয়াবহ পরিকল্পনা। ফরাসী এবং বৃটিশ
উভয়েই একমত হলো যে তারা তাদের উপনিবেশসমূহকে দু'টি ভাগে বিভক্ত করবে। একটি ভাগ সরাসরি তারা
নিয়ন্ত্রণ করবে এবং অন্য ভাগটি থাকবে আধাস্বাধীন কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপীয়দের
নিয়ন্ত্রণে। বিভক্তির এই পরিকল্পনা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে আরব অঞ্চল সর্বদাই
বিভক্ত এবং দূর্বল থাকে। এই পরিকল্পনাই পরবর্তীতে জন্ম দিয়েছিল "জাতি-রাষ্ট্র" ধারণার, বিশেষত মধ্য
প্রাচ্যে।
এটা অবশ্যই বলতে হয় বিভক্ত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উপর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারেও পশ্চিমাশক্তি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই তারা পশ্চিমা
রাষ্ট্রের ধাচে মুসলিম মক্কেল জাতি রাষ্ট্র (Client Nation state) তৈরী
করল। এই জাতিরাষ্ট্রসমূহ পশ্চিমা ধাচের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো নির্মানে মনোযোগী হলো। ঔপনিবেশিক দেশসমূহের মানুষদের নতুন এই
ব্যবস্থায় "প্রগতি"র (Modernism) সুযোগ
ও অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হলো যদি তারা ইংরেজি ভাষার শিক্ষা নেয়, ইউরোপীয় ধাচের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করে এবং সাধারণভাবে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও
জীবনব্যবস্থা মেনে নেয়। এসবের পরেও যদি তারা কঠোরভাবে ইসলাম চর্চার মাধ্যমে
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত 'তাকওয়া' অর্জন করতে চায়, তাহলে ইউরোপীয়দের এতে কোন
আপত্তি নেই। এরকম ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক মুসলিম জাতি-রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখাই হলো মুসলিম উম্মাহকে
চিরতরের জন্য শোষণ করার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। ইসলামকে শুধুমাত্র কিছু নৈতিকতার
সমষ্টিতে পরিণত করা এবং গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে এই রাষ্ট্রসমূহের জন্য
রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে নির্বাচিত করাই হলো ইউরোপীয়দের সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা যার
চর্চা এখনো মুসলিম ভূমিসমূহতে আমরা দেখতে পাই। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে মুসলিমরা
ইউরোপীয় ধাচের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষিত ও আলোকিত হওয়া শুরু করল। যুগে যগে এই
বিদ্যাপিঠসমূহ এমন সব মুসলিম জ্ঞানীর জন্ম দিল যাদের কাজই ছিল মুসলিমদের ইসলাম
নিয়ে এমনভাবে বিভ্রান্ত করা যাতে তারা উম্মাহকে একত্রিত করার চিন্তাশক্তি হারিয়ে
ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, সমসাময়িক
পশ্চিমা মুসলিম চিন্তাবিদ ডাঃ আসগার আলি ইঞ্জিনিয়ার ও ফজলুর রহমান - যারা
মনে করে কুর'আন-সুন্নাহর কোথাও খিলাফতের
কথা উল্লেখ নেই, এসবই
পরবর্তীকালের মুসলিমদের সংযোজন। এই নিবন্ধের এক পর্যায়ে আমরা এই প্রকারের মুসলিম
চিন্তাবিদ ও পুনর্জাগরণকর্মীদের ব্যাপারে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করব।
ইউরোপীয় ভাবধারায় দীক্ষিত নব্য এলিট (Elite) মুসলিম নেতাদের ভূমিকাও
উল্লেখযোগ্য যাদের উত্তরসূরি আজও আমাদের ভেতর বর্তমান, খিলাফতের পতন পরবর্তীতে এই
এলিটদের হতে "স্বাধীন" হওয়া মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের দায়িত্বভার প্রদানের
সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ওসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের
মাধ্যমে অর্জিত "স্বাধীনতা" ছিল মূলতঃ পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে এক ভয়ংঙ্কর
প্রতারণা ও ফাঁদ। সাম্রাজ্যবাদীদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিম এই স্বাধীন জাতি
রাষ্ট্রসমূহকে নিজেদের উপনিবেশ (Colony) বানানো এসব এলিটদের দ্বারা।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে প্রথমতঃ উম্মাহর বিশ্বাস ও চেতনাকে
নিস্তেজ করল এবং অবশেষে যখনই খিলাফত ধ্বংস হলো, "স্বাধীন" আরব দেশসমূহকে এই জাতীয়তাবাদী মুসলিম এলিট
নেতাদের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা নিজেদের কবজায় নিয়ে এল। একই রকমের পরিনতি তুরস্কের
জন্যও অপেক্ষা করছিল। এক সময়কার বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত খিলাফতের রাজধানী
তুরস্ক আজ ইউরোপীয় দেশসমূহের পদলেহন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির জন্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আরব
বিপ্লব এবং অবশেষে এরই মধ্যে দূর্বল ও নমনীয় খিলাফতকে ''তুর্কি জাতীয়তাবাদের'' মাধ্যমে ১৯২৪ সালের মার্চ
মাসে ধ্বংস করে দেওয়া- এসবই
আমাদের দূর্ভাগ্যজনক অতীত এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
যাই হোক, যেটা
আমরা বলছিলাম এই "স্বাধীন" মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ মূলতঃ স্বাধীনতার
পর জাতীয়তাবাদী এলিট নেতাদের মাধ্যমে ইউরোপীয় বলয়ে চলে এল। তারই নমুনা আমরা দেখতে
পাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী "লিগ অব নেশনস" (League of Nations) এর "আর্টিকেল ২২" (Article 22) তে- "নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল যা পূর্বে তুর্কি সাম্রাজ্যের
অধীনে ছিল সেগুলোকে এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কিন্তু এই শর্তে
যে যতক্ষণ পর্যন্ত এই দেশসমূহ নিজের পায়ে দাড়াতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এদের
জন্য প্রশাসনিক পরামর্শ ও সহযোগীতা (Administrative advice & assistance) বাধ্যতামূলক।"
স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশাসনিক পরামর্শ ছিল সরাসরি মুসলিম ভূমিসমূহকে ইউরোপীয়দের
করালগ্রাসে নিয়ে আসা। ব্রিটেন ইরাক, প্যালেস্টাইন ও ট্রান্সজর্ডান দখল করল এবং
ফ্রান্সের ভাগে পড়ল সিরিয়া এবং লেবানন। শরীফ হোসেন এর ভাগে অবশিষ্ট যেসব "স্বাধীন আরব রাষ্ট্র" রয়ে গেল যেগুলোকে বলা হতো "হিজাজ রাজ্য" (Kingdom of Hijaz), সেগুলোর
নতুন নামকরণ দেয়া হলো ১৯২৫ সালে- সউদী এরাবিয়া।
এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যদিওবা মুসলিম দেশসমূহ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা
বিভক্ত হয়ে গেল স্বাধীনতার নামে কিন্তু দেশসমূহের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা
ও নিয়ন্ত্রণ ঠিকই রয়ে গেল পশ্চিমাদের হাতে এই এলিটদের দ্বারা। যদিওবা বর্তমানে
মুসলিম দেশসমূহে পশ্চিমাদের উপনিবেশ আর নেই কিন্তু যুগে যুগে এই রাজনৈতিক এলিটদের
উত্তরসুরি আমরা এখনো মুসলিম দেশসমূহে দেখতে পাই। ইরাকের নুরী আল মালিকি এবং
আফগানিস্তানের হামিদ কারজাইদের মতো অসংখ্য নেতা আজো বিদ্যামান যারা এখনো মার্কিন-বিট্রিশদের "Administrative Advice" নেওয়ার
জন্য সদা প্রস্তুত। মুসলিম দেশসমূহকে যারা কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে দিতে চায় না, মুসলিম ভূমিসমূহকে তারা
পশ্চিমাদের দাস বানিয়ে রেখেছে। তাইতো আমরা অপারগতার সাথে দেখি যখন ফিলিস্তিন
আক্রান্ত হয় ইয়াহুদ দ্বারা, তখন
জর্ডানের বাদশা হোসেন সার্বিক সহায়তা ইয়াহুদী নাসারাদের দিয়ে থাকে। পশ্চিমা
রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই এলিট তৈরীর সিলসিলা খিলাফতের পুনরাগমনের আগ
পর্যন্ত চলতে থাকবে।
নব্য এই ইউরোপীয় শ্রেণীর হাতে 'স্বাধীন' মুসলিম দেশসমূহর ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শর্তই
ছিল "জাতীয়তাবাদী" হওয়া, জাতীয়তাবাদীদের উৎসাহ দেওয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষ
রাজনীতির সাথে কিছুটা ইসলাম এর সংমিশ্রণ করা। "পশ্চাৎপদ" মুসলিম দেশসমূহের সাথে যোগাযোগের এটাই ছিল
সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ মুসলিম দেশের রাজনৈতিক
মুক্তির জন্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয়দের মতো নব্য ইউরোপীয় শ্রেণীর
প্রয়োজন এখনো ফুরায়নি।
ইউরোপের সাথে যোগাযোগের আরো একটি সেতুর সফল নির্মাণ সম্পন্ন হলো- "জাতির পিতা"
(Father of the Nation)। যে স্বাধীনতা তারা আমাদের উপহার দিয়েছিল তা
ইউরোপের উপনিবেশ রাষ্ট্র বৈকি কিছুই ছিলনা। এই জাতির পিতারা এমন জাতি রাষ্ট্র
আমাদের উপহার দিল যেগুলো জাতীয় সীমানা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় দিন, জাতীয় ভাষা, জাতীয় স্বার্থে পরিপূর্ণ
ছিল। প্রতিটি জাতিরই সুনির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র পরিচয় দেয়া হলো। কোন দু'টি জাতি রাষ্ট্রের অভিন্ন স্বার্থ থাকা চলবে
না। এই জাতি রাষ্ট্রের ধারণা মুসলিম উম্মাহর জন্য ছিল খুবই ধ্বংসাত্মক। বিশেষ করে
বর্তমান সময়ে "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" তথা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
মুসলিম উম্মাহর মর্মান্তিক পরিণতি আমাদের আরো একটিবার এই "জাতীয়তাবাদ" নামক ষড়যন্ত্রের কথা স্মরণ
করিয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদ এমন এক রাজনৈতিক হাতিয়ার যা মানুষদের খুবই আত্মকেন্দ্রিক
করে তোলে। অতপরঃ "Divide and Rule" নীতি
খুবই সফলতার সাথে আত্মকেন্দ্রিক এই মানুষদের উপর প্রয়োগ করা যায় যা ৫০ এর বেশী
মুসলিম জাতি-রাষ্ট্রসমূহে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান।
তাইতো ইরাক আক্রমণ হলে শক্তিশালী ইরান নিশ্চুপ থাকে, অসহায় ফিলিস্তিনিরা মুসলিম
সৈন্যদের দিকে শুধুমাত্র তাকিয়েই ছিল। সাহায্য পাওয়া দূরেই থাক ফিলিস্তিনের এই
জাতীয় সমস্যা নিয়ে জর্ডান, সিরিয়া
নিজেকে জড়াতে চায় না, যেরকম
আফগান জাতির নিজস্ব সমস্যা নিয়ে পারমানবিক ক্ষমতাধর পাকিস্তান মোটেও আগ্রহী নয়।
এভাবেই ইউরোপ/আমেরিকা মুসলিম উম্মাহকে
একাধিক জাতি-রাষ্ট্রে বিভক্ত করে "জাতীয়তাবাদ" নামক রাজনৈতিক মারনাস্ত্র
এমনসব ক্ষমতালোভী নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছে যাদের উদ্দেশ্যই হলো মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উম্মতকে যত পারা যায় বিভক্ত রাখা আর তাদের
সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের হাতে উম্মাহর সম্পদ ও সম্মান নাজরানা হিসেবে উপহার দেয়া।
এই "হামান" আর "কারুন"-রাই উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা একের পর এক করেই যাচ্ছে
আজকের ফেরাউন "আমেরিকার" পক্ষে। তাই আমেরিকা-বৃটেন আজ আমাদের বুকে ছুরি চালাচ্ছে আমাদের
পেটের ওপরেই বসে। তারা আজ ইরাক, আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করে রেখেছে মুসলিম
দেশসমূহের ঘাঁটিসমূহে অবস্থানের মাধ্যমে। কাতারের আদিদ ঘাঁটি, সৌদি আরবের আমীর সুলতান
ঘাঁটি, দোহার
আহমেদ আল জাবির ঘাঁটি, কুয়েতের
আরিফজান প্রশিক্ষণ ঘাঁটি, ওমানের
মুসিরা ঘাঁটিসহ বাহরাইন, তুর্কি, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তানে
কুফফার সৈন্যদের অবস্থান হলো মুসলিম এই মক্কেল শাসকদের আতিথেয়তা ও উদারতার জ্বলন্ত
প্রমাণ। এই দালালরাই পরাশক্তি ইউরোপ ও আমেরিকার স্বার্থে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হতে
দিচ্ছে না- একদার
মুসলিম উম্মাহকে ৫০ এরও বেশী শক্তিহীন জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করে রেখেছে। "প্রভু" ও "মক্কেল"-দের "জাতীয়তাবাদ" নামক এই হীন ষড়যন্ত্র আমাদের বারবার স্মরণ
করিয়ে দেয় উম্মাহর বর্তমান সমস্যাই হলো রাজনৈতিক সমস্যা যার জন্য চাই উম্মাহকে
পুনরায় একত্রিত করা এবং খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাগুতের মুলৎপাটন এবং এর
জন্য চাই বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এক আন্দোলন যার একমাত্র উদ্দেশ্যই হবে খিলাফত
ফিরিয়ে আনা।
খিলাফত পতন পরবর্তী বিভিন্ন পুনর্জাগরণী আন্দোলন
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা ২০০ বছরেরও অধিককাল শোষিত হওয়া এবং পরিশেষে
খিলাফত ধ্বংসের পরবর্তীতে বহু ইসলামী আন্দোলন ও ব্যক্তিত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল
উম্মাহকে তার এই করুণ বাস্তবতা থেকে উদ্ধার করতে। উম্মাহ এমন অসংখ্য আন্দোলন দেখলো
যা "মুক্তির" কথা বলে মূলতঃ পশ্চিমা রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা গ্রহণ করেছিল। বিগত ২০০ বছরের মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তা
মুসলিমদের রাজনৈতিক শক্তির পতন ও পশ্চিমা পুজিবাদী রাজনৈতিক শক্তির ও সভ্যতার
উত্থানের বিপরীতে সার্বিকভাবে প্রতিক্রিয়া বৈ আর কিছুই ছিলনা। পশ্চিমের বিজ্ঞান
প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক অর্জন মুসলিম চিন্তাবিদদের এতই মোহিত করেছিল যে তারা
পশ্চিমের দেয়া "প্রগতির" (Progress)' সংজ্ঞাই নিজেদের সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মনে
করল। প্রচুর সময় ও শক্তি ব্যয় করা হলো ইসলাম ও পশ্চিমা "প্রগতির" ভেতর সেতুবন্ধন তৈরীতে।
পশ্চিমা "প্রগতির" সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে অবশেষে এই
মুসলিম মনীষীরা ইসলামের জন্য "জাতীয়তাবাদ" "পুজিবাদ" "গণতন্ত্র" এমনকি "সমাজতন্ত্রও" বেছে নিতে শুরু করেছিল। পশ্চিমের সাথে সেতু
তৈরীর এই প্রচেষ্টা আমরা এখনো দেখতে পাই "Islamization" (ইসলামীকরণ), "Integration" ও "Interfaith
dialogue" এর মাধ্যমে। পশ্চিমের এই মোহই এসব "Islamist"-দের ৮০ এর দশকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে আমেরিকা হলো "খোদাহীন (Godless)
সমাজতন্ত্রের" বিরুদ্ধে মুসলিমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (Ismail
Fargi in ARABIA, London June 1982)। আসুন এবার আমরা দেখি কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী
পুনর্জাগরণী ইসলামী আন্দোলন ও ব্যক্তিত্বের ইতিহাস যারা পুনর্জাগরন করাতো দূরেই
থাক বরং উম্মাহর বাস্তবতা আরো করুণ করে তুলেছিল।
আরব জাতীয়তাবাদ
খ্রিষ্টান লেভান্টিন (Levantine) লেখকদের মস্তিষ্ক প্রসূত আরব
জাতীয়তাবাদী চেতনা ও চিন্তাধারা যার দ্বারা ওসমানীয় খিলাফতকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই একই চিন্তাধারা
পরবর্তীতে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল আরব মুসলিমদের পুনর্জাগরিত করতে যা আজ
পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল আরব
জাতীয়তাবাদের শূন্য স্লোগান শুনে। আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও পুনর্জাগরনী
ব্যক্তিদের আবির্ভাব বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মিশর থেকেই শুরু হয়েছিল। অতীতে জামাল
আবদুল নাসের এবং নিকট অতীতে সাদ্দাম হোসেন উপসাগরীয় অঞ্চলের সংকটকে কেন্দ্র করে
উম্মাহর আবেগ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। এই শাসকদের কারণেই উম্মাহ যুগে যুগে আরো
বিভক্তির শিকার হয়; জাতিগত
বিভাজন আরো প্রকট হয়। আরব জাতীয়তাবাদের বিবর্তীত আধুনিক রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি "আরবলীগ" সৃষ্টির মাধ্যমে। এই লীগ
মুসলিম দেশসমূহের ভেতর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উজ্জীবিত রেখেছে এবং দেশসমূহের
সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মূলতঃ বৃটেন ও ফ্রান্স দ্বারা অংকিত আরব বিশ্বের
মানচিত্র অটুট রেখেছে।
আরব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ইতিহাসের এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল
মিশরের জামাল আবদুল নাসের ১৯৫০ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর। সে তার "Philosophy
of Revolution" বইতে মিশরের ব্যাপারে তার স্বপ্ন তুলে ধরেছিল।
মিশরকে সে আরব বিশ্বের নেতা, মুসলিম বিশ্বের নেতা এবং কালো আফ্রিকানদের নেতা
হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের রাষ্ট্রয়াত্ব করা ও তার দু'বছর পরে ১৯৫৮ সালে মিশরকে সিরিয়ার সাথে একত্রিত
করে "United Arab Republic" এর
গঠন আরব জাতীয়তাবাদের দাবীকে আরো শক্তিশালী করে। কিন্তু ১৯৬১ সালে এই "United
Arab Republic" এর ভাঙন এবং ১৯৬৭ সালে সিনাই পর্বত দখলের
মাধ্যমে ইসরাইলের কাছে পরাজয় এই আরব জাতীয়তাবাদের ইতি টানে। পরবর্তীতে সকলের কাছ
এটা অজানা ছিল না জামাল আবদুল নাসের মূলত আমেরিকার নগণ্য এক সহচারী যার নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে CIA Mukhabarat (গোয়েন্দা সংস্থা) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল।
এই বিখ্যাত আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আজ পর্যন্ত ব্যর্থতার প্রতিমা হিসেবেই রয়ে
গেলে। খিলাফত ধ্বংসের আগ থেকে ধ্বংস পরবর্তী সময়ে যত বিখ্যাত আরব জাতীয়তাবাদী
আন্দোলন মাথাচারা দিয়ে উর্ঠেছিল তার কোনটারই বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক ভিত্তি ছিল
না। খিলাফতের পতনের প্রাক্কালে আরব জাতীয়তাবাদের নামে কিছু আরব দেশকে ওসমানী
খেলাফতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং ধ্বংস পরবর্তীতে এই উম্মাহ যাতে আবার একত্রিত
হতে না পারে তাই বহু বিখ্যাত আন্দোলন ও মুসলিম চিন্তাবিদ তৈরী করা হয়েছিল যাদের
পশ্চিমা বিশ্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেছিল, তাই এদের দ্বারা কখনোই
মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। Bathist এবং Nasirrist যারা
তথাকথিত "জাতি-রাষ্ট্র" গঠন ও স্বাধীনতা লাভের সময়
ক্ষমতায় আরোহন করেছিল পরিকল্পিতভাবেই তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে মুসলিম
দেশসমূহের ভেতর প্রভাবশালী করার ষড়যেেন্ত্র লিপ্ত ছিল। আরব জাতীয়তাবাদ তাই মুসলিম
আরব দেশসমূহে পশ্চিমা শক্তির চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসার Trojan
Horse এ পরিণত হয়েছিল। তাই উম্মাহর পুনর্জাগরণ দুরেই
থাক, উম্মাহকে
পশ্চিমা শক্তির অতল গহ্বরে তলিয়ে দিতে আরব জাতীয়তাবাদ হতাশাজনক ভূমিকা পালন
করেছিল।
সউদী আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের ভূমিকাও মুসলিম পুনর্জাগরণে
উল্লেখযোগ্য, ১৯২৩
সাল থেকে সউদ পরিবার আজ পর্যন্ত খুবই কড়া নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে আসছে সউদি আরবে।
তেল সমৃদ্ধ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কোন উন্নতি আমরা দেখতে পাইনি এই দেশে। তেল থেকে যে
পরিমান মুদ্রা অর্জিত হয় তার প্রায় সবটুকুই সউদী আরব Swiss
Banks এবং পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন Investment
House সমূহে ১৯৪০ সাল থেকে নিয়মিত ঢেলে আসছে।
সেই খিলাফত ধ্বংসের আগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পশ্চিমা কুফর শক্তির সবচেয়ে
বড় দোসর সউদী আরবের সউদ পরিবার উম্মাহর সাথে অবিরত বিশ্বাসঘাতকতা করেই আসছে।
সাইয়্যেদ কুতুব সহ ইখওয়ানুল মুসলিমীন এর বড় বড় নেতাদের জামাল আবদুল নাসেরের সরকার
দ্বারা হত্যা ও নির্যাতনের এক পর্যায়ে সউদী আরব এদের আশ্রয় দানের মাধ্যমে ইসলামী
আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে ফেলার চেষ্টায় সফল হয় যার পরবর্তীতে ইসলামী আন্দোলন ও
দাওয়াহ আরেক দফা বিকৃতির স্বীকার হয়। আশ্রয়দানের মাধ্যমে এক সময়কার ত্যাগী ইখওয়ান
নেতাদের সউদী সরকার আরাম প্রিয় ও সুবিধাভোগী Islamist এ পরিণত করে। একই প্রকারের
বাস্তবতা আমরা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির ইতিহাসেও দেখতে পাই। একদার ত্যাগী এই
ইখওয়ান ও জামাতী নেতৃত্ব এখন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে
উম্মাহকে পুনরুজ্জীবীত করার নামে মুলতঃ Pro-saudi (সৌদি ঘেষা) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত রয়েছে।
নিজেদের আসল এজেন্ডা গোপন করার জন্য এরা বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের নামে কুর'আনের কপি বিনামূল্যে সরবরাহ
করছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম চিন্তাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য এরা সউদী অনুদানের বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠান ও চিন্তাবিদ তৈরী করেই যাচ্ছে যার মধ্যে ISNA
(Islamic Society of North America), ওয়াশিংটনের North
American Islamic Trust (NAIT), International Institute of Islamic Thought
(IIIT), East-West University of Chicago, বৃটেনের Federation
of students' Islamic societies, International federation of students'
organization (IFSO) এবং কুয়ালালামপুরের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়
প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তারা বিশ্বব্যাপী সউদী যোগ্যতাসম্পন্ন (Saudi-qualified) দাওয়াহকারী, চিন্তাবিদ ও ইমামদের বেতন
দিয়ে থাকে। সউদী আরবে এ বিশাল গুরু দায়িত্ব সরকার একাই সামাল দেয় না, বরং প্রধান তিনটি সউদী
নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান যারা বিশ্বব্যাপী "American Islam" বিস্তারের
এ মহান দায়িত্ব পালন করে যাচেছ তারা হলো মক্কার- Rabita Al-Alam-Al Islami, দারুল ইফতা এবং রিয়াদ ভিত্তিক World Assembly of Muslim Youth
(WAMY)। ইতিহাসের
নির্মম পরিহাস ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের দুইটি বুহৎ শক্তি - ইখওয়ান
ও জামায়াত, কিভাবে স্বেচ্ছায় ইসলামকে
বিরাজনীতিকরণের (depoliticization) সউদী-আমেরিকার ষড়যন্ত্রের অস্ত্রে পরিণত হলো।
এভাবেই শুধু মিশর সউদী আরবসহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসমূহই নয় বরং তুরস্ক, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়াসহ অসংখ্য দেশ
মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
উম্মাহ বারে বারে শুধু তাকিয়েই ছিল নতুন আন্দোলন ও নেতৃত্বের দিকে কিন্তু কিছুতেই
এসব আন্দোলন পশ্চিমা বলয় থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। নব্য-সাম্রাজ্যবাদ (Neo-colonialism) বরাবরই
এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব সরবরাহ করে আসছে। নব্য সাম্রাজ্যবাদ মূলতঃ আরো ভয়ানক এক
প্রক্রিয়া ছিল যা সাম্রাজ্যবাদকে নতুন করে গঠন করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী
দল ও আন্দোলনসমূহ প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা সভ্যতার জন্য আতংকের কোন বিষয়ই ছিল না বরং
সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে নতুন রূপে বিভক্ত মুসলিম দেশসমূহে পশ্চিমা প্রভাব
চিরস্থায়ী করতে। পরবর্তীতে "জাতিসংঘ" প্রতিষ্ঠা করা হলো এই শোষণের প্রতিষ্ঠানিক রুপ
দিতে।
জাতীয়তাবাদ জ্বরে আক্রান্ত মুসলিম পুনর্জাগরণী মনীষা
শত বৎসরেরও অধিক কালের পশ্চিমা সভ্যতার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসণ মুসলিম
উম্মাহকে এমনভাবে ধরাশায়ী করেছিল যে আমরা দেখতে পেয়েছি প্রতিটি পুনর্জাগরণ আন্দোলন
পশ্চিমা ছকের ভেতর বন্দি ছিল। পশ্চাৎপদ ও বিভক্ত উম্মাহকে পুনর্জীবিত করার লক্ষে
বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী মনীষার আবির্ভাব হয়েছিল যারাও জাতীয়তাবাদ জ্বরে
প্রবলভাবে আক্রান্ত ছিল। আমার এই প্রবন্ধের এক পর্যায়ে বলেছিলাম এই পন্ডিতদের
চিন্তাসমূহ মূলতঃ পশ্চিমা সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের বিপরীতে নিছক প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই
ছিল না। পশ্চিমা সভ্যতা মুসলিম উম্মাহকে এমনই কিছু পরাজিত মানসিকতার (Defeatist
mentality) পন্ডিত উপহার দিয়েছিল যারা যদিওবা মুসলিম
ঐক্যের কথা বলতেন কিন্তু খিলাফতকে সমাধান মনে করতেন না, যারা যদিওবা মনে করতেন
মুসলিমদের পতনের মূলে ইজতিহাদ চর্চার বন্ধই হলো মূল কারণ, আবার সমাধান হিসেবে এও মনে
করতেন ইজতিহাদ চর্চার মাধ্যমে ১৪০০ বছরের পুরনো ইসলামকে 'সংস্কার' (Reform) করতে হবে। ওরিয়েন্টালিজম এবং
জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত এমন সব কিছু পন্ডিতদের ব্যাপারে এখন আলোচনা করব যারা
পুনর্জাগরিত করার নামে মূলতঃ উম্মাহকে সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে
রেখেছেল।
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর
একটি হাদীস দিয়েই লেখার এ পর্বটুকু শুরু করতে চাই। উরওয়া বিন আল যুবায়ের থেকে
বর্ণিত, আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেঃ "আল্লাহ তোমাদের জ্ঞান দানের পর তা থেকে তোমাদের
বঞ্চিত করবেন না। কিন্তু এই জ্ঞান আল্লাহ উঠিয়ে নিবেন ধার্মিক জ্ঞানী ব্যক্তিদের
মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। অতঃপর কিছু মুর্খ লোক তোমাদের মাঝে বিদ্যমান থাকবে যারা
নিজেরা পরামর্শ করে এমন সব ফতোয়া দিবে যা তোমাদের ভুল পথে চালিত করবে" [বুখারী]
এমনই কিছু মূর্খ মুসলিম পন্ডিত উনিশ শতকের গোড়াতে শক্তিশালী জীবনব্যবস্থা
হিসেবে পুঁজিবাদের উত্থানের বিপরীতে ঘুণে ধরা খিলাফত ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছিলেন
না। পতিত সভ্যতাকে কোন চিন্তার ভিত্তিতে পুনর্জীবিত করা যায় তারা সেটি বোঝার শক্তি
হারিয়ে ফেলেছিল। ইসলামের মৌলিক চিন্তা (Fikrah) এবং এই চিন্তাকে বাস্তবায়নের
পদ্ধতি (Tareeqah) কি, কিভাবে চিন্তা ও পদ্ধতি একে
অপরের সাথে সম্পর্কিত - এসবের ব্যাপারে তারা বোধশক্তি অর্জন করতে
ব্যর্থ হয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব পশ্চিমা সভ্যতাকে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকে।
রিফা রাফি আল তাহতাওয়ি (মিশর, ১৮০১-১৮৭৩)
মুসলিম উম্মাহকে পশ্চিমীকরণের অগ্রপথিক হলো এই তাহতাওয়ি যাকে পাঠানো হয়েছিল
প্যারিসে যাতে ফেরত এসে সে পশ্চিমাদের গুণকীর্তন করতে পারে। তার আত্মজীবনী বই Takhlis
al Ibris ila talkhis bariz (The extraction of Gold, or overview of paris,
1834)-এ
সে প্যারিসের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাজের প্রতি ভালবাসা এবং সর্বোপরি সামাজিক
মুল্যবোধ দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেছে। ইসলামী সমাজে মহিলাদের স্বাধীনতা এবং খিলাফত
ব্যবস্থায় পশ্চিমা ধাঁচের সংস্কার সাধনের পক্ষে সে মত দিয়েছিল। তাহতাওয়ির সূচিত এই
সংস্কার পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত মুসলিম দেশসমূহে বাস্তবায়নের কাজ চলছে তার
উত্তরসূরিদের দ্বারা।
জামালউদ্দীন আফগানি আসাদাবাদি (ইরাক, ১৮৩৯-১৮৯০)
যেসব মুসলিম পন্ডিত পশ্চিমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দেখে মনোমুগ্ধ
হয়ে গিয়েছিল জামালউদ্দীন আফগানি তাদের মধ্যে অন্যতম। সে আধুনিকতার ব্যাপারে
ইসলামের অপারগতার কথা অকপটে স্বীকার করল পশ্চিমাদের কাছে। তাই তাকে চিহ্নিত করা হয় "আধুনিক মুসলিম চিন্তা"র জনক। প্রখ্যাত পশ্চিমা দার্শনিক "Ernest
Renan" যখন তার লেকচার "ইসলাম ও বিজ্ঞান (La Islamime et la Science)"এর মাধ্যমে ইসলামকে আক্রমণ
করল এ বলে যে ইসলাম বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও দর্শন তৈরীতে অক্ষম। তখন আফগানী অপরাধ
স্বীকারমূলক ভঙ্গিতে Renan এর কাছে মাফ চাইলেন Journal
des Debats (March 27, 1883) এ চিঠি পাঠিয়ে। আফগানি স্বীকার করলেন যে ইসলাম
ধর্ম মানুষের যুক্তির অবাধ প্রয়োগে (Free use of Reason) বাঁধা
দিয়ে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
অথচ অতীতে আমরা দেখতে পেয়েছি ইসলামী চিন্তাবিদরা "জ্ঞান" (Uloom) কে
দু'টি ভাগে ভাগ
করতেন। ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত "আল মুকাদ্দিমায়" স্পষ্ট করে বলেছেন জ্ঞান দু’প্রকারেরঃ
১. প্রাকৃতিক, যা সকল জাতি তার চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে বিকশিত করতে পারে।
২. ঐতিহাসিক বা পাঠসংক্রান্ত, যে ব্যাপারে হুকুম শরী'আর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
মানুষের মন কখনোই এসবের ব্যাখ্যা দিতে পারেনা।
এই বিভাজন খিলাফত পতনের আগ থেকে পতন পরবর্তীতে কোন পন্ডিতই বুঝতে পারেনি।
খিলাফত ধ্বংসের পর (Uloom) জ্ঞানের ব্যাপারে এরকম মৌলিক
চিন্তা আমরা প্রথমবারের মতো দেখতে পাই শেখ তাকিউদ্দীন নাবহানী (রহ.) এর লেখনিতে। তিনি "হাদারাহ" ও "মাদানিয়া"-র চিন্তার দ্বারা ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক
নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছেন।
মুহাম্মাদ আবদুহ (মিশর, ১৮৪৯-১৯০৫)
মুহাম্মাদ আবদুহ
হলো জামালউদ্দীন আফগানির ঘনিষ্ট সহকর্মী। উম্মাহর ক্ষতিসাধনকারী এরকম পন্ডিতের
ব্যাপারে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা কিরকম আত্মবিশ্বাসী ছিল তা একটি ঘটনা থেকেই বোঝা
যায়- ১৮৮৪
সালে আবদুহ প্যারিসে বসে যে বৃটিশদের
বিরুদ্ধে কথা বলত, সেই
একই বৃটিশরা আবদুহকে "শাইখুল আযহার" (Shekh ul Azher) পদে
ভূষিত করেছিল যখন সে মিশরে ফেরত আসে। আবদুহ বিশ্বাস করত "নৈতিকতা" ও "আইন" যুগে যুগে পরিবর্তন সম্ভব সাধারণ মানুষের
কল্যাণকে (Maslaha) বিবেচনায় রেখে। সে মনে করত
ভাল (খায়ের) ও খারাপ (শার) নিজের ইজতিহাদী যোগ্যতা দ্বারা নির্ণয় করা
সম্ভব কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই তা পারেনা।
এছাড়াও আবদুহ ও জামাল আফগানী খিলাফতকে
শক্তিশালী করার মাধ্যমে উম্মাহর সব সমস্যার সমাধানে বিশ্বাস করতেন না। তারা মনে
করতেন মুসলিম দেশসমূহ একত্রিত থাকুক কিন্তু সব দেশের জন্য একজন খলীফার প্রয়োজন
নেই। এদের এই বিখ্যাত চিন্তাকে বলা হতো "Pan-Islamism" যা
পরবর্তী "Pan-Arabism" এ রূপলাভ করে। আবদুহর চিন্তার পতন এত নীচে তলিয়ে গিয়েছিল যে, ভারতীয় মুসলিমদের আল্লাহর
আইন (হুকুম শরী’আহ) এর
পরিবর্তে "British" আইন মেনে নিতে বলেছিল "মন্দের ভালো" (Lesser of two evils) এর "ইজতিহাদী" নীতির উপর ভিত্তি করে [Tafsir
al-Manar, Vol 6, p. 406-409, Muhemmad Abduh]। এভাবে "মন্দের ভালো" "Take and demand" ইত্যাদি
ভুয়া শরী’আহ নীতির
দ্বারা প্রথমত খিলাফতকে দূর্বল ও ধ্বংস করা এবং পরবর্তীতে এই ধ্বংসকে অব্যাহত
রাখার জন্য বহু অবদান আবদুহদের রয়েছে।
রাশিদ রিদা (সিরিয়া, ১৮৬৫ - মিশর, ১৯৩৫)
রাশিদ রিদা ছিল মুহম্মাদ আবদুহ এর ছাত্র ও তার সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম আইন
শাস্ত্রবিদ, যে
মৃয়মান খিলাফতকে পুরোপুরি ধ্বংসের জন্য "সংস্কার" প্রস্তাব দেয়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা
দ্বারা মোহিত এই পন্ডিত "শুরা" (পরামর্শ) ব্যবস্থার প্রতি জোর দেন।
রাশিদ রিদার বিখ্যাত যুক্তি যার দ্বারা সে খিলাফতকে "সংস্কার" করতে চেয়েছিল তা হলো- শরী’আহ "ইবাদত" ও "মুয়ামালাত" (সামাজিক সম্পর্ক) দ্বারা গঠিত, মানুষের মনের তেমন কোন
ক্ষমতা নেই ইবাদতের বিষয়ে পরিবর্তন আনার কিন্তু "মুয়ামালাত" বিভিন্ন প্রজন্ম ও সমাজের জন্য প্রয়োজনে
পরিবর্তিত হতে পারে।
আলি আবদুর রাযিক (১৮৮৮-১৯৬৬)
মুহাম্মাদ আবদুহ
এর আরেক শিষ্য যে খিলাফতের জানাযা পড়ানোর জন্য খুবই তৎপর ছিল সে হলো আলি আবদুর রাযিক। তাকে বলা হতো "ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার পিতা" (Father of Islamic
secularism)। তার
বিখ্যাত গ্রন্থ হলো "Islam and the principles of Government" (Al
Islam wa usul Al-Hukm) যেটির মাধ্যমে সে ইসলামকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক
আচার আচরণের সমষ্টিতে বন্দি করতে চেয়েছিল। তার দাবি হলো ইসলামে কোন সুনির্দিষ্ট
সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি, তাই খিলাফত ব্যবস্থা কখনোই বাধ্যতামূলক হতে
পারে না। তার ভাষ্য হলো ইসলামের আত্মিক উন্নতির (Personal
Salvation) ধারণা সুস্পষ্টভাবে খিলাফতের আওতায় রাজনীতির
ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম সবসময় ব্যক্তিগত ইবাদতের কথাই বলেছে, সিয়াসাহ (Politics) এবং
ধর্ম কখনোই এক হতে পারে না। সে আরো দাবি করেছিল যেহেতু সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধ দলিল
নাই কুর'আন ও
সুন্নাহর এবং ইজমাও নেই খিলাফতের পক্ষে তাই কোন অর্থ হয় না খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা
করা। বরং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাই ইসলামকে রাজনৈতিক অপব্যবহার (Political
Abuse) থেকে রক্ষা করতে পারে। মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংসের
রসাতলে নিয়ে যাওয়া এসব মনীষী পশ্চিমাদের কোন পর্যায়ের দাস ছিল তার বড় প্রমাণ আবদুল রাযিক এর মতো ভন্ড শরী’আহ বিচারকদের লেখনী থেকে
প্রমাণিত। সে তার "Al Islam wa Usul al Hukm" বইয়ে
সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতটি ["হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ তার রাসূল (সাঃ) ও উলিল আমরদের অনুসরণ কর"] ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১১৯
পৃষ্টায় উল্লেখ করে,
"যদি
তোমরা এ ব্যাপারে আরো বিশদ জানতে চাও তাহলে Sir Arnold Thomas এর "The
Caliphate" বইটি পড়।" উল্লেখ্য Sir Arnold ছিলেন পশ্চিমা ইতিহাসখ্যাত Orientalist যার কাজই ছিল পরিকল্পিতভাবে ইসলামের ইতিহাস
বিকৃত করা।
এভাবেই যুগে যুগে বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী পুনর্জাগরণবাদী মুসলিম চিন্তাবিদের
উদয় হয়েছিল যাদের মূল কাজই ছিলো সমাজ থেকে ইসলামকে পৃথক করা (Secularism)। তাদের সংস্কারের বিষয়ই ছিল মুয়ামালাত, উকুবাত এবং এমনসব ইবাদত যা ব্যক্তিগত, উদাহরণস্বরূপ জিহাদ। এরকম মনীষী ও প্রতিষ্ঠান
বর্তমানেও বিদ্যমান, যেমন- ইউসুফ
আল কারদাওয়ি,
Islam and Democracy Institute England, সুদানের ড. হাসান
আল তুরাবি প্রমুখ। বিভিন্ন একাডেমি, Activist ও Traditional Alem-রা এখনো আবদুহ, রাযিকদের
ভাবশিষ্য হয়ে আছে যারা ইসলামকে বর্তমান বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত, ইসলাম দ্বারা বাস্তবতাকে পরিবর্তন তাদের
উদ্দেশ্য নয়। এ প্রকারের (Compromising) সমঝোতামূলক আন্দোলন যে দল, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিই করুক না কেন মুসলিম
উম্মাহর পুনর্জাগরণ এদের দ্বারা সম্ভব নয়। খিলাফতের পৃথিবীব্যাপী উপস্থিতি এদের
বোধগম্য নয়। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলশ্রুতিতে তাই
রাজনৈতিকভাবে তারা জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের
স্বার্থ সংরক্ষনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়েই রয়ে গেল।
খিলাফত যেভাবে জাতীয়তাবাদ সমস্যার সমাধান ও উম্মাহকে
একত্রিত করবে
কোন একটি অঞ্চলে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা অতঃপর অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহকে
খিলাফতের ছায়াতলে একত্রিত করা অবশ্যই মুসলিম দেশসমূহে রাজনৈতিক গতিশীলতা (Dominno effect) ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহে ব্যাপক
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করবে। কুফর শক্তির সকল ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতার
ব্যর্থতার এক পর্যায়েই মূলতঃ আন্তর্জাতিক
রাজনীতির পট-পরিবর্তনের মাধ্যমেই কোন এক
দেশে খিলাফতের পুনরাবির্ভাব হবে যা অপরাপর সকল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উম্মাহর ভেতর
প্রাণসঞ্চার করবে। জাতীয়তাবাদের মূল্যোৎপাটন ও মুসলিম দেশসমূহের একত্রীকরণের
ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় আমাদের বুঝতে হবে-
১. খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার বহুকাল আগ থেকে বিশ্বের
প্রতিটি মুসলিম দেশসমূহে খিলাফতের সঠিক আন্দোলন-এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম উম্মাহকে
সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করে তুলবে এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার উর্দ্ধে তুলে
নিবে।
২. আমরা খুব সহজেই এটা বুঝতে পারি উম্মাহর করুণ ও
শোচণীয় বাস্তবাতা এবং পশ্চাৎপদতার মূল কারণটিই হলো রাজনৈতিক। তাই রাজনীতিকে দাওয়ার
একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়ে উম্মাহ ও শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিভাজন
সৃষ্টির এক পর্যায়ে যখন খিলাফত "উম্মাহর দাবী" (Popular demand)-তে পরিণত হবে তখন খিলাফত
প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মীরা নুসরার মাধ্যমে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে যা
অন্যান্য সকল মুসলিম দেশসমূহের "আহলুল হাল্লি ওয়াল আকাদ"-দের (ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী) দৃষ্টি
আকর্ষণে বাধ্য করবে। ফলে খিলাফতের রাজধানীর সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য সেসব দেশের
প্রভাবশালীদের অবশ্যই দাবি জানানো হবে।
৩. উম্মাহর একত্রীকরণ মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক- এ তিন পর্যায়ে হতে হবে। কোন এক অঞ্চলে খিলাফতের
পুনঃপ্রতিষ্ঠা এই তিনটি বিষয়ে উম্মাহকে একত্রিত করবে। অতঃপর, প্রতিষ্ঠিত খিলাফতের সাথে অন্যান্য মুসলিম
দেশসমূহের একত্রিত হওয়া কেবলই "সামরিক" বিষয় মাত্র হবে কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও
সাংস্কৃতিকভাবে অন্যান্য দেশসমূহের উম্মাহকে পুনর্জাগরিত করে রাখা হবে।
পরিশেষে এটা উল্লেখ করতে হবে খিলাফত যেভাবে জাতীয়তাবাদের ব্যধি থেকে উম্মাহকে
বের করে এনে একে একত্রিত করবে তা বুঝতে হলে শুধুমাত্র আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে
বিবেচেনা করলে চলবে না। একদার সুপার পাওয়ার "খিলাফত" পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাই বিশ্বব্যাপী সংগঠন ও
আন্দোলনের (Global Movement) চোখ দিয়েই বোঝা সম্ভব।
উপসংহার
এই নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করা হলো কিভাবে পরিকল্পিতভাবে ইসলাম বহির্ভূত "জাতীয়তাবাদ" নামক ব্যধি খিলাফতের ভেতর ছড়িয়ে এর ধ্বংস করা
হলো। আরো দেখতে পেলাম ধ্বংসকালীন ও পরবর্তীতে পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী পন্ডিতদের
আবির্ভাব যারা উম্মাহর ভেতর থেকেই এর বুকে ছুরি চালিয়েছে যার ক্ষতদাগ আর যন্ত্রনা
আজও এই মিল্লাত বহন করে চলেছে। যত আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল এবং এখনও টিকে আছে তার সবই
জাতীয়তাবাদ এবং বিবর্তিত জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের স্বীকার।
রাসূলের (সাঃ) প্রিয় এই উম্মাহর জন্য
প্রয়োজন ছিল এমন একটি বৈশ্বিক (Global) দল যারা উম্মাহর এই সার্বিক
পতন ঠেকাতে সক্ষম। জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে উঠে সংঘটিত এই দলটিকে হতে হবে সম্পূর্ণ
নতুন চিন্তার ভিত্তিতে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আপোষহীন। উম্মাহর সমগ্রিক
চিন্তা যা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা দূষিত তা থেকে বের করে আনার জন্য এ জাতিকে তার
জীবনের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তবেই ফিরে আসবে নতুন এক শাসনব্যবস্থা 'খিলাফত' যা
এই পুনর্জাগরিত জাতির বিষয়াদি ও স্বার্থের যত্ন নিবে।
আমাদের বুঝতে হবে উম্মাহর মূল সমস্যা অর্থনীতি, শিক্ষা, দূর্নীতি ইত্যাদি নয়, বরং খিলাফতের তত্ত্বাবধানে ইসলামী জীবনব্যবস্থার
অনুপস্থিতিই হলো মূল সমস্যা। খিলাফত ছাড়া উম্মাহকে নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে
সাম্রাজ্যবাদীরা খেলতে পারে- এই প্রবন্ধে আমরা তাই দেখতে পেলাম। আজ আমাদের
সম্পদ কুফরের পদতলে, আমাদের জীবনের সম্মান ও
নিরাপত্তা নির্ভর করছে তাদের মর্জির উপর, আমাদের মন আজ মিথ্যা ও দ্বীন ইসলামের বিকৃতির স্বীকার। এসব
সমস্যা বার বার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলো অতীব
গুরুত্বপূর্ণ (Vital) বিষয়। আমাদের অবশ্যই অজ্ঞতার সময়কালীন দূর্নীতি
ও অবিশ্বাসের শিকড়ের মূলোৎপাটন করতে হবে এবং আরো একবার উম্মাহর মুখে হাসি ফোটাতে
হবে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যার কথা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন- "....... এবং এরপর আবারো আসবে নবুওয়্যাতের আদলের খিলাফত"। পরিশেষে অবশ্যই সকলকে খলীফা আলীর (রা.) একটি উক্তি স্মরন করিয়ে দিতে চাই- "তোমাদের জীবন হলো অনেক মূল্যবান; যার বিনিময়মূল্য জান্নাত ছাড়া আর কিছুই হতে
পারেনা। অতএব, শুধুমাত্র জান্নাতের মূল্যের
বিনিময়ে একে বিক্রি কর।"
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার
কাছে এ বলে দু’আ করেই শেষ করব উনি যাতে আমাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও দুনিয়ার বুকে বহু
প্রত্যাশিত এই খিলাফাহ এবং পরকালে আমাদের জান্নাতুল ফেরদৌস উপহার দেন। আমীন।
***লেখকঃ ইমতিয়াজ সেলিম